ধূসর_রঙে_আকাশ পর্ব_৩৯

0
885

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩৯
লিখা: Sudratul Muntaz

তোহা আর শিউলি শপিংমল থেকে বের হওয়ার সময় একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।শপিং মলের মেইন গেট থেকে ওরা যখন বের হচ্ছিল সামি নামের একটা ছেলে আচমকা এসে তোহার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,”কি খবর তোহা? কতদিন পর দেখা। কেমন আছো তুমি? আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছো দেখছি।”
তোহা পিঠে অপ্রত্যাশিত স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। সামিকে দেখে সে যে খুব একটা খুশি হয়নি সেটা বোঝা যাচ্ছে। তোহা আগুপিছু করে বললো,” ভালো। ভালো আছি।”
তোহা জোরপূর্বক হাসলো। শিউলির মেজাজটাই গরম হয়ে গেল। কথা বলার জন্য পিঠে হাত রাখতে হবে কেন? সামি বললো,
” তোমার পাশে এটা কে?”
তোহা হাসার চেষ্টা করে বললো,” আমার কাজিন। ”
” ও, শপিংয়ে এসেছিলে? ”
” হ্যাঁ।”
” আচ্ছা, আচ্ছা। তো কেমন চলছে দিন কাল?তুমি তো আগের চেয়েও অনেক সুন্দর হয়ে গেছো। রহস্য কি?”
সামি আবার তোহার পিঠে হাত রাখল। তোহা পুনরায় কেঁপে উঠল। ভয়ে জড়োসড়ো হলো। সে যে যথেষ্ট অস্বস্তি বোধ করছে সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শিউলি সরু চোখে সামির দিকে তাকায়। তার খুব রাগ লাগছে। এই বেটা আস্তো লুচ্চা। চেহারার মধ্যেই কেমন বদমাইশি ভাব।শিউলির যদি ক্ষমতা থাকতো এখনি ঘুষি মেরে লোকটার নাট-বল্টু ঢিলা করে দিতো। তার কত বড় সাহস, তোহা আপার গায়ে হাত দেয়! শিউলি তোহাকে সরিয়ে নিজে মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। সামি এবার তোহাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। শিউলি মাঝখানে এসে দাঁড়াতেই সে ডানপাশ থেকে বামপাশে গিয়ে আবার তোহার পাশে দাঁড়ালো। শিউলি কোমড়ে হাত রেখে অগ্নিমূর্তির মতো আবার তোহাকে টেনে ডানপাশে দাঁড় করায়। আর সে মাঝখানে চলে আসে। সামি এবার শিউলিকে উপেক্ষা করেই তোহার কাঁধে হাত রেখে বললো,
” এতোদিন কই ছিলে তোহা। তোমাকে তো এলাকায় খুঁজেই পাওয়া যায়না।”
তোহা হাতটা সরিয়ে দিল। অস্বস্তি নিয়ে বললো,
” আসলে আমি ইদানীং একটু ব্যস্ত থাকি। তাই বাসা থেকে বের হওয়া হয়না।”
” কলেজেও কি যাওনা?”
” না।”
সামি একটু ঝুঁকে তোহার মুখের কাছে এসে বললো,
” চলো একদিন রমনা পার্কে দেখা করি। আজকেই যাওয়া যায়। যাবে?”
শিউলি চোখ বড় করে বললো,” ক্যান? রমনায় যাইবো ক্যান?”
সামি হেসে বললো,” এমনি। একটু বাদামভাজা খেতে খেতে গল্প করা যেতো এই আরকি!”
” ক্যান? রমনায় কি আপনি বাদাম বেঁচেন? বুঝছি, বাদামওয়ালা।”
তোহা মুখ টিপে হাসলো। সামি অপ্রস্তুত গলায় বললো,
” আমি বাদামওয়ালা হবো কেনো?”
শিউলি বললো,” থাক বাদ দেন। বাদামভাজা খাওয়ার জন্য আমাদের রমনায় যাইতে হইবো না। আপনি বরং আমাগো বাসায় আইসেন। বাদাম ভাজার সাথে নতুন আইটেম ঝাড়ুর বারিও খাওয়ায় দিমুনে।”
তোহা জোরপূর্বক হাসি আটকে শিউলিকে চোখ রাঙানি দিল। শিউলি সেসবের তোয়াক্কা করলো না। তোহার হাত ধরে বললো,
” আপু চলেন এখান থেকা। আজাইরা কামে খাড়ায় থাইক্কা লাভ নাই।”
সামি রাগান্বিত গলায় বললো,” ঝাড়ুর বারি মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?”
তোহা হাসতে হাসতে শিউলির সাথে লিফটে উঠলো। শিউলিও হাসছে। তোহা বললো,
” তুই এটা কি করলি?”
” ঠিকই করসি৷ বেডারে আমার পছন্দ হয়নাই। আস্তা লুইচ্চা, খাটাশ।”
তোহা আবারও ফিক করে হাসে। এরপর বললো,
” শোন শিউলি, আমাদের কিন্তু এখানে আরেকটা কাজ আছে।”
” কি কাজ আপু?”
” তোর ভাইজানের জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনবো।”
” ভাইজানের লাইগা পাঞ্জাবী? উনি কি পাঞ্জাবী পড়ে? কোনোদিন তো দেখলাম না।”
” সেজন্যই তো কিনবো। আমারও দেখার শখ। পাঞ্জাবী পড়লে ওকে কেমন দেখতে লাগে। কি রঙের কেনা যায় বলতো?”
লিফট খুলে গেছে। শিউলি বের হতে বের হতে বললো,
” ভাইজান তো খুব ফরসা। তারে যেকোনো রঙে মানাইবো। কিন্তু পেইজ কালারে বেশি মানাইবো।”
” পেইজ কালার? সেটা আবার কি?”
” আরে ওইযে, গোলাপি রঙের মতো একটা রঙ আছে না?”
” বুঝেছি। পীচ কালার।”
” হো আপা। ঠিক কইসেন।”
পাঞ্জাবী কিনে শপিং মল থেকে বের হওয়ার সময় ওরা দেখলো মেইনগেইটে অনেক ভীড়। সামি ফ্লোরে বসে আধমরা মাছের মতো আর্তনাদ করছে। ওর ডানহাতের আঙুলগুলো ধারালো ধাগা দিয়ে কেটে মেঝেতে পড়ে আছে। এটা এক্সিডেন্ট নাকি কারো ভয়ংকর ষড়যন্ত্র বোঝা যাচ্ছে না। তবে সাংঘাতিক রক্তপাত হচ্ছে। তোহার মাথা ঘুরতে লাগলো। মনে হচ্ছে ঠিক এমনি একটা রোমহর্ষক দৃশ্য সে আগেও কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় যে দেখেছে, কিছুতেই মনে আসছে না। মনে করতে গেলেই মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণায় চক্কর দিয়ে উঠছে। শিউলি তোহার অসুস্থতা দেখে ওকে জলদি গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। ওরা প্রাইভেট কারে এসেছিল। গাড়িটা আমীরের। ড্রাইভারও আমীরের। এদিকে কতবড় ঘটনা ঘটে গেছে। সবাই আতঙ্ক অস্থির। কিন্তু ড্রাইভার নির্লিপ্তভাবে গাড়িতে ঠেস দিয়ে সিগারেট টানছে। সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে এমন ঘটনা দেখে স্বাভাবিক থাকার কথা না। শিউলির অবশ্য বিষয়টা তখন মাথায় আসেনি। সে তোহাকে নিয়ে ব্যস্ত। কোনোমতে সে তোহাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভার একবার ধরতেও এলোনা। ওরা যখন গাড়িতে ঠিক করে বসে গেল তখন ড্রাইভার নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ফেলে পা দিয়ে কচলে গাড়ি স্টার্ট দিল। শিউলি ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তোহার চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয়। অস্থির হয়ে বলে,” আপু, আপনার কি হইসে? চোখ খুলেন আপু। বেশি খারাপ লাগতাসে? ডাক্তারের কাছে নিতে হইবো?”
তোহা কোনমতে সোজা হয়ে বসলো। মাথায় হাত রেখে বললো,
” জানিনা রে শিউলি। কেমন যেন লাগছে।”
শিউলির প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম। তোহার কষ্টে তার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তোহা চোখমুখ কুচকে মাথাভর্তি যন্ত্রণা সহ্য করেই যাচ্ছে। কিছু একটা মনে আসতে চাইছে তার। খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো দৃশ্য মস্তিষ্কে ভেসে উঠতে চাইছে। কিন্তু কোথায় জানি একটা বাধা। সেই বাধার কারণে দৃশ্যটা ওর স্মৃতিতে আসতে পারছে না। সব অদৃশ্য মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলে তোহা সব সাদা রঙ দেখছে। আবার চোখ খুললে মনে হচ্ছে দুনিয়া অন্ধকার। তোহা মাথায় হাত দিয়ে বিকট চিৎকার শুরু করলো। শিউলি এবার কেঁদেই দিল। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” ভাই, দেখেন না আপুর জানি কি হইসে। আপু এমন ক্যান করতাসে? জলদি হাসপাতালে চলেন। আপুরে হাসপাতাল নিতে হইবো।”
ড্রাইভার শুধু আয়না দিয়ে ওদের দিকে একবার তাকালো। কোনো জবাব দিল না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সব স্বাভাবিক। তোহা বুঝতে পারলো ওর পুরনো স্মৃতি মনে পড়তে চলেছে। অতীতে হয়তো এমন কোনো ভয়ংকর দৃশ্য দেখে ওর আত্মা কেঁপে উঠেছিল। সেই ভয় এখনো মন থেকে যায়নি৷ এতো সহজে ওর কিচ্ছু মনে পড়বে না। একটা সাহায্য দরকার। আচ্ছা এমন কেউ কি নেই? যে সব ওকে মনে করাতে পারে? তোহা ঘনিষ্ট কাউকে খুঁজতে লাগলো। যে বিগত একবছর তোহার সাথে ছিল। যে তোহার বিষয়ে সব জানে। তোহা মস্তিষ্কে ধরা দিল মিতুর নাম। মিতু, কাকলী, ওরা তোহার স্কুল জীবনের বান্ধবি। কলেজেও উঠেও ফার্স্ট ইয়ার ওদের সাথে কাটিয়েছে। এর মাঝখানেই কি যেন হয়। তোহা সব ভুলে যায়। কাকলীর বাসা তোহা চিনেনা। কিন্তু মিতুর বাসা চিনতো। তাই ড্রাইভারকে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিল গাড়ি ঘুরাতে। সে মিতুর বাসায় যাবে। ড্রাইভার তোহার কথায় কোনো রিয়েকশন দেখালো না। কিন্তু ওর নির্দেশ ঠিকই পালন করলো। মিতুদের ফ্ল্যাটে যখন গাড়ি থামলো, তোহা তড়বড় করে গাড়ি থেকে নামে। শিউলিও ওর সাথে যেতে নেয় কিন্তু তার আগেই ড্রাইভার গাড়ি লক করে দিয়েছে। শিউলি আর বের হতে পারলো না। চিৎকার করে তোহাকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু তোহা ততক্ষণে ফ্ল্যাটে ঢুকে গেছে। শিউলির আওয়াজ ওর কানেও পৌঁছায়নি।

এতোদিন পর তোহাকে দেখে মিতুর চঞ্চলতা বেড়ে যায়। সে দিশেহারা হয়ে কি করবে, কি বলবে বুঝতে পারেনা। শুধু উত্তেজনা আটকে জিজ্ঞেস করলো,
” তুই এতোদিন কোথায় ছিলি দোস্ত?”
তোহা শান্ত হয়ে বসে বললো,” পানি খাবো।”
মিতু চটজলদি পানি এনে দেয়৷ তোহা একঢোকে পানি শেষ করলো। মিতু উতলা হয়ে তোহার দিকে চেয়ে আছে। ওর হাত-পা কাঁপছে। এটা দুঃস্বপ্ন নয়তো? তোহা সত্যিই ফিরে এসেছে? কি করবে মিতু? কাকলীকে একটা ফোন দিবে? তোহা বললো,
” এই তিনমাসে অনেক কিছু বদলে গেছে মিতু। আমি এখন বিবাহিত।”
মিতু থমকে যায় তোহার কথা শুনে। এজন্যই কি তোহা কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে? কিন্তু তোহার পরিবার তো এমন না, যে লেখাপড়া বন্ধ করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবে। আর তোহা এতো ভালো স্টুডেন্ট হয়ে এই বয়সে বিয়ে করে ফেললো? কলেজে আসাও বন্ধ করে দিলো? কি এমন হয়েছে ওর সাথে? তোহা আজকের অদ্ভুত ঘটনাটি মিতুকে বললো। তারপর বললো, সে গত এক বছরের কোনো স্মৃতি মনে করতে পারছে না। মিতু যেন তাকে মনে করিয়ে দেয়। তখন বললো,
” এইরকম একটা ঘটনা তুই আরও আগেও বলেছিলি। রেললাইনের রাস্তা হয়ে যখন তুই বাসায় ফিরছিলি, রগ কাটা শাহ নামের একজন কারো কান কেটে দিয়েছিল। তুই ওই দৃশ্য দেখে খুব ভয় পেয়েছিলি। তার পরদিন কলেজের চীফ গেস্টকেও রগ কাটা শাহ মনে করে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলি। কত মজার ছিল দিনগুলো। তোর মনে পড়ছে?”
” কিচ্ছু মনে পড়ছে না। কিন্তু তুই এইমাত্র যে নামটা বললি, ‘রগ কাটা শাহ’ এই নাম আমি আগেও শুনেছি। পূরবী বলেছিল। কিন্তু এটা কে?”
” তুই যে এইমাত্র আঙুল কাটার ঘটনা বললি। এটাও রগ কাটা শাহের কাজ হতে পারে।”
” কিন্তু কেনো? সে সামির আঙুল কেন কাটবে? সামি তার কি ক্ষতি করেছে?”
” সেটা আমি কিভাবে বলবো দোস্ত?”
তোহা চুপ করে থাকে। মিতু বললো,
” আচ্ছা এসব কথা এখন থাক। তুই তোর কথা বল। তোর সংসার কেমন চলছে? আর তোর হাসব্যান্ড কি করে? দেখতে কেমন?”
তোহা প্রচন্ড চমকালো। ভ্রু কুচকে বললো,” আমার হাসব্যান্ড মানে? আমি আবার কবে বিয়ে করলাম?”
” তুই না এইমাত্র বললি তুই বিবাহিত?”
” কখন বললাম? তুই মনে হয় ভুল শুনেছিস। আমি বিবাহিত কেন হবো?”
” ওহ। এতোবড় ভুল শুনলাম? আচ্ছা যাইহোক, তুই কলেজে আসিস না কেন?”
” জানিনা। কিচ্ছু মনে পড়ছে না। আচ্ছা আমি কে? এখানেই বা কেন এসেছি?”
মিতু বুঝতে পারলো তোহা খুব ডিপ্রেসড। অসহ্য বিষণ্ণতায় ভুগছে। তাই সে তোহাকে আর প্রশ্ন করে বিব্রত করলো না। কিছুক্ষণ তোহা মিতুদের বাসায় থেকে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়। ওর মাথা তখন পুরোপুরি ঠান্ডা। আর কিছু ভাবতেও ইচ্ছা করছে না। শিউলি তোহাকে জিজ্ঞেস করলো,
” আপু আপনি কই গেসিলেন?”
তোহা নির্বিকার জবাব দিল,” কোথাও না।”
শিউলি আর প্রশ্ন করার সাহস পায়না। বাসায় ফিরে আসার পর তোহার হঠাৎ সব মনে পড়ে। সে মিতুদের বাসায় গিয়েছিল অতীত মনে করতে। মস্তিষ্কে যে ভাবনাটা তাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালাচ্ছে সেই সম্পর্কে মিতুকে জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। নাকি হয়েছিল? আসলে মিতুর বাসায় যাওয়ার পর কি হয়েছিল তোহার মনে পড়ছে না। কিছুই মনে পড়ছে না। আবার সব আউলিয়ে যাচ্ছে। ভয়ানকভাবে জট পাকিয়ে যাচ্ছে।

চলবে

( আপনারা জানেন কি? আগামী পর্বে আমীর তোহাকে ছেড়ে চলে যাবে। তখন তোহার সবকিছু মনে পড়বে। কিন্তু তখন সে আফসোস করবে, কেন সব মনে করতে গিয়েছিল? যদি মনে করতে না চাইতো, তাহলে আমীর আরও কিছুদিন তার পাশে থাকতো।😐)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here