ধূসর রঙে আকাশ পর্ব-৭

0
1220

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৭
লিখা: Sidratul Muntaz

রিম্মিদের ফ্ল্যাটের সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে নীলাভ্রর পা অসাড় হয়ে আসছে। হাত দুটোও ঠিক মতো নাড়ানো যায়না। মনে হচ্ছে, কেউ শক্ত করে চার হাত-পা বেধে রেখেছে। আর নীলাভ্র প্রাণপণ চেষ্টা করছে বন্ধন ছাড়ানোর। তার চার হাত-পায়ে যদি কেউ সুন্দর করে মালিশ দিতো তাহলে হয়তো একটু আরাম পাওয়া যেতো। রিম্মি নীলাভ্রর একই পায়ে দুইবার লাথি মেরেছিল। নীলাভ্রর ধারণা হাটুর লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে। মেয়েমানুষের শরীরে এতো শক্তি হয়? রিম্মি কি আসলেই মেয়ে না স্টিল?নীলাভ্র যখন সিড়ি ভেঙে মেইনগেইটের সামনে আসল, দেখতে পেল লাভলী আন্টি হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছেন। হয়তো ওর জন্যই অপেক্ষা করছেন। নীলাভ্র খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে সামনে দাঁড়ায়। লাভলী নীলাভ্রকে দেখেই চিন্তিত মুখে বললেন,
” কি করবো বলোতো বাবা? মেয়েটার ফোন এখনো বন্ধ। কোনো খোঁজ নেই। আমার মাথা কাজ করছে না। কই গেলো?”
লাভলীর চোখেমুখে তীব্র দুশ্চিন্তার ছাপ। নীলাভ্র সান্ত্বনা দিল,
” টেনশন করবেন না আন্টি। খুঁজে পাওয়া যাবে।”
” তোমার আঙ্কেল বাসায় আসলে আমি কি জবাব দিবো সেটাই ভাবছি। সে যদি জানে, আমি তোহাকে শপিং এ পাঠিয়েছি তাও আবার একা.. তাহলে বাসায় তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে যাবে।”
” আপাতত আঙ্কেলকে কিছু জানানোর দরকার নেই। আমরা আগে চেষ্টা করে দেখি, যদি পেয়ে যাই তাহলে তো ভালো। নাহলে পরে আঙ্কেলকে জানাতেই হবে।”
লাভলী নিঃশ্বাস আটকে বললেন,” এসব বোলো না প্লিজ। নিশ্চয়ই খুঁজে পাবো।”
” ইনশাল্লাহ। রিকশা নিবো আন্টি।”
” কোথায় যাবে?”
” সবার আগে শপিংমলটায় গিয়ে দেখি।”
” ঠিকাছে।”
নীলাভ্র গেইট দিয়ে বের হলো রিকশা খোঁজার উদ্দেশ্যে। এতোক্ষণে নীলাভ্রর এক পায়ে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটা লাভলী খেয়াল করলেন। কিছুটা বিচলিত গলায় বললেন,
” তোমার পায়ে কি হয়েছে নীল?”
নীলাভ্র স্মিত হেসে বলল,
” তেমন কিছুনা আন্টি, হালকা একটু ব্যথা পেয়েছি।”
” যেতে পারবে?”
” নিশ্চয়ই পারবো আন্টি। ব্যথাটা সহনীয়। আপনি চলুন।”

নীলাভ্র বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রিম্মি দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা আটকালো। তারপর টেবিলে সযত্নে নীল কলম দিয়ে আটকানো নীলাভ্রর সেই চিরকুটটা হাতে নিল। এর আগে কখনো কিছুর প্রতি এতো আগ্রহবোধ করেনি রিম্মি৷ ব্যক্তিগত ভাবে রিম্মির ধৈর্য্য মাত্রাহীন। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যেটা রিম্মি পারেনা। তার ডিকশনারীতে অসম্ভব বলতে কোনো শব্দ নেই। অথচ সে আজকে সামান্য এই চিরকুটের লেখা পড়ার জন্য নিজের ছোট্ট মনটাকে আটকাতে পারছে না? মন অবাধ্যের মতো আনচান করছে? এমন হওয়ার কারণ কি? রিম্মি বুঝতে পারেনা। কিন্তু এতটুকু স্পষ্ট , তার মনটা বেশ কয়েকদিন ধরে মস্তিষ্কের বিরোধিতা করে চলেছে অবিরাম। আগে রিম্মি যেভাবে চাইতো মন-মস্তিষ্ককে ঠিক সেভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো। সাধারণ মানুষ পরিচালিত হয় মস্তিষ্ক দ্বারা। কিন্তু রিম্মি নিজেই তার মস্তিষ্ককে পরিচালনা করে। সে যেভাবে চায়, মস্তিষ্ক সেভাবেই চলে। আজ পর্যন্ত রিম্মি তার দেহ, হাত-পা কিংবা মস্তিষ্ক দিয়ে এমন কিছু করেনি যেটা সে চায়নি। যেমন একজন সাধারণ মানুষের শরীরে যদি হুট করে একটা মাকড়সা উঠে যায় তাহলে সে অজান্তেই চিৎকার দিবে। তারপর হয়তো নিজেই অবাক হবে৷ কেন চিৎকার দিল? চিৎকারটা আসে মস্তিষ্কের আদেশে। কিন্তু রিম্মির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টা হয়। কোনো মাকড়সা যদি তার শরীর বেয়ে উঠে যায় সে চিৎকার করবে না। তার শরীরে কিছু অনুভূতিও হবে না। অনুভূতিটা কেবল তখনি হবে যখন রিম্মি অনুভব করতে চাইবে। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। হঠাৎ করেই যেন সব নিয়ম ভেঙে যাচ্ছে। রিম্মি নিজেকেই সামলাতে পারছে না। মনটা এমন বেসামাল হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? অযথা দমবন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে কেন? নীলাভ্রর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে রিম্মি যে সকল অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছে সবই তার বাইশ বছরের জীবনে প্রথম। এর আগে কখনো রিম্মি কারো প্রতি এমন আকর্ষণ অনুভব করেনি। চিকন গড়ন, শ্যামবর্ণ, নীলাভ্রর নিষ্পাপ চোখ দুটি রিম্মির শান্ত মনে অবাধ ঘূর্ণিঝড় তুলে দেয়। নীলাভ্র যখন অবাক হয়ে রিম্মির দিকে চেয়ে থাকে, ওর চোখেমুখে ঘোর বিস্ময়ের ছাপ থাকে, রিম্মির স্নায়ু তখন অকারণেই দূর্বল হয়ে পড়ে। অজানা এক আতঙ্ক সুচের মতো মনে গাঈ দেয়। সব এলোমেলো হয়ে যায়। আগে যা কখনো হয়নি সেসবই হতে থাকে নীলাভ্র তাকিয়ে থাকলে। হুট করেই যেন মহাপ্রলয়ের মতো অদ্ভুত অনুভূতিরা রিম্মিকে অগোছালো করে দেয়। এমন কেন হয়?কিভাবে হয়? রিম্মি যুক্তি খুঁজে পায়না। তার অসহ্য লাগে। এখনো লাগছে। রিম্মি চিরকুটটা খুলবে না। ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নীলাভ্রর কথা আর ভাববে না সে। আধঘণ্টা যাবত মুখের সামনে বই ধরে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করার পর রিম্মি খেয়াল করল, তার মনোযোগ বইয়ে নেই। সে এতোক্ষণ ধরে নীলাভ্রর কথাই চিন্তা করছে। তার মন বারবার আকুতি জানাচ্ছে নীলাভ্রর চিরকুটটা পড়ে দেখার জন্য। নাহলে যেন কিছুতেই অশান্ত মনের প্রলয় থামবে না। রিম্মির অবাক লাগে। আগে রিম্মি যে স্মৃতি ব্রেইন থেকে মুছে দিতে চাইতো, সঙ্গে সঙ্গে তা ভ্যানিশ হয়ে যেতো। কখনো অবাঞ্চিত স্মৃতি রিম্মিকে বিরক্ত করতে পারে না৷ তার মস্তিষ্কে শুধু সেই স্মৃতিই আসে যেটা রিম্মি মনে করতে চায়। এটাই তার মন আর মস্তিষ্কের সামঞ্জস্যতা। আজকে সেই সামঞ্জস্যতায় ব্যঘাত ঘটছে কি করে? কিভাবে মস্তিষ্ককে টেক্কা দিয়ে মন জিতে যাচ্ছে? মনটা কি তাহলে মস্তিষ্কের চাইতেও অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে? কিন্তু কেন? মনে কি এমন আছে যা মস্তিষ্কে নেই? রিম্মি বাধ্য হয়ে চিরকুট খুলে। নীলাভ্রর গোটা গোটা অক্ষরের সুন্দর কিছু লেখা,

” আজকে আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেওয়া হয়নি। সেজন্য আবার আমাকে অভদ্র ভাবছেন না তো? আসলে আমি না বুঝতে পারি না। কিছুই বুঝিনা। আমি একটা অধম। আপনি কি চান, কি পছন্দ করেন, কিভাবে কথা বললে আপনি খুশি হন, আমি এসব কিছুই বুঝিনা। এই যে এখন লিখছি, এখনো কিন্তু বুঝতে পারছি না কিভাবে লিখলে আপনি বুঝবেন। আপনি কি ইংরেজি পড়তে বেশি কমফোর্টেবল নাকি বাংলা?আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার সামনে বসেই লেখাগুলো পড়ছেন। আর মিটিমিটি হাসছেনও৷ আমার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছে। আপনার সামনে দাঁড়ালেই আমার লজ্জা লাগে। এজন্য আবার আমাকে আঁতেল মনে করবেন না। ছেলেমানুষ হয়ে লজ্জা পাই, আঁতেলই তো আমি। আঁতেল মানে বুঝেন? নির্বোধ। ভাইয়া আর মা অবশ্য আমাকে এই নামেই ডাকে। কিন্তু আপনি প্লিজ এই নামে ডাকবেন না। কারণ আপনি আমাকে আঁতেল বললে আমার লজ্জা লাগবে। আচ্ছা আপনি আমার সাথে কথা বলেন না কেন? আমি কি এতোই অধম যে একটিবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসা যায়না? হাসির উত্তর হাসি দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু আপনি দেন চোখ রাঙানি। আপনার হরিণী চোখের তেজস্ক্রিয়তায় আমার ছোট্ট মন ভয়ে লাফঝাপ শুরু করে দেয়। এখন আবার আমাকে ভীতু ভাবছেন না তো? আমি কিন্তু ভীতু না। ভীতু হলে কি এতোবার চোখের ধমক খাওয়ার পরেও আপনার পিছু নিতাম? এবার আপনি বলতে পারেন আমি বেহায়া। হ্যা তাহলে আমি স্বীকার করছি। আসলেই আমি বেহায়া। আগে কিন্তু ছিলাম না, আপনাকে দেখার পর বেহায়া হয়েছি। আমার মন আমার কথা শুনতে চায় না। এটা কি আমার দোষ? প্রতিদিন এই অপরাধী চোখ দুটো আপনাকে দেখার তৃষ্ণায় কাতর হয়। মন আপনার রাগী চোখের আগুনে ঝলসে যেতে চায়। কি বেহায়া ইচ্ছে তাইনা? আপনি আমার অভ্যাস হয়ে গেছেন। যদিও আমি জানিনা এটা কেমন অভ্যাস। ভালো অভ্যাস নাকি বদভ্যাস?”
চিঠিটা পড়ার পর রিম্মির মুখের ভাবভঙ্গি একটুও বদলায় নি। কিন্তু মন থেকে এক পশলা হাসি উঠে আসতে চাইছে। রিম্মি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। না, হচ্ছে না। হাসতেই হবে। নাহলে জীবন বৃথা। মনটাও স্থির হবে না প্রাণখুলে না হাসলে। রিম্মি চিঠিটা মুখে গুজে হাসতে শুরু করল। আনন্দ নামক অনুভূতিটা যেন তার প্রথমবার হচ্ছে।

সারা শপিংমল তোলপাড় করার পরেও তোহার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি সেদিন। টানা এক সপ্তাহ এসব নিয়ে পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকেন লাভলী আর জাবিদ সাহেব। একমাত্র মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার শোকে দুজনের অবস্থা পাগলপ্রায়। বাড়িতে শোক নেমে আসে। একমাসের মাথায় লাভলী প্রচন্ড হতাশা থেকে স্ট্রোক করে বসেন। অতঃপর অসুস্থ হয়ে বিছানায় দিনাতিপাত করতে থাকেন। পূরবীর দিন যায় বড়খালার সেবা করে। মাঝে মাঝে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে সে। একা হাতে সব সামলাতে গিয়ে হিমশিম খায়। পূরবীর মা লতিফা মেয়েকে নিতে আসেন। কিন্তু পূরবী অসুস্থ বড়খালাকে রেখে যেতে নারাজ। লতিফার বিবেকও সায় দেয়না। তাই তিনিও থেকে যান মেয়ের সাথে। মা-মেয়ে মিলেই সংসারটা আগলে রেখেছে। এখন এই বাড়িটা তাদের নিজের বাড়ির মতো। লতিফা রান্না-বান্না করেন। আর পূরবী লাভলীর দেখা-শুনা করে। জাবিদ সাহেব সকালে বাসা থেকে বের হোন।রাত দুইটা-তিনটায় ফিরেন। তারপর বিরসমুখে সদর দরজার কাছে বুকে হাত রেখে বসে থাকেন। লতিফা উনাকে ঠান্ডা পানি খেতে দেন। জাবিদ সাহেব ঢকঢক করে পানি টেনে নেন। তারপর আবার বুকে হাত দিয়ে বসে থাকেন। উনার চোখমুখ কুচকে থাকে তীব্র ব্যথায়। পূরবী উত্তর জানার পরেও ছুটে আসে প্রশ্ন করতে। ছলছল চোখে ভাঙা কণ্ঠে প্রত্যেকদিন জিজ্ঞেস করে,
” কোন খোঁজ পেয়েছেন আঙ্কেল?”
জাবিদ সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে না সূচক মাথা নাড়েন। তারপর কি একটা চিন্তা করতে থাকেন। উনার চশমা অস্বচ্ছ হতে থাকে ক্রমাগত। লতিফা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। পূরবী ধীরপায়ে রুমে চলে আসে। বিছানায় বসে কাঁদে। তোহার ছবি বুকে নিয়ে ডুকরে কাঁদে। মাঝে মাঝে ধমকায়,” কোথায় হারিয়ে গেলি তুই? এখনো কেন ফিরে আসছিস না? আর কত জ্বালাবি? মা-বাবাকে মেরে ফেলতে চাস? আমিও মরে যাই তোর জন্য? তারপর না হয় আমাদের কবর দিতে ফিরে আসিস!”
পূরবীর বুকফাটা কান্না থামতে চায়না। আগে লাভলী কাঁদলে পূরবী শক্ত হাতে সামলে রাখতো। সান্ত্বনা দিতো, শক্তি যোগাতো। এখন লাভলী আর কাঁদেন না। উনি পাথরের মতো হয়ে গেছেন। কিন্তু পূরবী কাঁদে। সে আজ-কাল বড্ড বেশি মিস করে তোহাকে।
প্রতিদিন মনে আতঙ্কের দহন নিয়ে খবরের কাগজ খুলেন জাবিদ সাহেব। উনার হৃদয় ততক্ষণ ধুকধুক করে কাঁপতে থাকে যতক্ষণ উনি নিউজপেপার পড়েন। মনে দানা বাঁধে অনাকাঙ্ক্ষিত শংকা। কখন জানি ধেয়ে আসে দুঃসংবাদ। দীর্ঘ তিনমাস ছোট্ট মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই। কি এমন হয়েছে তার সাথে? মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেছে? ইদানীং কেউ মিষ্টি গলায় বাবা বলে ডাকেনা। কলেজে যাওয়ার জন্য রিকশা ভাড়া চাইতে আসেনা। জাবিদ সাহেবের নখ বেড়েছে। চুল- দাড়ি বড় হয়েছে। তোহা থাকলে ধমকি-ধামকি দিয়ে সেলুনে পাঠাতো।বারান্দায় বসে কত যত্ন করে নখগুলো কেটে দিতো।সেজন্য আবার বকশিস হিসেবে টাকাও ঝাড়তো। যখনি তোহার টাকার দরকার হতো তখনি বাবার সেবা-যত্ন শুরু করতো। কাপড় ধুয়ে দিতো। জুতা পালিশ করতো। কফি বানিয়ে দিতো। অতীত মনে পড়লে জাবিদ সাহেবের বুক খা খা করে। তার রাজকন্যাটি আর নেই। বাবা বলে আর ডাকে না। বাড়িটা তাকে ছাড়া মরুভূমির মতো। বাবা-মা’র কথা কি একবারো মনে পড়ে না তার? মেয়েটা কি অভিমান করেছে?
নীলাভ্র প্রতিদিন তোহাকে খুঁজতে বের হয়। দিনে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা নীলাভ্র ব্যয় করে তোহাকে খুঁজতে। প্রতিদিন একবার করে থানায় খোঁজ নেয়। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো নীলাভ্র অপরাধে
দগ্ধ হয়। তোহা যখন বলেছিল ওর সাথে থাকতে, নীলাভ্র কেন থাকলো না? কেন তোহাকে ফেলে চলে গেল? যদি না যেতো তাহলে হয়তো তোহা সুরক্ষিত থাকতো। তোহার হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সব দায় নীলাভ্র নিজের ঘাড়ে নিয়ে রেখেছে। সব দোষ তার। তোহার আর্তনাদ এখনো নীলাভ্রর কানে বাজে। নীলাভ্র প্রায় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে তোহা কাঁদতে কাঁদতে ওকে ডাকছে। আর্তনাদ করে বলছে, যেও না নীল ভাইয়া। প্লিজ আমার সাথে থাকো।”
নীলাভ্রর অদ্ভুত যন্ত্রণা হয়। মারুফা ইয়াসমিনের ধারণা নীলাভ্র তোহার প্রেমে পড়েছে। নাহলে বাহিরের একটা মেয়ের জন্য কিসের এতো আকুলতা তার ছেলের? অথচ নীলাভ্র যে অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছে সেই খবর কেউ রাখেনা।

একদিন সকালে, বড় একটা গাড়ি বিকট শব্দ করে জাবিদ সাহেবের ভবনের সামনে এসে থামলো। লাভলী তখন বারান্দায় কপালে হাত রেখে বসেছিলেন। চোখের পানি শুকনো। পূরবী বড়খালাকে দুপুরের খাবার বিকালে খাওয়াচ্ছে। মানুষটা আজ-কাল খাওয়া দাওয়া করতেই চায়না একদম। তাকে খাওয়াতে গেলে নানান ধানাইপানাই সহ্য করতে হয়। পূরবী এই কঠিন কাজটা প্রতিদিন করে। তো পূরবী যখন লাভলীর সাথে খাওয়া নিয়ে তর্ক করছিল তখনি বড় গাড়িটা থামার শব্দ হয়। দুজনেই জানালার বাহিরে তাকালো। তোহা গাড়ি থেকে নামে। ওর গায়ে মেরুন রঙের শাড়ি। উপরে নীল একটা শাল জড়ানো। কাধ পর্যন্ত চুলগুলো আরেকটু লম্বা হয়েছে। খুলে রেখেছে চুল। অপর পাশ থেকে নামল খুব লম্বা, ফরসা, সুদর্শন দেখতে একটা অচেনা ছেলে। চোখে স্কয়ার ফ্রেমের চশমা। ছেলেটি কাছে এসে তোহার হাত ধরল। তারপর দুজন মেইন গেইট দিয়ে ঢুকে গেল। পূরবী আর লাভলী স্তব্ধ হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকেন। তারপর হঠাৎ পূরবী দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। লাভলী মূর্তির মতো বসে থাকেন। তারপর অসাড় শরীর নিয়ে ধীরপায়ে হেটে যান। যতক্ষণ উনি হাটেন, ততক্ষণ উনার বোধশক্তি কাজ করেনা। পূরবী দরজা খোলার পাঁচমিনিট পরই তোহা আর অপরিচিত ছেলেটা দরজায় এসে দাড়ালো। পূরবী হা করে তাকিয়ে থাকে। বিস্ময়ে টু শব্দ করতে পারেনা। রান্নাঘর থেকে লতিফা উঁকি দেয়। লাভলী পূরবীর পেছনে এসে দাঁড়ায়। তোহা মাকে দেখে মাথা নিচু করে ভীতগলায় বলল,
” মা, আমি বিয়ে করেছি। ওর নাম, শাহভীর আমীর হোসাইন খান। আমার স্বামী।”
শব্দটা তিনবার প্রতিধ্বনিত হয় দেয়ালে দেয়ালে। লাভলী হঠাৎ হাত-পা ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়েন। পূরবী আর লতিফা ছুটে এসে দুইদিক থেকে লাভলীকে ধরল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here