ধূসর রঙে আকাশ পর্ব-১৬

0
918

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১৬
লিখা: Sidratul Muntaz

তোহা নীলাভ্রকে দেখে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল,
” কেমন আছো ভাইয়া?”
” আমার কথা মনে আছে তোর?”
” মনে থাকবে না কেন? ভেতরে আসো।”
নীলাভ্র ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,” পূরবী বলল তুই নাকি জামাই পেয়ে সব ভুলে গেছিস?”
” সব ভুলে গেলেও তোমাকে ভুলিনি। আমি কি তোমাকে ভুলতে পারি বলো?”
” হয়েছে আর পাম দিস না।”
” সত্যি নীল ভাইয়া, একদম পাম দিচ্ছি না।”
” এ বাসায় আসার পর একবারও আমার সাথে দেখা করেছিস? আচ্ছা তুই কি আমার উপর এখনো রেগে আছিস তোহা?”
” না তো। তোমার উপর কেন রেগে থাকবো?”
” সেদিন শপিংমলে তোকে একা ফেলে চলে এসেছিলাম সেজন্য রেগে থাকতেই পারিস। অবশ্য আমি চলে আসায় মনে হয় তোর সুবিধাই হয়েছিল। নাহলে পালাতি কিভাবে?”
তোহা ভ্রু কুচকে বলল” কোনদিনের কথা বলছো? মনে পড়ছে না।”
” আরে যেদিন তুই নিখোঁজ হলি, সেদিন শপিংমলেই তো আমাদের লাস্ট দেখা হয়েছিল তাইনা?”
তোহার মনে পড়েনি। তবুও বলল,
” এইটা নিয়ে আবার রেগে থাকার কি আছে? আমি মোটেও রেগে নেই।”
নীলাভ্র এবার বিয়ের কার্ড এগিয়ে দিল,” এটা তোর জন্য। ”
তোহা কার্ডটা ধরে বলল,
” কি এটা?”
” ইনভিটেশন কার্ড।”
” কিসের ইনভিটেশন?”
” আমার বিয়ের। তুই তো বেঈমানি করে বিয়ের দাওয়াতটাও দিলি না। তাই আমি নিজের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেলাম। জামাই নিয়ে চলে আসিস।”
” তুমিও বিয়ে করে ফেলছো?”
” তো করবো না? বিয়ে কি খালি তোরাই করতে পারিস? আমরা পারি না?”
” কিভাবে কি হলো? পাত্রী কে? রিম্মি আপু নিশ্চয়ই!”
” হ্যা। তুই জানলি কিভাবে?”
” পূরবী বলেছে।”
” ওহ। ওই মেয়ের পেটে কোনো কথাই থাকে না।”
তোহা উত্তেজিত গলায় বলল,
” আচ্ছা বলো না, তোমাদের মধ্যে কিভাবে কি হলো? আমার খুব আগ্রহ লাগছে।”
” কি নিয়ে আগ্রহ লাগছে?”
” আগ্রহ লাগছে এইটা জানতে যে, এত্তো কিউট একটা মেয়ে তোমার মতো উজবুকের দ্বারা পটলো কিভাবে?”
নীলাভ্র গরমচোখে তাকিয়ে বলল,” কি বললি?”
” সরি,সরি। মানে আমি জানতে চাইছি তোমাদের প্রেমটা কিভাবে হলো?”
নীলাভ্র আরাম করে সোফায় বসল। তোহাও ওর পাশে বসল। নীলাভ্র পায়ের উপর পা তুলে বলল,
” রিম্মি হচ্ছে ভাইয়ার শালি। মানে তিলোত্তমা ভাবীর ছোটবোন। আপন না,মামাতো। ও যে কথা বলতে পারেনা সেটা আমি প্রথম থেকেই জানতাম৷ এটাও ওকে ভালো লাগার একটা কারণ। ”
” তাই? কেন?”
” বোবা মানুষ বিয়ে করলে সংসারে কখনো ঝগড়া লাগবে না। নিরবে নিভৃতে জীবন কেটে যাবে। এমন কপাল কয়জনের হয় বল?”

সেদিন শপিংমল থেকে ফিরে এসে নীলাভ্র খুব সংবিগ্ন ছিল। লাভলী আন্টির কান্নাকাটি, জাবিদ আঙ্কেলের হল্লাহল্লি, পুরো বাড়িটা যেন মরাবাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছিল। নীলাভ্র বিষণ্ণ মনে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে টেবিলে বসে। তখন বুকশেলফে একটা সুন্দর খামে গোঁজা চিরকুট খুঁজে পায়। চিরকুট থেকে খুব মোহনীয় একটা সুঘ্রাণ আসছিল। নীলাভ্র যদি খামটা না দেখতো তাহলে সুঘ্রাণ অনুসরণ করেই খুঁজে নেওয়া যেতো। চিরকুটের লেখাগুলো খুব সুন্দর ছিল। এতো সুন্দর হাতের লেখা নীলাভ্র আগে কখনো দেখেনি। একদম বইয়ের মতো। মনে হচ্ছে কেউ কলম দিয়ে টাইপ করেছে। একটুও কাটাছিড়া নেই। এতো নিঁখুত কারো হাতের লেখা হতে পারে? নীলাভ্র চিরকুট পড়বে কি? মিনিট দুয়েক নিষ্পলক চোখে শুধু লেখার সৌন্দর্য্যই দেখে গেল। তারপর পড়তে শুরু করল। নিঃসন্দেহে চিঠিটা রিম্মির।
” মিস্টার নীলাভ্র পাটোয়ারী,
আমি কখনো কল্পনাও করিনি কাউকে এভাবে চিঠি লিখবো। আপনি আমার জীবনের প্রথম মানুষ যার জন্য আমি না চাইতেও চিন্তা করছি। যার কথা ভেবে ভেবে আমার দিনের অর্ধেক সময় কেটে যায়। আর যার কথা ভাবতে আমার একটুও বিরক্ত লাগে না। বরং সবচেয়ে আনন্দ লাগে। আমি কখনো কাউকে নিয়ে এতোটা ভাবিনি। অথচ দুনিয়ার সব মানুষ আমাকে নিয়ে ভাবে। অনেক ভাবে। আমার কাজ-কর্মে আশ্চর্য হয়নি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে পৃথিবীতে। আমি এটাও জানি আপনিও আমাকে নিয়ে সারাদিন ভাবেন। ভয়ও পান। কিন্তু তবুও আমার থেকে পালাতে চান না। হয়তো এই ভয় পাওয়াটাও আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দিনে অন্তত একবার আমার চোখ রাঙানী না খেলে আপনার মন ভরে না। এটা কিন্তু আপনি নিজেই চিঠিতে বলেছেন। একটা সত্যি কথা কি জানেন? আমি যতই বিরক্ত হওয়ার ভান করি না কেন। আসলে আমি কখনোই বিরক্ত হইনি। বরং আপনি সাথে থাকলে আমার ভালোই লাগে। আজকে আমাকে ধন্যবাদ দিতে পারেন নি বলে আফসোস হচ্ছে? আফসোস করবেন না। আমি ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কিছুই করিনি। আর আপনাকে অভদ্র ভাবার প্রশ্নই আসেনা। সামান্য ধন্যবাদের জন্য আপনি আমার কাছে অভদ্র হয়ে যাবেন? এতোটা সংকীর্ণ মানসিকতা অন্তত আমার নেই। আজকে যে কাজটা আমি করেছি সেটা কিন্তু আমার নিজের জন্য করেছি। কারো বিপদের সময় আমি নিরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না। আর সেই বিপদটা যদি হয় আপনার মতো মানুষের। আচ্ছা আপনি ধন্যবাদ দিতে চান তাইনা? আমি কিন্তু ধন্যবাদ নিবো না। এর বদলে অন্যকিছু নিবো। সেটা হচ্ছে সময় আর প্রতিশ্রুতি। দিনের অন্তত পাঁচঘণ্টা সময় আপনি আমার জন্য বরাদ্দ রাখবেন। এই পাঁচঘণ্টা আপনি শুধু আমার সাথে থাকবেন। অন্যকোনো কাজ করতে পারবেন না। কি? খুশি লাগছে? এখন প্রতিশ্রুতির বিষয়টা বলি। আপনি কখনো আমার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। আসলে পারবেন, কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। এটা মাথায় রেখেই প্রশ্ন করবেন। যদি কোনো প্রশ্ন আমি একবার এড়িয়ে যাই তাহলে দ্বিতীয়বার ওই প্রশ্ন আর কখনো করতে পারবেন না। আপনাকে এবার একটা সিকরেট বলি। আমি কিন্তু ম্যাজিক জানি। কাপড়ের রঙ পালটে দেওয়া, খালি বাক্স থেকে কবুতর বের করা, পাখিকে খরগোশ বানানো এসব যেন তেন ম্যাজিক না। আমার ম্যাজিক অন্য ধাচের। যখন দেখাবো তখন বুঝবেন। আর অবাকও হবেন। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখবেন। সব সিকরেট। কাউকে কিচ্ছু জানানো যাবে না। যদি এসব মাথায় রেখে আমার সাথে দেখা করতে পারেন তাহলে আগামীকাল সকাল এগারোটায় পদ্মপুকুর পার্কে আসবেন। আমি অপেক্ষায় থাকবো। আরেকটা কথা, তোহার বিষয়টা জানি। আপনি ওকে নিয়ে খুব চিন্তিত এটাও জানি। কাল থেকে আমরা একসঙ্গে ওকে খুঁজবো। এটা হবে আমাদের অন্যতম মিশন। আজকের মতো বিদায়। ভালো থাকবেন।
রিম্মি।”
নীলাভ্র এরপরদিনই সকাল এগারোটায় পদ্মপুকুর পার্কে যায়। রিম্মির সাথে কথা বলার জন্য একটা ছোট নোটপ্যাডও পকেটে নিয়েছিল। কিন্তু সেটা কোনো কাজে লাগেনি। নীলাভ্র অবাক হয়ে খেয়াল করে, রিম্মির সাথে কোনোরকম শব্দ না করেই কথা বলা যাচ্ছে। রিম্মি মনে মনে যা বলছে, নীলাভ্র সেটাই শুনতে পাচ্ছে। নীলাভ্র বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
” এটা কিভাবে হচ্ছে?”
রিম্মি শব্দ ছাড়া উত্তর দেয়,” আমি ইচ্ছে করলেই যে কারো মস্তিষ্কে শব্দ পাঠাতে পারি। সেই শব্দ শুধু সেই নির্দিষ্ট মানুষটি শুনবে যাকে আমি টার্গেট করবো। এটাই আমার ম্যাজিক।”
নীলাভ্র বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এমন কখনো হতে পারে? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,” এটা কিভাবে সম্ভব?”
রিম্মি সামান্য হাসে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। শর্ত ছিল রিম্মি কোনো প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে দ্বিতীয়বার সেটা জিজ্ঞেস করা যাবে না। তাই নীলাভ্র আর এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেনি। ওরা প্রতিদিন দেখা করতো। একসাথে অনেক জায়গায় ঘুরতো৷ তাদের এই ঘুরাঘুরির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তোহাকে খোঁজা। নীলাভ্র তোহার কলেজে গিয়ে মিতু আর কাকলীর সাথেও দেখা করে। কিন্তু ওরা তোহা সম্পর্কে কোনো ইনফরমেশন দিতে পারেনি। তোহার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে নীলাভ্রর সবচেয়ে সন্দেহ ছিল অন্তু আর নিয়াজের উপর। অন্তু নীলাভ্রর ভার্সিটি ফ্রেন্ড। তোহাকে প্রায়ই উত্যক্ত করতো। প্রপোজ করেছিল কিন্তু তোহা পাত্তা দেয়নি। আর নিয়াজ তোহাদের ব্যাচেরই একটা পিচ্চি ছেলে। ওর বয়স সতেরো বছর চারমাস। তোহার বয়স সতেরো বছর আটমাস৷ নিয়াজ তোহার চারমাসের ছোট৷ তাই তোহা ওকে ‘পিচ্চি ডাব্বু’ বলেই ডাকে। পিচ্চি বলার কারণ বয়সে ছোট। আর ডাব্বু বলার কারণ ওর মাথায় কদমছাঁটের মতো চুল। ছেলেটা দেখতে যথেষ্ট সুন্দর। কিন্তু গোলগাল মুখ হওয়ায় একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে৷ এই ছেলে তোহার পিছনে আড়াইবছর ধরে ঘুরছে। নীলাভ্রর হাতে কত যে মার খেয়েছে তার হিসেব নেই৷ তোহা দিনে কমপক্ষে তিন-চারবার নিয়াজকে চড় দিতো৷ তাও নিয়াজের ভ্রুক্ষেপ ছিল না। যখন তোহার কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না, নীলাভ্র অন্তু আর নিয়াজকে সন্দেহের তালিকায় তুলে রাখে। একদিন সময় করে গিয়ে ওদের ইচ্ছামতো পিটায়। ওরা হাত-জোর করে মাফ চাইছিল। বারবার বলছিল তোহার বিষয়ে ওরা কিছু জানেনা। কিন্তু নীলাভ্র থামার পাত্র নয়। শেষে রিম্মির জোরাজুরিতে নীলাভ্রকে থামতে হয়। রিম্মি খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, তোহার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে ওদের কোনো হাত নেই। ওরা নির্দোষ। নীলাভ্র জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কিভাবে জানলেন ওরা নির্দোষ? আমি তো বলবো ওরা ভীষণ চতুর। কিভাবে যে মিথ্যে বলবে টেরও পাবেন না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ওরাই আমাদের তোহাকে কিছু একটা করে গুম করে দিয়েছে। নিয়াজ আড়াই বছর ধরে তোহার পেছনে ঘুরেও পাত্তা পায়না। অন্তুও বিগত দুইবছর ধরে লেগেছে৷ অন্তু আর নিয়াজ কিন্তু আগে পরিচিত ছিল না। মাত্র কয়েকমাস ধরে ওদের গলায় গলায় ভাব। আর তারপরই তোহার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। এসব কি শুধুই কাকতালীয়? আপনার কাছে গোলমাল লাগছে না?”
” আপনি একটু বেশিই চিন্তা করছেন। ওরা তোহা সম্পর্কে কিছু জানেনা।”
” সেটা আপনি কিভাবে বুঝলেন?”
” আমি মানুষের চেহারা দেখেই বুঝতে পারি কার মনে কি চলে।”
” তাই? তাহলে আমার চেহারা দেখে বলুন তো আমার মনে কি চলছে?”
নীলাভ্রকে হতভম্ব বানিয়ে রিম্মি বলল,” আপনি এখন আমাকে সন্দেহ করছেন। ভাবছেন তোহার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আমার হাত আছে। ঠিক বললাম না?”
রিম্মি নিঃশব্দে কথাগুলো বলে মুচকি হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইল। নীলাভ্রর চোখেমুখে ঘোর বিস্ময়। সেদিন থেকেই সে বুঝতে পারে, রিম্মি শুধু মানুষের সাথে মস্তিষ্কের মাধ্যমে কথাই বলতে পারেনা। কার মস্তিষ্কে কি চলছে সেটাও নিখুঁতভাবে বুঝে ফেলতে পারে। কেউ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে মিথ্যে বললেও রিম্মি ধরতে পারে। নীলাভ্র নিজেই মিথ্যে বলতে গিয়ে অনেকবার রিম্মির কাছে ধরা খেয়েছে। তারপর থেকে খুব সাবধানে চলে সে। সবসময় নীলাভ্র কিছু বলার আগেই রিম্মি ওর মনের কথা বুঝে নেয়। নীলাভ্র তাই রিম্মিকে অপশরী বলে ডাকে৷ তার ধারণা, আল্লাহ রিম্মিকে বিশেষভাবে তৈরী করেছে শুধুমাত্র নীলাভ্রর জন্য। রিম্মি নীলাভ্রর জীবনের অপশরী। একদিন একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। রিম্মি আর নীলাভ্র রিকশা থেকে নামতেই শুরু হলো উথাল-পাথাল বৃষ্টি। রিম্মি কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেনা। অন্যদিকে নীলাভ্রর অন্যতম শখ বৃষ্টিতে ভেজা। রিম্মি যত পালাতে চাইছিল নীলাভ্র তত ওকে আটকে রাখতে চাইছিল৷ রিম্মিকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার সুযোগ এতো সহজে হাত ছাড়া হতে দেওয়া যায়না৷ তখন প্রায় দুপুর৷ রাস্তাঘাট নিরিবিলি, বৃষ্টির ঝুমঝাম শব্দ আর মাঝে মাঝে মেঘের হাক-ডাক সাথে ঠান্ডা বায়ুপ্রবাহ, দারুণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। রিম্মির পিঠ অবধি লম্বা চুল ভিজে জপজপে হয়ে আছে৷ ভেজা চুলে রিম্মিকে সুন্দরী ঝর্ণা মনে হচ্ছিল। আবেদনময়ী লাগছিল। নীলাভ্রর মনে পাগলামী ইচ্ছা জাগে। রিম্মিকে দেয়ালে ঠেকিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরল। তারপর ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিতে চাইল। রিম্মি তখন একহাতে নীলাভ্রর বামগালে এমন জোরে একটা চড় মারলো, নীলাভ্র স্লিপ কেটে রাস্তার বাহিরে ছিটকে পড়ে। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। সেই চড়ের কথা মনে পড়লে এখনো তার সারা গা শিউরে উঠে। সয়ংক্রিয়ভাবে শরীর ঝাকুনি দেয়। সেদিন থেকে আর রিম্মিকে অপশরী মনে হয়নি। অপশরীটা যেন হঠাৎ করেই ডাকিনী হয়ে উঠেছিল। এ কেমন অভিঘাত করেছিল রিম্মি সেদিন? নীলাভ্র তখন বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে!

তোহা এটুকু শুনেই খিকখিক করে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। পেট ব্যথা হয়ে যায় তাও যেন হাসি থামে না। নীলাভ্র কঠিনগলায় বলল,
” হাসির কি হলো? আমি তোর সাথে দুঃখের কথা শেয়ার করছি৷ তুই সেন্টি না খেয়ে ব্যাক্কলের মতো হাসছিস কেন?”
তোহা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,” এরপর কি হয়েছিল?”
” কি আর হবে! তিনদিন হসপিটালে ছিলাম৷ সে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা।”
নীলাভ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তোহার হাসির বেগ আরও বেড়ে যায়। নীলাভ্র চরম বিরক্ত হয়ে বলল,
” তুই আবার হাসছিস? এবার কিন্তু মার খাবি।”
তোহা হাসতে হাসতে বলল,” আমি ভাবছি বাসর রাতের কথা। শুধু কিস করতে গিয়েছিলে তাতেই তিনদিনের জন্য হসপিটালে। আর বাসর রাতে যখন..”
” থাম, অসভ্য মাইয়া। আমি যে তোর বড়ভাই সেটা ভুলে গেছিস?”
” আচ্ছা সরি, সরি।”
হাসাহাসির শব্দে আমীর দরজা খুলে বেরিয়ে আসল। নীলাভ্রকে দেখেই সবার আগে ভ্রু কুচকায় আমীর। তারপর অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
” এতো হাসাহাসি কিসের?”
তোহা সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। নীলাভ্র উঠে দাড়িয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল,
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, ভালো আছেন?”
” ভালো। আপনি এখানে?”
” আমি এসেছিলাম তোহাকে বিয়ের কার্ড দিতে।”
” কার বিয়ে?”
” আমার নিজের। আপনারা দুজন আগামী শুক্রবার পলওয়েল কমিউনিটি সেন্টারে চলে আসবেন। আর গায়ে হলুদ হবে বৃহস্পতিবার। ওইটা ছাদে।আপনারা আসবেন।”
” বিয়ে কার সাথে হচ্ছে?”
তোহা বলল,” কার সাথে আবার? রিম্মিআপু, নীলাভ্র ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। তুমি তো চেনো। আমাদের সামনের ফ্ল্যাটেই থাকে। প্রতিবেশী।”
আমীর হাসল। বিয়ের সংবাদে তাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে। তোহার হাত থেকে বিয়ের কার্ডটা নিয়ে আনন্দিত গলায় আমীর বলল,
” তাই নাকি? খুব ভালো সংবাদ। আপনাদের নতুন জীবনের জন্য কংগ্রাচুলেশনস। আমরা নিশ্চয়ই আসবো।”
নীলাভ্র হাসি দিয়ে বলল,” থ্যাঙ্কিউ ব্রাদার।”
আমীর এক ভ্রু উচু করে বলল,” দোয়া করি, যেন খুব শীঘ্রই আপনাদের ঘরে নতুন সদস্য আসে।”
তোহা এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। কি আজব! বিয়েই যেখানে হয়নি সেখানে আমীর বাচ্চার জন্য দোয়া করে দিচ্ছে? দাওয়াত পেয়ে কেউ এমন দোয়া করে? নীলাভ্র আমীরের কথা বুঝল না। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
” মানে?”
তোহা বিষয়টা এড়ানোর জন্য বলল,” মানে রিম্মি আপু তোমাদের ঘরে নতুন সদস্য হয়ে যাচ্ছে না? সেটাই বলেছে ও।”
নীলাভ্র হাসার চেষ্টা করে বলল,” ও আচ্ছা। আমি তাহলে আজ আসি ভাইয়া?”
” আচ্ছা আসুন। আর বিয়ের পর ভাবীকে নিয়ে একদিন আমাদের বাসা থেকে ঘুরে যাবেন। অগ্রীম দাওয়াত দিয়ে রাখলাম।”
আমীরের এতো আগ্রহ দেখে তোহা শুধু অবাকই হচ্ছে। নীলাভ্র সবকয়টা দাঁত বের করে হাসল৷ তারপর সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিল। আমীর দরজাটা বন্ধ করে প্রফুল্লমনে জিজ্ঞেস করল,
” নীলাভ্রকে তুমি কতদিন ধরে চেনো?”
” সেই ছোটবেলা থেকে। কেন?”
” না এমনি। ও কি করে?”
” তেমন কিছু তো করে না। ওর বড় ভাইয়ের একটা বিজনেস আছে৷ সারাদিন টই টই করে একটা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ভাইয়ের টাকা উড়ায়। আপাতত বেকারই বলা চলে। কেন?”
আমীর কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রইল। কি যেন একটা চিন্তা করছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে খুব জটিল কোনো ধাধার উত্তর মিলানোর চেষ্টায় আছে। তোহা আর প্রশ্ন করল না। সকালে স্বপ্ন দেখে অদ্ভুত কথা বলার জন্য আরেকবার ক্ষমা চাইল,
” সরি।”
” সরি কেন?”
” সকালে আমি একটা আজব স্বপ্ন দেখে ওইসব বলেছি। ইচ্ছে করে বলিনি কিন্তু। কান ধরছি, আর জীবনে বাচ্চা সংক্রান্ত কিছু বলবো না। বাচ্চার নাম মুখেই আনবো না।”
আমীর জবাব দিল না। কি যেন ভাবছে৷ তোহা ভয়ে ভয়ে বলল,
” তুমি কি এখনো রেগে আছো?”
আমীর দায়সারা উত্তর দিল,” নাহ।”
তারপর দ্বিতীয় বেডরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল৷ তোহা হা করে তাকিয়ে রইল৷ বিয়ের কথা শুনে আমীরের মনে মেঘ সরে গিয়ে যেন বৃষ্টি নেমেছিল। এখন মনে হচ্ছে আবার মেঘ জমেছে। এই মানুষটার মতিগতি বোঝা বড় দায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here