ধূসর রঙে আকাশ পর্ব-২

0
2064

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২
লিখা: Sidratul Muntaz

ডিনার শেষ। তোহা আর পূরবী একই রুমে ঘুমাতে
এসেছে। তোহার হাতে একটা দার্শনিক বই। সচরাচর কখনো বই পড়ে না সে। কিন্তু তার বাবা জাবিদ সাহেবের বই পড়ার নেশা আছে। উনার ঘরে এক আলমারি বই। ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বইয়ের ভান্ডার।। আজকে তোহা ভয় কাটাতে বই নিয়ে বসেছে। বইয়ের ভেতর ডুবে থাকলে আজে-বাজে চিন্তা কল্পনায় আসবে না। পূরবী নখে নেইলপালিশ লাগাতে লাগাতে বলল,
” ঘুমাবি না?”
তোহা বইয়ে মনোযোগ রেখে উত্তর দিল, ” ঘুম আসছে না।”
” আমারও আসছে না। আচ্ছা, নীল যে বইটা নিয়ে গেছিল আর ফেরত দিতে এলো না তো?”
” বইয়ের জন্য তুই এতো পাগল হচ্ছিস কেন? দিবে একসময়।”
” ও সাংকেতিক ভাষা শিখে করবেটা কি? তোর জানতে ইচ্ছা করছে না?”
” না।”
পূরবী বিরসমুখে আবার নেইলপলিশ লাগানোয় মন দিল৷ মনে মনে গুনগুন করল,
” সে যে কেন আসেনা, আমার ভালো লাগেনা, আজ আসুক! তারে আমি মজা দেখাবো!”
তোহা চট করে বইটা ভাজ করে পূরবীর দিকে ঘুরে বলল,
” সত্যি করে বল পূরবী, নীল ভাইয়াকে তুই পছন্দ করিস তাইনা?”
পূরবী তাকিয়ে একচোখ টিপে বলল,
” প্রথম দিন থেকেই।”
তোহা অবাক হয়ে বলল,” আমাকে বলিস নি কেন?”
” তুই জিজ্ঞেস করিস নি তাই। আগ বাড়িয়ে বলে নিজের দাম কমাতে যাবো কেন?”
” তুই কি সিরিয়াস?”
” সিরিয়াসের উপরেও যদি আর কিছু থাকে আমি সেটাই।”
পূরবী কথা শেষ করে নখে ফু দিল। তোহা মুখ ছোট করে বলল,
” কিন্তু পূরবী, আমি শুনেছিলাম নীল ভাইয়ের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হয়ে গেছে।”
পূরবী ছ্যাত করে উঠল,” কোথ থেকে শুনেছিস?”
” তিলু ভাবী একদিন বলেছিল।”
” কোন মেয়ে?” পূরবী চোখ সরু করল। যেন মেয়ের নামটা জানতে পারলে এখনি খুন করতে চলে যাবে৷ তোহা ঠোঁট উল্টে বলল,
” আমি কি জানি কোন মেয়ে? শুধু জানি বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
পূরবী দুইহাত কপালে ঠুকতে ঠুকতে বলল,” হায় রাব্বা! আভ মেরা কেয়া হোগা? ম্যায় তো মার গায়ি।”
তোহা বইটা দুম করে বিছানায় রেখে উঠে দাড়ালো। ওরনা ঠিক করতে করতে বলল,
” ঢং করিস না। আমি মিথ্যে বলেছি।”
পূরবী হি-হি করে হেসে বলল,” আমিও আগেই বুঝেছি।”
তোহা আয়নার সামনে দাড়িয়ে ওর কান দুটো একবার দেখল। কল্পনা করতে লাগল, কান ছাড়া একটা মানুষকে দেখতে কেমন লাগে? তার যদি কান না থাকতো তাহলে তাকে দেখতে কেমন লাগতো? চুল দিয়ে নিজের ডানকান ঢেকে কল্পনা করতে লাগল তোহা। ধরে নিল তার কান নেই। এখন তাকে কেমন লাগছে? খুব বেশি খারাপ লাগছে না। কিন্তু চুল সরিয়ে দিলে ঠিকই খারাপ লাগবে। বিদঘুটে,ভয়ংকর, জঘন্য দেখাবে।
পূরবী হঠাৎ বিছানা থেকে বইটা তুলে মাইকের মতো বানালো। তারপর রকিং স্টাইলে উচ্চশব্দে গান শুরু করল। রক সং উচ্চশব্দে না গাইলে শুনতে ভালো লাগে না।
” শাহ,শাহ,শাহ! রগ কাটা শাহ৷ এক রগ কাটা শাহ মেরা দিল লে গায়া। যাতে যাতে মিঠা মিঠা গাম দে গায়া! শাহ,শাহ,শাহ,ওরে শাহ,শাহ।”
তোহা কান চেপে ধরল। তোহার মা সৈয়দালাভলী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন,
” কি হয়েছে তোদের? চেচাচ্ছিস কেন?”
পূরবী দ্রুত বই দিয়ে বানানো মাইক পেছনে লুকিয়ে ফেলে। চিমসানো গলায় বলে,” সরি আন্টি। গান গাইছিলাম।”
লাভলী বললেন,” এটা গান ছিল? আমি ভাবলাম ভূমিকম্প শুরু হয়েছে।”
তোহা মুখে হাত দিয়ে হেসে দিল। পূরবী লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে জিভ কাটল। লাভলী বললেন,
” আজকে অনেক কষ্ট করেছিস তোরা। এখন ঘুমা। চিৎকার চেচামেচী যেন আর না শুনি।”
পূরবী অনুগত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল,” আচ্ছা।”
লাভলি বললেন,” তোহা তুইও শুয়ে পড়। সকালে কলেজ আছে ন?”
” জ্বী আম্মু।”
লাভলি চলে যেতেই তোহা রেগেমেগে বলল,” আজকে আমরা সারপ্রাইজ দিয়েছি বলে মায়ের মন ভালো ছিল। এজন্যই কিছু বলেনি। নাহলে এখনি পিঠে দু-চার ঘা পড়তো। সমস্যা কি তোর?”
” আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তো তোর। তুই-ই তো আয়নার দিকে তাকিয়ে শাহ এর কথা চিন্তা করছিস।”
তোহা চোরের মতো চোখ ঘুরিয়ে বলল,” তুই কিভাবে বুঝলি?”
” কানে হাত দেওয়া দেখেই বুঝেছি। তুই কি ভাবছিলি সত্যি করে বলতো! নিশ্চয়ই ভাবছিলি কান কাটা শাহের সাথে তোর বিয়ে হয়েছে। বাসর রাতে সে ছুরি দিয়ে ছিত ছিত করে তোর কান কেটে দিচ্ছে। তাই না?”
পূরবী মুখে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করল। তোহার হাত-পা ভয়ংকর ভাবে শিরশির করে উঠল। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তোহা বলল,
” ভেরি লেইম জোকস।”
তোহা ঠোঁট ভেঙিয়ে পূরবীর হাত থেকে বই কেড়ে নিল। বইটা বাবার আলমারিতে রাখতে যেতেও তার ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে দরজার বাহিরে কেউ দাড়িয়ে আছে। বের হলেই অঘটন ঘটবে। উফফ! এ অবস্থায় বাঁচবে কিভাবে সে? তার উপর পূরবী যে ভয় দেখিয়েছে, আজরাতে ঘুমালে তোহা এই নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখবেই। স্বপ্নে সত্যিই শাহের সাথে তার বিয়ে হবে। তারপর?তোহা চোখমুখ খিচে দাড়িয়ে রইল। আর কল্পনা করা যাচ্ছে না। বুকে দুমদাম শব্দ হচ্ছে। ভয়ংকর শব্দ। পূরবী শিষ বাজাতে বাজাতে নেইল পলিশ ড্রেসিং টেবিলে রাখল। তোহা রুমের বাহিরে পা বাড়ালো না। বিছানায় বসে ভয় কাটাতে বলল,
” আচ্ছা তুই এই রাতের বেলা নেইল পলিশ লাগিয়েছিস কেন? ফজরের নামায পড়বি না? নাকি তোর নামায নেই?”
” নামায আছে। আমি একটু পরেই তুলে ফেলবো। ছবি তোলার জন্য দিয়েছি।”
তোহা ঠোঁট বাকিয়ে বলল,” কত ঢং!”
পূরবী দাঁত বের করে চোখ খিচে হাসল,” হি-হি-হি।”
তোহা হঠাৎ বলল,” আচ্ছা পূরবী, ছাদে যাবি?”
” কেন?”
” আমার ভালো লাগছে না। কেমন জানি দম বন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে। খোলা জায়গায় গেলে শান্তি লাগবে।”
” ছাদে গিয়ে ইচ্ছেমতো ছবিও তোলা যাবে। আচ্ছা চল।”
দুইবোন একসাথে ছাদে গেল। নীলাভ্র ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে। যে দড়িতে মানুষ কাপড় নাড়ে সেই দড়িতে নীলাভ্র লাইট ঝুলিয়েছে। তারপর লাইটের নিচে শুয়ে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। পায়ের জুতা কাগজে মুড়িয়ে বানিয়েছে বালিশ। পূরবী আর তোহা প্রথমে নীলাভ্রকে দেখে অনেক ভয় পেয়ে গেছিল। পূরবী বুকে থু দিয়ে ভয়টা সামলে নিলেও তোহা দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইল। পূরবী বলল,
” চলে যাচ্ছিস কেন?”
তোহা আতঙ্কিত গলায় বলল,” লাশ,লাশ! রক্ত,রক্ত!”
” আরে রক্ত কোথায় দেখলি? আর লাশ কে? এটা তো নীল শুয়ে আছে।”
তোহা স্থির হলো। চোখ কচলে আরেকবার দেখল। হ্যা আসলেই, নীলাভ্র শুয়ে আছে। তোহা হাফ ছেড়ে বলল,
” উফফ!”
পূরবী তোহার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” চল।”
তোহা আর পূরবী নীলাভ্রর কাছে গেল। নীলাভ্র ওদের দেখে উঠে বসল। ভ্রু কুচকে বলল,
” তোরা এতোরাতে এখানে কি করিস? ঘুম নেই?”
পূরবী তর্ক করার মতো বলল,” তোমার ঘুম নেই?”
নীলাভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে পূরবীকে ভয় দেখাল। পূরবী মুখ ভেংচি দিল। তোহা শান্তগলায় জিজ্ঞেস করল,
” এতো রাতে তুমি এখানে বসে বই পড়ছো কেন ভাইয়া? মশা কামড়ায় না?”
” অ্যারোসোল নিয়ে বসেছি। মশার বাপও আসতে পারবে না।”
নীলাভ্র চারদিকে অ্যারোসোল স্প্রে করে দিল। তোহা হেসে বলল,
” এতো আয়োজন করে কি বই পড়ছো?”
” বিকালে যে তোর কাছ থেকে আনলাম, সেটাই।”
” কি? এতো মনোযোগ দিয়ে তুমি একটা নন-ফিকশন বই পড়ছো?”
” আরে অনেক কিছু শিখেছি। মুখ ছাড়া হাতেরও যে নিজস্ব ভাষা থাকে সেটা এই বই না পড়লে জানতেই পারতাম না। ইশারায় কথা বলার যে কত মজা সেটা না দেখলে বুঝবি না। দাড়া তোদের দেখাই। অনুমান করতো আমি কি বলছি?”
নীলাভ্র প্রথমে তোহা-পূরবী দিকে আঙুল তাক করল। তারপর বুকের কাছে হাত নিয়ে পাখির ঠোঁটের মতো ইশারা করল। তারপর শাহাদাত আঙুল আর বৃদ্ধাঙুলি দিয়ে বৃত্ত বানিয়ে বুঝালো দারুণ। পূরবী কিছুই বুঝল না। কিন্তু তোহা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অনেকটাই জানে। তাই হাসিমুখে বলল,
” তোমাকে আমার ভালো লেগেছে।”
পূরবী চোখ গোল করে তাকাল। নীলাভ্র হেসে আঙুল উঠিয়ে মাথা উপর-নিচ করল। মানে ঠিক হয়েছে। এরপর সে আবার তোহার দিকে আঙুল ইশারা করে নিজের চেহারায় হাত ঘুরিয়ে একই প্রকাশভঙ্গী দেখিয়ে দারুণ বুঝালো। এবার তোহা বলল,
” তুমি দেখতে অনেক সুন্দর। ”
পূরবীর মুখ হা হয়ে গেল। নীলাভ্র এবারও সন্তোষজনক হাসি দিল। তোহা ঠিক বুঝেছে। নীলাভ্র বুকের বামপাশে হাত নিয়ে চার আঙুলে লাভ সাইন তৈরী করল। এবার তোহা বলল,
” আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
পূরবী বিস্ফোরিত চোখে বলল,” এক মিনিট। তুমি দেখতে সুন্দর, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, এসব সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কেন শিখছো? তুমি কি কোনো বোবা মেয়েকে প্রপোজ করার কথা ভাবছো?”
নীলাভ্র এক চোখ ছোট করে কঠিনমুখে তাকাল। তোহা বলল,
” তাতে তোর বাপের কি?”
পূরবী আগুন দৃষ্টিতে তাকালো তোহার দিকে। তোহা হেসে বলল,” সরি,সরি। আমি কি করবো? নীল ভাইয়াই তো এটা বলেছে।”
পূরবী এবার কঠিন দৃষ্টিতে নীলাভ্রর দিকে তাকালো। নীলাভ্র নাকের কাছে হাত নিয়ে জিভ বের করে পূরবীকে ভেঙালো। পূরবী রেগেমেগে ছাদের অন্যপাশে চলে গেল। নীলাভ্র হাসতে হাসতে তোহাকে জিজ্ঞেস করল,
” কেমন শিখেছি?”
” দারুণ। ”
নীলাভ্র মনে সাহস পেল। এখন রিম্মির সাথে কথা বলতে আর দ্বিধা নেই। নীলাভ্র বইটা দিয়ে বলল,
” তোর বই তুই নিয়ে যা। আমার কাজ শেষ। থ্যাঙ্কিউ। নীলাভ্র উঠে দাড়াল। তখনি পূরবী এসে বলল,
” এক মিনিট।”
নীলাভ্র বিরক্তগলায় বলল,
” কি হয়েছে?”
” এখনি সাতশো টাকা ফেলো।”
” মানে? কিসের টাকা?”
” বই ভাড়া নিয়েছো সাতঘণ্টার জন্য। প্রতি ঘণ্টায় একশো করে হলে মোট সাতশো টাকা জমেছে। মিনিটের খুচরা হিসাব বাদ। ভালোয় ভালোয় সাতশো টাকা ফেলো। নাহলে যেতে দিবো না। বেধে রাখবো।”
তোহা চোখ পাকিয়ে বলল,” হোয়াট ইজ দিস পূরবী?আমরা কি বই ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা খুলেছি নাকি? ছি!”
পূরবী গর্জিত গলায় বলল,” অবশ্যই! সব কি মাগনা নাকি? এখনি সাতশো টাকা দিতে হবে।”
নীলাভ্র বিরসমুখে বলল,” এই বইয়ের দামও তো সাতশো হবে না।”
পূরবী বিনুনি দুলিয়ে বলল,” এতোকিছু বুঝিনা। তুমি বই নিয়েছো,পড়েছো,প্রতি ঘণ্টায় একশো করে ভাড়া সাতশো হয়েছে। এখন দিতেই হবে।”
নীলাভ্র তোহার দিকে তাকালো। তোহা বলল,
” এই পাগলীর কথা শুনো না তো। তুমি যাও। কোনো টাকা লাগবে না। বই আমি তোমাকে দিয়েছি না?আমি বলছি টাকা লাগবে না।”
নীলাভ্র হেসে পূরবীর দিকে তাকাল। এই হাসির মানে সে জিতে গেছে। পূরবী গা জ্বালানো ভঙ্গিতে বলল,
” মাগনা বই পড়ার কত শখ! ছ্যাচড়া স্বভাব!”
তোহা পূরবীকে চোখ রাঙিয়ে ধমক দিল,” পূরবী! কি যা-তা বলছিস?”
নীলাভ্র চেতে গেল। পূরবী বলল,
” আচ্ছা থাক, টাকা লাগবে না। কিন্তু এর বদলে আমাকে ট্রিট দিতে হবে। কালকে শুধু তুমি আর আমি পূর্বাচলে ঘুরতে যাবে। একসাথে রুমালী পরোটা খাবো। বলো রাজি?”
তোহা এবার মুখ টিপে হেসে দিল। তাহলে এই সুযোগের অপেক্ষাতেই পূরবী এসব করছিল? নীলাভ্র সরুচোখে তাকিয়ে ঘাড়ত্যাড়ার মতো বলল,
” না রাজি না।”
তারপর পকেট থেকে এক হাজার টাকার নোট বের করে পূরবীর হাতে দিয়ে বলল,” তুই নিজে গিয়ে খেয়ে আসিস। তিনশো টাকা এক্সট্রা টিপ দিলাম। ফালতু!”
নীলাভ্র চলে গেল। তোহার হাসি থামছেই না। পূরবীর মুখ অপমানে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তোহা বলল,
” এবার ভালো হয়েছে না?”
পূরবী হাত-পা আছড়ে রাগী গলায় বলল,” ওকে কিভাবে শিক্ষা দেই দেখিস।”

ডাইনিং রুমে বসলেই প্রত্যেকটা বেডরুমের ভেতরে দেখা যায়। নীলাভ্রদের ফ্ল্যাটে বেডরুম তিনটা। একরুমে ভাইয়া-ভাবী থাকে। অন্যরুম নীলাভ্রর নিজের। আরেকরুমে তো রিম্মির থাকার কথা। কিন্তু সে নেই কেন? দুটো রুমই ফাঁকা। ভাইয়া-ভাবীর ঘরের দরজা ভিড়ানো। রিম্মি কি ভেতরে আছে? একটু পরেই তিলোত্তমা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। নীলাভ্রকে দেখে রাগী গলায় বলল,
” কি ব্যাপার দেবরমশাই? তোমার কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই? এতো রাত পর্যন্ত কই ছিলে?”
নীলাভ্র আশেপাশে তাকিয়ে কথা বের করার উদ্দেশ্যে বলল,” সবাই কি ঘুমিয়ে গেছে?”
তিলোত্তমা হাই তুলতে তুলতে বলল,” সবাই আর কে? তোমার ভাইয়া ঘুমিয়েছে। আমি জেগেছিলাম তোমার জন্য। তোমাকে খেতে দিবো তাই।”
” আমি খেয়ে নিতাম ভাবী। তোমার কষ্ট করে জেগে থাকার দরকার ছিল না।”
তিলোত্তমা ফ্রিজ থেকে খাবার বের করতে করতে বলল,
” হুম! আমি না থাকলে খাবার গরম করতো কে? ফ্রীজ থেকে বের করে ঠান্ডা খাবার খেতে বুঝি?”
” আমিই গরম করতাম।”
তিলোত্তমা ব্যঙ্গ করে বলল,
” ইশশ! আগামীকাল মা আসছেন। তোমার এসব অনিয়ম আর চলবে না। কাল থেকে ঠিকঠাক সময়ে বাসায় ফিরবে। সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করবে। নাহলে মা আমাকেই বকবে। ভাববে আমি তোমার যত্ন নেই না। কিন্তু তুমি যে আমার কথাই শোনো না সেটা মাকে কে বুঝাবে? তোমার জন্য আমি মায়ের ঝাড়ি শুনতে পারবো না।”
তিলোত্তমা কথা শেষ করে খাবার ওভেনে ঢুকিয়ে দিল।নীলাভ্র তিলোত্তমার কোনো কথাই শুনছে না। সে উঁকিঝুঁকি মেরে রিম্মিকে খুঁজে যাচ্ছে। তিলোত্তমা বলল,
” আর কতদিন আলালের ভাই দুলাল হয়ে থাকবে? এবার একটু সেল্ফ ডিপেন্ডেট হওয়ার চেষ্টা করো না। চাকরি-বাকরি খোঁজো। প্রয়োজনে ব্যবসা শুরু করো। তোমার বয়সী ছেলে-মেয়েরা কত কি করে।”
” এখনো ডিগ্রি শেষ হয়নি ভাবী। এটা অন্তত শেষ করতে দাও৷ তারপর চাকরির প্রসঙ্গ টেনো।”
” ডিগ্রি শেষ না হলে কিছু করা যায়না বুঝি? অনলাইনে ফ্রি ল্যান্সিং এর কাজও তো করতে পারো। তাছাড়া তোমার ভাইয়ার বন্ধুর ছোটভাই, তার কাছ থেকেও কিছু শেখা উচিৎ। ছেলেটা কত সুন্দর সুন্দর কন্টেন্ট আপ্লোড করে ইউটিউবে। মিলিয়ন ভিউজ ছাড়িয়ে যায়। মাসে মাসে কত যে ইনকাম হয় কোনো ধারণা আছে? এসবে অনেক লাভ। তুমিও শুরু করতে পারো৷ সারাদিন করোটা কি? পড়াশুনা আর টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া অন্যকোনো কাজ আছে তোমার?”
” এসব কথা এখন কেন ভাবী?”
” বিয়ে-শাদি তো করতে হবে নাকি? চিরকুমার থাকার প্ল্যান নিশ্চয়ই নেই।”
নীলাভ্রর গলায় ভাত আটকে গেল৷ভাবী তাহলে এজন্যই এতোকিছু বলছে? নীলাভ্র সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করল,
” মা কি আগামীকাল বাসায় আসছে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য?”
” তুমি ছেলেমানুষ। তোমাকে বিয়ে দিবে কেন? বিয়ে করাবে। অবশ্য মায়ের মনের কথা আমি জানিনা। তবে আমি আন্দাজ করেছি। সত্যি নাও হতে পারে।”
” অসম্ভব। এই বয়সে বিয়ে করে স্বাধীন জীবন পরাধীন করার কোনো ইচ্ছে নেই।”
” বিয়ে করলে বুঝি জীবন পরাধীন হয়?”
” ভাইয়াকে তো দেখছিই। কত স্বাধীন!”
তিলোত্তমা হেসে বলল,” ফাজিল একটা! খাও তাড়াতাড়ি। পানি দিবো?”
” দাও।”
তিলোত্তমা পানি ঢেলে নীলাভ্রর পাশে বসল। নীলাভ্র অস্বস্তি ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
” তোমার বিদেশী বোন খেয়েছে?”
” কে রিম্মি?”
” আর কেউ আছে নাকি?”
” ও তো দুপুরেই খেয়ে-দেয়ে চলে গেছে।”
নীলাভ্র বিষম খেল। তিলোত্তমা দ্রুত পানি এগিয়ে দিল। নীলাভ্র পানি খেয়ে জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল,
” চলে গেছে মানে?”
” তো যাবে না? সারাজীবন এখানে থাকতে এসেছে নাকি?”
” তাই বলে একদিনও থাকবে না? আমি তো ভেবেছিলাম কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকবে।”
” তোমার সাথে ওর পরিচয় করানোটা জরুরী ছিল।তোমার জন্য অপেক্ষাও করেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আসলেই না।”
” আসবো কিভাবে? প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম তো। ” “কিসের প্রিপারেশন?”
” তুমিই তো বলেছো, তোমার বোন উগান্ডার ভাষাও বোঝে না। সাংকেতিক ভাষা লাগবে। সেটাই প্র্যাকটিস করছিলাম।”
” আজব! সাংকেতিক ভাষা কেন লাগবে?”
” তুমিই না বললে ও বোবা? সাংকেতিক ভাষা ছাড়া অন্যকিছু বোঝে না?”
তিলোত্তমা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,” হায়রে! দেবরমশাই,আমার বোন বোবা হতে পারে, বধির হতে পারে। কিন্তু মুর্খ তো আর না। আমরা ওর লিখে লিখে কথা বলি। তাছাড়া ওর কাছেই সবসময় কলম, চিরকুট থাকে। তুমি কথা বলতে গেলেই তোমার হাতে চিরকুট আর পেন ধরিয়ে দিবে।”
” কই? আমাকে তো দেয়নি।”
তিলোত্তমা হেসে বলল,” তাহলে মনে হয় তোমাকে পছন্দ হয়নি।”
নীলাভ্র রেগে উঠে দাড়াল। শক্তগলায় বলল,
” তোমার বোন অহংকারী।”
তারপর বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল। তিলোত্তমা বলল,” আরে আরে, খাবারটা শেষ করো!”
নীলাভ্র রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল৷ তিলোত্তমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” কত জেদ ছেলের!”
তারপর টেবিল গুছাতে শুরু করল।

” তোহা, তুই রিসেন্ট ডিবেট কম্পিটিশনে সেরা বক্তা হয়েছিলি না? আজকে তোকে পুরস্কৃত করা হবে। জানিস?”
তোহার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে আসল,” আজই?”
” হ্যা। আজকে সাড়ে দশটা বাজেই ক্লাস শেষ। তারপর অনুষ্ঠান শুরু হবে। চীফ গেস্ট হিসেবে কে আসছে জানিস? দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম গায়, আই হেভ এভার সিন। তুই ওর উনার হাত থেকে পুরষ্কার নিবি, এটা ভাবতে আমারই এক্সাইটেড লাগছে।”
কাকলী বলল,” আমারও রে! তোহা তুই অনেক লাকি। ইশশ পুরষ্কারটা যদি আমি পেতাম!”
তোহা ঠোঁট উল্টে বলল,” কি এমন পুরষ্কার দিবে? হয় একটা পেন্সিল বক্স নাহলে কোনো মেডেল অথবা শপিস। সেটা আমি তোদের দিয়ে দিবোনে যা।”
মিতু আর কাকলী অবাক হয়ে চোখাচোখি করল। কাকলী বলল,
” এই মেয়ে বলে কি? তোর পুরষ্কারের জন্য আমরা হা হুতাশ করছি না। আমরা তো হা হুতাশ করছি শাহভীর খানের হাত থেকে পুরষ্কার নিতে পারবো না তাই।”
মিতু বুকে হাত রেখে চোখ বুজে বলল,” হুম।”
তোহা বলল,
” আচ্ছা তোরা কার কথা বলছিস? আমি না চিনিনা।”
মিতু তোহাকে ধাক্কা মেরে বলল,” তুই আমাদের ফ্রেন্ড? ভাবতেই লজ্জা লাগছে। এতোবড় কেমিস্ট উনি। আর তুই উনাকেই চিনিস না?”
তোহা মাথা নাড়িয়ে বলল,” চিনিনা তো। কি করবো?”
কাকলী বলল,” আমি বলি শোন, উনি হচ্ছে শাহভীর আমীর হোসাইন খান।”
” আচ্ছা! উনি কি করে?”
কাকলী বলার আগেই মিতু বলল,
” ঔষধ আবিষ্কার করে। ”
এবার মিতুকে থামিয়ে কাকলী বলল,
” বলা যায় একই সাথে ডাক্তার, সাইন্টিস্ট,ফার্মাসিস্ট সবকিছু।”
তোহা ভ্রু কুচকে বলল,” কিভাবে?”
মিতু কাকলীর মুখ চেপে বলল,
” আমি বলছি, ডাক্তার কারণ মানুষের জন্য ঔষধ তৈরী করে। সাইন্টিস্ট কারণ উনি এ পর্যন্ত অনেক রোগের বিকল্প ঔষধ আবিষ্কার করেছেন। আর উনার সবকাজ ল্যাবে। তাই কেমিস্টও। আর এ ধরণের কাজ যারা করে তাদের তো ফার্মাসিস্টই বলে।”
” এক মানুষের এতো গুণ? মানুষ না জুপিটার গাইড?”
কাকলী হেসে ববলল,” উনার অর্জনের কথা জানলে তুই তাক লেগে যাবি।”
মিতু বলল,” এটা আমাকে বলতে দে প্লিজ।”
কাকলী ওর মুখ চেপে বলল,” চুপ। আমি বলবো। শুধু মানুষের জন্য না, উনি সব প্রাণী নিয়ে গবেষণা করেছেন। গতবছর যখন উনি ফ্রান্সে ছিলেন, বিশ্বসেরা মেডিকেল সাইন্টিস্টদের একটা রেংকিং এ উনার অবস্থান কততম ছিল জানিস?”
” কত?”
মিতু মুখ থেকে কাকলীর হাত সরিয়ে বলল,” ২।”
তোহা মুখ কুচকে বলল,” মাত্র ২?”
কাকলী বলল,” এই মেয়ের মাথাখারাপ। তুই এটাকে মাত্র বলছিস?”
” তাহলে ১ নাম্বার রেংকে কে ছিল?”
” একটা বুইড়া বেটা। ওইটার নামও জানিনা, চিনিও না। কিন্তু শাহভীর খান ফিউচারে নোবেল পাবে। দেখে নিস।”
মিতু বলল,” এটা আমি বলতে নিয়েছিলাম।”
তোহা বলল,” তোরা মারামারি লেগে যাচ্ছিস কেন? একজন বললেই হয়েছে। ”
মিতু হেসে বলল,” রাজপুত্র, রাজপুত্র। তুই দেখলে ক্রাশ খাবি।”
তোহা ভ্রু নাচিয়ে বলল,” ইশশ! এতো সুন্দর? ”
” দেখলেই বুঝবি। আমার অনেক এক্সাইটেড লাগছে। ইশশ কেন যে ডিবেট কম্পিটিশনে পার্ট নিলাম না। তাহলে আমিও তার হাত থেকে পুরষ্কার পেতাম। ”
তোহা বলল,” খুব ভালো হয়েছে৷ আমি আগেই তোদের বলেছিলাম আমার সাথে জয়েন কর।”
কাকলী বলল,” সেকথা বাদ দে। আফসোস করে লাভ কি? কপালে নেই।”
মিতু বলল,
“আমাদের এমন ভাঙাচুরা কলেজের প্রিন্সিপাল কিভাবে যে এতো বিখ্যাত একজন মানুষকে আনছেন আমার ভাবতেই অবাক লাগছে। নিজের কলেজের জন্য এই প্রথম গর্ব হচ্ছে।”
কাকলী বলল,” এখানে প্রিন্সিপাল স্যারের কোনো ভূমিকা নেই। শাহভীর খান নিজে এই ডিবেট কম্পিটিশন অর্গানাইজ করেছিলেন। তাই উনি আসছেন।”
মিতু চোখ বড় করে বলল,” সিরিয়াসলি? ”
কাকলী বলল,” হ্যা।”
” তুই এটা আগে বললি না কেন? তাহলে আমি জান-প্রাণ দিয়ে হলেও পার্টিসিপেট করতাম। হায় আল্লাহ!”
কাকলী বলল,” আমি অবশ্য আগেই জানতাম। কিন্তু এটা ভাবিনি যে উনি নিজেই পুরষ্কার দিতে আসবেন।”
তোহা চুপচাপ ওদের কথা শুনল। একটু পর জিজ্ঞেস করল,
” আচ্ছা আঙ্কেলটার বয়স কত ?”
মিতু আর কাকলী এমন ভাবে তাকাল যেন গিলে খাবে। তোহা বলল,” কি হয়েছে?”
মিতু সিরিয়াস গলায় বলল,” আঙ্কেল বললি কেন?”
তোহা বলল,” আর কি বলবো?”
কাকলী বলল,” ছাব্বিশ বছর বয়সী পোলা তোমার আঙ্কেল লাগে?”
তোহা ঘোর বিস্ময় নিয়ে বলল,” কিহ! এটা তো রীতিমতো বাচ্চা। এই বয়সে এতো সফলতা কিভাবে?”
” কারণ উনার বাবা অনেক ব্রিলিয়ান্ট সাইন্টিস্ট ছিলেন। আর উনিও ছোটবেলা থেকে সেই পথেই হেঁটেছেন। মানব শরীর নিয়ে গবেষণা উনার নেশা। তোমার মতো হাফ সাইজের মেয়ের শরীরের কোথায় কি আছে সব ইঞ্চি ইঞ্চি বলে দিতে পারবে। একবার না তাকিয়েই।”
তোহা নিজের কাপড়ে হাত দিয়ে আতঙ্ক নিয়ে বলল,” মানে?”
মিতু হাসতে হাসতে বলল,” আরে শরীরের ভিতরে মানে কাপড়ের ভিতর না। বডির ভিতর।”
তোহা হাসার চেষ্টা করল,” ও আচ্ছা।”
তোহার বোকামি প্রশ্ন শুনে মিতু আর কাকলী হাত মিলিয়ে উদ্ভট হাসি শুরু করল। তোহা চুপ থাকলেও মনে মনে ঠিকই চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here