ধূসর রঙে আকাশ পর্ব_৫৮

0
1239

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫৮
লিখা: Sidratul Muntaz

তোহা বিছানায় মনমরা হয়ে বসে আছে। বাড়িজুড়ে রমরমা বিয়ের আয়োজন চললেও তোহার ছোট্ট ঘরটিতে গাঢ় নিস্তব্ধতা। তোহা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তিরানের দেওয়া আওয়ার গ্লাসটির দিকে। প্রথম কাঁচের গোলকের বালি সেই কবেই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ তো আর ফিরে এলো না। তবুও তোহার মনে কিঞ্চিৎ আশা, কেউ ফিরবে। এখনো এমন আশা মনে পুষে রাখার কোনো মানে আছে কিনা তোহা জানে না। দরজায় মৃদু আওয়াজ হলো, কেউ ভিতরে আসছে। তোহা একটু নড়েচড়ে বসলো। পূরবী তোহাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বললো,
” তুই এখনও শাড়িটাও পড়লি না? সময় নেই তো হাতে। জলদি কর!”
তোহা জায়গা থেকে একটুও নড়লো না। পূরবীর দিকেও তাকালো না। একইভাবে বসে আছে। চেয়ে আছে আওয়ার গ্লাসটির দিকে। পূরবী বিরক্তি নিয়ে হাফ ছাড়লো। আজকে সে জমকালো সাজ দিয়েছে। মাথায় পদ্মফুলের গাজরা পড়েছে। কিছুটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে, কিন্তু পূরবীর বেশ ভালোই লাগছে। নীলাভ্রর পদ্মফুল খুব পছন্দ। তোহার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে নীলাভ্র এসেছে৷ সন্ধ্যায় বিয়েতেও আসবে। তখনও পূরবী পদ্মফুল দিয়ে সাজবে। রিম্মি যেহেতু আর নীলাভ্রর জীবনে নেই ওকে নতুন করে পাওয়ার স্বপ্ন পূরবী দেখতেই পারে। এতে দোষ কই? পূরবী আয়নায় তাকিয়ে চুল ঠিক করতে করতে খোশমেজাজে বললো,
” আমাকে কেমন লাগছে তোহু?”
তোহা উত্তর দিলনা। যেনো প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি। পূরবী কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বললো,
” আচ্ছা তোর প্রবলেমটা কি? অস্ট্রেলিয়া তোকে পাঠানো হয়েছিল মাথা থেকে আমীরের ভূত নামাতে। সেই ভূত নেমেছে কিনা জানিনা, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নতুন করে আরও একটা ভূত অস্ট্রেলিয়ার বটগাছ থেকে তোর ঘাড়ে উঠে এসেছে৷ সেটা হচ্ছে এই আওয়ার গ্লাসের ভূত। সারাদিন একদৃষ্টিতে একটা জিনিসের দিকে কিভাবে তাকিয়ে থাকে মানুষ? তোর কি ক্লান্ত লাগে না?”
তোহা এবারও কিছু বললো না। পূরবীকে ও সম্পূর্ণ ইগনোর করছে। প্রয়োজন ছাড়া ইদানীং তোহা একদম কথা বলে না৷ সারাদিন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এইযে বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে, এই বিয়েতে ওর বিন্দু পরিমাণ উৎসাহ নেই। কিন্তু তবুও বিয়েটা সে করছে। একপ্রকার জোর করে বাসার সবাইকে রাজিও করিয়েছে। যদি বিয়ে করে তাহলে হাসাদকেই করবে। নাহলে কোনোদিন বিয়েই করবে না, এমনও বলেছে। সবাই অবশ্য তোহার বিয়ের সিদ্ধান্তে খুশি। কিন্তু হঠাৎ একটা অপরিচিত ভিনদেশী ছেলেকে পাত্র হিসেবে মেনে নিতে সবারই একটু অসুবিধা হচ্ছে। তোহা অস্ট্রেলিয়া ছিল মাত্র দুইদিন। এই দুইদিনেই আমীরকে ভুলে সে অন্য একটা ছেলের প্রেমে পড়ে গেল। ব্যাপারটা আজব। শুধু আজব না অনেক বেশিই আজব। নীলাভ্র আর তোহা একসাথে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছিল। তোহা ভুলে গেল আমীরকে আর নীলাভ্র ভুলে গেল রিম্মিকে। রিম্মির সাথে নীলাভ্রর বিয়েটাও আর হলো না। ওদের সম্পর্ক ভাঙনের কারণটা কেউ জানেনা। তোহা জানে, কিন্তু সে কাউকে বলেনি। পূরবী বললো,
” আচ্ছা তোহা, তোর কি আসলেই বিয়ে করার ইচ্ছা আছে? সত্যি করে বলতো, টার্কিশ ছেলেটা আবার ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করছে না তো?”
তোহার মুখে এতোক্ষণে বুলি ফুটলো,” আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে কিছু করানোর সাধ্য কারো নেই। আমি যা করি সব নিজের ইচ্ছায়।”
” আমীর ভাইয়াকেও কি নিজের ইচ্ছায় ভুলে গেছিস?”
তোহা খুব রেগে অগ্নিময় দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। পূরবী একটা ঢোক গিলে বললো,
” স্যরি। আন্টি আমাকে পাঠিয়েছে তোর সাজ-গোজ কতটুকু শেষ হয়েছে দেখার জন্য। তাড়াতাড়ি, ত্রিশমিনিটে আমাদের নিচে যেতে বলেছে।”
” তুই যা। আমি ত্রিশমিনিটেই আসছি।”
” ঠিকাছে।”
পূরবী গেল না, দাঁড়িয়ে আছে। তোহা জানে পূরবী আরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু তোহা ওকে কিছুই বলবে না। বিছানা থেকে উঠতে নিয়ে আওয়ার গ্লাসটি তোহার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। তোহা আৎকে উঠলো একদম। পূরবীর হাসি পাচ্ছে, যা হয়েছে একদম ভালো হয়েছে। এই ঠুনকো জিনিসটির প্রতি তোহার এতো যত্ন পূরবীর মোটেও সহ্য হয়না। কি এমন জিনিস যে সারাক্ষণ হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে? তোহা ছলছল চোখে ভাঙা টুকরোগুলো তুলছে৷ তিরানের শেষ স্মৃতিটাও সংরক্ষিত রাখতে পারলো না সে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তোহার। হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার জন্য আজ-কাল অনেক বেশি মায়া লাগে তোহার। কাচের টুকরোগুলো মেঝে থেকে তোলার সময় কাঠের ছোট্ট বাটখারার ভেতরে একটা সাদা কাগজ খুঁজে পেল তোহা। কাগজটিতে নীল কালি দিয়ে খুব সুন্দর করে লেখা,
‘Do what your mind wants you to do.’
তোহা বিস্ময় নিয়ে একধ্যানে তাকিয়ে রইল লেখাটির দিকে। এটা হুবুহু তার নিজের হাতের লেখা। তিরানের দেওয়া জিনিসে ওর লেখার ম্যাসেজ আসলো কিভাবে? তাছাড়া তোহার তো মনে পড়েনা সে এমন ম্যাসেজ জীবনে লিখেছিল কিনা। লেখাটির অর্থ হলো, সেটাই করো যা তোমার মন করতে চায়। মনের ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তোহার মন এই মুহুর্তে চাইছে বিয়েটা ভেঙে দিতে। কিন্তু হুট করে এই সিদ্ধান্তের কথা মা-বাবাকে জানালে বিষয়টা কেমন দেখায় এই ভেবেই সে কিছু করতে পারছিল না। তবে এখন সে অবশ্যই করবে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করা উচিৎ না। তোহাও এই বিয়ে করবে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে খুব জোরালো কণ্ঠে বললো,
” মাকে ডাক পূরবী।”
পূরবী থতমত খেয়ে বললো,
” কেনো? আন্টি তো খুব জরুরী কাজে ব্যস্ত আছে।”
তোহা শব্দ করে বললো,” আমার কাজ এর চেয়েও জরুরী। এখনি ডাক মাকে।”
পূরবী আর টু শব্দ করলো না। চলে গেল সৈয়দা লাভলীকে ডাকতে। তোহা কপালে একহাত রেখে বিছানায় বসলো। ওর কেমন যেনো লাগছে। আমীররা অন্তরীক্ষে চলে যাওয়ার পর তোহা আর নীলাভ্র জানতে পারে ওদের মেমোরি ক্লিন করে বাংলাদেশে পৌছে দেওয়া হবে৷ কারণ রিসার্চ সেন্টারের অনেক সিকরেট ওরা জেনে গেছিল। তাই প্রতিষ্ঠানের প্রাইভেসি রক্ষার্থে ওরা তোহা-নীলাভ্রর ব্রেইন থেকে অনেক স্মৃতি মুছে দিবে। এমনও হতে পারে, রিম্মি- আমীরের নামটাও ওদের মনে থাকবে না। তোহা এই সিদ্ধান্তে রাজি হয়নি। আমীরের স্মৃতিগুলো তার বাঁচার অবলম্বন। এগুলো কি করে হারিয়ে যেতে দিবে সে? তোহা সংস্থার কাছে অনুরোধ করে সে এখানে এসে যা যা জেনেছে তা কখনো কাউকে বলবে না। ওদের প্রাইভেসি নষ্ট হয় এমন কাজও করবে না। কিন্তু কেউ তোহার কথা শুনছিল না। তখন হাসাদ তোহাকে সাহায্য করে। ওদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়। হাসাদ তোহা-নীলাভ্রর ব্রেইন থেকে কোনো স্মৃতি মুছতে দিবে না। ওদের সেইফলি রিসার্চ সেন্টার থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করবে কিন্তু বিনিময়ে তোহা যেনো হাসাদকে বিয়ে করে। এই কথা শুনে প্রথমে তোহা প্রচন্ড রেগে গিয়েছিল। পরে হাসাদই ওকে বুঝায়, আমীর তোহার দায়িত্ব হাসাদের কাছে দিয়ে গেছে। আমীর জানতো তো আর কখনও ফিরবে না। তাই তার শেষ অনুরোধ তোহা যেনো হাসাদকে বিয়ে করে সুখে থাকে। এতে আমীরও সুখে থাকবে। তোহা একথা শুনেই বিয়েতে রাজি হয়। আমীরের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য সে এইটুকু ত্যাগ করতেই পারে। তারপর বাংলাদেশে এসে মা-বাবাকে বিয়ের জন্য রাজি করায় তোহা৷ সবাই প্রথমে খুব অবাক আচরণ করলেও পরে রাজি হয়। হাসাদের সাথে তোহার বিয়েটা কনফার্ম হয়ে যায়। একটু পরেই তোহার গায়ে হলুদ, সন্ধ্যায় ওদের বিয়ে। কিন্তু তোহা এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিয়েটা করবে না। নিজেই বিয়ের কথা বলে এখন আবার নিজেই বিয়েটা ভাঙতে চাইছে। মা-বাবা কি তোহার কথা শুনবে? সৈয়দা লাভলী রুমে আসতেই তোহা মায়ের পা জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করলো। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করতে চায়না। এই বিয়ে না আটকালে সে বিষ খাবে এমন হুমকিও দিয়ে বসলো। লাভলী আবার এই ক’দিনের হবু মেয়ে জামাইয়ের খুব ভক্ত হয়ে গেছেন। যেকোনো সমস্যায় উনার হাসাদকে স্মরণ করতে ইচ্ছে হয়। এবারও তাই করলেন। এক মুহুর্ত দেরি না করে হাসাদকে ফোন করে চলে আসতে বললেন। উনার ধারণা হাসাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেই তোহা ঠিক হয়ে যাবে।
তোহা আর হাসাদ এখন ফাঁকা রুমে বসে আছে। বিছানার একপ্রান্তে হাসাদ অন্যপ্রান্তে তোহা। হাসাদ হালকা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললো,
” তোহা, আপনি কি সিরিয়াস? আমাকে বিয়ে করবেন না?”
” না, আমি আপনার জীবন নষ্ট করতে চাই না। আমাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ।”
হাসাদ হাসার চেষ্টা করে বললো,
” এখানে জীবন নষ্ট করার প্রশ্ন আসছে কোথ থেকে?”
” আমি আমার স্বামীকে অনেক ভালোবাসি। ওকে ছাড়া অন্যকাউকে ভালোবাসা আমার দ্বারা সম্ভব না। ওর জায়গায় অন্যকাউকে আমি চিন্তাও করতে পারিনা৷ আপনার সাথে বিয়ে হলে আমি কখনও সুখী হবো না। আর আমি নিজেই যদি সুখী না হই তাহলে আপনাকে কিভাবে সুখে রাখবো? আমাকে বিয়ে করলে আপনার জীবন নষ্ট হবেই।”
” হোক নষ্ট। ”
হাসাদ খুব রূঢ় কণ্ঠে বললো। তোহা তাকাতেই হাসাদ গলার স্বর নরম করে ফেললো। মুখে হাসি নামিয়ে বললো,
” মানে আমার জীবন নষ্ট হলে হোক। আমি আপাতত নিজের জীবন নিয়ে ভাবছি না। আমি শুধু আপনাকে ভালো রাখতে চাই তোহা। আপনি আমার কাছে আমীরের রেখে যাওয়া একটা আমানতস্বরুপ। এই আমানতের খিয়ানত আমি করতে চাইনা।”
” আমিও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনাকে বিয়ে করতে চাইনা।”
” তাহলে প্রথমে কেনো রাজি হলেন? আপনার জন্য আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছি। বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষ। পরিচিতরা সবাই জানে আপনার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। এখন হঠাৎ করে আপনার মুড সুইং হলো আর বিয়েটা ভেঙে দিলেন। এতোই সহজ সবকিছু?”
” সেজন্যই তো আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে। জানি আমারই দোষ। এ বিয়েতে রাজি হওয়াই সবচেয়ে বড় দোষ আমার। আমি খুব দুঃখিত।”
” ক্ষমা চাইলেই সব ঠিক হয়ে যায়? ঠিকাছে তাহলে আমিও ক্ষমা চাইছি। আমাকে ক্ষমা করবেন মিস তোহা কারণ আমি আপনাকে জোর করেই বিয়ে করবো৷ সেজন্য অগ্রীম স্যরি।”
তোহা চমকে তাকালো। হাসাদ মৃদু হাসলো। তোহা গভীর আক্রোশে বললো,
” মরে গেলেও বিয়ে করবো না আমি। দেখে নিবো আপনি কি করতে পারেন।”
হাসাদ উঠে চলে যেতে যেতে পেছনে তাকিয়ে বললো,” দেখা যাবে, কার দৌড় কতদূর।”
তোহার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হচ্ছে হাসাদকে। এখন তো মনে হচ্ছে হাসাদ যা বলেছে সবই মিথ্যা। আমীর আসলে কখনোই চায়নি তোহা হাসাদকে বিয়ে করুক। এটা হাসাদের বানানো কথা। সে তোহাকে বিয়ে করার জন্য মিথ্যে গল্প সাজিয়েছে। রাগে, ক্ষোভে তোহা ফ্লোরে বসে গেল।জোরে একটা চিৎকার দিল।

ঘরোয়াভাবে আয়োজন হচ্ছে বিয়ের। পাত্রপক্ষ এখনও আসেনি৷ চারদিকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পূরবী আর শিউলি মিলে তোহাকে বউ সাজিয়েছে। তোহা পুতুলের মতো খাটে বসে আছে। চেহারায় কোনো প্রাণ নেই। চোখের পলক নেই। শিউলি খুশিতে ডগমগ গলায় বললো,
” আফা, আপনেরে যে কি সুন্দর লাগতাসে!”
কথাটা শুনে তোহার শরীর জ্বলে উঠলো। সে হঠাৎ শিউলিকে চড় দিল। চড় খেয়ে শিউলির মুখের হাসি উঁবে গেল। সে অবাক হয়ে পূরবীর দিকে তাকায়। পূরবী আঙুলের ইশারায় শিউলিকে বলে চুপ থাকতে। তোহার মেজাজ গরম। শিউলি আর পূরবী তোহাকে এইভাবে রেখেই বেরিয়ে যায়। তোহা মোবাইল বের করে নীলাভ্রকে কল দিল। বললো ছাদে দেখা করতে, খুব জরুরী দরকার। নীলাভ্র আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিল। তোহা বাসার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বিশমিনিটের মধ্যে ছাদে উপস্থিত হয়। নীলাভ্র আগে থেকেই ওর অপেক্ষায় ছিল। তোহা ছাদে আসতেই নীলাভ্র বললো,
” বল কি হয়েছে?”
তোহা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,” আমাকে সাহায্য করো ভাইয়া, আমি পালাবো?”
নীলাভ্র কপালে গুরুতর ভাজ ফেলে বললো,” মানে?”
” আমি এই বিয়েতে রাজি না। মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না বিয়েটা করতে। মনে হচ্ছে এই বিয়ে করার চেয়ে মৃত্যু ভালো। ”
” কি বলছিস এসব?”
” ঠিকই বলছি। আর তুমি জানো, আজকে সকালে হাসাদের সাথে আমার কথা হয়েছিল। আমি ওকে বলেছি বিয়ে করতে পারবো না। অথচ ও কি বললো জানো? আমাকে নাকি জোর করে হলেও বিয়ে করবে। সে কতটা খারাপ চিন্তা করতে পারছো? এখন তো আমার মনে হচ্ছে সব মিথ্যে। আমীর আসলে কখনোই চায়নি ওর সাথে আমার বিয়ে হোক। হাসাদ সব বানিয়ে বলেছে।”
নীলাভ্র ফিক করে হেসে বললো,” এই কথা আমিও তোকে বহুবার বলেছিলাম তোহা। কিন্তু তুই কি কখনও আমার কথা শুনেছিস? এখন আমাদের হাতে আর কিচ্ছু নেই। বিয়েটা তোকে করতেই হবে।”
” কেনো করবো? আমি জীবনেও এই বিয়ে করবো না। তুমি আছো না? তুমি আমাকে পালাতে সাহায্য করবে। চলো আমাকে নিয়ে পালাও।”
তোহা নীলাভ্রর হাত ধরলো। নীলাভ্র বললো,
” আরে, তোকে নিয়ে আমি কোথায় পালাবো? তাছাড়া বাসার চারদিকে হাসাদ ইনভিসিবল রোবট দ্বারা প্রটেক্ট করে রেখেছে। আমরা পালানোর আগেই ধরা পড়ে যাবো। রোবট ফোর্স আমাদের আটকে ফেলবে।”
তোহা সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
” তুমি কিভাবে জানলে?”
নীলাভ্র হঠাৎ উদ্ভট শব্দে হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে পিছিয়ে যেতে লাগলো। অনেকটাই দূরে চলে গেল। তোহার দৃষ্টি সীমার বাহিরে। তোহা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মুহুর্তেই নীলাভ্রর রূপ বদলে হাসাদ বেরিয়ে এলো। তোহা ভয়ে দুইহাতে মুখে চেপে অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করলো। হাসাদ হাসতে হাসতে বললো,
” পাগলামী বন্ধ করুন তোহা। আই লভ ইউর সুইটিশ এটিটিউড। কিন্তু সিরিয়াস মোমেন্টে এসব ভালো লাগছে না। চুপচাপ ঘরে যান।”
তোহা ভয়ে আর উদ্বেগে গলা দিয়ে শব্দ পর্যন্ত বের করতে পারছে না। নীলাভ্র কি করে হাসাদ হয়ে গেল? এটা কিভাবে সম্ভব? হাসাদ তোহার চারিপাশে ঘুরতে ঘুরতে বললো,
” আপনার ফোনে একটা বিশেষ ডিভাইস সেট করা আছে। সেটা কি জানেন? এর মাধ্যমে আপনি যখন যে নাম্বারেই ফোন করেন, সবসময় কলটা আমার কাছেই আসবে আর আমিই রিসিভ করবো৷ তখন নীলাভ্রর নাম্বারে ফোন করে আপনার মনে হয়েছে আপনি নীলাভ্রর সাথে কথা বলছেন। কিন্তু আসলে ওইটা নীলাভ্র না, আমিই ছিলাম। আর একটু আগে আমার জায়গায় যে নীলাভ্রকে দেখলেন, এটা একটা ইল্যুশন। আপনার মনের বিশ্বাস থেকে মনে হয়েছে আপনি নীলাভ্রকে দেখছেন। কিন্তু নীলাভ্র রূপে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম আপনার সামনে। এটা কেনো করলাম জানেন? ওইযে বললেন না জরুরী কথা? আপনার অতি প্রয়োজনীয় জরুরী কথা শুনতেই এসেছিলাম। এখন বুঝলাম আপনার জরুরী কাজটি হলো পালানো। কিন্তু এটা যে অসম্ভব মিস তোহা! আপনি বৃথা চেষ্টা করছেন। পালিয়ে আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান আমি আপনাকে ঠিকই খুঁজে বের করবো। আর নীলাভ্র? সে আপাতত হসপিটালে আছে। ওকে নিয়ে টেনশন করবেন না।”
তোহা তীব্র ক্রোধ নিয়ে উচ্চারণ করলো,” শয়তান!”
অতঃপর হাসাদের চোখেমুখে খামচি মারতে চাইলো। কিন্তু হাসাদ তোহার দুইহাত শক্ত করে ধরে ফেললো। তোহা ওর হাতে কামড় দিতে চাইলো, হাসাদ সেই সুযোগটাই দিল না। তোহার হাত মুচড়ে ওকে সামনে ঘুরিয়ে পেছনদিক থেকে কানে কানে বললো,
” আপনার কাছে দু’টো রাস্তা খোলা আছে। হয় বিয়ে করো, না হয় মারো।”
” আমি দ্বিতীয় রাস্তাটাই বেছে নিলাম। মরবো, তবুও আপনার মতো মানবরূপী জানোয়ারকে বিয়ে করবো না।”
” এক মিনিট। আমি মরতে বলিনি, বলেছি মারতে। মানে মার্ডার। আর কার মার্ডার জানেন? আপনার অতি প্রিয়, অতি ভালোবাসার নকল স্বামীর মার্ডার।”
তোহা কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। হাসাদের সাথে ধস্তাধস্তি করাও থামিয়ে দিল। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হাসাদ পুনরায় বললো,
” জানেন আমীর এখন জীবনের মাঝনদীতে আটকে আছে। হয় এসপার নাহয় ওসপার। যদি আমাদের বিয়েটা হয়, তাহলে এসপার। মানে আমীর বেঁচে যাবে। আর যদি বিয়ে না হয় তাহলে ওসপার। আমীর মরবে। তাই বলা যায় ওর বাঁচা-মরা আপনার হাতে।”
তোহা চোয়াল শক্ত করে বললো,” আপনি আবারও মিথ্যে বলছেন। আমীর অন্তরীক্ষে চলে গেছে। সে আপনার নাগাল থেকে মুক্ত। আপনি চাইলেও ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না।”
” উহুম, আমীর ইজ ব্যাক। সে স্পেস থেকে ফিরে এসেছে মিস তোহা। এখনও খবর পান নি? অবশ্য খবর না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরটা আমি আপনার কানে পৌছাতেই দেইনি। ভেবেছিলাম বিয়ের প্রথমরাতে আপনাকে সারপ্রাইজ দিবো।”
হাসাদের আর একটা কথাও তোহার কানে গেল না। কেবল একটা বাক্যই মস্তিষ্কে ঝনঝন করে বাজছে, আমীর ইজ ব্যাক! তোহার জবাব না পেয়ে হাসাদ আলতো করে ধাক্কা দিল। তোহা নড়ে উঠলো। ঢোক গিলে বললো,
” আমীর কি সত্যি ফিরে এসেছে?”
” আমি কি আপনার সাথে উপহাস করছি? বিশ্বাস না হলে প্রমাণ দিতে পারি। আপনার লাগবে প্রমাণ?”
” অবশ্যই লাগবে, আপনার মুখের কথা আমি আর বিশ্বাস করিনা।”
হাসাদ হাসলো। তোহা খেয়াল করলো হাসাদের দাঁতগুলো আঁকাবাঁকা। ভয়ংকর লাগে দেখতে।

চলবে

( এই পর্বে শেষ হলো না। 😐তো কি হয়েছে? আগামী পর্বে শেষ হবে।😑 আর আগামী পর্বেও শেষ না হলে তার পরের পর্বে শেষ হবে! মানে শেষ কিন্তু হবেই।😅)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here