#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(তেরো)
-“সতীত্ব! এসব কী কথা! এটা ঠিক যে আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম, তোমার হঠাৎ করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসা, কৌস্তভের সঙ্গে অতো অন্তরঙ্গ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সব মিলিয়ে আমি ভেবেছিলাম তোমার কৌস্তভের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তুমি বলো, মেয়েরাও কি ছেলেদের ভুল বোঝে না? সব মেয়েই কি খুব স্পোর্টিং হয়?”
-“কী চাও তুমি আমার কাছে এখন? নিজের এই জীবন ছেড়ে ওই জেলখানায় আমি আর ফিরবো না।”
-“মালবিকা, ওটা তোমার সংসার। টুবলু তোমার নিজের ছেলে। এসব ছেড়ে তুমি কেন মোহের পেছনে দৌড়োচ্ছ?”
-“মোহ নয়, যার পেছনে দৌড়োচ্ছি, সেটা আমার স্বপ্ন। আমার জীবন।”
-“জীবনটা অতো সোজা নয় মালবিকা।এদিক ওদিক কয়েকটা গানের প্রোগ্রামের ডাক পেয়ে, আর সবেমাত্র একটা ক্যাসেট বের করে তুমি ভাবছো তোমার বাকি জার্নিটাও এতটাই স্মুথ হবে! ঘরছাড়া হয়ে জীবন কাটানোটা কোনো জীবন হতে পারে না। সবারই একটা ঘর লাগে, আশ্রয় লাগে, পরিবার লাগে।”
-“গত তিনবছর আমি যখন প্রায় একলা অচেনা শহরটায় গিয়ে হোঁচট খেতে খেতে লড়ে গেছি, তখন তোমার মনে আসে নি যে আমি আদৌ বেঁচে আছি কিনা! তখন আমার পরিবার কী করছিল?আমার লড়াইটা একদমই স্মুথ ছিল না। কতটা কঠিন ছিল তা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।তাই এখন আমি আর ভয় পাই না কোনো অনিশ্চয়তাকে।”
-“আচ্ছা,তুমি যে তখন ওরকম হুট করে বাড়ি ছেড়ে চলে এলে, আমাদের কারোর মানসম্মানের কথা তুমি ভাবলে না!তোমার কি দায়িত্ব ছিল না আমাদের কথা ভাবার!ঝগড়াঝাঁটি সব জায়গায় হয়, অ্যাডজাস্টমেন্ট জানতে হয়।”
-“পুরোপুরি টক্সিসিটির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখাকে হাজার হাজার মেয়ে অ্যাডজাস্টমেন্ট ভাবতে পারে, আমি পারি না। আর সংসার মানে শুধু নিজের বাবা মা বর শ্বশুড় শাশুড়ি নাও হতে পারে। আমার সংসার আমি আমার মতো করেই তৈরি করবো।নিজে যেখানে ভালো থাকা যায় না, সেটা সংসার নয় আমার কাছে। “
-“ তোমার সন্তান! তাকে পৃথিবীতে আনার পর তার প্রতি তোমার কোনো দায়িত্ব নেই!”
-“ তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি সন্তান নেওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিলাম না। তুমি বারবার জোর করতে। আমার নিজের মা-ই আমাকে বলেছিলো, ‘এবার বাচ্চা নিয়ে ফেল। নাহলে কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো থাকে না। তোরও বয়স হচ্ছে, এরপর শরীরে অনেক কমপ্লিকেশন হবে।‘ নিজের মাটি বলতে কিছুই ছিল না আমার শুভেন্দু। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সন্তান এনেছি তাই। সারাক্ষন ভয় পেতাম, এই বুঝি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে তোমরা। আমার তো নিজের বাড়িতেও জায়গা হবে না। তবে একদিন সব ভয় ভেঙে গেল।বেরিয়েই পড়লাম বাড়ি ছেড়ে।”
শুভেন্দু হতভম্ব হয়ে তাকালো। বলল, “তুমি আমাকে এতটা মিন ভাবতে! তোমাকে আমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো! সেই ভয়ে তুমি একটা প্রাণকে পৃথিবীতে এনে ফেললে! দেখো মালবিকা,এটা ঠিক,অনেক ঝগড়ার সময়ে তোমাকে আমি বলেছি, না পোষালে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু ওগুলো তো শুধুই কথার কথা। আমার বাবাকেও এমন কথা বলতে শুনেছি। আমার মা তো তাই বলে সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় নি! আমরা খুব সাধারণ লোকজন মালবিকা। চাকরিবাকরি, সংসার, সন্তান এসব নিয়েই আমরা জীবন কাটাতে চাই। বৌকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো, ডিভোর্স দেবো, এসব অ্যাডভেঞ্চার আমরা চাই না।”
-“টুবলু খারাপ আছে আমাকে ছেড়ে?এতদিন তো দিব্যি চলল।”
-“টুবলু খারাপ নেই। তবে মালবিকা, টুবলু আমাদের সন্তান। ওর উপর সব চেয়ে বেশি দায়িত্ব আমাদের। আমি অফিস চলে যাই। সে সময়ে ওকে অন্য কেউ কেন দেখবে!”
-“অন্য কেউ বলতে, সে তো ওর নিজেরই দাদু আর ঠাম্মা। তারা কি কোনো আপত্তি করছে?যদি তাদের প্রবলেম হয়, তাহলে টুবলুকে আমার কাছে দিয়ে দাও।টুবলু আমার কাছেই বড়ো হবে। এখন আমার মোটামুটি একটা রোজগার আছে। তবে ওই তোমাদের সংসার করার নাটক আমি আর করবো না।”
-“তোমার কাছে একলা টুবলু বড়ো হবে!তোমার এমন বোহেমিয়ান লাইফস্টাইলের সঙ্গে! আফটার অল হি ইজ মাই চাইল্ড! টুবলু এভাবে বড়ো হতে পারে না।“
শুভেন্দু উত্তেজিত হয়ে পড়েছে দেখে মালবিকা একটু হাসল। বলল, “আমিও চাই না টুবলু কষ্ট পাক। আমি জানি আমার লাইফ স্টাইল এখন কেমন। তাই আমি তোমাকে জোর করবো না টুবলুকে দেওয়ার জন্য। তোমার কাছে ও যেমন আছে থাকুক। আর টুবলুকে আনার ইচ্ছে তোমারই বেশি ছিল, আমার নয়। তাই দায়িত্বটা তোমারই থাকুক। “
-“জানো, তোমার ক্যাসেট কিনে গান শুনেছি আমরা! টুবলু কী বলেছে জানো! ওইটুকু বাচ্চা, তোমার গান শুনলেই আনন্দে হেসে ওঠে। বারবার বলে, এই গলাটা আমি চিনি তো! নাড়ির টানকে এমনভাবে দায়িত্ব ভাগাভাগি দিয়ে অসম্মান করো না!“
-“শুভেন্দু, যে স্বাধীনতার স্বাদ আমি পেয়ে গেছি, তা ফেলে ওই থোড় বড়ি খাড়া, আর খাড়া বড়ি থোড়ের ওই সংসার খাঁচায় আমি আর ফিরবো না। নিজের এই জীবনটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি বড়ো। “
-“তুমি গান করতে চাইলে তো সংসার করেও গান করতে পারবে।“
-“ফারাক্কা শহরে আমার গান কজন শুনবে?এত শো, এত অডিয়েন্স, এত হাততালি..এগুলো আমি কোথায় পাবো! তুমি তাহলে কলকাতা চলে এসো।আমাদের তিনজনের সংসার হোক শুধু। “
-“মালবিকা, আমার চাকরি যে এখানেই। সেটা তো আমি ছেড়ে দিতে পারি না!”
-“বেশ, তুমি তোমার মতো ভালো থেকো। আমি আমার মতো। টুবলুকে ভালো রেখো। না পারলে আমাকে বলো তখন। “
হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইল শুভেন্দু। অসম্ভব জেদ এই মেয়ের। ও সেদিন ভুল বুঝেছিলো মালবিকাকে। তার জন্য ও এতবার করে ক্ষমা চাইছে, তবুও মালবিকা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।শুভেন্দু তো একটা স্বাভাবিক সংসার চেয়েছে বরাবর।শুভেন্দুও এবার বলল, “টুবলুকে এতদিন আমি ভালো রেখেছি যখন, তখন বাকিটাও পারবো।টুবলু আমার কাছে শুধু দায় নয়, ও আমার নিজের রক্ত, ওকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি আমি।আমি বেঁচে থাকলে তোমাকে ওর কথা ভাবতে হবে না। তুমি স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়েই ভাবো শুধু।”
শুভেন্দু চলে গেল। মালবিকা উঠে জল খেলো এক গ্লাস।শুভেন্দুর মতো শিক্ষিত, সুচাকুরে, সুদর্শন বর, টুবলুর মতো ফুটফুটে বুক জুড়োনো সন্তান – কোনো কিছুকেই আপন করতে পারলো না ও।মাথাটা ধরে আছে। ওর জীবনে কত কিছু যে ঘটছে! কৌস্তভের বিয়ে হয়ে গেল। বিদিশা কোনোভাবে মালবিকার কথা জানতে পেরে একদিন এসেছিল ওর সঙ্গে কথা বলতে।ওকে পরিষ্কার করে খুলে বলেছিলো মালবিকা, কৌস্তভের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা শুধুই রটনা। বিদিশাকে আশ্বাস দিয়েছে মালবিকা, যদি বিদিশা চায়, তাহলে বিয়ে মিটে যাওয়ার পর কৌস্তভের সঙ্গে কোনোদিন কোনোরকম যোগাযোগ রাখবে না ও।
***********************************
অরণ্য বলল, “এরকম একলা জীবন এখন ভালোলাগে আপনার?” মালবিকা বলল, “তুমি এসে থাকবে আমার সঙ্গে?” অরণ্য অবাক হয়ে বলল, “আমি কেন?”
-“তুমি আমার সঙ্গে থাকলে আমার বেশ সঙ্গী হয় একজন। তুমি এখানে থাকলে অনেক আরামেও থাকবে। আরো ভালো করে পড়াশোনা করতে পারবে।”
-“না, আমি যেমন আছি ভালোই আছি।ওখানে থাকতে আমার কোনো কষ্ট হয় না, বরং বেশ ভালো লাগে।”
মালবিকা বলল, “দেবাংশির জন্য কষ্ট হবে তোমার?” অরণ্য মালবিকার দিকে তাকালো। বলল, “হঠাৎ দিয়ার কথা কোথা থেকে এলো!” মালবিকা বলল, “মেয়েটি তোমাকে খুব পছন্দ করে মনে হল। তুমি করো না ওকে?” অরণ্য বলল, “ভেবে দেখি নি।” মালবিকা বলল, “অন্য কাউকে ভালো লাগে?” অরণ্য বলল, “নাহ! এসব নিয়ে ভাবি না।”
-“কেন?”
-“আমি কোনো সম্পর্কতে বিশ্বাস করি না। ভুল সম্পর্কতে জড়ানোর চেয়ে একা থাকাই ভালো।”
-“তোমাদের এই বয়সটা ভারী মধুর সময়। এটাকে তিক্ততা নিয়ে দেখো না। নিজের ভেতরের ভালোলাগাগুলোকে এনজয় করো।”
-“মানে?”
-“তোমার বাবা-মায়ের সম্পর্ক দিয়ে বিচার করে ভালোবাসা শব্দটার প্রতি অনীহা এনো না। বিয়ে নিয়ে ভাবার সময় তোমাদের হয় নি। শুধু এই সময়ের মধুর অনুভূতিগুলোকে আগলে রেখো।”
(ক্রমশ)
© Asmita Roy