ধূসর রঙে আকাশ পর্ব-১৩

0
907

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১৩
লিখা: Sidratul Muntaz

তোহা এতোটাই ঘাবড়ে যায় যে ওর মুখ দিয়ে তোতলানো শব্দ বের হয়,” ব বিয়ে হ হয়নি? ম মানে কি?”
আমীর একহাতে চশমা সোজা করে বলল,” হয়নি মানে.. বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বিয়ের ছবি তোলা হয়নি।”
তোহা বুকের মাঝে হাত রেখে শান্ত হলো। ঠান্ডা শ্বাস নিয়ে বলল,
” ওহ, তাই বলো। আমি ভাবলাম বিয়েটাই হয়নি। আচ্ছা কিন্তু ছবি তোলা হলো না কেন?”
” কারণ আগেই বলেছি। আমরা খুব ঝামেলার মধ্যে দিয়ে বিয়েটা করেছিলাম। কবুল কিভাবে বলেছি সেটাই মনে পড়ছে না। আবার তুমি ছবির কথা বলছো?”
তোহা সন্দিহান মুখে চোখ সংকুচিত করে বলল,” তাই বলে একটা ছবিও তোলা হয়নি? বিয়ের সাজে আমার কোনো ছবি নেই? তুমি মোবাইলেও একটা সেলফি তুলতে পারোনি?”
” না। ”
তোহা হাত ভাজ করে অভিমানী কণ্ঠে বলল,” অদ্ভুত। আমাদের বিয়ে হয়েছে কিন্তু একটা ছবি পর্যন্ত তোলা হয়নি?”
” ছবি কি খুব ইম্পোর্ট্যান্ট?”
” অন্তত একটা ছবি স্মৃতি হিসেবে থাকা দরকার ছিল।”
” স্মৃতি হিসেবে ছবিই কেন রাখতে হবে? অন্যকিছুও তো রাখা যায়৷ বিয়ের রাতে আমি তোমাকে যে পায়েলটা দিয়েছিলাম ওইটা ধরে নাও আমাদের বিয়ের স্মৃতি। এইটা কখনো পা থেকে খুলবে না। কখনো হারাবে না।”
তোহা নিজের পায়ের দিকে তাকালো। একটা খুব সুন্দর সিলভারের তৈরী স্টোন পায়েল তোহার পায়ে লাগানো। এই জিনিসটা তোহা সত্যিই খুব পছন্দ করে। গোসল ছাড়া কখনো পা থেকে খুলে না। আবার গোসলের পরেও সবার আগে এইটা পায়ে পড়ে নেয়। তোহা মনখারাপের স্বরে বলল,
” আচ্ছা, তোমার বন্ধু ওয়াহিদ ভাইয়ের বাসায় গিয়েও কি আমাদের কোনো ছবি তোলা হয়নি?”
” হয়তো ওরা তুলেছিল। কিন্তু সেই ছবি আমার কাছে থাকবে কি করে? ওদের কাছে মনে হয় আছে।”
” তাহলে ওদেরকে বলো হোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠিয়ে দিতে।”
আমীরের মুখ কঠিন হয়ে এলো। শক্ত গলায় বলল,
” আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিভ না, এটা তো তুমি জানো তোহা।”
তোহা আমীরের হাত ধরে বাচ্চাদের মতো আবদার শুরু করল,” প্লিজ প্লিজ প্লিজ। আমার জন্য একটু সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিভ হও।”
আমীর উত্তর দিল না। অপ্রয়োজনীয় কথা সে একদম পছন্দ করে না। তোহার কথাগুলো এখন অপ্রয়োজনীয়। তাই একটা কথার উত্তরও সে দিবে না। নিশ্চুপ থাকবে। তোহা সর্বোচ্চ পাঁচমিনিট ঘ্যানঘ্যান করবে। এরপর নিরাশ হয়ে চলে যাবে। তাই হলো। তোহা যখন কোনো উত্তর পেল না তখন হার মেনে বেরিয়ে গেল বারান্দা থেকে। আমীরের এই অভ্যাসটা তার খুব অপছন্দ। মাঝে মাঝে তাকে একদম পাত্তা দিতে চায় না আমীর। মনে হয় যেন তোহা কোনো মানুষই না। তাকে এইভাবে অবহেলা করার জন্য আমীরের একটা শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু কি শাস্তি দেওয়া যায়? খাবারে ঝাল বেশি দিবে? লবণ কম দিয়ে কাচা সবজি রান্না করবে? এসব করেও তো কোনো লাভ নেই। খাবারের স্বাদ যতই জঘন্য হোক, আমীর নির্বিকার ভঙ্গিতে খেয়ে উঠে যেতে পারে। এমন তৃপ্তি নিয়ে খায়, যেন খাবার খুব মজা ছিল। কিন্তু তোহা খেতে গেলেই বুঝতে পারে। ওই খাবার কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে মুখে তোলা সম্ভব না। কিন্তু আমীর আঙুল চেটে খায়। যেন অমৃত খাচ্ছে। অদ্ভুত না? অদ্ভুত হলেও অভ্যাসটা ভালো। ছোটবেলা থেকেই তোহা দেখতো খাবারে একটু মশলা বেশি হলেই বাবা ক্যাটক্যাট শুরু করতো মায়ের সাথে। শুধু বাবা কেন? চাচা,ফুপা,খালু, সব পুরুষই এমন। কিন্তু আমীর কত কিউট। লবণ দিয়ে পায়েস রেধে দিলেও মাথা নিচু করে খেয়ে ফেলবে। একটুও মুখ কুচকাবে না। এত শত ভালো অভ্যাসের মাঝে আমীরের দুই-একটা বদভ্যাস ক্ষমা করাই যায়। তোহার মনখারাপ হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গেল। প্রফুল্ল মন নিয়ে আবার বারান্দায় গিয়ে আমীরের পাশে দাড়ালো তোহা। কিন্তু আমীর তোহার উপস্থিতি খেয়াল করল না। সে ডানপাশে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। তোহা আমীরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দেখল ডানপাশে তাদের বারান্দার মতোই আরেকটা বারান্দা৷ মানে পাশের বাড়ির বারান্দা। সেখান থেকে গ্রিলের ভেতর দিয়ে দুটো চোখ আমীরের দিকে তাক করা। তোহা প্রথমে ভয় পেয়ে আমীরের কাধ চেপে ধরল। আমীর ঝারি মেরে কাধ ছাড়িয়ে নিল। তোহা স্পষ্ট দেখল রিম্মি এদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে৷ মেয়েটা কি চোখের পলকও ফেলে না? তোহা যেই না আমীরের কাধে হাত দিয়ে রিম্মির কথা বলতে যাবে তখনি খেয়াল করল আমীর নিজেও রিম্মির দিকেই তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখ যেন ম্যাগনেটের মতো। নিষ্পলক একজন-আরেকজনকে দেখছে। মনে হচ্ছে ওরা চুপ করে থেকেও কথা বলছে। কারণ সময়ের সাথে সাথে ওদের মুখের অঙ্গভঙ্গি বদলাচ্ছে। কখনো আমীর ভ্রু কুঞ্চিত করছে, কখনো রিম্মির ঠোঁটে হালকা হাসির ছাপ দেখা যাচ্ছে। আবার কখনো দুজনই বিস্মিত হচ্ছে। তাদের চেহারার এই পরিবর্তনটা খুব দ্রুত হচ্ছে। আর এতোটাই সুক্ষ্ম যে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল না করলে কেউ বুঝবে না। তোহাও বুঝতে পারল না এটা কি তার মনের ভুল? নাকি সত্যি? তার চেয়েও বড় কথা রিম্মি এই বারান্দায় কি করছে? তোহার মনে পড়ল, এই বিল্ডিং এ দুটো করে ইউনিট। আর তারা যে তলায় থাকে তার দ্বিতীয় ইউনিট রিম্মিদের। আচ্ছা আমীর তোহাদের বিল্ডিং এ বাসা না নিয়ে রিম্মিদের বিল্ডিং এ কেন নিল? অবশ্য আমীর এর কারণ আগেই বলেছিল। তাদের বিল্ডিং এ নাকি বাসা খালি পায়নি। তবুও তোহার সন্দেহ হচ্ছে। সে বারান্দা থেকে চলে আসল। আমীরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে কি না বুঝতে পারছে না।

জাবিদ সাহেব প্রেশার মাপাতে ফার্মেসীতে ঢুকলেন। উনার বাসায় প্রেশার মাপার জন্য যে মেশিন সেটা কয়েকদিন আগেই নষ্ট হয়েছে। তাই ইদানীং ফার্মেসীতেই আসতে হচ্ছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানের একটা কোণায় গিয়ে লাইনে দাড়ান জাবিদ সাহেব। এখানে অনেক মানুষ ঔষধ নিতে আসে। আপাতত লাইন লেগে গেছে। তার সিরিয়াল দুই-তিনজনের পরেই। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে ঠিকমতো দাড়াতে পারছেন না জাবিদ সাহেব। বসারও জায়গা নেই। সব ফুল।হঠাৎ বামপাশ থেকে একটা ছেলে খুব বিনয়ী গলায় বলল,
” আপনি চাইলে আমার জায়গায় বসতে পারেন আঙ্কেল।”
জাবিদ সাহেব আগ্রহ নিয়ে তাকালেন। প্রথম উনার মুখে সৌজন্যতার হাসি আসলেও ছেলেটার মুখ দেখার সাথে সাথে সেই হাসি মিলিয়ে যায়। জাবিদ সাহেবের চিনতে অসুবিধা হলোনা। ছেলেটা আমীর। আমীর নিজের জায়গা থেকে উঠে দাড়িয়ে হাতের ইশারায় বলল,
” বসুন আঙ্কেল।”
জাবিদ সাহেব গুরুগম্ভীর মুখে সামনে তাকিয়ে বললেন,
” আমি এভাবেই ভালো আছি।”
” মিথ্যে কেন বলছেন আঙ্কেল? আমি জানি আপনার দাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ বসুন। সিরিয়াল মিস হবে না। আমি আপনার হয়ে সিরিয়ালে দাড়াবো।”
জাবিদ সাহেব কঠিন দৃষ্টিতে বললেন,” কোনো প্রয়োজন নেই।”
আমীর ফ্যাকাশে মুখে বলল,” আমি এখানে এসেছিলাম তোহার জন্য। ওর শরীর খুব একটা ভালো না। কালরাতে..”
আমীরের কথায় বাগড়া দিয়ে জাবিদ সাহেব বললেন,” আমি কি তোমার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি? চুপ করে বসো।”
আমীর তবুও অনুনয়ের স্বরে বলল,” জানি খুব রেগে আছেন আমাদের উপর। আপনার রাগ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তো আমাদের ভুল স্বীকার করেছি আঙ্কেল। আপনার শাস্তি দিতে হলে আমাকে দিন। কিন্তু তোহাকে দিবেন না। ও আপনাদের ছাড়া খুব কষ্টে আছে। কাল থেকেই প্রচুর কাঁদছে। তারপর একটা দূর্ঘটনা ঘটে।”
জাবিদ সাহেবের মনে দুশ্চিন্তা উদয় হলেও তিনি চুপ করে রইলেন। যেন উনার কিছুই যায় আসছে না। আমীর বলেই গেল,
” গতরাতে তোহার খুব শরীর খারাপ ছিল। একা একা বাথরুমে যেতে নিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে। তারপর বাচ্চাটা মিস ক্যারেজ হয়ে যায়।”
জাবিদ সাহেবের মুখ দিয়ে না চাইতেও ধমক বেরিয়ে এলো,” তুমি থাকতে এতোবড় দূর্ঘটনা ঘটল কিভাবে?”
সবাই অবাক হয়ে তাকায় এদিকে। জাবিদ সাহেব কণ্ঠস্বর নিচু করে বললেন,
” এখন কেমন আছে?”
” বেশি একটা ভালো না। গায়ে খুব জ্বর। সকাল থেকেই শুধু কান্নাকাটি করছে। আমি ওর জন্য ঔষধ নিতে এসেছি।”
রিসেপশনিস্ট আমীরের হাতে ঔষধের প্যাকেট দিল। আমীর সেটা নিতে নিতে বলল,
” সারাদিন শুধু আপনাদের নাম নিয়েছে। হয়তো আপনাদের দেখলে ওর মনটা একটু ভালো হবে। আসলে এতোবড় একটা ঘটনায় ওর মন একদম দূর্বল হয়ে গেছে। ও নিজেও খুব ভেঙে পড়েছে।”
আমীর কথা শেষ করে চলে গেল৷ জাবিদ সাহেব পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলেন। বুকের মধ্যে অবাধ্য কম্পন অনুভব হচ্ছে। পেছন থেকে একটা লোক বলল,
” ভাই, সামনে আগান না। লাইন তো ক্লিয়ার।”
জাবিদ সাহেবের সম্বিত ফিরে আসে।

আমীর বাসায় গিয়ে তোহাকে ঔষধের প্যাকেটগুলো দিল। তোহা জিজ্ঞেস করল,” কিসের ঔষধ?”
” তোমার গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম না? তাই গ্যাসের ঔষধ এনেছি। আর হসপিটালে ডাক্তার যে ঔষধগুলো দিয়েছিল সেগুলোও আছে। টাইমলি খাবে।”
তোহা সরলমনে জিজ্ঞেস করল,
” আচ্ছা, এগুলো খেলে কি আস্তে আস্তে আমার সব মনে পড়বে?”
আমীর সামান্য হেসে বলল,” নিশ্চয়ই।”
তারপর তোহার দুইহাত ধরে বলল,” কালকের মধ্যে তুমি একটা সারপ্রাইজ পাবে।”
” কি সারপ্রাইজ? ”
” বলে দিবো? তাহলে কিন্তু সারপ্রাইজের মজা থাকবে না।”
” প্লিজ প্লিজ তবুও বলো। নাহলে আমার অস্থির অস্থির লাগবে।”
” আন্টি-আঙ্কেল কালকের মধ্যেই তোমাকে দেখতে এ বাসায় আসবে।”
তোহা অবিশ্বাস্য গলায় বলল,” সত্যি?”
” হুম।”
” তুমি কিভাবে জানলে?”
আমীর রহস্যের ভঙ্গিতে বলল,” আমি কিভাবে জানলাম সেটা পরে বলবো। তুমি শুধু জেনে রাখো আসবে।”
” যদি না আসে?”
আমীর হাসল। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল,” আসবেই।”
তোহার ইচ্ছে করছে আমীরের কথা বিশ্বাস করতে। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও খুশি লাগছে। খুশিমনে ঔষধগুলো ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল তোহা। কিন্তু সে জানেও না, প্রতিদিন রাতে তোহা স্মৃতি ফিরে পাওয়ার আশায় যে ঔষধ খায় সেগুলো কোনো ডাক্তারের নির্দেশিত নয়। বরং আমীরের নির্দেশিত ঘুমের ঔষধ। এসব আমীর নকল প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে কিনে আনে শুধু তোহার জন্য।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here