ধূসর রঙে আকাশ পর্ব_৫৯

0
1356

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫৯
লিখা: Sidratul Muntaz

তোহার চোখে পট্টি বেঁধে হাসাদ কোথায় যেনো নিয়ে এসেছে। জায়গাটা বিশাল, গ্যারেজের মতো। তোহা ভারী মাল-পত্র সরানোর আওয়াজ পাচ্ছে। একটু পর ওর চোখের পট্টি খুলে দেওয়া হলো। তারপর তোহা যেটা দেখলো সেটা দেখার পর ওর পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব হয়ে গেল। তোহা ঢলে পড়ে যাচ্ছিল, হাসাদ ওকে ধরে সোজা করলো। জেলখানার মতো একটা বদ্ধ ঘরে আমীরকে আটকে রাখা হয়েছে। ওর হাতে-পায়ে কয়েদীদের মতো শিকল। রক্তিম দৃষ্টি নিয়ে তোহার দিকে চেয়ে আছে আমীর। তোহার মাথাটা ঘুরছে। সে কপালে হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে দাঁড়িয়ে রইল। আমীর কি আসলেই ওর সামনে বসে আছে? নাকি এবারও কোনো ইল্যুশন? হাসাদ বললো,
” আজকে সকালেই স্পেস থেকে ফিরেছে বেচারা। বেচারা ওয়ার্ডটা কেনো বললাম জানো? ওর দূভাগ্য দেখে। অন্তরীক্ষ থেকে পৃথিবীর মাটিতে পা রাখার আগেই প্রেয়সীর বিয়ের খবর শুনতে হল বেচারাকে। এর চেয়ে দূর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? সো স্যাড!”
হাসাদের কণ্ঠে উপহাস। তোহা অসহায় মুখে আমীরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। পলক ফেললেই যেন জল গড়িয়ে পড়বে। হাসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” কথা বলো তোমরা।”
হাসাদ ওদের একা রেখে চলে গেল। তোহা একপা,দু’পা করে আমীরের দিকে হেঁটে যায়। সামনে খাচার মতো গ্রিল, তোহা সেই গ্রিল ধরে বসে পড়লো। আমীর তখনও ক্রোধানল চোখে তাকিয়ে আছে। ওর গলার শিরা রাগে দপদপ করে কাঁপছে। তোহা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
” এতো দেরি করে কেনো ফিরলেন আপনি?”
আমীর ক্রোধপূর্ণ গলায় বললো,” ফিরে না আসলেই খুশি হতে তাইনা?”
তোহা যেন আকাশ থেকে পড়লো। অবাক হয়ে করুণ গলায় বললো,
” আপনি ফিরে না আসলে আমি খুশি হতাম?”
আমীর উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তোহার দিকে তাকাতেও ঘৃণাবোধ করছে। তোহা বললো,
” আপনার অপেক্ষায় প্রত্যেকটা দিন আমার বছরের মতো কেটেছে। অপেক্ষার এই তিক্ত কষ্ট কিভাবে সহ্য করেছি তা শুধু আমি জানি। ”
” হ্যা সেটা দেখতেই পাচ্ছি। অনেক কষ্ট হয়েছে তোমার। এতোই কষ্ট হয়েছে যে মাত্র কয়েকটা দিনও অপেক্ষা করতে পারলে না। কি সুন্দর বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছো। একেবারে বিয়ের সাজে দেখতে হচ্ছে তোমায়। তাও এমন একজনের সাথে বিয়ে যে একটা বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান।”
আমীরের কণ্ঠে প্রগাঢ় অভিমান, অভিযোগের ছাপ।
তোহা একহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বললো,” এই বিয়েটা আমি করতাম না বিশ্বাস করুন। হাসাদ আমাকে বলেছিল এটা আপনার শেষ ইচ্ছা। আপনি ওকে বলে গেছেন আর কখনো ফিরবেন না। তাই আমি যেনো আপনাকে ভুলে ওকে বিয়ে করে সুখে থাকি। এতেই নাকি আপনি খুশি থাকবেন। তাছাড়া ও আমায় ব্ল্যাকমেইল করেছিল। বিয়ে না করলে আপনার সব স্মৃতি আমার ব্রেইন থেকে মুছে দিবে। আমি আপনাকে ভুলেতে চাইনি। আপনার স্মৃতি নিয়ে সারাজীবন বাঁচতে চেয়েছি।”
” তাহলে এই বুঝি তার নমুনা? আচ্ছা অগত্যা তোমার ব্রেইন থেকে আমার স্মৃতি মুছে দেওয়ার তো কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি তো এমনি আমাকে ভুলে গেছো। কতো জলদি ভুলে গেছো।”
” না ভুলিনি।”
তোহার নিঃশ্বাস আটকে গেল কথাটা বলতে গিয়ে। বার কয়েক শ্বাস নিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো,
” ভুলিনি বিশ্বাস করুন। আমার জীবনের এমন কোনো মুহুর্ত নেই যে মুহুর্তে আপনাকে মনে পড়েনি৷ একটা মুহুর্তের জন্যেও ভুলে থাকতে পারিনি আপনাকে। সারাদিন, সারারাত, পাগলের মতো কেঁদেছি। আপনাকে পাওয়ার তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে কেঁদেছি। শুধু একটিবার আপনাকে ছোঁয়ার জন্য আমি পৃথিবীও বাজি রাখতে পারি। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”
তোহা কথা শেষ করে হু হু করে কেঁদে উঠলো। আমীর কঠোরভাবে বললো,
” তাই যদি হয়, তাহলে এতো সহজে হাসাদকে বিয়ে করতে কিভাবে রাজি হলে তোহা? আমার কথা একবারও তোমার মনে পড়েনি?”
” পড়েছে, সত্যি মনে পড়েছে। সেজন্যই তো আমি রাজি হয়েছি বিয়েতে। নাহলে রাজি হতাম না।”
আমীর এমন একটা হাসি দিল যেনো তোহার মুখে কৌতুক শুনছে। আমীরের অবজ্ঞাসূচক হাসিটা তোহার বুকে গিয়ে বিধলো। কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। তার মনের কষ্টটা কিভাবে বোঝাবে সে আমীরকে? আমীর বললো,
” খুব ভালো। যাও এখন বিয়ে করো তোমার হবু বরকে। আমার সামনে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে কি হবে?”
” আমি ভুল করেছি। হাসাদকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে মস্তবড় ভুল করেছি। এটা আমার পাপ। আমি পাপী, তাই আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
আমীর দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে উদাসভাবে বললো,
” অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। যেতে পারো।”
তোহা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে চাইনা।”
আমীর আবার অবজ্ঞাসূচক হাসি দিল।তোহা গ্রিল স্পর্শ করে কিছুটা কাছে এসে বললো,
” আপনি চাইলেই আমরা আবার এক হতে পারি। পারিনা?”
আমীর নিরুত্তর রইল। তোহা বললো,
” আচ্ছা, তিরান কোথায়? রিম্মিআপু? ওরা সবাই কোথায়?”
” কেউ আসেনি।”
” কেনো?”
” হারিয়ে গেছে।”
” কিভাবে হারিয়ে গেলো?”
” জানিনা। আই উইশ আমিও ওদের মতো হারিয়ে যেতাম তোহা। তাহলে তোমাকে এইরূপে দেখতে হতো না।”
তোহার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। আমীর ওকে বারবার কেনো ভুল বুঝছে? সে আমীরকে বুঝাতে পারছে না কতটা ক্লেশ নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছিল সে। ওইরকম পরিস্থিতিতে তোহার ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতাই কাজ করছিল না। সে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। এখন তো সে বিয়েটা ভাঙতে চাইছে। কিন্তু হাসাদ ওকে জোর করে বিয়ে করবে। এটা কি আমীর জানেনা? তাহলে কেনো ওকে বাচাচ্ছে না? তোহা বললো,
” আমাকে বাঁচান প্লিজ। আমি হাসাদকে বিয়ে করতে চাইনা। কিন্তু ও আমাকে জোর করে বিয়ে করবে। আপনি আমাকে বাঁচান।”
আমীর শিকলে বাধা হাত দুটো তোহার দিকে তাক করে বললো,
” কার কাছে সাহায্য চাইছো তুমি? যে নিজেই বন্দী অবস্থায় আছে সে তোমাকে কিভাবে সাহায্য করবে? বরং পারলে তুমি আমাকে সাহায্য করো। আমাকে এই বন্দীশালা থেকে মুক্ত করো।”
তোহা অবাক হয়ে চারদিকে একবার তাকালো। ধরে থাকা লোহার গ্রিল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
” আসলেই তো, কে বন্দী করেছে আপনাকে? আপনি কিভাবে বন্দী হলেন? কেনো আপনাকে বন্দী করা হয়েছে?”
পেছন থেকে হাসাদ এসে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
” আপনার জন্যই ওকে বন্দী করা হয়েছে মিস তোহা। এখানে আসার আগে কি বলেছিলাম মনে নেই?আমীর এখন জীবনের মাঝনদীতে আটকে আছে। হয় এসপার নাহয় ওসপার। যদি আমাদের বিয়েটা হয়, তাহলে এসপার। মানে আমীর বেঁচে থাকবে। আর যদি বিয়ে না হয় তাহলে ওসপার। আমীর মরবে। তাই বলা যায় ওর বাঁচা-মরা সব আপনার হাতে। এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন। আমাকে বিয়ে করে আমীরকে বাঁচিয়ে রাখবেন? নাকি বিয়ে না করে ওকে মেরে ফেলবেন? চয়েস ইউর’স।”
তোহা চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। ধারালো কণ্ঠে বললো,
” আমি আপনাকে খুন করে ফেলবো।”
তোহা ধেয়ে গেল হাসাদের দিকে। দুইহাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাসাদের গলা চেপে ধরলো। তোহার কান্ডে হাসাদ হেসেও কুল পাচ্ছে না। হাসতে হাসতে বললো,
” আপনি আবারও প্রমাণ করলেন আপনি কত কিউট আর ইনোসেন্ট। এজন্যই আপনাকে এতো ভালো লাগে আমার। আই এম ইন লভ উইথ ইউ মিস তোহা।”
রাগে তোহার সম্পূর্ণ মুখ লালবর্ণ হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। চোখ দিয়ে ক্রোধ উপচে পড়ছে। হাসাদ আচমকা তোহাকে সামনে ঘুরিয়ে ওর হাত দুটি খুব শক্তভাবে পেছনে চেপে ধরলো। তোহা ব্যথায় মৃদু চিৎকার দেয়। ওইটুকু চিৎকারেই আমীর উঠে দাঁড়ায়। ভারী গলায় তর্জন করে বললো,
” হাসাদ, ওর গায়ে সামান্য আচড় কেটে দ্যাখ। তোকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো।”
হাসাদ অট্টহাসিতে মত্ত হলো। আমীর দুইহাতে লোহার গ্রিল মুচড়াচ্ছে। সে জানে তার দ্বারা এই মুহুর্তে কিছুই করা সম্ভব না। তাইতো হাসাদ হাসছে। হাসাদ একটু পর হাসি থামিয়ে রসিক গলায় বললো,
” ও তাই ? তাহলে তুই বরং তোহাকে বলে দে। আমাকে বিয়ে করতে যেনো রাজি হয়। তাহলেই প্রবলেম সোলভড।”
আমীর তোহার দিকে চেয়ে বললো,” তোহা, আমি যদি মরেও যাই তাও তুমি এই বেঈমানকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।”
তারপর হাসাদের দিকে তাকিয়ে বললো,” বলে দিয়েছি।”
হাসাদের চোখমুখের অবস্থা কঠিন দেখা যাচ্ছে। সে তোহার উদ্দেশ্যে বললো,
” তুমি কি বলো তোহা?”
তোহা বললো,” জোর করেও যদি আপনি আমাকে বিয়ে করেন তাহলে আমার লাশ যাবে আপনার সাথে। জীবন্ত আমি কখনওই না।”
” ঠিকাছে তাহলে তোমার ইচ্ছাই পূরণ হোক।”
হাসাদ এই কথা বলে তোহাকে টানতে টানতে কোথায় যেন নিয়ে গেল। আমীর কারাগার থেকে চিৎকার শুরু করলো,
” তোহা! হাসাদ ওর কিছু হলে আই সুয়্যার আমি তোকে খুন করে ফেলবো। আই উইল কিল ইউ!”
আমীর লোহার গ্রিলে জোরে জোরে ধাক্কাচ্ছে। তাই ঝনঝন শব্দ হচ্ছে৷ একপর্যায়ে জোরে একটা লাথি দিল গ্রিলে। খুব তীক্ষ্ণ আওয়াজ সৃষ্টি হলো। হাসাদ প্রথমে তোহার দুইহাত পেছনদিকে বেধে নিল। তারপর একটা পানিপূর্ণ বিশাল এক্যুরিয়াম প্রস্তুত করলো। তোহার মুখটা ধরে নিষ্ঠুর গলায় বললো,
” তুমি আমার না হলে আর কারো হতে পারবে না। আমাকে ক্ষমা করো তোহা।”
হাসাদ কথা শেষ করেই তোহাকে কোলে নিয়ে ওই পানিপূর্ণ এক্যুরিয়ামে ছেড়ে দিল। তখন হাতের বাধনটাও খুলে দিল। তোহা দুইহাতে সাতরে উঠার বৃথা চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। ডানাহীন পাখির মতো ছটফট করছে। হাসাদ উপর থেকে এক্যুরিয়ামের মুখ বন্ধ করে দিল। পানিপূর্ণ এক্যুরিয়ামটি দুইহাতে ঠেলে আমীরের সামনে এনে থামলো হাসাদ। পাশে একটা ছোট্ট স্টপওয়াচ রেখে বললো,
” খুব বেশি না, মাত্র পাঁচমিনিট। তারপরই তোর তোহা ফুসস। দম আটকে তোর সামনেই হাসফাঁস করতে করতে মরে যাবে। আর তুই শালা কিচ্ছু করতে পারবি না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবি। আপাতত তোর জন্য এর চেয়ে ভালো শাস্তি আর হতে পারেনা।”
হাসাদ আফসোসের শিষ বাজিয়ে বললো,
” ইশশ, খুব কষ্ট নারে? চিন্তা করিস না৷ তোহার মৃত্যুর পর তোকেও ওর কাছে পাঠিয়ে দিবো। কিন্তু তোর মৃত্যুটা হবে তার চেয়েও ভয়ানক।”
হাসাদ কথা শেষ করে চলে যাচ্ছে। আমীর অসহায় কণ্ঠে ডাকলো,
” হাসাদ, হাসাদ তুই এটা করতে পারিস না প্লিজ। প্লিজ ওকে ছেড়ে দে হাসাদ। হাসাদ!”
শেষে তীব্র গর্জন করে ডাকলো আমীর। ওর গলার সমস্ত রগ ফুলে উঠলো। তোহা পানির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্যেও শ্বাস নেওয়ার উপায় নেই। এর চেয়ে করুণ অবস্থা আর কি হতে পারে? আমীর হাত বাড়িয়ে কাচের এক্যুরিয়ামটা ছোয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। হতাশ হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো আমীর। তার দুইচোখে অশ্রুধারা বইছে। সত্যিই কি তোহা তার চোখের সামনেই ছটফট করতে করতে মারা যাবে? আর সে কিচ্ছু করতে পারবে না? তোহা কাঁচের দেয়ালে হাত দুইহাত ঠেকালো। আমীর সেটা দেখে খুব কষ্টে গ্রিল থেকে হাত বের করে তোহার হাতের বরাবর নিজের হাত রাখলো। মনে হচ্ছে ওরা একজন-আরেকজনকে স্পর্শ করতে পেরেছে। দু’জনের মুখেই হাসি ফুটে উঠলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here