ধূসর রঙে আকাশ পর্ব- ৩৩

0
808

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩৩
লিখা: Sidratul Muntaz

তোহা ভয় নিয়ে রিম্মির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। রিম্মি দরজায় করাঘাত করলো। একটু পরেই আমীর গম্ভীরমুখে দরজা খুলে ভ্রু কুচকালো। ভারী কণ্ঠে বললো,” কি ব্যাপার?”
রিম্মি সামান্য হেসে বললো,” মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওকে মাফ করো, ভিতরে আসতে দাও। প্লিজ।”
তোহা বা শিউলি কেউই রিম্মির কথা শুনতে পেল না। আমীর সহজগলায় বললো,
” ভিতরে এসো।”
তোহার চোখেমুখে আনন্দময় বাতাস খেলে গেল। রিম্মি কি এমন বলেছে যে আমীর এতো সহজেই ঢুকতে দিল? সেটা বড় কথা না, বড় কথা হলো আমীরের রাগ কমেছে। তোহা হাসি হাসি মুখ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। শিউলিও সাথে ঢুকলো। রিম্মি তোহাকে ইশারায় বাই বলে চলে গেল। আমীর দরজা আটকে দিচ্ছে। তোহা খাবারের বক্সটা ডাইনিং টেবিলে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
” শিউলি, তুমি ওই বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নাও। তারপর ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় শুয়ে পড়বে। ঠিকাছে?”
” আচ্ছা আপু।”
শিউলি বাথরুমে ঢুকলো। আমীর তার কাজের জায়গা মানে তোহার ভাষায় লঙ্গরখানায় ঢুকে যাচ্ছিল। তোহা আস্তে করে বললো,
” শুনুন।”
আমীর দাড়ালো। তোহা আচমকা গিয়ে আমীরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
” সরি, অনেক বেশি বেশি সরি। আর কখনো করবো না। এরপর থেকে যেখানেই যাই আপনাকে জানিয়ে যাবো। আর আপনি যেখানে যেতে নিষেধ করবেন সেই জায়গার নাম দ্বিতীয়বার আর মুখেও আনবো না। প্রমিস করছি।”
আমীর বিরক্তগলায় বললো,” ঠিকাছে ছাড়ো।”
আমীরকে জড়িয়ে ধরে রাখতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে একটা নরম পিলার সে আঁকড়ে ধরে আছে। পিলারের গায়ে ঔষধ ঔষধ গন্ধ। তাও যে সে ঔষধ না। নেশা লাগানো ঔষধ। আমীর বললো,
” ছাড়ো তোহা।”
” আগে বলুন ক্ষমা করেছেন?”
” হ্যা করেছি। এবার ছাড়ো।”
তোহার বলতে ইচ্ছে করলো,” ছাড়ো ছাড়া আর কিছু বলতে শিখেন নি? কখনো ভুল করে এটাও তো বলতে পারেন, তোহা আমাকে একবার জড়িয়ে ধরো৷ মাথাব্যথা করছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। অথবা ক্ষিদে পেয়েছে, একটু খাইয়ে দাও৷ এসব তো কখনো বলেন না। শুধু ছাড়ো,ছাড়ো। আমি ধরলেই যেন গায়ে ফোশকা পড়ে আপনার। মগার মগা!”
তোহা মাথা নিচু করে বললো,” রিম্মি আপু আপনার আর আমার জন্য খাবার পাঠিয়েছে। যেন এতোরাতে আমাকে কষ্ট করে রান্না করতে না হয়। চলুন একসাথে বসে খাই?”
” আমার ক্ষিদে নেই। তুমি খাও।”
আমীর যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তোহা পেছন থেকে বললো,
” আপনি না খেলে আমিও খাবো না। আমার অবশ্য ক্ষিদে পেয়েছে, তাও খাবো না।”
আমীর তোহার দিকে ঘুরে বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে বললো,” কেন খাবে না?”
” বাঃরে, আপনাকে রেখে আমি খেতে পারি?”
আমীর বাধ্য হয়ে চেয়ার টেনে খেতে বসলো। তোহা খুশি হয়ে খাবার প্লেটে ঢালতে ঢালতে বললো,
” থ্যাংকস। আমি খাওয়িয়ে দেই আপনাকে?”
আমীর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” দাও!”
তোহার এতো ভালো লাগলো, খুশিতে হাতের প্লেটটা ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো। তারপর মনে হলো, কাচের প্লেট ছুড়ে ফেললে ভেঙে যাবে। ম্যালামাইন হলে রিস্ক কম ছিল। তোহা নিজের ইচ্ছাকে সংবরণ করলো। শিউলি ওরনা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ড্রয়িংরুমে যাচ্ছিল। কিন্তু তার চোখ আটকায় ডাইনিং রুমের কোণায় মনোহর দৃশ্যটিতে। কি চমৎকার দৃশ্য! ফ্রেমে বন্দী করে রাখার মতো। তোহা আমীরের একপাশে দাঁড়িয়ে ওকে ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। পার্কে ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করার সময় কত রোমান্টিক দৃশ্য শিউলি দেখেছে। কিন্তু এতো সুন্দর আর মোহনীয় কখনো লাগেনি। তোহা খেয়াল করলো শিউলি হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তোহার লজ্জা লাগতে শুরু করলো। সে উশখুশ করে বললো,
” কিছু বলবে শিউলি?”
শিউলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,” না আপু। ”
” তাহলে যাও৷ সোফায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকো।”
” যাচ্ছি।”
শিউলি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে সোফার কোণার সাথে পায়ের কেণী আঙুলে ব্যাথা পেল। তোহা বললো,
” আরে, মেয়ে করে কি? লাইট জ্বালিয়ে নাও।”
শিউলি লাইট জ্বালিয়ে ড্রয়িংরুমটা দেখলো। তোহা বললো,
” বালিশ লাগবে?”
” না আপু, যেই বালিশ আছে তাতেই আমার হইবো।”
” ঠিকাছে। ভয় না পেলে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। আর ভয় পেলে লাইট থাক।”
” ভয় পামু না।”
শিউলি লাইট নিভিয়ে দিল। আমীর বললো,
” কে এটা?”
তোহা ভাত মাখতে মাখতে বললো,” আমার কাজিন। খুব মিষ্টি না?”
” হুম।”
” আপনার বিশ্বাস হলো?”
” কি?”
” ও যে আমার কাজিন, এই কথা বিশ্বাস হলো?”
” অবিশ্বাসের তো কিছু নেই।”
” আসলে ও আমার কাজিন না। ওকে আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি।”
” হোয়াট?”
” মেয়েটার মা মরে গেছে সাতদিন হলো। রাস্তায় বসে কাঁদছিল। যে বাড়িতে থাকতো ওই বাড়িওয়ালা তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। বাবাও নেই। আপন বলতে ওর কেউই নেই। অসহায় মেয়েটা যাবে কোথায়? তাই আমি ধরে এনেছি। আমার কাজে লাগবে।”
” চেনো না, জানো না, আন্দাজে একজনকে রাস্তা থেকে তুলে আনলে? এই মেয়ে যদি চোর-ডাকাত হয়? মাঝরাতে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে যদি ডাকাতি করে পালায়?”
তোহা ড্রয়িং রুমের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বললো,” আস্তে, শিউলি শুনে ফেলবে তো।”
” তুমি ওকে বাসায় এনে একদম ঠিক করোনি।”
” কি করবো? আমার মায়া লাগছিল। এতোকিছু মাথায় আসেনি তখন। তাছাড়া আমার ওকে ভালোই মনে হয়েছে।”
” দয়া-মায়া মানুষের খুব বাজে একটা বৈশিষ্ট্য। এগুলো মানুষকে দূর্বল করে দেয়, বোকা বানায়।”
” আপনি কি আমাকে বোকা বলতে চাইছেন?”
” চাইছি না। তুমি অবশ্যই বোকা। পরে কোনো ঝামেলা হলে আমাকে বলতে এসো না।”
তোহা আমীরের মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললো,
” কিচ্ছু হবে না।”
” শুধু আমাকেই দিচ্ছো। তুমি খাচ্ছো না কেন?”
” আপনার খাওয়া হয়ে গেলে আমি খাবো।”

তোহার বিছানায় একা শুয়ে থাকতে ভয় লাগছে। তার পিঠে ব্যথা করছে। এপাশ-অপাশ হওয়া যাচ্ছে না। ডানদিকে ফিরলে মনে হয় বামে কেউ শুয়ে আছে। আবার বামে ফিরলে মনে হয় ডানে কেউ শুয়ে আছে। বত্রিশ পাটি বের করে হাসছে। সবকয়টি দাঁতের রঙ হলুদ। কি মুশকিল! তোহা উঠে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালো। আমীর আজকে তার সাথে শুতে আসেনি। সে নাকি এখন থেকে ওই লঙ্গরখানাতেই ঘুমাবে। এই কথা শুনে তোহার ভীষণ মনখারাপ হয়। ড্রয়িংরুমেই তো শিউলি আছে। ওকে ডেকে আনলে কেমন হয়? মেয়েটা তোহার পাশে শুয়ে থাকবে। আর তোহা নিশ্চিন্তে ঘুমুবে। তাছাড়া শিউলির নিশ্চয়ই সোফায় ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটার বয়স মাত্র তেরো হলেও গায়ের গড়নে সে বেশ লম্বা। তোহার সমান। ওর সোফায় পা আটবে না। তোহা শিউলিকে ডেকে আনলো৷ কিন্তু এবার আরেকটা মসিবত হয় মেয়েটা ঘুমানোর সময় ঘেরঘের নাক-ডাকে। এলোপাথাড়ি লম্বা চুল দিয়ে মুখে বারি দেয়। গায়ের উপর হাত-পা তুলে দেয়। কি বিপদ!

সকালে, তোহা আমীরের ঘরে ঢুকলো নাস্তা নিয়ে। আমীর কম্পিউটারে মনোযোগ দিয়ে কিছু টাইপ করছে। তোহা ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় হালকা কাশলো। আমীরের মুখ স্বাভাবিক ছিল। এবার গম্ভীর হয়ে গেল। ভ্রু কুচকে তোহার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
” কিছু বলবে?”
” আপনার জন্য ব্রেকফাস্ট। ”
” থ্যাঙ্কিউ। রেখে যাও।”
” আচ্ছা।”
তোহা একটা মুখ ভেংচি কাটলো। দিন দিন আমীরের ভাব আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। বেটাকে অতি জলদি বাগে আনা প্রয়োজন। সে তোহার সাথে এতো গম্ভীর থাকবে কেন? যত জরুরী কাজই থাকুক, দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাক, তোহার সাথে সবসময় আমীরকে হাসিমুখে কথা বলতে হবে। ভ্রু কুচকে কথা বলা যাবেনা। কোমল গলায় আদর করে কথা বলতে হবে। তোহার বাবাও তো কম গম্ভীর মানুষ না। অথচ তিনি তোহার সাথে সবসময় হেসে কথা বলেন। তাহলে আমীরের কিসের এতো ভাব? ওর এই ভাব তোহা যদি কুচি কুচি করে মাটিতে না পুতেছে তাহলে নিজের নাম সে বদলে রাখবে। তোহা দরজা অবধি গিয়ে থেমে দাড়ালো। ঘুরে জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা, আপনার পছন্দের খাবার কি?”
আমীর থেমে তোহার দিকে তাকিয়ে বললো,” কেনো?”
” এমনি। আজকে লাঞ্চে কি বানাবো মাথায় আসছে না। ভাবলাম আপনার পছন্দ মতো কিছু করি।”
আমীর আবার কাজে মনোযোগী হয়ে দায়সারা জবাব দিল,” আলু ছাড়া সিঙারা।”
তোহা মুখ কুচকে আনমনে বললো,” অ্যা! আলু ছাড়া সিঙারা? তাও লাঞ্চে!”

রান্নাঘরে গিয়ে তোহা শিউলিকে জিজ্ঞেস করলো,” তুমি আলু ছাড়া সিঙারা বানাতে পারো?”
” হো পারি তো। ক্যান আপু?”
” আজকে আলু ছাড়া সিঙারা বানাতে হবে। আমাকে প্রসেসটা শিখিয়ে দিও। আজকে তুমিই বানাবে। অন্য একদিন যেনো আমিও বানাতে পারি।”
” আইচ্ছা।”
শিউলি খুব মজার আলু ছাড়া কলিজা সিঙারা বানিয়েছে। তোহা মুখে দিয়েই চোখ বন্ধ করে বললো,
” ওয়াও, ফ্যান্টাস্টিক। শোনো, এইটা কিন্তু তুমি বানাও নি। আমি বানিয়েছি। তোমার ভাইয়ার সামনে একথাই বলবে। আর আমার রান্নার বেশি বেশি প্রশংসা করবে। মনে থাকবে?”
শিউলি মুখ অন্ধকার করে বললো,” এইটা কিন্তু ঠিক না আপু। আপনি ভাইয়ের লগে মিথ্যা কইবেন?”
” বোকা মেয়ে। মিথ্যা ছাড়া আজ-কাল চলে নাকি? জগৎটাই টিকে আছে মিথ্যার উপর। যারা সত্যি বলে তারা মগা।”
রিম্মি রান্নাঘরে ঢুকে হাসিমুখে দাঁড়ালো। শিউলি বললো,
” ওই দেখেন আপু, কেডায় আইসে।”
তোহা তাকিয়ে দেখলো রিম্মিকে।
” আরে রিম্মি আপু, ভালো করেছো এসে। দেখো আমি কি মজার কলিজার সিঙারা বানিয়েছি! একবার খেয়ে দেখো।”
শিউলি তোহার পাগলামি দেখে মুখে ওড়না চেপে খিকখিক করে হাসছে। তোহা চোখ রাঙিয়ে ধমক দিল,
” হাসছো কেনো? আমার সামনে অযথা হাসবে না।”
শিউলি হাসতে হাসতেই বললো,” আইচ্ছা আপু। আর হাসতাম না।”
বলেই আবার হাসতে লাগলো। রিম্মি তোহার একহাত ধরে বার্তা দিল,” রুমে চলো তোহা। তোমার সাথে কথা আছে।”
” কি কথা?”
” জরুরী কথা।”
তোহা রিম্মির সাথে রুমে গেল। রিম্মি বললো,
” এই মেয়ের মধ্যে ঝামেলা আছে। ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করো। নাহলে পস্তাতে হবে।”
তোহা অবাক হয়ে বললো,” কেন? ওর মধ্যে কি ঝামেলা? আমি তো কোনো ঝামেলা দেখছি না! কি সহজ-সরল একটা মেয়ে।”
” যতই সহজ-সরল হোক। মেয়ে তো। যেখানে তোমার হাসব্যান্ড সারাদিন বাসায় থাকে সেখানে এমন একটা উপযুক্ত কাজের মেয়ে রাখা একদমই উচিৎ না। তুমি এই মেয়েটাকে বিদায় করে দাও তোহা। ভালোর জন্য বলছি।”
তোহা মুখ বিকৃত করে বললো,” ছি, এতো নিকৃষ্ট চিন্তা কিভাবে করতে পারলে? আমীরের উপর আমার শতভাগ বিশ্বাস আছে। তাছাড়া শিউলি একটা বাচ্চা মেয়ে। ও এসবের কি বুঝে?”
” তেরো বছরের একটা মেয়ে বাচ্চা? ওকে দেখলে কি আদৌ তেরো বছর মনে হয় তোহা? ওর শরীর-স্বাস্থ্য তোমার থেকেও অনেক উন্নত। আর সবথেকে বড় কথা, ছেলেদের বিশ্বাস করতে নেই। বউ ছাড়া পৃথিবীর সবমেয়ে ওদের কাছে অপশরী। ”
তোহা রিম্মির কথা হেসে উড়িয়ে দিল। আমীর তো সারাখন কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তোহার দিকে তাকানোরই সময় হয়না ওর। আবার শিউলি? ওই মেয়ে তো তোহার ধারে-কাছেও নেই। কোথায় সে আর কোথায় শিউলি! আকাশ-পাতাল তফাৎ। অন্তত সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে তোহার সাথে শিউলির তুলনা করাও বোকামী। রিম্মি এসব অহেতুক কথা কেন বলছে? শিউলিকে তোহা হারাতে চায়না। মেয়েটার রান্নার হাত অসাধারণ। ওর কাছ থেকে রান্না শিখে আমীরকে সহজেই ইম্প্রেস করা যাবে। এই মেয়ে তোহার কাছে হীরের টুকরো। রিম্মি বললো,
” আমার কথাগুলো ভেবে দেখো তোহা। আমি যা আশংকা করি তা কখনো ভুল হয়না।”
রিম্মি চলে যায়। তোহা ব্যঙ্গ করে বললো,” আমি যা আশংকা করি তা কখনো ভুল হয়না। ন্যাকামো! তোমার কি কাজ আছে মানুষের কানে বিষ ঢালা ছাড়া?”
তোহা যতই মুখে এসব বলুক। মনে মনে ঠিকই তার শংকা কাজ করে। দুপুরে খাবার টেবিলে যখন তোহা পরম যত্নে আমীরকে সিঙারা দিয়ে বললো,
” খেয়ে দেখুন তো, ভালো হয়েছে কিনা? আমি বানিয়েছি।”
শিউলি তখনো মিটমিট করে হাসলো। আমীর বললো,
” শিউলি, সিঙারা অসাধারণ হয়েছে। গুড জব।”
শিউলি হাসিমুখে বললো,” ঠ্যাংকিউ ভাইজান।”
তোহা বিস্ময়ে কপাল ভাজ করে বললো,” সিঙারা আমি বানিয়েছি। আপনি ওকে বাহবা দিচ্ছেন কেন?”
” এখনো ভালো করে মিথ্যে বলা শেখোনি তুমি। আরও প্র্যাকটিস লাগবে।”
শিউলি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার যোগান। তোহা বললো,
” আপনি বুঝলেন কিভাবে আমি মিথ্যে বলছি?”
আমীর একটু হেসে বললো,” যে মেয়ে ভালো করে রুটিটাও বেলতে পারেনা সে এতো পারফেক্ট সিঙারা বানিয়েছে? এটা আমাকে বললেই বিশ্বাস করবো? আমাকে কি অগাচণ্ডী মনে হয় তোমার?”
শিউলি চাপাস্বরে বললো,” অগাচন্ডী!”
তারপর আবার মুখে ওরনা চেপে হাসতে লাগলো। আমীরও হেসে দিল। তোহা তখন রেগেমেগে অস্থির। শিউলি তাহলে আগেই জানতো, তোহা সিঙারা বানিয়েছে এটা আমীর বিশ্বাস করবে না৷ তাই এতোক্ষণ চুপ করে ছিল। দুজনের সামনে নিজেকে মগা মগা লাগছে তোহার। এই অপমান মনে থাকলে আর কখনো মিথ্যে বলবে না সে। নিজের রান্না হলেই কেবল জোরগলায় বলবে, আমি রান্না করেছি। অন্য আরেকজনের কাজ নিজের বলে চালিয়ে দিবে না। এ ঘোর অন্যায়।

পনেরো দিনের বেশি সময় ধরে তোহাদের বাসায় শিউলি থাকছে। মেয়েটা কাজকর্মে আসলেই দক্ষ। ঝটপট সবকাজ শেষ করে ফেলে। তোহার বিছানা থেকে নামতেও হয়না। আরামের জীবন পেয়ে গেছে। পটের বিবি সেজে সারাক্ষণ বিছানায় বসে মোবাইল টেপে। আরাম থাকলেও মনে শান্তি নেই একটুও। গতরাতের পর থেকে তোহার প্রচন্ড বমি পাচ্ছে। গা গুলিয়ে শুধু বমি আসছে। গতরাতে তোহা খুব অদ্ভুত একটা জিনিস দেখেছে৷ এই সন্দেহ তার মনে আগে থেকেই ছিল৷ এ বাসায় আসার প্রথম দুইদিন শিউলি স্বাভাবিকভাবেই তোহার সাথে রাতে ঘুমাতো। হঠাৎ মেয়েটার কি যেন হলো। যুদ্ধ করেও তোহার পাশে রাখা যায় না ওকে। ও ড্রয়িংরুমে গিয়ে ঘুমায়। যেদিন তোহা খুব জোর জবরদস্তি করে ওকে নিজের পাশে শুয়িয়ে রাখে, সেদিন তোহা ঘুমিয়ে যাওয়ার পরই শিউলি জায়গা ত্যাগ করে। আবারও ড্রয়িংরুমে গিয়ে ঘুমায়। ঝামেলা হচ্ছে আমীরের রুম আর ড্রয়িংরুম প্রায় বরাবর। তাই শিউলি যদি ড্রয়িংরুমে ঘুমায়, আমীর তাকালেই ওর শুয়ে থাকা দেখতে পাবে। ব্যাপারটা কেমন দেখায়? শিউলিকে তো এই কথা সরাসরি বলা যায়না। গতরাতে তোহা জোর করে শিউলিকে বিছানায় ওর পাশে এনে ঘুম পাড়িয়েছিল। মাঝরাতে আযানের শব্দে তোহা ঘুম ভেঙে দেখলো শিউলি ওর পাশে নেই। তোহার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সে ঠিক করে ফেলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে কষিয়ে একটা চড় দিবে শিউলিকে। যেন আর কখনো বিছানা ছেড়ে যাওয়ার সাহস না করে। মেয়েটা এতো ঘাড়ত্যাড়া কেন? তোহা রুম থেকে বের হতে গিয়ে অদৃশ্য কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে বিছানায় ছিটকে পড়ে। এই অভিজ্ঞতা তার জন্য নতুন না। তবুও তোহা ভয়ে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে আমীরকে ডাকলো। আমীর হয়তো তখন জেগেছিল। সে হন্তদন্ত হয়ে তোহার কাছে আসলো। তোহা লক্ষ্য করলো, আমীরের শরীর ঘর্মাক্ত। তাকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তোহা বললো,
” আজকে আবারও আমার সাথে ওই কাহিনি হয়েছে। আমি ঘর থেকে বের হতে পারছি না কেন?”
” ঔষধ খাওনি তাইনা?”
” ঔষধ ইচ্ছে করেই খাইনি। শিউলিকে পাহাড়া দেওয়ার জন্য। মেয়েটা সাংঘাতিক। আমি ঘুমিয়ে পড়লেই উঠে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। ওকে একশোবার বলেছি আমার সাথে ঘুমাতে। তাও ওর কেন মাঝরাতে ড্রয়িংরুমে গিয়ে শুতে হবে? আজকে ওর খবর আছে। ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। এই আপনি সরুন তো, আমি শিউলির ঘরে যাবো।”
” মাঝরাতে সিন ক্রিয়েট করার দরকার নেই ৷ এখন ঘুমাও।”
” সিন ক্রিয়েট মানে? আপনার মনে হচ্ছে আমি সিন ক্রিয়েট করছি? ঝামেলা তো ও-ই শুরু করেছে। ওকে আমি এ বাসায় রাখবো না।”
” তাহলে এনেছো কেন?”
” তখন কি জানতাম এই মেয়ে এতো ঘাড়ত্যাড়া!”
” আচ্ছা বাদ দাও, এখন শুয়ে পড়ো। সকালে উঠে আমি ওকে বলে দিবো যেন রাতে এদিক-ওদিক না যায়৷ তোমার সাথেই থাকে।”
” ওর মনে থাকবে না। আমিও অসংখ্যবার বলেছি। এখন কান ধরে ঘুম থেকে উঠিয়ে দু’টা চড় মারলেই মনে থাকবে৷ সরুন আপনি, যেতে দিন।”
” যেতে হবেনা তোহা, বললাম তো।”
তোহা ভ্রু কুচকে বললো,” আশ্চর্য, আপনি এমন করছেন কেন? আমি ওকে যা ইচ্ছে বলি আপনার কি?”
ওদের কথা কাটাকাটির মাঝখানেই শিউলি ঘরে ঢুকলো। ওর মাথায় গামছা। কপালে বিন্দু বিন্দু পানি। সাবানের গন্ধ আসছে। মনে হয় মাত্র গোসল করেছে। কিন্তু এইসময় গোসল কেন? এতো ভোরে কেউ গোসল করে? কথাটা মনে আসতেই আরেকবার মুখভর্তি বমি আসলো তোহার। বেসিনে দাঁড়িয়ে একদলা বমি ছাড়লো। আজকে সকালে আরও একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে। পূরবী আর লতিফা এসেছিল বাসায়। লতিফা বলেছেন, শিউলিকে দেখে উনার মনে হয় পোয়াতি। এসব বিষয়ে লতিফার অঅভিজ্ঞতা ভালো। তার ধারণা কখনো ভুল হয়না। তোহা রীতিমতো পাগল হয়ে গেছে। রিম্মির কথাগুলোই তাহলে মিলে গেল? সকাল থেকে শুধু একটা কথাই কানে বাজছে। রিম্মি বলেছিল,” আমার কথাগুলো ভেবে দেখো তোহা। আমি যা আশংকা করি তা কখনো ভুল হয়না।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here