ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (বারো)

0
119

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(বারো)
লাইট গ্রে কালারের বড়ো সোফাটার উপর সাটিন কাপড়ের নানা রঙের কুশন সাজিয়ে রাখা আছে। লাল, সবুজ, বেগুনি, মেরুন, গোলাপি, নীল.. অনেক রকম রঙ। অরণ্য বসে বসে ঘরখানা দেখছিল। ঘরের মালকিনের রুচি আছে বোঝা যায়। এক পাশের তাকে নানারকম শো-পিস রাখা। ঘরের কোনায় কোনায় মানানসই টবে পাতাবাহার গাছ।
মালবিকা দাশগুপ্ত এসে বললেন, “তোমার জন্য হট চকোলেট আর চিকেন চিজ স্যান্ডউইচ বললাম তাহলে এখন। আজ লাঞ্চ আর ডিনারটাও করে নাও এখানে।রাতে থাকবে এখানে?“ অরণ্য বলল, “না, ওসব কিছু লাগবে না। আমি একটু বাদেই চলে যাবো। জাস্ট একটু চা অথবা কফি হলেই হবে।”
-“শুধুই চা কফি তো খাওয়াবো না তোমাকে।”
-“আচ্ছা, এখনকার মতো আপনার যেটা ইচ্ছে, সেটাই দিন।“ অরণ্যর আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। মালবিকা বলল, “তুমি আমাকে আপনি করে কথা বলো না।” অরণ্য বলল, “কেন?বয়সে বড়ো অচেনা কারোর সঙ্গে প্রথম আলাপে তো আপনি করেই সম্বোধন করতে হয়!” মালবিকা একটু থমকে গেল।নয়টা মাস যে তার শরীরে মিশে বড়ো হয়েছে, তার কাছে সে অচেনাই বটে! মালবিকা বলল,”তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?“অরণ্য বলল, “কী জানি!”
-“তুমি সেদিন প্রোগ্রামের দিন, আমাকে একটা কাগজে তোমার নাম আর ফোন নম্বর লিখে পাঠিয়ে জানিয়েছিলে তুমি আমার সাথে আলাদা করে দেখা করতে চাও…”
-“হ্যাঁ, বলেছিলাম। তবে আমি জানি না, আমি ঠিক কী বলতে চাই। বা আদৌ বলতে চাই কিনা কিছু। আসলে আপনার ব্যাপারে অনেকদিন ধরেই আমার একটা কৌতূহল ছিল। আপনার জীবনযাপনটা জানতে ইচ্ছে করতো খুব।”
-“আমার জীবনযাপন!”মালবিকা ভুরু তুলল। অরণ্য হেসে বলল, “হ্যাঁ, আসলে ছোটো থেকে সবার মায়েদের দেখেছি, জীবনে যা কিছুই হয়ে যাক, সন্তানকে কখনও ত্যাগ করে না কেউ। সবাই বলে সন্তানসুখ সবচেয়ে বড়ো সুখ।সেখানে আপনি নিজের সন্তানকে ছেড়ে যে সুখ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন,আপনার সেই সুখী জীবনটা সামনে থেকে দেখতে ইচ্ছে করতো।”
কথা বলতে বলতে একজন বয়স্ক মহিলা এসে খাবার রেখে গেলেন। মালবিকা বলল, “নাও, খাওয়া শুরু করো।” অরণ্য হট চকোলেটের গ্লাসে চুমুক দিল। মালবিকা বলল, “তোমার রাগ হয় আমার উপর?”অরণ্য বলল, “নাহ, রাগ করার কোনো কারণ তো নেই।” মালবিকা প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে বলল, “শুভেন্দু কেমন আছে?” অরণ্য বলল, “এমনি আছে ভালোই। তবে আজকাল একটু একা হয়ে পড়েছে। আমি এখন বাইরে থাকি।”মালবিকা বলল, “আচ্ছা।”
এরপর আর দুজনই কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলো।এর মধ্যে সেই মহিলা আরেকবার এসে মালবিকার ব্রেকফাস্টটা দিয়ে গেল।মালবিকার খাওয়া বলতে একটা ডিমসেদ্ধ, একটু টকদই আর একটা আপেল।সেদিকে তাকিয়ে অরণ্য বলল, “আপনি ডায়েট করেন?” মালবিকা বলল, “হ্যাঁ, সিঙ্গার হয়েও যে নিজেকে স্লিম রাখার দায়িত্ব নিতে হবে, এটা আগে ভাবি নি। কত কী চেঞ্জ যে দেখলাম এতগুলো বছরে! একে একে ক্যাসেট, ডিভিডি এসবের জমানা পেরোলো। এখন তো ওসব আর কেউ শোনে না। এখন সবই ডিজিটাল যুগ। ইউটিউবেই এখন সবাই গানটান শোনে। সেখানে গানের সঙ্গে ভিডিওটাও ইম্পরট্যান্ট।আমি চেষ্টা করি আমার গানে যেন অন্য মডেলকে হায়ার না করতে হয়, তাহলে কোম্পানির খরচ বাড়বে অনেক।তোমরা এখনকার দিনের ছেলেমেয়েরা অবশ্য এমনিতেই হেলথ কনসাস।” অরণ্য বলল, “আমি ডায়েট করি না। তবে খেলতে ভালোবাসি।”
আরো কিছুক্ষন এটা ওটা গল্প হল এত বছর বাদে আলাপ হওয়া মা আর ছেলের। মালবিকার কাজ, অরণ্যর পড়াশোনা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। দুজনের মধ্যেই কাজ করছে অস্বস্তি, কিন্তু সেটা কাটাতে দুজনই সচেষ্ট। খানিকক্ষণ পরে মালবিকা জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, দেবাংশী নামের মেয়েটি কে হয় তোমার? আসলে ওইদিন ওকে দিয়েই আমাকে চিরকুটটা পাঠিয়েছিলে তো তাই।” অরণ্য বলল, “আমি যে অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকি, সেখানে ও একটা ফ্ল্যাটে থাকে। তাছাড়া ওকে আমি একটু পড়াশুনা দেখিয়ে দিই।” মালবিকা বলল, “একটা কথা বলবো?” অরণ্য বলল, “হ্যাঁ বলুন।”
-“দেখো, জীবনে আমি দাঁতে দাঁত চেপে অনেক সংগ্রাম করেছি,চেয়েছিলাম সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা ক্র্যাক করে অফিসার হতে। তবে ভাগ্য আমাকে গায়িকা হিসেবে পরিচিতি দিল। মোটামুটি জীবনে যা উপার্জন করেছি এখনও অবধি, সেটা খারাপ না। মোটামুটি একটা পরিচিতিও পেয়েছি। তবে নিজের সন্তানের বড়ো হওয়ায় তার পাশে থাকতে পারি নি বলে রাতের পর রাত আমি বালিশ ভিজিয়েছি। তারপর ভেবেছি, তোমার তো তাও অনেকে আছে। ওদিকে যাদের কেউ থাকে না, আমি না হয় তাদের জন্য ভাবি। এই কারণে আমি একটা অনাথআশ্রমে যুক্ত হয়েছি। তবে যতই যাই হোক, তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে, স্বয়ং ভগবান তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তোমার জন্য যদি কিছু আমি এখনও না করি, তাহলে ওপারে গিয়ে আমাকে অনেক জবাবদিহি করতে হবে।”
-“আপনি পাপপুণ্যের ভয় পান?” অরণ্য হাসল। মালবিকা বলল, “তুমি কি আমাকে অনেক খারাপ মানুষ মনে করো?”
-“আমি আপনার ব্যাপারে কোনো ধারণা করতে যাবোই বা কেন! তাছাড়া সব মানুষই ভালো খারাপ মিশিয়ে তৈরি। এই ভালো খারাপ বিষয়টাও ভীষণ আপেক্ষিক। আমার যেটা ভালো বা খারাপ মনে হয়, অন্যদের কাছে সেটা উল্টো হতে পারে। তবে, আমার মনে হয়, ভীষণ রকম বাস্তববাদীরা সাধারণত পাপপুণ্য নিয়ে মাথা ঘামায় না।”
-“পাপপুণ্যের বোধ সবারই থাকা উচিত।”
-“আপনার আফসোস হয় সব কিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য?”
-“না, তখন আমার যা উচিত মনে হয়েছিল তাই আমি করেছিলাম। তাছাড়া যদি জানতাম, তুমি খারাপ আছো, তাহলে আমার খুব খারাপ লাগতো। তোমাকে তাহলে নিজের কাছে নিয়েও আসতাম আমি।কিন্তু আমি জানতাম, তুমি খারাপ থাকবে না।শুভেন্দু তোমাকে খারাপ রাখবে না।”
-“আপনার আর কখনও মনে হয় নি ঘরে ফেরার কথা?বাবা তো আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে গেছিল আবার।”
মালবিকা আলতো হাসল। হেলান দিয়ে বসল ধূসর রঙের সোফাটায়। নীল আর হলুদ রঙের দুটো কুশন তুলে নিজের কোলে রাখলো। পুরোনো অনেক কিছু স্মৃতি মাথায় আসছে ওর। সব কি নিজের ছেলেকে বলা যাবে? এখনকার ছেলেমেয়েরা যদিও অনেক বেশি ম্যাচিওর্ড হয়।

******************************

কৌস্তভের বৌভাতের অনুষ্ঠান সেরে নিজের হোটেলে ফিরছিল মালবিকা। নিজের শহর মালদায় এসেও নিজের বাড়িতে ওঠে নি ও।রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা।এমন সময়ে পেছন থেকে একটা পরিচিত গলার আওয়াজ শুনলো, “মালবিকা, একটু শোনো।” ঘুরে তাকিয়ে মালবিকা দেখলো, শুভেন্দু দাঁড়িয়ে আছে।একা।কতদিন পরে শুভেন্দুকে দেখলো ও। তিন বছর কেটেও গেল এর মধ্যে!গলা খাঁকড়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মালবিকা বলল, “বলো।” শুভেন্দু বলল, “আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে।” মালবিকা শুভেন্দুকে একবার ভালো করে দেখলো।
হোটেলে মালবিকার ঘরে মুখোমুখি বসে শুভেন্দু আর মালবিকা। মালবিকাই প্রথমে বলল, “কী বলবে বলছিলে?”
-“কৌস্তভের বিয়ে হয়ে গেল?”
-“হ্যাঁ, বিদিশা খুব ভালো মেয়ে।”
-“তোমার সঙ্গে কৌস্তভের সম্পর্ক… ”
-“বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছুই না।”
-“কিন্তু আমি যে সেদিন দেখেছিলাম, তোমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছো, আর কৌস্তভ সেদিন তোমাকে…”
-“চোখে দেখা সব জিনিস সত্যি নাও হতে পারে।আবেগ থেকে মানুষ অনেক সময় অনেক কাজ করে ফেলে ঠিকই, কিন্তু তাকে এক্সপ্লেইন করারও সুযোগ দিতে হয়।”
-“তোমাদের মধ্যে তাহলে কোনোদিন কোনো সম্পর্ক ছিল না?”
-“আবার বলছি, সম্পর্ক ওর সঙ্গে আমার তখনও ছিল, আজও আছে, সেটা হল বন্ধুত্ব।তুমি যদি আরো ডিটেলসে জানতে চাও, তাহলে বলি, এক সময় কৌস্তভের আমার প্রতি কিছুটা দুর্বলতা ছিল, তবে সেটা কোনো বড়ো ব্যাপার না। ও ব্যাপারটা থেকে মুভ অন করে গেছে। আর এসব ব্যাপার বিদিশা ভালোমতোই জানে।ও একজন সেনসিবল মেয়ে।“
শুভেন্দু উঠে এসে মালবিকার সামনে দাঁড়ালো। বলল, “মালবিকা বাড়ি ফিরে চলো।”মালবিকা হাসল। বলল, “কৌস্তভের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে আমি সতীত্বের পরীক্ষায় পাশ করলাম তাহলে?”

(ক্রমশ)

© Asmita Roy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here