#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩১
লিখা: Sidratul Muntaz
মানুষের মস্তিষ্ক খুবই জটিল। প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে একটি মানব মস্তিষ্ক গঠিত। এতগুলো নিউরনের প্রতিটিতে আছে প্রায় দশ হাজার সিন্যাপটিক যোগাযোগ। সব মিলিয়ে মোট সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১০০ ট্রিলিয়নে। এর সর্বোচ্চ হিসাব গিয়ে ঠেকতে পারে ১০০০ ট্রিলিয়নে।এত এত নিউরন আর সিন্যাপসগুলো বৈদ্যুতিক আর রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে মস্তিষ্কের সাথে সারা দেহের যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। আগে ধারণা করা হতো মানুষ তার মস্তিষ্কের প্রায় দশ শতাংশ ব্যবহার করে। বাকি নব্বই শতাংশ অকেজো থাকে। যদি একশো ভাগ মস্তিষ্ক মানুষ ব্যবহার করতে পারতো তাহলে সে হয়ে যেতো সুপারম্যান টাইপ কিছু। অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পন্ন। বিস্ময় মানব। দূর্ভাগ্যবশত এই ধারণাটি নিতান্তই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। যদি সত্যিই নব্বই ভাগ মস্তিষ্ক অকার্যকর থাকতো তাহলে সেগুলোতে আঘাত লাগলে বা ক্ষতি হলেও আমাদের কিছু যায় আসার কথা না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মস্তিষ্কের একটা ক্ষুদ্র অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমাদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষেত্রে সেটি প্রভাব ফেলে। তাছাড়া বিবর্তনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নব্বই ভাগ অকেজো অংশ অনেক আগেই বিলীন হয়ে যেতো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মানব মস্তিষ্কে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। মানুষ কখনোই মস্তিষ্কের একশো ভাগ একসাথে ব্যবহার করতে পারেনা। যেকোনো কাজের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা শাখা। মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি শাখাই কি প্রয়োজনীয়? এর মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় কিংবা অতিরিক্ত জিনিস আছে৷ যেগুলো বাদ দিতে পারলেই একটি উন্নত মস্তিষ্ক তৈরী করা সম্ভব। কিন্তু একটি চতুর্থমাত্রিক মস্তিষ্ক গঠন কি আদৌ সম্ভব? যেই মস্তিষ্ক চলবে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে এবং যে পুরো পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। যার কাছে সময়টা হবে খেলার মতো। অতীত,ভবিষ্যৎ হবে নিতান্তই রসিকতা। কথা বলা মানুষের একটি রোগ৷ অপ্রয়োজনীয় কথা মানে অপ্রয়োজনীয় শব্দদূষণ। মানুষ যদি কথা না বলেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, ব্যপারটা মন্দ হয় না৷ সেই উন্নত মস্তিষ্কের থাকবে কথা না বলেও অন্য ত্রিমাত্রিক মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠানোর বিস্ময়কর ক্ষমতা। ধরা-ছোয়ার বাহিরে, সকল মানুষের কল্পনাশক্তির বাহিরে সে হবে এক ও অনন্য। মুখ দেখেই হৃদয়ের আকুতি বোঝার ক্ষমতা থাকবে। শুধু মানুষ না, পশুপাখির হৃৎস্পন্দনও পরিমাপ করতে পারবে সহজেই। এমন একটা মানুষ যদি পৃথিবীতে আসে তাহলে কেমন হয়?
আমীর নিরবে বসে এসবই চিন্তা করছিল৷ হঠাৎ রিম্মির কথা মনে পড়ে। মেয়েটা ভীষণ আবেগী৷ এখন নিশ্চয়ই একাকী বসে কাঁদছে। আমীরের কি করা উচিৎ? ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ? অবশ্যই চাওয়া উচিৎ। আমীর রিম্মির কাছে গেল। রিম্মি কাঁদছে না। হাটু জড়িয়ে ডেস্ক টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। আমীর হাটু গেড়ে রিম্মির সামনে বসলো। রিম্মি নির্লিপ্ত মুখে তাকায়৷ তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। আমীর নরম গলায় বললো,
” সরি।”
রিম্মি উঠে চলে যেতে চাইলো। আমীর ওর হাত ধরে আবারও বললো,
” সরি বলেছি।”
রিম্মি অস্পষ্ট স্বরে বললো,” শুনেছি।”
আমীর উঠে রিম্মির সামনে দাড়িয়ে বললো,” ক্ষমা করেছো?”
” ক্ষমা করার প্রশ্ন আসছে কেন? আমার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। ভুল তো আমি করেছি।”
রিম্মির কপালের কাটা দাগটা দেখে আমীর বললো,
” অনেকটা কেটে গেছে। আসো ব্যান্ডেজ করে দেই।”
” লাগবে না।”
আমীর জোর করে রিম্মির কোমড় ধরে ওকে উঠিয়ে নিয়ে গেল ব্যান্ডেজ করাতে। রিম্মির চোখে পানি জমতে শুরু করলো। আমীর ব্যান্ডেজ শেষে রিম্মিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” আর হবে না, প্রমিস।”
রিম্মির বাধ ভেঙে কান্না উঠে আসলো। এখন আর আমীরের উপর রেগে থাকতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে মানুষটা তাকে সত্যিই ভালোবাসে। যখন আমীরের কঠিন ব্যবহারে সে হতভম্ব হয় তখন কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হয় আমীর তাকে ভালোবাসে না। তারপর যখন এভাবেই এসে আমীর ক্ষমা চায়, রিম্মির পূর্ববর্তী ধারণাগুলো সব পাল্টে যায়। আসলে মানুষের মন খুবই অদ্ভুত। যখন যেটা মানতে ইচ্ছে করে তার স্বপক্ষে হাজার যুক্তি আপনা-আপনি তৈরী হয়ে যায়। সত্যি-মিথ্যা সবই আপেক্ষিক।যেভাবে মন মেনে নেয় সেভাবেই সব সত্যি। যা মন মানতে চায়না তাই মিথ্যা! ব্যাপারটা শুধুই আপেক্ষিক সময়ের জন্য!
টেস্ট এক্সামে রিম্মি ফেইল করে বসে। তার প্রমোশন হবে না। এসএসসি এক্সাম দিতে দেওয়া হবে না। রিম্মি ফেইল করার মতো স্টুডেন্ট না, তবুও ফেইল করেছে। পাঠ্যবই পড়ার সময় তার হাতে নেই। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে আমীরের সাথে। কমার্সের স্টুডেন্ট হয়েও সাইন্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। দিনশেষে নিজের বিষয় নিয়ে পড়ার আগ্রহ হয়না৷ যার পরিণতি ফেইল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই নিয়ে বাসায় একটাও কটুক্তি শুনতে হয়নি তাকে। আমীর বলেছে কমার্স থেকে সাইন্সে চলে আসতে। এরপর উন্মুক্তে ভর্তি হয়ে যেতে। রিম্মি সেটাই করে। আমীরের কাছে শুরু হয় তার নতুন করে পড়াশুনা। ওদের সম্পর্কের এক বছরের মাথায় আমীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা আবদার করে রিম্মির কাছে। আবদারটা ভালো না খারাপ রিম্মি বুঝতে পারেনা। কিন্তু ভয় পায়। আমীর রিম্মিকে নিয়ে অনেক বড় একটা এক্সপেরিমেন্ট করার কথা ভাবছে। যেখানে ওর মস্তিষ্ক ট্রান্সপ্লান্ট করা হবে। রিম্মি সাধারণ মানুষের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে অনন্য হয়ে উঠবে। এই পরীক্ষায় রিম্মির বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা দশ ভাগ। নব্বই ভাগ সম্ভাবনা মরে যাওয়ার। আমীর রিম্মিকে সাহস যোগানোর জন্য বলে, সে পূর্বেও এমন এক্সপেরিমেন্ট করেছে। একটা বানরকে নিয়ে। অপারেশন শেষে বানরটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। রিম্মির তবুও ভয় লাগে। আমীরের উপর তার আস্থা ছিল, কিন্তু নিজের উপর আস্থা ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা আমীর সামান্য এক্সপেরিমেন্টের জন্য রিম্মির জীবন এতোবড় ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারবে?
আমীর রিম্মিকে মিথ্যে বলেছিল। সে আসলে কোনো বানর নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেনি। কথাটা শুধু রিম্মিকে রাজি করানোর জন্য বলেছে। এই ভয়ংকর অপারেশনের পর রিম্মির বেঁচে থাকার আশা খুবই ক্ষীণ। রিম্মি মরে গেলে আমীরের তেমন কিছুই হবে না। কিন্তু যদি অপারেশনের পরেও রিম্মি জীবিত থাকে তাহলে দুনিয়ার ইতিহাসে কালজয়ী পরিবর্তন আসবে। আমীরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পরিণতি পাবে। এই জন্য একটা সামান্য মেয়ের জীবন তার কাছে কিছুই না।
ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট এক্সপেরিমেন্টের জন্য রিম্মিকে সবার আগে স্ট্যাবল হতে হবে। তাই একটা আলোকবিহীন ঘরে সাতদিনের জন্য ওকে বন্দী রাখা হয়। এই সাতদিন কোনো পানি, খাদ্য, আলো তাকে দেওয়া হয়নি। শুধু অক্সিজেনের মাধ্যমে সে বেঁচে ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও রিম্মির মনে হতো সে এই মুহুর্তে দম আটকে মরে যাবে। বরং মরে গেলেই যেন সে বাঁচে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা,ঘুম কোনোকিছুর প্রয়োজন সে অনুভব করেনি। শুধু প্রয়োজন অনুভব করেছে একফোঁটা আলোর। বেঁচে থাকার জন্য যেন শুধু একফোঁটা আলোই যথেষ্ট। রিম্মি আলো পায়নি। ধুকে ধুকে আধমরার মতো সাতদিন বেঁচে ছিল মৃত্যকূপের মতো ভয়ানক সেই ঘরটিতে। তারপর রিম্মিকে রাখা হয় পরিপূর্ণ আলোকযুক্ত একটা ঘরে। সেই ঘরে আলোর পরিমাণ এতোই বেশি ছিল যে, রিম্মি সর্বক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখতো। ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস ছিল সাদা। বিছানার চাদর থেকে শুরু করে দরজা পর্যন্ত, প্রত্যেকটা বালুকণা ধবধবে সাদা। তখন রিম্মিকে খাবার দেওয়া হতো। কিন্তু রিম্মি সেই খাবার খেতে পারতো না। খাবারগুলোও থাকতো সাদা সাদা। সাদা ভাতের সাথে সাদা লবণ। সাদা পানীয়। এতো সাদার মাঝখানে রিম্মি এক ফোঁটা ভিন্ন রঙের খোঁজে ছটফট করতো কিন্তু পেতো না। অমানবিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কেটে যায় আরও সাতদিন। এরপর অনেক ভয়ংকর এক্সপেরিমেন্ট করা হয় ওকে দিয়ে। আরও অনেক টর্চার সহ্য করতে করতে অবশেষে আসে সেই প্রতিক্ষীত দিন। যেদিন রিম্মির অপারেশন। রিম্মি মনে প্রাণে দোয়া করে সে যেন এই অপারেশনে বাঁচতে না পারে। মৃত্যু ছাড়া এমন যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
এটুকু শুনেই নীলাভ্র ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বললো,
” তুমি কেন অপারেশনের জন্য রাজি হয়েছিলে? কিসের এতো দায় তোমার? এতো টর্চার সহ্য করার কোনো দরকার ছিল? তোমার উচিৎ ছিল আমীরের কপালে জুতো মেরে চলে আসার।”
নীলাভ্রর প্রতিটি রগ ফুলে উঠেছে। চোখ লাল, টলমল করছে। আরেকটু হলেই কাঁদতে শুরু করবে বেচারা। রিম্মি মুচকি হেসে বললো,
” তখন আর সেই পরিস্থিতি ছিল না।”
” কেনো ছিলনা? তুমি কি ওর হাতের পুতুল? ও যা বলবে তাই করতে হবে? তোমার নিজের কোনো জীবন নেই? ইচ্ছে নেই?”
” আমি ওর হাতের পুতুলই। ও আমার সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। যদি আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়, তাও কেউ কিছু বলতে আসবে না ওকে। কারণ আমার প্রতি কর্তৃত্ব ফলানোর পূর্ণ অধিকার ও পেয়ে গেছিল।”
” কিভাবে পেয়ে গেছিল?”
এবার রিম্মি বললো তার জীবনের সবচেয়ে করুণ সত্যিটা। যখন আমীর তাকে ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট এক্সপেরিমেন্টের বিষয়ে বলেছিল, তখন রিম্মি রাজি হয়নি। তার কিছুদিন পরেই রিম্মি জানতে পারে তার মা, মুন আর অন্তরা নতুন একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। প্রাইভেট কার কিনেছে। তনিমা এলাকায় একটা কাপড়ের বড় দোকান দিচ্ছে। কিন্তু এতোটাকা কিভাবে আসলো? সব আসলে আমীরের টাকায় হচ্ছিল। আমীর একশো বিশ হাজার ডলার দিয়ে রিম্মিকে ওদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে। এই কথা জানার পর রিম্মির দুনিয়া বদলে যায়। পৃথিবীতে এতো মানুষ থাকতে আমীর তার সাথেই কেন এতো নোংরা খেলা খেললো? কারণ রিম্মি আমীরের দেখা সবচেয়ে অসহায়। সে বুঝতে পেরেছিল রিম্মিকে পাওয়া খুব সহজ। তাছাড়া রিম্মির মধ্যে এমনকিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্যকারো মধ্যে নেই। যেমন রিম্মির লাল চুল, নীলচোখ। এই দুই জিনিস একসাথে খুব কম মেয়েদের থাকে। পৃথিবীতে একশোভাগের চারভাগে এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে। সব জানার পর রিম্মি দীর্ঘদিন আমীরের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি৷ তার কষ্ট এইটা না যে তার বাড়ির লোক তাকে বিক্রি করে দিয়েছে। বরং কষ্টটা এই জায়গায় যে আমীরের কাছে সে শুধুই একটা জড়পদার্থ। যেমন আমীরের ল্যাব, বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টাল যন্ত্রপাতি, এসবের মতো রিম্মিও তার কাছে একটা যন্ত্র। যদি সত্যিই তাই হয়, আমীর প্রথমেই রিম্মিকে কিনে নিলো না কেন? তারপর যেভাবে খুশি ব্যবহার করতো। রিম্মি নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিতো। কিন্তু আমীর এর চেয়েও জঘন্য কাজ করেছে। প্রথমে ওর কোমল মনটা নিয়ে খেলেছে। ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়েছে৷ তারপর এক নিমেষে সেই স্বপ্ন ঝাঝরা করে দিয়েছে। স্বপ্ন ভাঙলে প্রচুর কষ্ট হয়। তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয় চির-পরিচিত মানুষটির হঠাৎ বদলে যাওয়া ভয়ংকর, বিদঘুটে রূপ দেখলে। রিম্মি পরবর্তীতে এটাও জানতে পারে, সাহিল আসলে অনেক আগেই মারা গেছিল৷ এতোদিন সাহিলরূপে রিম্মি যাকে দেখে এসেছে সে আওয়ান। রিম্মি আওয়ানকে ভয় পেতো, তাই আওয়ান সাহিলরূপে ওর সামনে আসতো যেন রিম্মি ভয় না পায়। যেকোনো মানুষের চেহারাধারণের ক্ষমতা আওয়ানের ছিল। ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্টের অপারেশন করতে রিম্মি রাজি হয়নি। আমীর তাকে মেন্টালি ব্লেকমেইল শুরু করে। আমীর জানতো রিম্মি কত ভালোবাসে মুনকে। তাই একদিন রিম্মির সামনে মুনের সাথে জঘন্য একটা কান্ড করল আমীর। মুনের পায়ে ক্রমাগত ইলেকট্রিক শক দিতে লাগলো। যে কারণে মুনের পা বাঁকিয়ে যায়। নাহলে মুন আগে স্বাভাবিকভাবেই হাটতে পারতো। এরপর থেকে আমীরকে মুন যমের মতো ভয় পায়। আমীর সামনে আসলেই মুন তটস্থ হয়ে পড়ে। ভয়ে খিচুনি উঠে যায়। আমীর বলেছিল, রিম্মি যদি এই এক্সপেরিমেন্টে আমীরকে সাহায্য না করে তাহলে আমীর মুনকেও কিনে নিবে। তারপর ওর দ্বারাই শুরু করবে এক্সপেরিমেন্ট। রিম্মি ভয় পেয়ে গেছিলো। তনিমা দিন দিন লোভী হয়ে উঠছে৷ উনি হয়তো আপন মেয়ে মুনকেও আমীরের কাছে বেঁচে দিতে দ্বিধান্বিত হবেন না। যে পরের মেয়ের উপর এতো নির্দয় হতে পারে, সে নিজের মেয়ের উপর আর কতটা সদয় হবে? রিম্মি অবশেষে রাজি হয়। আমীর তার এক্সপেরিমেন্টে সফল হয়েছিল৷ দূর্ভাগ্যবশত রিম্মি বেঁচে যায়। দীর্ঘ চারবছর সে আকাশের আলো দেখেনি। তাকে কাচের বাক্সে হিমশীতল ঘরে বন্দী রাখা হয়েছিল। অনেকটা লাশের মতো। তারপর হঠাৎ একদিন রিম্মির জ্ঞান ফিরে আসে। তাকে নতুন করে স্বাভাবিক মানুষের মতো হাটাচলা শিখতে হয়। তখন থেকে রিম্মির কথাও বন্ধ হয়ে যায়। শব্দ না করেই সে মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারতো। তাহলে শব্দ করার কি দরকার? যেকোনো মানুষের মুখ দেখেই রিম্মি বলে দিতে পারে মনের কথা। রিম্মি নিজসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ এক আলাদা সত্তায় রূপান্তরিত হয়ে যায়৷ কারো চেহারা দেখে রিম্মি চরিত্র বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখে। সবার আগে সে আমীর নামক বিচিত্র মানুষটিকে বিশ্লেষণ করে। এবং বুঝতে পারে আমীর অন্য পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো একদমই না। সে কঠিন হৃদয়ের মানুষ। তার জীবনের প্রধান লক্ষ্যই হলো আবিষ্কার। তবে আরেকটা নেশা তার আছে। সে মানুষকে শাস্তি দিতে ভালোবাসে। তবে সাধারণ মানুষকে না। অপরাধীদের। অন্যায়কারী দেখলেই তার শিরা-উপশিরার রক্ত গরম হয়ে যায়। তাদের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দিতে পেরে সে আনন্দিত হয়৷ তার বেশিরভাগ শাস্তি হয় শিরাকেন্দ্রিক। সে নিজহাতে অপরাধীদের শিরা কাটতে ভালোবাসে। এজন্য তার আরেক নাম, ড. রিব সিকেন্ট৷ অর্থ শিরা ছেদনকারী। অথচ আমীর জানেই না, বিচিত্রময় জগতের এক ভয়ংকর অপরাধী সে নিজেও। কিন্তু নিজের এই অপরাধকে সে অপরাধ মনে করেনা। এখানেই প্রতিটি মানুষের ভুল। অন্যের অপরাধ শনাক্ত করার আগে মানুষ যদি নিজের অপরাধ শনাক্ত করতে পারতো তাহলে দুনিয়াটাই পাল্টে যেতো। অপরাধ হলো পিঠের মতো। মানুষেরটা সহজেই চোখে পড়ে, নিজেরটা চোখে পড়েনা। আমীর ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে আইপি রোগের নিরাময়ও খুঁজে পেয়েছিল। এই বিরল রোগের ঔষধ আবিষ্কারের জন্য তাকে ফ্রান্সে ডেকে নিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। রিম্মি তারপর আমীরের কাছে মুক্তি চায়। আমীর বলেছিল, সে যেখানে খুশি যেতে পারে। যতদিন আমীরের থেকে সে লুকিয়ে থাকতে পারবে ততদিন সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু আমীর যদি রিম্মিকে কোনোদিন খুঁজে পায় তাহলে সে যা চাইবে রিম্মিকে তাই করতে হবে। অন্তরা আর ডার্কের অবৈধ সম্পর্কের কথাও তখন বাসায় জানাজানি হয়। তনিমা সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশে চলে আসবে৷ তাই রিম্মিও ওদের সাথে চলে আসে।রিম্মি সকল প্রকার দূর্বলতার উর্ধ্বে। তার এখন অনেক ক্ষমতা। সে সহজে দুঃখ পায় না, ভয় তাকে গ্রাস করতে পারেনা, কান্নাকাটির অভ্যাসও তার নেই। ইচ্ছে হলেই নিজের প্রতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। এমনকি চাইলে আশেপাশের মানুষকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতোকিছুর পরেও রিম্মির ছোট্ট একটা দূর্বলতা আছে। সেই দূর্বলতার কথা শুধু আমীর জানে। রিম্মি শুরু থেকেই আওয়ানকে ভয় পেতো। সেই ভয়ের অনুভূতিটা আমীর তার মস্তিষ্ক থেকে হারাতে দেয়নি। যেন ভবিষ্যতে আওয়ানের মাধ্যমে রিম্মিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেদিন নীলাভ্রর সাথে রিম্মির প্রথম দেখা হয়, সে ধরেই নিয়েছিল এটা আওয়ান। সাহিলের রূপ ধরে তাকে নিতে এসেছে৷ রিম্মি সবার মনের কথা পড়তে পারলেও আওয়ানের মনের কথা পড়তে পারেনা। এখানেই সবচেয়ে বড় ভয়। তাই রিম্মির একমাত্র দূর্বলতা হলো আওয়ান। নীলাভ্র অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ বলে উঠলো,
” আচ্ছা, আমীর এখনো তোমার কাছে কি চায়?”
” ও শুধু আমাকেই চায়। আমাকে নিয়ে ওর নেক্সট এক্সপেরিমেন্ট করতে চায়। নিউরোক্লোন এক্সপেরিমেন্ট। এর মাধ্যমে আমার মতো আরও দশজন মানুষ তৈরী হবে। একটা সময় পৃথিবী ভরে যাবে আমাদের মতো মানুষদের দিয়ে।”
” তাহলে তো সর্বনাশ হবে।”
” আসলেই সর্বনাশ হবে। এজন্যই আমি ওকে এই কাজ করতে দিতে চাইছি না। কিন্তু ইদানীং ওর মাথায় একটা নতুন ভূত চেপেছে।”
” কিরকম?”
” ও চায়, আমি যেন বাচ্চা জন্ম দেই। ”
” কেনো?”
” কারণ আমার গর্ভে জন্ম নেওয়া বাচ্চার ব্রেইন নিশ্চয়ই আমার মতো হবে। অথবা আরও শক্তিশালী হতে পারে৷ নতুন করে ক্লোন তৈরীর দরকার নেই। যা হবে, প্রাকৃতিকভাবে হবে। আমার জন্ম দেওয়া প্রথম বাচ্চাটা আমি ওকে দিয়ে দিবো। এই শর্তেই ও আমাকে মুক্তি দিবে।”
নীলাভ্র আতঙ্কিত হয়ে বললো,
” এই চিন্তা তো আমার মাথাতেও আসেনি। এজন্যই তুমি বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখাচ্ছিলে?”
রিম্মি আস্তে-ধীরে হ্যাসূচক মাথা নাড়ল। নীলাভ্র বললো,
” তাহলে তো এখন সবচেয়ে বড় বিপদে আছে তোহা।”
চলবে