ধূসর রঙে আকাশ পর্ব-১৭

0
846

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১৭
লিখা: Sidratul Muntaz

আজকে গোসল করতে গিয়ে একটা বাজে ঘটনা ঘটেছে। তোহা পায়ের পায়েলটা খুলতে ভুলে গেছিল। গোসলে ঢুকে মাথায় পানি ঢালার পর সেকথা মনে পড়ে। তখন তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে পায়েলটা ফসকে বাধরুমের কোণায় কূপে পড়ে যায়। তোহা কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাড়িয়ে রইল। তারপর পাগলের মতো খুঁজতে লাগল পায়েলটা। কিন্তু ততক্ষণে ওইটা অনেক নিচে চলে গেছে। তোহা আর নাগাল পেলো না। পা ঢেকে যায় এমন লম্বা একটা শাড়ি পড়ল। তারপর বিষণ্ণমুখে বিছানায় বসে রইল। আমীরকে এই কথা জানতে দেওয়া যাবে না। পায়েলটা আমীর খুব যত্ন করতে দিয়েছিল তোহাকে। অথচ তোহা সেটা হারিয়ে ফেলল। প্রথম ভালোবাসার উপহারটাও যত্ন করে রাখতে পারল না। এটা জানলে সে কষ্ট পাবে নিশ্চয়ই! তাছাড়া তোহা এই কথা কোন মুখে বলবে আমীরকে? ইদানীং অবশ্য আমীরের সাথে তোহার তেমন একটা কথা হচ্ছে না। ছেলেটা সারাখন দ্বিতীয় বেডরুমে দরজা আটকে বসে থাকে। খাওয়ার সময় হলে খায় তারপর আবার দরজা দিয়ে ফেলে। রাতে ঘুমানোর সময় শুধু তোহার কাছে আসে। তবুও তোহার মনে হয়, সে ঘুমিয়ে গেলে আমীর আবার চলে যায়। এতো কাজ কিসের ওর? দ্বিতীয় বেডরুমটা যেন কোনো বেডরুম নয়। আস্তো এক লঙ্গরখানা বানিয়ে রেখেছে আমীর। যদিও আমীরের ভাষ্যমতে ওইটা ল্যাবরেটরি। কিন্তু তোহার কাছে লঙ্গরখানাই বটে। আমীরের ওইসব ফর্মুলা তৈরীর গবেষণা তোহার একদম পছন্দ না। সারাজীবন যদি এসব নিয়েই থাকবে তাহলে বিয়েটা কেন করল? তোহার নিজেকে গুরুত্বহীন মনে হয়। আমীরের কাছে যেন তোহার কোনো দামই নেই। ওই লঙ্গরখানাই সব। এইযে তোহার রাতের ঔষধগুলো শেষ হয়ে গেছে। আমীর কি একবারও খোঁজ নিয়েছে? ওর হয়তো মনেও নেই। অথচ আগে তোহার ঔষধ শেষ হতে দেরি লাগতো কিন্তু আমীরের সেটা নিয়ে আসতে দেরি লাগতো না। আর এখন? একটাবার খোঁজও নেয়না। তোহার ধারণা সে যদি মরেও যায়, আমীর তাকে ওই লঙ্গরখানায় নিয়ে খাটের নিচে ঢুকিয়ে রাখবে। তারপর গবেষণা চালিয়ে যাবে। জানাযা’র ব্যবস্থাটাও করবে না। যদি সময় নষ্ট হয়!
রাতে ঘুমাতে এসে আমীর সবার আগে তোহাকে জিজ্ঞেস করল,
” ঔষধ খেয়েছো তোহা?”
ঔষধ তো নেই। তোহা খাবে কি? তাও অভিমান করে মিথ্যে বলল,
” হুম খেয়েছি।”
” গুড৷ এবার ঘুমাও।”
তোহার ভেতর থেকে রাগ উঠে আসে। আমীর প্রত্যেকদিন ঘুমানোর সময় শুধু এই দুইটা বাক্যই বলে। এর বাহিরে একটা কথাও বলেনা। যেন কথা বললেও মুখ ফোসকা পড়বে। তোহা হঠাৎ একটা অদ্ভুত কান্ড করল। সহসা পেছনে ঘুরে আমীরের টি-শার্টের কলার চেপে ধরল। আমীর আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে ফেলে। তোহা আমীরের বুকের টেনে বোতামগুলো খুলে গাঢ় একটা কামড় বসিয়ে দেয় ঠিক মাঝখানে। আমীর চিৎকার দিয়ে উঠল। তোহার ভাবনার ঘোর কাটল। প্রতিদিন এই দৃশ্য কল্পনা করে সে। মনে মনে শপথ করে আজকে সে এই কাজটা অবশ্যই করবে। কিন্তু করা হয়না৷ তাছাড়া তোহার মনে হয়, সে যদি এমনকিছু করেও আমীর চিৎকার দিবে না। কি করবে সে বিষয়েও তোহার ধারণা নেই। আসলে আমীর তখন কেমন রিয়েকশন দিবে সেটা জানতেই তোহার এই কাজ করতে ইচ্ছে করে। তোহা ঠিক করল আজ ঘুমাবেই না। শুধু ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকবে। আমীর কি মাঝরাতে ওকে একা ফেলে লঙ্গরখানায় চলে যায়? তোহা আজকে দেখবে, আমীর সত্যিই যায় কিনা। ঘড়িতে একটারো বেশি বাজে। তোহা একপাশে ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছে। হঠাৎ কেন জানি পেছন ফিরে একবার দেখতে ইচ্ছে হলো আমীর আছে নাকি। তোহা যেইমাত্র পেছনে ঘুরল দেখতে পেল আমীর নেই! ভয়ে আঁতকে উঠল তোহা। এই ছেলেটা কি ভূত? হাটলেও শব্দ পাওয়া যায় না! কখন পাশ থেকে উঠে গেল তোহা টেরই পায়নি।
শোয়া থেকে উঠে বসল তোহা। দ্বিতীয় বেডরুমে গিয়ে আমীরকে ডাকবে কিনা চিন্তা করছে। ইচ্ছে করছে যেতে। আবার ভয়ও লাগছে। যদি দরজায় সামনে গিয়ে আবার ওইদিনের মতো ঘটনা হয়? ছিটকে যদি বিছানায় পড়ে যায়? তোহার শরীর কাটা দিয়ে উঠল। প্রায় আধঘণ্টার মতো চুপচাপ বসে রইল। অবশেষে মনের কৌতুহলের কাছে হার মানলো ভয়। তোহা উঠে দাড়ালো। ওই ঘরে না যেতে পারলে তার অবাধ্য মনের উত্তাল থামবে না। মনটা কেমন জানি করছে। বারবার মনে হয়, তোহার চারপাশে এমনকিছু হচ্ছে যেটা খুব বড় ভুল। তোহা দেখল ঠিক সেদিনের ঠিক মতোই দ্বিতীয় বেডরুমের লাইট জ্বালানো। দরজা ভিড়ানো। সরু আলোর রেখা ডাইনিং টেবিলে এসে পড়েছে। তোহা যথেষ্ট ধীরে ধীরে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। এবার কিছুই হলো না। সে সহজেই বের হতে পারল। কোনো শব্দ না করে শুধু একটু উকি দিল ঘরটার দিকে। তারপর যেটা দেখল, তোহা আর দাড়িয়ে থাকার শক্তি পেল না। মেঝেতে ঢলে পড়তে চাইল। মাথা দু-তিনবার চক্কর দিল। মেরুদণ্ড বরাবর শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুকের পাজর টনটন করছে। রিম্মি বিছানায় শুয়ে আছে। গায়ে সাদা চাদর। কোনো কাপড় নেই। আমীরের শুধু অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ও হয়তো দাড়িয়ে আছে। তোহা দরজার হাতল ধরে নিজেকে সামলালো। চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। চোখ ফেটে কান্না আসছে। তীব্র মাথাব্যথা করছে। তোহা যেদিন আমীর আর রিম্মিকে বারান্দায় একে-অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল সেদিনই আঁচ করেছিল ওদের মধ্যে কিছু আছে। কিন্তু সেই সম্পর্ক যে এতোটা গভীর, অন্তরঙ্গ,নোংরা তোহা কল্পনাও করেনি । এখন কষ্টের চেয়েও ঘৃণা বেশি হচ্ছে। এই মেয়েটার সাথে না নীলাভ্র ভাইয়ের বিয়ে? তোহা কি বিয়েটা হতে দিবে? কখনো দিবে না। তার ইচ্ছে করছে এখনি নীলাভ্রকে ডেকে সবকিছু দেখাতে। কিন্তু নীলাভ্রকে ডাকবে কিভাবে? তোহার কাছে না আছে ফোন না আছে নীলাভ্রর নাম্বার। হাত-পা শিথিল হয়ে আসতে লাগল। এ অবস্থায় হেটে পাশের বিল্ডিংএ যাওয়াও সম্ভব না। তোহা তাও চেষ্টা করলো। বুক পাজরের টনটনে ব্যথাটা তিক্ত জখমে রূপান্তর হয়েছে। শরীর জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। বিতৃষ্ণায় বমি আসার মতো অবস্থা। তোহা দরজা খুলে কোনোমতে নিচে নামল। গ্যারেজরুমে গিয়ে দেখল তাদের বাসার দাড়োয়ান এখনো জেগে আছে। লোকটার নাম হাসান। নীলাভ্রর সাথে উনার খুব ভালো বন্ধুত্ব। আচ্ছা? উনার ফোনে কি নীলাভ্র ভাইয়ের নাম্বার পাওয়া যাবে? তোহা হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকল,
” হাসান ভাই।”
হাসান ঘুরে তাকালো। তোহাকে দেখে উনার চক্ষু গোল। বিচলিত হয়ে বলল,
” আরে আপামণি, কি হইসে?”
তোহা ঢোক গিলে বলল,” নীলাভ্র ভাইকে একটা ফোন দেন না হাসান ভাই। খুব জরুরী দরকার। এখনি একবার আসতে বলুন। প্লিজ।”
” ক্যান আপা? ভাইজানের কিছু হইসে?”
” না না, সব ঠিকাছে। আপনি নীলাভ্র ভাইকে আসতে বলুন। অনেক জরুরী দরকার উনাকে।”
তোহার অবস্থা দেখে হাসান ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিল। দ্রুত নীলাভ্রর নাম্বার ডায়াল করে। তোহা সিড়ি ধরে মিনিট পাচেক অপেক্ষা করে। তার মাথা তখনো ভনভন করছিল। হাতের আঙুলগুলো কাঁপছিল। আর শুধু কান্না আসছিল। একটু পর টি-শার্ট আর লুঙ্গী পড়ে নীলাভ্র আসে। তার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাঁচা ঘুম ভেঙে ছুটে এসেছে। তোহার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে নীলাভ্র ঘাবড়ে যায়। ওকে দ্রুত কাছে এসে ধরল,
” কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? ভাইয়ার কিছু হয়েছে?”
” নীল ভাইয়া, তুমি শুধু একবার আমাকে উপরে নিয়ে চলো। আজকে তোমাকে এমন একটা জিনিস দেখাবো, তুমি কোনোদিন ভুলবে না।”
তোহা এই কথা বলে ডুকরে কেঁদে উঠল। নীলাভ্র আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। তোহার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই উল্টে পড়বে সিড়িতে৷ তাই নীলাভ্র আর রিস্ক না নিয়ে তোহাকে পাঁজাকোলায় তুলল। তারপর দৌড়ে তোহাকে নিয়ে সিড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। বাসার দরজাটা খোলা। নীলাভ্র তোহাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে চেয়ারে বসালো। তোহা হাতের ইশারায় বলল একদম চুপ থাকতে। নীলাভ্র লাইট জ্বালাতে যাচ্ছিল। তোহা সেটাও নিষেধ করল। নীলাভ্র ফিসফিস করে বলল,
” কি যেন দেখাবি? দেখা!”
তোহা নীলাভ্রর কাধে ভর দিয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর হেলতে দুলতে হেঁটে গেল দ্বিতীয় বেডরুমের দিকে। নীলাভ্র ওর পেছন পেছন গেল। রিম্মি এখন আর শুয়ে নেই। উঠে দাড়িয়েছে। আমীরকেও দেখা যাচ্ছে। রিম্মি জড়িয়ে ধরে আছে আমীরকে। তোহা এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে হু হু করে কেঁদে ফেলল। নীলাভ্র কয়েক মুহুর্তের জন্য হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। কি দেখছে সে এসব? চোখ কচলে আবার দেখার চেষ্টা করল। তোহা চুপ থাকতে না পেরে তেড়ে গেল ওদের দিকে। শব্দ পেয়ে আমীর আর রিম্মি ঘুরে তাকায়। তোহাকে দেখে আমীরের চোখেমুখে চমক দেখা গেলেও রিম্মি নির্বিকার ছিল। আমীর সবার আগেই তাকালো তোহার পায়ের দিকে। পায়েলটা ওর পায়ে নেই কেন? তোহা আক্রণাত্মকভাবে রিম্মিকে সজোরে ধাক্কা মারল। রিম্মি দেয়ালের সাথে বারি খায়। তোহা রিম্মির হাত টেনে ধরে ওর গালে সটান চড় দেয়। তারপর গলা টিপে ধরে। কালনাগিনীর মতো ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নিতে থাকে। ওর তেজ দেখে মনে হচ্ছে যেন এখনি সব ধ্বংস করে দিবে। শান্তশিষ্ট মেয়েটার এমন ভয়ংকর রূপ দেখে আমীর বিভ্রান্ত। কিন্তু রিম্মির গায়ে হাত তোলার শাস্তি ওকে পেতে হবে। আমীর রিম্মির গলা থেকে জোর-জবরদস্তি টেনে তোহার হাত ছাড়ায়। তোহা তীক্ষ্ণ শব্দে চিৎকার করে নিজের মাথা খামচে ধরল। নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে। রিম্মিকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমীর হঠাৎ কান্নারত তোহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বামহাতে একটা কঠিন চড় দিল। তোহা ছিটকে পড়ে যায়, নীলাভ্র এসে ধরল। তারপর আহত দৃষ্টিতে রিম্মিকে দেখতে লাগল। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here