ধূসর রঙে আকাশ পর্ব-১২

0
963

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১২
লিখা: Sidratul Muntaz

তোহার মুখের সামনে তূরি বাজায় পূরবী৷ ভ্রু কুচকে বললো,
” কি এতো চিন্তা করছিস? আমি সব বুঝে ফেললাম কিভাবে এটা ভাবছিস? আরে বুঝবোই তো। সেই লেদাকাল থেকে তোকে আমি চিনি। তুই যে উপরে ভোলাভালা সাজার ভান করিস আর তলে তলে টেম্পু চালানো ভালোই জানিস সেটা তোকে দেখলেই বোঝা যায়। আচ্ছা তোহা, আমি তো তোর বেস্টফ্রেন্ডের মতো ছিলাম৷ একবার কি আমার সাথে সব শেয়ার করা যেতো না? তুই তো সব পেটের কথা আমাকে বলতি। অথচ এতোবড় একটা ঘটনা আমার কাছে কিভাবে লুকিয়ে রাখলি?”
তোহা নিশ্চুপ। পূরবী যখন বুঝল তোহার কাছ থেকে কোনো উত্তর আসবে না তখন হার মেনে বলল,
” আচ্ছা শোন, আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। আন্টি ডেকেছে। জলদি কাজ শেষ করে আমার সাথে চল।”
তোহার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। প্রফুল্লচিত্তে বলল,
” আম্মু আমায় যেতে বলেছে?”
” হ্যা। আর এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আন্টির মেজাজ ভালো না। সাবধানে কথা বলবি। নাহলে আবার কালকের মতো দু-চার ঘা লাগিয়ে দিতে পারে। তখন কিন্তু তোর আহ্লাদী জামাই থাকবে না বাঁচানোর জন্য।”
পূরবী ব্যঙ্গ কণ্ঠে আমীরের গলা নকল করে শোনাল,” আন্টি, আন্টি,ওকে মারবেন না প্লিজ। তোহা প্র্যাগনেন্ট। ওর কষ্ট হবে।”
পূরবী কথা শেষ করেই মুখ টিপে হাসতে শুরু করে। তোহা বলল,
” পূরবী তুই একমিনিট দাঁড়া। আমি উনাকে চা দিয়েই আসছি। আর তুই কি চা খাবি?”
পূরবী মুখ বিকৃত করে বলল,” ছি, এতো জঘন্য রঙের চা আমি খাইনা।”
তোহা হেসে ফেলে। কোনো কথাই গায়ে লাগছে না। দুনিয়া ভেসে গেলেও তার কিচ্ছু যায় আসেনা। মা তাকে ডেকেছে এর চেয়ে খুশির সংবাদ আর কি হতে পারে? তোহা উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে আমীরের ঘরে গেলো চা নিয়ে। তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। মুখে হাসি লেগে আছে। আমীর তোহার হাসি দেখে নিজেও হাসে। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি ব্যাপার?”
” পূরবী এসেছে। আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে চায়।আম্মু নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। ”
” তাই? কোথায় পূরবী?”
” রান্নাঘরে আছে।”
” রান্নাঘরে কেন? ওকে বসতে বলো। আমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করুক।”
” ও করবে না। চা অফার করেছিলাম সেটাই না করে দিয়েছে। আসলে ও একটু ঘাড়ত্যাড়া টাইপ। বাদ দাও। তুমি থাকো, আমি ওর সাথে যাই। আর ফ্রীজ থেকে ব্রেড নিয়ে ব্রেকফাস্ট করবে।”
” শোনো তোহা।”
” বলো।”
খুশিতে তোহার গলা কাঁপছে। আমীর বলল,
” মনে হচ্ছে আন্টির রাগ কমেছে।”
” আমারও তাই মনে হয়। ”
আমীর তোহার মুখের ডানপাশ আলতো করে ছুয়ে বলল,
” বলেছিলাম না? আন্টি বেশিক্ষণ তোমার উপর রাগ জমিয়ে রাখতে পারবে না। ”
তোহা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”
” বেস্ট অফ লাক।”
” থ্যাঙ্কিউ। এবার যাই?”
” আচ্ছা যাও। কিন্তু প্র্যাগনেন্সির বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করলে কি বলবে?”
” ঠিকই তো। কি বলবো?”
” বলবে তিনমাস চলে।”
” আবার মিথ্যে বলবো? আম্মু যদি বুঝে যায়?”
” বুঝবে না। আপাতত এটাই বলো। আমার মনে হয় এসব জিজ্ঞেস করতেই তোমাকে ডেকেছে। ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারবে তো? আবার গন্ডগোল যেন না হয়।”
” কিছু হবে না। যাই?”
” যাও।”
তোহা খুশিতে দৌড়ে যায়। আমীর মৃদু হাসি দিয়ে চশমাটা ঠিক করল।

লতিফা দরজা খুলে পূরবী আর তোহাকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বলল,
” তোরা?ভিত্রে আয়।”
পূরবী তোহাকে নিয়ে ঢুকল। লাভলীর ঘরের দরজাটা সম্পূর্ণ ভিড়ানো। পূরবী আস্তে করে দরজাটা খুলে। ক্যাটক্যাট শব্দ হয়। পূরবী বলল,
” আসবো আন্টি?”
লাভলী কি যেন বললেন, তোহা শুনল না। তার নজর রান্নাঘরের দিকে। রিম্মি দাঁড়িয়ে সিংকের উপর সবজি কাটছে। আর একদৃষ্টে চেয়ে আছে তোহার দিকে। মেয়েটাকে প্রথম থেকেই খুব অদ্ভুত লাগে তোহার। এখনো লাগছে। তোহাকে থম মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে পূরবী কনুই দিয়ে ধাক্কা মারল। তোহা সম্বিত ফিরে পায়। তারপর চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করল,
” এই মেয়ে এখানে কেন?”
পূরবী ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল,
” ওর নাম রিম্মি। নীল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। জানিস ভাইয়া এই মেয়েটার জন্য একদম পাগল। হাতে কাজ বেশি থাকলেই মা ওকে ডেকে আনে। যেকোনো কাজে মারাত্মক পারদর্শী। মেয়েটা মেশিনের মতো কাজ করতে পারে।”
তোহা আর কিছু না বলে লাভলীর ঘরে ঢুকল। সে পূরবীর কথা এতো সিরিয়াসলি নেয়নি। মেশিনের মতো কাজ বলতে তোহা ভেবেছে খুব দ্রুত কাজ। লাভলী বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলেন। তোহা মাথা নত করে বলল,
” আম্মু, কেমন আছো?”
কথাটা বলতে গিয়ে তোহার গলা ধরে আসে। চোখ ভিজে যায়। লাভলী নির্বিকার ভঙ্গিতে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন,
” পূরবী, ওকে জিজ্ঞেস কর আমাদের বাসার পাশে ও কেন বাসা নিয়েছে? দুনিয়াতে কি আর কোথাও জায়গা ছিল না? এখানেই কেন মরতে এলো?”
মায়ের ঝাঝালো কথায় তোহা বুক ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চায়। পূরবী মাথা নিচু করে চুপ রইল৷ লাভলী বললেন,
” ও আসলে কি চাইছে? আমরা মরে যাই ওর জন্য? তিনটি মাস ধরে নিখোঁজ থেকে কম জ্বালায়নি। এখন স্বশরীরে এসেছে জ্বালাতে। এমনিও আমার শরীর ভালো নেই। তার উপর ও চোখের সামনে থাকলে জীবনেও সুস্থ হতে পারবো না। রাগে দুঃখে ওকে আমার খুন করতে ইচ্ছে করে। ও কি আমাদের শান্তিতে বাঁচতে দিবে না? ওকে বল আজকের মধ্যেই যেন ওই বাসা থেকে চলে যায় ওরা। নাহলে আমরা চলে যাবো। ওর প্রতিবেশী হয়ে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই।”
তোহা হাউমাউ করে কেঁদে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমায় মেরে ফেলো মা। তবুও চলে যেতে বলো না। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।”
লাভলী পা টেনে নিয়ে বললেন,
” এজন্যই তো পালিয়ে গেছিলি তাইনা?”
তোহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। লাভলী পুনরায় বললেন,
” আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি না তবুও তিনমাস দিব্যি আরামে থেকেছিস। আর এখন কি এসেছিস নাটক দেখাতে? তোর নাটক দেখার সময় আমার হাতে নেই। আর তোকে সহ্যও হয়না এখন। ওই মুখ দিয়ে আমাকে মা বলবি না। আমি কারো মা হতে চাইনা। আমার মেয়ে মরে গেছে।”
তোহা হু হু করে কান্না শুরু করল। লাভলী উঠে দাড়িয়ে কঠিনগলায় বললেন,
” দুইদিনের মধ্যে তুই এই এলাকা ছেড়ে না গেলে আমরা চলে যাবো। পূরবীর আঙ্কেলকে বলেছি নতুন বাসা দেখতে।”
তোহার কান্নার বেগ আরও বাড়ে। আগে মা বলতেন,” তোর বাবা।” এখন বললেন,” পূরবীর আঙ্কেল।” আবার মা ডাকতেও নিষেধ করে দিলেন। উনার মেয়ে নাকি মরে গেছে। এসব তোহার মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। লাভলী রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। তোহা মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে বসে কাঁদতেই থাকল। পূরবী তোহার একহাত ধরে বলল,
” উঠ, কাঁদিস না। আন্টি রাগ করে এগুলো বলছে। সকালে উঠে কিন্তু আমাকে তোর খোঁজ নিতেই পাঠিয়েছিল। কাল সারারাত তোর জন্য কান্নাকাটি করেছে। আন্টি-আঙ্কেল দুজনেই তোর কাজে খুব কষ্ট পেয়েছে৷ এই ঘা এতো সহজে সারবে না। একটু ধৈর্য্য ধর।”
তোহা মাথায় হাত রেখে কাঁদছেই। হঠাৎ ধুমধাম শব্দ হলো। চোখের পলকে রিম্মি ঘরে ঢুকে বিদ্যুতের গতিতে দেয়ালে ঝুলানো ছবিটা আকড়ে ধরে৷ তোহা আর পূরবী হকচকিয়ে যায় রিম্মির অদ্ভুত আগমনে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর ওরা বুঝতে পারলো তোহার মা-বাবার বড় ফ্রেমের বিয়ের ছবিটা আরেকটু হলেই দেয়াল খসে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। রিম্মি এভাবে এসে না ধরলে আঠারো বছরের স্মৃতি এক নিমেষে গুড়িয়ে যেতো। কিন্তু এটা কিভাবে হলো? তারা দুজন এতো কাছে বসে থেকেও বুঝতে পারল না ছবিটা পড়ে যাচ্ছে। আর রিম্মি সেই রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে ছবিটা ধরেও ফেলল। কোনো সাধারণ মানুষ এতো দ্রুত দৌড়াতে পারে নাকি? তোহার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সে হতভম্ব। পূরবী উঠে গিয়ে রিম্মির সাথে ছবিটা ধরল। তারপর দুজন মিলে ছবিটা দেয়ালে সুন্দরমতো সেট করে দিল। তোহা চুপচাপ বসে দেখল৷ রিম্মি কাজ শেষ করে রোবটিক স্টাইলে চলে গেল। তোহা জিজ্ঞেস করল,
” এটা কি ছিল?”
পূরবী হেসে বলে,” কেরামতি। এই মেয়ে যে কত কেরামতি দেখায় রে ভাই! এটা তো কিছুই না। প্রথম প্রথম আমার খুব ভয় লাগতো। ও বাসায় আসলেই আমি বারান্দায় নাহলে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতাম৷ এমনভাবে মুখের দিকে তাকায় মনে হয় খুন করে দিবে। ডাইনির মতো লাগে। সেদিন কি হলো জানিস? সন্ধ্যায় আমি মাত্র গোসল করে বের হয়েছি। হঠাৎ ধাম ধাম করে দরজা ধাক্কানো শুরু করল।”
” কে রিম্মি?”
” হ্যা। দরজা খুলার পর মেয়ে আমাদের সবাইকে টেনে হিচড়ে নিচে নিয়ে যায়। শুধু আমাদের না, সারা ফ্ল্যাটের মানুষকে এক মিনিটের মধ্যে বড় মাঠের সামনে নিয়ে জড়ো করে।”
” কেন?”
” ভূমিকম্প হচ্ছিল৷ আমরা তখনো কিছু টের পাইনি। এরপর যখন বড়মাঠে গিয়ে দাড়ালাম, মাটি এমনভাবে কাঁপছিল, প্রত্যেকটা বিল্ডিং দোলনার মতো দুলছিল। মনে পড়লেই আমার আত্মা কাঁপে। তুই বিশ্বাস করবি না তোহা, কি ভয়ানক দিন ছিল সেদিন।”
” ভূমিকম্প কতক্ষণ হয়েছে?”
” উমম.. সর্বোচ্চ দশ সেকেন্ড।”
” দশ সেকেন্ডে ফ্ল্যাটের সবাই বড়মাঠে কিভাবে চলে গেল?”
” আরে রিম্মি আমাদের আগেই বাসা থেকে বের করেছে। তখন ভূমিকম্প হচ্ছিল না। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম হচ্ছে। তাই সবাই যেভাবে পারি দৌড়ে দৌড়ে বের হয়ে যাই। এরপর যখন বাসায় আসলাম, দেখি চেয়ার,টেবিল সব উলটানো। অনেক কিছু পড়ে ভেঙে গেছে। দেয়ালের অনেক জায়গায় ফেটে গেছে। আর আন্টি-আঙ্কেলের বিয়ের ছবিটা তখন খাটের উপর পড়েছিল৷ তাই ভাঙেনি। কিন্তু আমরা যদি বড়মাঠে আশ্রয় না নিতাম তাহলে অনেক বড় বিপদ হতো। সবাই গুরুতর আহত হতাম। খালি জায়গায় ছিলাম দেখেই অক্ষত ছিলাম।”
তোহা রসগোল্লার মতো চোখ করে বলল,
” এই মেয়ে ভূমিকম্পের আভাস আগে থেকে কিভাবে টের পেলো?”
পূরবী ঠোঁট উল্টে বলল,” আল্লাহই জানে! আমার কাছে তো মাঝে মাঝে ভূত মনে হয়। ও বাসায় আসলে আমি আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করি।”
” আচ্ছা, এই মেয়েটা নীল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড কিভাবে হলো?”
” সে অনেক কাহিনি। প্রথমে নীল ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল ওর বড়বোন অন্তরার সাথে। কিন্তু নীল ভাই এই মেয়েকেই বিয়ে করবে। এসব নিয়ে কত যে কাহিনি! মারুফা আন্টি তো এখনো মানতে পারেনি এই মেয়েকে।”
” মারুফা আন্টি কে?”
” নীল ভাইয়ের মা। তুই দেখিস নি উনাকে?”
” ছোট থাকতে একবার দেখেছিলাম৷ তেমন একটা মনে নেই।”
” হুম। আমার কি মনে হয় জানিস? মেয়েটা জাদুকরী। নীল ভাইকে বশ করেছে। নাহলে উনি হঠাৎ এই বোবা মেয়ের জন্য কেন এতো পাগল হবে বল?”
” রিম্মি বোবা?”
” হ্যা। পুরো বোবা। কোনো শব্দ করতে পারেনা। এ আ করেও কথা বলতে পারে না।”
” এজন্যই তো বলি, এতো চুপচাপ কিভাবে থাকে। আমি শুনেছি বোবা মানুষের সিক্সথ সেন্স অনেক স্ট্রং হয়।”
” ও যেগুলো করে ওগুলো কোনো সিক্সথ সেন্সের মধ্যে পড়ে না। আলটিমেটলি কোনো সাধারণ কাজের মধ্যেই পড়েনা। ওর সব কাজ-কর্ম অদ্ভুত। আমার তো এই মেয়েকে ডাইনিই মনে হয়।”
তোহা চুপ করে ভাবছে। পূরবী আবার বলল,
” এই তোর মনে আছে?নীল ভাই একবার তোর কাছে সাংকেতিক ভাষা শেখার বই নিয়েছিল না? সেটাও কিন্তু এই মেয়ের জন্যই। তখন থেকেই চক্কর চলছে অথচ আমরা কেউই টের পাইনি। ”
” সাংকেতিক ভাষা শেখার বই কবে নিয়েছিল? আমার তো মনে পড়ছে না।”
” আরে, একদিন রাতেরবেলা যে আমরা ছাদে গিয়ে দেখলাম নীল ভাইয়া লাইট লাগিয়ে বই পড়ছে। তুই মরা লাশ ভেবে ভয় পেয়েছিলি। আচ্ছা তোহা, তোর রগ কাটা শাহের কথা মনে আছে? তুই তো উনার কথা শুনলেই ভয়ে কাঁপতি। এখনো কি ভয় লাগে?”
তোহা কপালে ভাজ সৃষ্টি করে বলল,” রগ কাটা শাহ আবার কি জিনিস?”
এবার পূরবীর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আলতো করে তোহাকে একটা চড় দিয়ে বলল,
” ঢং করিস কেন? রগ কাটা শাহকেও চিনিস না?আচ্ছা আমাদের ভুলে যাওয়ার জন্য তোর জামাই আবার তোকে পানি পড়া খাওয়ায়নি তো?”
” ধুর, ফালতু কথা বলিস না। মায়ের রাগ কিভাবে কমাবো সেই আইডিয়া দে।”
” ধৈর্য্য ধর। আপাতত এইটা ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না।”
তোহা উঠে চলে গেল। তার খুব অভিমান লাগছে। সে জানে সে দোষী। তাই বলে মা এভাবে বলবে? এমন করে তাড়িয়ে দিতে চাইবে? মা যেন তাকে এক মুহুর্তের জন্যও সহ্য করতে পারছে না। তোহা বাসায় যেতেই দেখল আমীর টেবিলে নাস্তা রেডি করছে। তোহাকে দেখে আমীর জিজ্ঞেস করল,
” কি অবস্থা?”
তোহা মাথা নিচু করে টেবিলে বসল৷ তারপর মনখারাপ করে মায়ের কথাগুলো বলল। আমীর তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” থাক, মনখারাপ কোরো না। একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। আসলে আন্টি-আঙ্কেল খুব বড় আঘাত পেয়েছে তো৷ রাগ কমতে সময় লাগবে।”
” পূরবীও তাই বলেছে।”
” নাও এখন ব্রেকফাস্ট করো।”
আমীর একথা বলে নিজেই ব্রেডে মাখন লাগিয়ে তোহাকে খাইয়ে দিতে লাগল। তোহা চুপচাপ খেল। যদিও তার একদম খেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আমীরের যত্নটা মিস করতে চায়না সে। আমীর নিশ্চয়ই বুঝেছে মনখারাপ দেখে তোহার নিজহাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই আমীর কিছু না বলেই ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। ওর এই ছোট ছোট যত্নগুলো তোহার খুব পছন্দ। আমীর যখন এভাবে যত্ন করে তোহার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা অহংকার জন্মায়। এই অহংকারবোধ কিসের তোহা জানেনা। তোহা চেয়ারে বসেছিল। আর আমীর ওর সামনে দাড়িয়ে। তোহার মুখে খাবার দেওয়ার জন্য বারবার আমীরকে একটু করে ঝুঁকতে হচ্ছে। হঠাৎই তোহার দৃষ্টিগোচর হলো আমীরের গলার সেই ব্লেডটা। সঙ্গে সঙ্গে হেচকি উঠে যায়। মাথা কয়েকবার চক্কর দেয়। আমীর তোহাকে দ্রুত পানি ঢেলে দিল। তোহা গড়গড় করে পানি খায়। তারপর জোরে জোরে শ্বাস নেয়। আমীরের গলার ওই জিনিসটা দেখলে তোহার এমন কেন লাগে সে নিজেও জানে না৷ একটা অবিদিত আতঙ্ক মনের মধ্যে জেঁকে বসে। ভয় ভয় লাগে। এখনো লাগছে। তোহাকে অস্বাভাবিক দেখে আমীর কপালে হাত রাখল। গালে, গলায় স্পর্শ করল। তোহার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। টেবিল ধরে উঠে দাড়ানোর সময় আরেকবার মাথাটা চক্কর দেয়। আমীর তোহার কাধ ধরে বলল,
” তুমি ঠিক আছো তোহা? খারাপ লাগছে?”
” তেমন কিছু হয়নি। একটু শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
” বিছানা পর্যন্ত যেতে পারবে?”
” হ্যা।”
” পারবে না। চলো আমি দিয়ে আসি।”
আমীর একথা বলেই তোহার বামহাত নিজের ঘাড়ের পেছনে নিয়ে তোহাকে কোলে তুলল৷ তোহার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ইলেকট্রিক শক। তোহা ঝিরঝির করে কাঁপতে থাকে। আমীর ওকে বালিশ পেতে শোয়ায়। তোহার কাঁপুনি থামে না। কারণ আমীরের হাত তখনো তোহার পিঠে। এই মানুষটার ছোয়া এতো যন্ত্রণাদায়ক কেন? সম্পূর্ণ শরীরে যেন বিষ ঢুকে গেছে। প্রশান্তির বিষ। আমীরের দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায় তোহা। সেই মোহময় দৃষ্টি আর কাপাকাপি দেখে আমীর বুঝতে পারে তোহার মনের অনুভূতি। সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় তোহাকে৷ তারপর সোজা হয়ে বসল। তোহা জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে রইল। ওর নিঃশ্বাস তখনো উঠানামা করছে। আমীর চোখ থেকে নেমে আসা চশমাটা ঠিক করে বলল,
” তুমি রেস্ট নাও, তোহা। কিছু দরকার লাগলে ডেকো।”
তোহা উত্তর দিতে পারল না। আমীর জায়গা ত্যাগ করল। কিছুক্ষণ বাদে তোহার মনে পড়ল রিম্মির অদ্ভুত কান্ডের কথা। ইচ্ছে হলো আমীরের সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে। পরমুহূর্তেই আবার মনে হলো, তার বাবা-মায়ের সুন্দর বিয়ের ছবিটার মতো তাদেরও একটা বিয়ের ছবি বানানো উচিৎ। কিন্তু তোহা কখনো তাদের বিয়ের ছবি দেখেনি। আমীরকে আগে জিজ্ঞেস করতে হবে তাদের বিয়ের ছবিগুলো কোথায়। এই ভেবে তোহা ঝটপট উঠে বসল। আমীর বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। তোহা বারান্দায় গিয়ে ডাকল,
” এই শোনো?”
আমীর না তাকিয়ে আনমনে জবাব দিল,” হুম?”
” আমাদের বিয়ের ছবিগুলো কিন্তু আমার এখনো দেখা হয়নি। একবার দেখাবে?”
” আমাদের তো বিয়ে হয়নি তোহা।”
তোহার মাথায় বজ্রপাত হলো,” কি? বিয়ে হয়নি মানে?”
আমীর মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেই নিজেকে মনে মনে গালি দেয়। এবার সামলাবে কিভাবে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here