#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১৫
লিখা: Sidratul Muntaz
তোহার কান্নার শব্দে আমীর দ্বিতীয় বেডরুম থেকে ছুটে এলো। তোহা বিছানার চাদর খামচে ধরে উল্টো হয়ে শুয়ে কাঁদছে৷ ওর সারা শরীর কাঁপছে। আমীর তোহাকে সোজা করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন তোহা?”
আমীরকে দেখে তোহার কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায়। অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বলতে থাকে। আমীর জিজ্ঞেস করল,
” দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
তোহা চোখমুখ হিম করে ভীত গলায় জবাব দিল,
” আমি এই রুম থেকে বের হতে পারছি না৷ কিছুতেই পারছি না।”
” মানে?”
তোহা ঢোক গিলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর বলল,” তোমাকে পাশে খুঁজে না পেয়ে ওই রুমে যেতে চেয়েছিলাম। দরজার কাছে পা রাখতেই আমার শরীরে শকের মতো কি জানি হয়। তারপর আমি ছিটকে বিছানায় পড়ে যাই। মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে খুব জোরে আছাড় মেরেছে।”
” কি বলছো এসব?”
” সত্যি বলছি। দুই দুইবার এরকম হয়েছে। আমার হাত-পা এখনো ব্যথা করছে।”
” এইটা মনে হয় তোমার মনের ভুল তোহা। হ্যালুসিনেশন টাইপ কিছু একটা হয়েছে হয়তো৷ আচ্ছা তুমি কি আজকে ঔষধ খেয়েছিলে? সত্যি করে বলো।”
তোহা তবুও মিথ্যা বলল,” খেয়েছিলাম তো।”
” ঔষধ খেলে তো ঘুম ভাঙার কথা না!”
” মানে?”
” মানে ডাক্তার বলেছিল ঔষধ মিস দেওয়া যাবে না৷ একদিন মিস দিলেই হ্যালুসিনেশন প্রবলেম হতে পারে। দেখলে তো সেটাই হলো। এই ঔষধ তোমার ব্রেইনের সাথে রিলেটেড। তুমি ঠিকঠাক ঔষধ না খেলে তো জীবনেও সুস্থ হতে পারবে না বরং আরও অসুস্থ হতে থাকবে। দেখো এখনি কেমন করছো তুমি!”
তোহা চিন্তায় পড়ে যায়। সত্যিই তো সে আজ ঔষধ খায়নি। কিন্তু এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত কোনো হ্যালুসিনেশন ছিল না ওইটা। সব সত্যি ছিল। এখন আমীরকে এই কথা কিভাবে বিশ্বাস করাবে? তোহা বলল,
” না। ওইটা হ্যালুসিনেশন হতে পারেনা। আমার সাথে সত্যিই এমন হয়েছে বিশ্বাস করো।”
” তাই? কে তোমাকে আছাড় মারবে শুনি? জ্বীন এসেছিল?”
” হতে পারে।”
” কিছুই হয়নি রে বাবা। সব তোমার মনের ভুল, বললাম তো। এবার আসো ঔষধ খেয়ে চুপচাপ ঘুমাও।”
আমীর ল্যাম্পটেবিলের কাছে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ঔষধ বের করল। তোহা ভয়ে আমীরের একহাত ধরে রাখে। তারপর অনুতপ্ত গলায় বলল,
” সরি।”
” সরি কেন?”
” ঔষধ খাওয়া নিয়ে মিথ্যে বলেছি তাই।”
আমীর সামান্য হাসল। তোহা চারিপাশে তাকাতে তাকাতে বলল,
” আচ্ছা তুমি ওইঘরে কি করছিলে?”
” কাজ করছিলাম। তুমি ঔষধ খাও।”
আমীর তোহাকে ঔষধ খাওয়িয়ে দিল। তোহা খেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,” এতোরাতে তোমার কিসের কাজ?”
” আছে। তুমি বুঝবে না।”
” বুঝবো না কেন? সব বুঝবো। বলো কি কাজ করছিলে?”
” একটা ফর্মুলা তৈরী করছিলাম।”
” নতুন এক্সপেরিমেন্ট? ”
” হুম।”
” চলো আমিও দেখবো।”
” দেখার কি আছে?”
” এমনি দেখবো।”
আমীর অগত্যাই তোহাকে নিয়ে দ্বিতীয় বেডরুমে যায়। তোহা সেখানে গিয়ে দেখল তেমন কিছু নেই। শুধু ডাক্তারির কিছু সরঞ্জাম এই যেমন, ছুরি, কাচি, লিক্যুইড দ্রবণ আর বিভিন্ন ধরণের এক্সপেরিমেন্টাল জিনিসপত্র। তোহা কি মনে করে যেন দরজার চিপায় উঁকি দিল। তারপর খাটের নিচেও দেখল। বাথরুমের দরজা খুলে আশেপাশেও দেখল। তার বারবার মনে হচ্ছে এ বাসায় তৃতীয় কেউ আছে। এমন মনে হওয়ার কারণ তোহা নিজেও জানেনা। আমীর তোহার কান্ড দেখে ফিক করে হেসে দিল৷ তারপর জিজ্ঞেস করল,
” এভাবে কি খুঁজছো?”
তোহা সন্দিহান কণ্ঠে বলল, ” তুমি এতোরাতে এসব জিনিস দিয়ে কি করছো?”
” বললাম না, নতুন একটা ঔষধের ফর্মূলা তৈরী করার চেষ্টা করছি।”
” কি ঔষধ? নাম কি?”
আমীর ঝটপট একটা নাম বানিয়ে ফেলল,” হ্যালোনাইট।”
” হ্যালোনাইট? এটা কিসের ঔষধ?”
” তোমার মতো রোগীদের জন্য। যাদের মাঝরাতে হ্যালুসিনেশন হয় আর সেটাকে সত্যি ভেবে কান্নাকাটি করে।”
তোহা কোমড়ে হাত রেখে বলল,” মজা নিচ্ছো?”
আমীর হেসে বলল,” সব তো দেখলে। এবার ঘরে চলো।”
” তুমি কি করবে?”
” আমি কাজ শেষ করে আসবো।”
” এসব চলবে না। মাঝরাতে জেগে জেগে কোনো কাজ করার দরকার নেই। আর যদি করতেই হয় তাহলে আমাকে সাথে নিয়ে করতে হবে।”
” এটা সম্ভব না। কেউ সাথে থাকলে আমি কনসেন্ট্রেট করতে পারিনা।”
” তাহলে তোমার রাত জেগে কাজ করাও হবে না। তুমি এখানে জেগে থেকে কষ্ট করবে আর আমি আরামে বিছানায় ঘুমাবো? তাও একা? এটা আমার দ্বারা সম্ভব না। শোনো, সব কাজ দিনেরবেলা করবে। এখন আমার সাথে ঘুমাতে চলো।”
” ঠিকাছে। ”
আমীর বাধ্যের মতো তোহার সাথে যায়। তোহার চোখ ফেটে ঘুম আসছে। কিন্তু ঘুমাতে মন চাইছে না। তার বারবার মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেলেই আমীর তাকে একা রেখে আবার ওই ঘরে চলে যাবে। সেই ভয়েই ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। তোহা আমীরের দিকে ফিরে বলল,
” একটা কথা বলি?”
আমীর চোখ খুলে তাকালো,” বলো।”
” বিয়ের পর মেয়েদের সবচেয়ে আপন হয় তার স্বামী। সেই হিসেবে তুমিই তো আমার সবচেয়ে আপন তাইনা?”
” হুম। তো?”
তোহা লাজুকমুখে বলল,
” তাহলে আমি কি তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারি?”
” না!”
আমীর খুব রূঢ় কণ্ঠে কথাটা বলে। বলার পর কিছুটা পিছিয়েও যায়। ওর ভাব-সাব দেখে মনে হচ্ছে যেন তোহা খুব অন্যায় আবদার করে ফেলেছে।
তোহা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” কেন?”
” কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ঘুম আসে না।”
” ও, আচ্ছা।”
তোহা নিচুস্বরে বলল। তারপর অন্যদিকে ফিরে গেল। আমীর নিষেধ করে দেওয়ায় লজ্জা লাগছে। যদি আমীর রাজি হতো তাহলেও লজ্জা লাগতো। কিন্তু সেই লজ্জাটা হতো প্রাপ্তির। এখন যেই লজ্জা লাগছে সেটা অপমানের। তোহার চোখ বেয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আমীর হঠাৎ ডাকল,
” তোহা।”
তোহা জবাব দেয় না। আমীর আবার ডাকল,” এই।”
তোহা দ্রুত হাতে চোখের জল মুছে জবাব দেয়,” হুম?”
” এদিকে তাকাও, আমার দিকে।”
তোহা পাশ ফিরল। কিন্তু মাথা নিচু করে রাখল। আমীর কাছে এসে তোহার থুতনি ধরে মাথাটা উপরে তুলল। তারপর নরম গলায় বলল,
” সরি।”
তোহা চুপ করে রইল। আমীর আবার বলল,
” আসলে আমার ভয় লাগে তোহা। তুমি কিন্তু রিলেশনের সময় খুব কনজার্ভেটিভ ছিলে৷ একটু হাত ধরলেই কাপাকাপি শুরু করতে। সেখানে জড়িয়ে ধরা তো অনেক বড় ব্যাপার৷ তাই আমি কখনো তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনা। আমার মনে হয় আমি কাছে আসলেই তুমি নর্ভাস হয়ে যাও। আর আমিও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করি। যেন কখনো কোনো ভুল না হয়। তোমার যখন সব মনে পড়বে মানে তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে, আমি চাই তখন আমাদের সম্পর্কটা আবার নতুনভাবে শুরু হবে।এজন্যই এখন দূরে দূরে থাকা। আশা করি বুঝতে পেরেছো।”
” হুম।”
” তাও যদি তুমি চাও, এখন জড়িয়ে ধরতে পারো।”
তোহা অভিমান করে বলল,” না থাক, কেউ জড়িয়ে ধরলে তো আপনার ঘুম আসে না।”
আমীর হেসে ফেলল। তারপর আলতো করে তোহার কপালে একটা চুমু দিল। তোহা অনেক অবাক হলো।
আমীর তোহার কানের লতিতে হালকা একটা কামড়ও দিল। তোহা শিউরে উঠল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। আমীর দুইহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তোহাকে। এবার যেন তোহার সারা শরীর কেঁপে উঠতে চাইল। আমীর বলল,
” কি? এখনি নর্ভাস লাগছে?”
তোহা উত্তর দিতে পারল না। কি বলবে? মাতাল মাতাল লাগছে নিজেকে। জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতিগুলো এতো ঈর্ষণীয় সুন্দর হয় কেন? আমীর বলল,
” ঠিকাছে তাহলে ছেড়ে দেই।”
তোহা দ্রুত গলায় বলল,” নাহ।”
তারপর নিজেই আমীরকে জড়িয়ে ধরল। আমীরের বুকে মুখ গুজল। ধাকধাক, ধাকধাক শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর একটা অন্যরকম সুভাষ। তোহার মনে হচ্ছে ওর পুরো পৃথিবীটাই এখন আমীরময়। দারুণ লাগছে। সারাজীবন কি এভাবে থাকা যায়না?
সকালে ঘুম থেকে উঠে তোহা দেখল সাদা শার্ট পরিহিত আমীর হাসিমুখে ওর দিকে চেয়ে আছে৷ তোহা চোখ খুলে তাকানোর দুই সেকেন্ড পরেই আমীর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” গুড মর্নিং।”
তোহা হাই তুলে বলল,” গুড মর্নিং। তুমি এভাবে বসে আছো কেন?”
” তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় ছিলাম।”
” কেন?”
” একটা ইম্পোর্ট্যান্ট কথা বলার ছিল যে!”
” কি কথা?”
আমীর তোহার মুখের কাছে ঝুঁকে রাশভারী কণ্ঠে বলল,” এবার আমাদের একটা বাচ্চা নেওয়া উচিৎ তোহা।”
এই কথা শুনে বিস্ময়ে তোহার চোখ বড় হয়ে যায়। কিছুটা উচ্চশব্দে বলল,” কি?”
” হুম। তোমার কি মনে হয় না আমাদের একটা বাচ্চার দরকার আছে?”
” এতো তাড়াতাড়ি?”
” তোমার জন্য তাড়াতাড়ি। কিন্তু আমার জন্য এটাই পারফেক্ট টাইম। আমি বুড়ো হয়ে বাবা হতে চাই না।”
তোহা গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। আমীরের বাচ্চা তার পেটে আসবে এই কথা ভাবতেই শরীরে কেমন যেন একটা লাগছে। অনুভূতিটা নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু আমীরের উদ্দেশ্য ভালো মনে হচ্ছে না। তোহা বলল,” তুমি কি সিরিয়াস?”
” একদম।”
তোহা বার কয়েক ঢোক গিলল। আমীর বলল,
” তুমি কি ভয় পাচ্ছো তোহা? ভয়ের কিছু নেই। খুবই সহজ প্রসেস। এমনকি তোমাকে বাচ্চা নয়মাস পেটেও রাখতে হবে না। চারমাসেই আমি বাচ্চা বের করে ফেলবো। তারপর বাচ্চাটা ল্যাবে বেড়ে উঠবে। ও পৃথিবীর প্রথম বাচ্চা হবে যে হাইব্রিড। অর্ধেক প্রাকৃতিক অর্ধেক কৃত্রিম। ”
” মানে? বুঝতে পারছি না তুমি কি বলছো?”
” আমার ড্রিম প্রজেক্টের কথা বলছি। ওর মাধ্যমেই আমি আমার নিউরোক্লোন প্রজেক্ট শেষ করবো। আমার এতোদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে। তোহা প্লিজ হেল্প মি। তুমি কি চাও না আমাদের বাচ্চা পুরো পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করুক? ওর মাধ্যমে গড়ে উঠুক শত শত বিস্ময়কর সৃষ্টি!”
” কি আবোল-তাবোল কথা বলছো? পাগল হয়ে গেছো তুমি?”
” পাগল হইনি। ঠিকই বলছি। তুমি বাচ্চা জন্ম দিবে কিনা বলো।”
তোহার কি উত্তর দিবে বুঝতে পারল না। আমীর হঠাৎই হিংস্র হয়ে উঠল। অধৈর্য্য গলায় বলল,
” কি হলো? বাচ্চা দরকার নেই তোমার? তুমি যদি বাচ্চা নিতে না চাও তাহলে আমিও তোমাকে চাইনা। ডিভোর্স।”
তোহা সঙ্গে সঙ্গে বলল,” না না, ডিভোর্স না। আমি বাচ্চা নিবো। আমাদের অবশ্যই বাচ্চার দরকার আছে। আমি বাচ্চা নিবো আমীর!”
ঘুমের মধ্যে তোহাকে বিরবির করতে দেখে আমীর বিস্মিত গলায় বলল,” কি হয়েছে তোহা?”
তোহা চোখ খুলে তাকায়। বিচলিত গলায় বলল,” আমি বাচ্চা নিতে চাই।”
আমীর কপালে গুরুতর ভাজ ফেলে বলল,” হোয়াট?”
তোহা বলল,” আমি বাচ্চা নেওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত।”
” হোয়াট রাবিশ! তুমি নিজেই তো একটা বাচ্চা। আবার আরেকটা বাচ্চা নিতে চাও?”
” হ্যা চাই। আমার বাচ্চা লাগবে। ঠিক তোমার মতো হবে বাচ্চাটা। সেও ঔষধের ফর্মূলা বানাবে। তোমার মতো ফার্মাসিস্ট হবে।”
আমীর চিন্তিত গলায় বলল,” আমার মতো হবে?”
” হ্যা। তোমার বাচ্চা তো তোমার মতোই হবে তাই না?”
আমীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ উঠে চলে গেল৷ দ্বিতীয় বেডরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তোহা চুপচাপ বিছানায় বসে রইল। তার মাথায় এখনো বাচ্চা প্রসঙ্গ ঘুরছে। সারাদিন আর একবারও দরজা খুলেনি আমীর। তোহা অনেকবার নক করেছে। স্বপ্নে দেখে আবোল-তাবোল কথা বলার জন্য আমীরকে সরি বলেছে। বিভিন্নভাবে ক্ষমা চেয়েছে। তাও আমীর দরজা খুলেনি। বিকালে নীলাভ্র আসল বাসায়। ওর হাতে ছিল বিয়ের কার্ড। সামনে শুক্রবার নীলাভ্র আর রিম্মির বিয়ে!
to be continued…