ধূসর_রঙে_আকাশ #পর্ব_৪২

0
802

 

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৪২
লিখা: Sidratul Muntaz

পূরবী শুকনো গলায় ঢোক গিলে নিম্ন কণ্ঠে বললো,” আমি, পূরবী। আসবো?”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো তোহা,” আয়।”
পূরবী ঘরে ঢুকে দেখলো সারাঘর অন্ধকারের কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত। বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী এখন দুপুর বারোটা বেজে বিশ মিনিট হলেও তোহার ঘর দেখে মনে হচ্ছে গভীর রাত। ঘড়িতে রাত দুইটা কিংবা আড়াইটা বাজে। আসলে তোহার পৃথিবীতে দিন বলে কিছু নেই। একমাসে আগে কালো আঁধারে ডুবে গেছিল ওর জীবন। এখন পর্যন্ত কোনো উজ্জ্বল আলো ওর অন্ধকারে নিমজ্জিত জীবনটা ছুঁতে পারেনি। পূরবী তোহার কাছে আসলো। বিছানার দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কিছু ভাবছে তোহা। পূরবী উশখুশ করছে। তোহার ঘরটা কেমন নিষ্প্রাণ! একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগছে। অনেকদিন পুরনো ঘরের দরজা-জানালা না খুললে যেমন হয় ঠিক তেমন। আসলে এ ঘরে তো কোনো প্রাণের অস্তিত্বই নেই। যে আছে সে একটা জীবন্ত লাশ। জলজ্যান্ত এই লাশের নাম তোহা। পূরবীর একসময়ের খুব মিষ্টি, ভীতু,কোমলমনা ছোটবোনটি। যে আগের মতো কোমলমনা আর নেই। সে এখন পাষাণবতী হয়ে গেছে৷ দিনের বেলাতেও যে একা ঘরে ঘুমাতে ভয় পেতো, সে এখন মৃত্যপুরীর মতো অন্ধকার ঘরটাকে নিজের জগৎ বানিয়ে ফেলেছে। যেকোনো সাধারণ মানুষ এ ঘরে ঢুকলে প্রথমেই তার গাঁ কাটা দিয়ে উঠবে। মনে হবে কবর খুড়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে! এই কবরের মতো দরজা-জানালাবিহীন ঘরে দিনের পর দিন তোহা কিভাবে কাটাচ্ছে অনায়াসে? একেই হয়তো বলে আমূল পরিবর্তন। অবশ্য এই পরিবর্তনটা ওর দরকার ছিল। কারণ এমন পরিবর্তন না হলে হয়তো তোহা বাঁচতেই পারতো না। যেভাবেই থাকুক, অন্তত মেয়েটা বেঁচে আছে। এইতো বেশি! অনেক বেশি! তোহা খুব শান্তগলায় বললো,
” দাঁড়িয়ে থাকার জন্যই কি এসেছিস?”
তোহার প্রশ্নে পূরবীর মনে হলো অত্যাধিক ঠান্ডা কোনো সূচ কলিজা বরাবর নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই মেয়ের কণ্ঠস্বর এতো অস্বাভাবিক শান্ত কেন? ওর কথা শুনলে সারা অঙ্গ শিউরে উঠে। পূরবী কথা ভুলে যায়। সে জানি কেন এসেছিল? হ্যা মনে পড়েছে। পূরবী একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
” শিউলি আজকে একটা ইম্পোর্ট্যান্ট জিনিস পেয়েছে।”
” কথার মাঝখানে থামবি না। বলতে থাক।”
পূরবী খুব দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললো,” আমীর ভাই যে ঘরে সুইসাইড করেছিল সেই ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে শিউলি একটা খামে মোড়ানো কাগজ পেয়েছে। আমীর ভাইয়ের আরেকটা চিঠি। ”
তোহার কণ্ঠে হঠাৎ করেই যেন প্রাণ ফিরে আসে,” কোথায় সেই চিঠি?”
” শিউলি চিঠিহাতে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আসার জন্য তোর অনুমতি নিতে আমাকে পাঠিয়েছে।”
তোহার খুব রাগ হলো। এইরকম একটা কথা বলতে আবার অনুমতির দরকার হয়? কোথায় দৌড়ে এসে উত্তেজিত গলায় বলবে! তা না, সবাই ভয়ে চিমসে আছে। এ বাড়ির মানুষ ওকে এতো ভয় পায় কেন? তোহা উত্তেজিত হয়ে ঝাড়ি দিয়ে বললো,” আমি আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট নাকি রানী ভিক্টোরিয়া যে আমার কাছে চিঠি আনার জন্য এতো অনুমতি লাগবে? ডাক শিউলিকে!”
পূরবী দ্রুত সরে যায়। তোহার ধমকে ভয় পেয়েছে প্রচুর! সে দরজার সামনে গিয়ে মনে মনে তোহার উপর রাগ ঝাড়লো,” তুই ভাইস প্রেসিডেন্টও না, রাণী ভিক্টোরিয়াও না। তুই আসলে একটা সাইকো। জটিল মানসিক রোগাক্রান্ত। তোর মতো সাইকোকে যে ব্যক্তি ভয় পাবে না, ধরে নিবি সেও তোর মতো সাইকো। সাধারণ মানুষ তোকে দেখলে ভয় পাবে এটা স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক বিষয়টা তোকে মানতে হবে! বুঝেছিস সাইকো? হুহ!”
শিউলি চিন্তায় অস্থির হয়ে বললো,” পূরবী আপু, কারে কন এডি?”
” কাউকে না। তুই যাহ।”
” আমারে যাইতে কইসে?”
” অবশ্যই। আমার মুখের উপর না বলার সাহস আছে নাকি ওর? আমি গিয়ে ধমক দিয়ে বললাম, তোহা, শিউলি তোর ঘরে আসতে চায়। আসতে বলবো? তোহা মিনমিনে গলায় বললো, আচ্ছা আপু। আসতে বলো। ব্যস! হয়ে গেল।”
” চিঠির কথা কন নাই? তাইলে আমি যামু না। পরে যদি থাপ্পড় দেয়?”
” আরে ধূর, আমি থাকতে এতো ভয় কিসের?”
” আপনি নিজেও তো একটা ধমক খায়া আইলেন। অহন এতো ভাব নিতাসেন ক্যা? ”
পূরবী কোমড়ে হাত দিয়ে অগ্নদৃষ্টিতে বললো,” কি বললি? বেয়াদব মাইয়া!”
শিউলি ফিক করে হেসে তোহার ঘরে ঢুকে গেল। তোহা উতলা হয়ে বিছানার সামনে পায়চারী করছিল। শিউলিকে দেখেই বললো,
” কোথায় চিঠি? দে!”
শিউলি আচানক তোহাকে সামনে দেখে ভয় পেয়ে দুই কদম পিছিয়ে যায়। তারপর দ্রুত এগিয়ে এসে চিঠিটা দিয়ে আবার পিছিয়ে যেতে নেয়। কিন্তু চিঠি তোহা ধরার আগেই ফ্লোরে পড়ে যায়। শিউলির বুকটা ধ্বক করে উঠে। এই বুঝি তোহা চড় দিবে। কিন্তু তোহা চড় দিল না। হাসোজ্জল মুখে চিঠিটা ফ্লোর থেকে কুড়িয়ে নিল। অধৈর্য্য হাতে চিঠি খুলছে সে। ওর হাত কাঁপছে আনন্দে। অনেকদিন পর ওর মলিন চোখেমুখে তৃপ্তি,উচ্ছাস,আনন্দ! দেখতে ভালো লাগছে। শিউলির বুকে প্রশান্তির বাতাস দোল খায়। তোহাকে খুশি দেখলে তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। এই মানুষটাকে সে যত ভয় পায়, তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তোহার সামনে ভয়ে ওর মাথা ঠিক থাকে না। প্রত্যেক কাজে ভুল করে বসে। যেমন এইমাত্র চিঠিটা দিতে নিয়ে ভুল করলো। চিঠিটা হাত থেকে ফেলে দিল। খিটখিটে মেজাজী তোহা অন্যসময় হলে ঠিকই এই ছোট ঘটনাটা নিয়েও সিডর(ঘূর্ণিঝড়ের নাম) ডেকে আনতো। কিন্তু আজকে আমীরের চিঠি পেয়ে সে তার কোমলসত্তায় ফিরে এসেছে। আমীরের কোমলমতী আহ্লাদী হয়ে উঠেছে। তোহা চিঠি পড়তে নিয়েও পড়লো না। শিউলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” তুই যা।”
শিউলি বুঝলো তোহা চিঠি একা পড়তে চাইছে৷ তাই হাসিমুখে বের হয়ে গেল। তার আজকে খুব ভালো লাগছে। তোহার হাসি দেখতে পেরেছে, আজকের দিনটা খুব সুন্দর হবে!
তোহা চিঠি নিয়ে বিছানায় বসে যায়। উত্তেজনায় পুরো শরীর কেপে কেপে উঠছে। আমীরের আরেকটা চিঠি! বেঁচে থাকার আরেকটা অবলম্বন! উফফ! এই চিঠিটাও আগের চিঠির মতোই টাইপ করা। তোহা পড়ার আগে খুশিতে কাগজে মুখ গুজলো। একটা কাগজ জুড়ে কত অদ্ভুত শান্তি! এই কাগজটির চেয়ে দামী তোহার জীবনে আর কি হতে পারে?

এইযে মিস, তাসনিয়া তোহা। আচ্ছা, প্রথম বাক্যেই ভুল করলাম নাকি? ‘মিস’ এর জায়গায় তো ‘মিসেস’ হওয়ার কথা ছিল না? আসলে আমি ভুল করিনি। ভুল আপনারই হচ্ছে। যদি শাহভীর আমীর হোসাইন খান’কে এখনো নিজের স্বামী ভেবে থাকেন তাহলে আপনি পুরো ভুলের স্বর্গে বাস করছেন মিস তোহা! এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে আমি আপনাকে সাহায্য করছি।
সুপ্রভাত! ঘড়িতে তাকিয়ে দেখুন, ঠিক সকাল আটটা বাজে। এই সকাল সকাল আপনাকে অনেকগুলো শক একসাথেই সামলাতে হবে। কিচ্ছু করার নেই। শকগুলো ইলেকট্রিক শকের থেকেও গুরুতর। বিস্ময়ে মূর্ছা যেতে পারেন। তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নিন। মন শক্ত করুন।
জনগণের কাছে ড. রিব সিকেন্ট একটা বিস্ময়ের নাম। কিন্তু আপনার কাছে তো ড. রিব সিকেন্ট একজন অপরিচিত ব্যক্তি। আপনি তাকে চেনেনই না। হঠাৎ করেই গতরাতে জানতে পারলেন, আপনার স্বামী শাহভীর আমীর হোসাইন খানের অন্যনাম ড. রিব সিকেন্ট! কি অদ্ভুত না? সে কোনো সাধারণ ডাক্তার বা ফার্মাসিস্ট নয়। একজন সাইন্টিস্ট! খুব অবাক লাগছে? আচ্ছা সে আপনার স্বামী হয়ে এতোবড় একটা সত্য কেন আড়াল করলো? যদি আপনি জেনেও যান, সে একজন গ্রেট সাইন্টিস্ট তাহলে ক্ষতি কি? সহধর্মিণী হওয়ার পরেও কেন আপনার সাথে এতো লুকোচুরি তার? আচ্ছা, আপনাকে সে রোজ কিসের ঔষধ খাওয়ায়? আপনার পায়ের পায়েলটা কি আদৌ ভালোবাসার চিহ্ন নাকি এটাও কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ? আর আপনার স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টা? এটাই বা কি? ফিল্মের হিরোইনের মতো ঔষধ খেয়েই নিশ্চয়ই স্মৃতি ফিরে পাওয়া সম্ভব না! অনেক প্রশ্ন! উত্তর আমি দিচ্ছি। সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই তো লিখতে বসলাম।
আমি শাহভীর আমীর হোসাইন খান। যাকে আপনি একশো সতেরো দিন আটঘণ্টা কিছু মিনিট আর কিছু সেকেন্ডের জন্য নিজের স্বামী ভেবেছেন। এখনি আপনার ভুল ধারণা ভেঙে দেই আসুন। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আমি আপনার কেউ নই। আমাদের কখনও বিয়েই হয়নি। প্রেম, ভালোবাসা তো দূরের কথা আপনি আমাকে এক অক্ষরও চেনেন না। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার বউ হয়ে গেলেন। আপনাকে বউ বানাতে হলো। আর বিশ্বাস করাতে হলো আমি আপনার প্রেমিক, আমাদের সম্পর্কের বয়স এক বছর। বিয়ে হয়েছে তিনমাস। আরও অনেক অনেক দাহা মিথ্যে কথা। যেগুলো আপনার বোকা মস্তিষ্ক মেনে নিতে বাধ্য। একদম চাপ নিবেন না, আস্তে আস্তে আপনার সব মনে পড়বে। কারণ আপনার ব্রেইন এখন আর কারো কন্ট্রোলে নেই। সে নিজের মতো চলছে। আপনার সাবকন্সিয়াস মাইন্ড নিজস্ব গতিতে কাজ করছে৷ এতোদিন এই সাবকন্সিয়াস মাইন্ডের দখলদারি করেছি আমি। এই আমি যা বলতাম, যেভাবে বলতাম, আপনি সেটাই বিশ্বাস করতেন। কারণ আপনার মস্তিষ্কে শুধু দুইটামাত্র অপশন ছিল। হয় বিশ্বাস করো, নাহয় মরো। আমার কথা বিশ্বাস না করলে আপনাকে অন্যকিছু ভাবতে হবে। আর সেটা করতে গেলেই হবে ব্রেইনের শিরা ছিড়ে ব্রেইন স্ট্রোক।যাকে বলে সেরিব্রাল হেমারেজ। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে আপনি আমার কথাগুলো সব অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছেন। এখানেও অবশ্য ক্রেডিটটা আমারই। আমাদের সুইট মোমেন্টের ভিডিও, ইমেজ, আরও কত প্রমাণ দেখিয়েছি। যদিও সবই মিথ্যে, কিন্তু আপনি তো বিশ্বাস করেছেন। সব দৃষ্টিভ্রম, কিন্তু আপনি মেনে নিয়েছেন। ঠিক রিম্মি যেমনটা বলেছিল, ভিশন অফ উইশেস। ওই মোবাইলে আসলে ভিডিও ফোল্ডার, ইমেজ ফোল্ডার বলে কিচ্ছু নেই। সব খালি, ফাঁকা। ঠিক আপনার মস্তিষ্কের মতো। সেখানে আছে শুধু একটা ধূসর রঙ। যেটা আপনার মস্তিষ্কের সাথে কানেক্টেড। ওই রঙে ইশারা করে আমি আপনাকে যে গল্প বলবো, আপনি সেটাই দেখতে পাবেন। পুরো পৃথিবীর মানুষ একসাথে এসে বুঝালেও আপনি আমার কথা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারবেন না। অনেক মজার গেইম। এই গেইমের আবিষ্কারকও আমি। এখন কথা হচ্ছে, কেন? আপনাকে বউ বানিয়ে, মিথ্যে সংসার সাজিয়ে, এতোবার ধোঁকা দিয়ে আমার লাভটা কি হলো? আমি কি চাই আপনার কাছে? আসলে আপনার কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। আপনি শুধু আমার কাছে একটা গুটি। যে গুটি চেলেই আমি খেলায় বিজয়ী হতে পারি। আপনি না থাকলে আমি এ বাসায় প্রবেশ করতে পারতাম না। মানুষ বিভিন্ন সন্দেহ করে আমার আসল পরিচয় বের করে ফেলতো। তাই আমি নিজের একটা নকল পরিচয় তৈরী করলাম। মিস তাসনিয়া তোহার হাসব্যান্ড। এবার কারো সন্দেহ করার অবকাশ নেই। রিম্মি পর্যন্ত পৌছাতে আপনার সাহায্যটা আসলেই বিশেষভাবে দরকার ছিল। এখন আপনি বলতেই পারেন, কেন বিনা দোষে আপনাকে এতোবড় শাস্তি দিলাম? রিম্মি আর আমার গোপন যুদ্ধে আপনাকেই কেন অস্ত্র বানাতে হলো? আসলে এখানে আপনার নিজেরই একটা মারাত্মক মিস্টেক আছে। সেই মিস্টেকটা যদি না করতেন তাহলে এসব কিছুই হতো না। উনত্রিশে নভেম্বর, বিকাল পাঁচটায় শপিংমলের পেছনের গেইট দিয়ে বের হচ্ছিলেন। ভেরি গুড জব। কিন্তু রিম্মির মতো একই ডিজাইনের ড্রেস কেন পড়তে গেলেন? এই ম্যাচিংটা কি খুব জরুরী ছিল? আমি জানি এটা কো-ইন্সিডেন্ট। কিন্তু মাথামোটা আওয়ান জানতো না। সে আপনাকে রিম্মি ভেবে ভুল করে তুলে আনলো। রিম্মিকে যে ডোজ দিয়ে অজ্ঞান করার কথা ছিল, সেটা আপনার উপর ওয়েস্ট হয়ে গেল। আমার কতবড় ক্ষতি হয়েছিল সেদিন তার কোনো ধারণা আছে? সেই আঙ্গিকে চিন্তা করলে আপনার এটুকু শাস্তি তো অনেক কম! আমি চাইলে অনেক ভয়ানক অবস্থা করতে পারতাম আপনার। কিন্তু করিনি। হালকা মায়া লেগেছে। আসলে রিম্মি তো কোনো সাধারণ মানবী না। ও আমার প্রোগ্রামিং করা বিস্ময় মানবী। ওর পেছনে কতটাকা ইনভেস্ট করেছি আপনি ভাবতেও পারবেন না। ওর ওই বিশেষ মস্তিষ্কের দাম কত জানেন? সংখ্যায় সেটার পরিমাপ প্রকাশ করতে গেলে আমার এই চিঠি আর শেষ করতে হবেনা। ওকে এইভাবে তৈরী করতে দীর্ঘ চারটি বছর আমি সূর্যের আলো থেকে দূরে থেকেছি। আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষয় হতে যাচ্ছিল , মস্তিষ্কের অসহনীয় যন্ত্রণায় সারাখন ছটফট করতে করতে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছিলাম। এই মিশন আমার জীবনের অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট এক্সপেরিমেন্ট আমার জন্য কি সেটা শব্দে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। এই এক্সপেরিমেন্ট করতে যদি আমার মৃত্যুও হতো, আমি পরোয়া করতাম না। অথচ রিম্মি এর গুরুত্বই বুঝলো না। প্রথমেও বেইমানি করেছে এখনো বেইমানি করছে। করেই যাচ্ছে। এই মেয়ে জাত বেইমান। আমি যখন ওর উপর এক্সপেরিমেন্টটা করতে চেয়েছিলাম, তখন ও খুব সহজেই রাজি হয়। বিনিময়ে আমার কাছে দাবী করে একশো বিশ হাজার ডলার। আমি দিয়ে দেই।শর্তমতো রিম্মি আমার ব্যবহারিক যন্ত্র হয়ে যায়। টাকায় কেনা সম্পত্তি। কিন্তু যখন আমার সারাজীবনের সঞ্চয় ইনভেস্ট করে এক্সপেরিমেন্টের ব্যবস্থা করলাম, তখন ও পালিয়ে গেল। ধোঁকাবাজ! এই ধোঁকাবাজকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম মুনের মাধ্যমে। মুনকে তো নিশ্চয়ই চেনেন। রিম্মির আদরের ছোটবোনটি। মুনকে তুলে এনে ল্যাবে আটকে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ রিম্মি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমি তো এটুকু কঠোর হতেই পারি। কিন্তু মুনের ক্ষতি করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। শুধু রিম্মিকে ভয় দেখানোর জন্য ওকে কিডন্যাপ করেছিলাম। মুন আমার কাছে যত্নেই ছিল। কিন্তু মেয়েটা কেন জানি আমাকে দেখলে ভয় পেতো। বড়বোনের মতো পিচ্চিটাও উড়নচন্ডী। চিপস, চকলেট, বেলুন, ফুল, আইসক্রিম কিচ্ছু দিয়ে আটকে রাখতে পারতাম না। মুনও রিম্মির মতোই আমার কাছ থেকে পালানোর চান্স খুঁজতো। বারবার হাই সিকিউরড ইলেকট্রিক দরজার সামনে চলে যেতো। ওই দরজা পাসওয়ার্ড ছাড়া খোলে না। মুন পা দিয়ে খোলার চেষ্টা করতো। কি সাংঘাতিক মেয়ে! দরজাতে শক লেগেই ওর একপায়ে ফ্রাকচার হয়ে যায়। তারপর থেকে ওই পায়ে ভর দিয়ে মেয়েটা আর হাটতে পারেনা। রিম্মি ভাবে এটাও আমার দোষ। আমি নাকি ওকে বাগে আনতে এসব করেছি। আচ্ছা তাও মেনে নিলাম। মুনের পা ঠিক করার দায়িত্বও নিলাম। কিন্তু রিম্মি দিল না। হয়তো ভেবেছিল ওর উপর যে এক্সপেরিমেন্ট করার কথা ছিল সেটা হয়তো এবার আমি মুনের উপর ট্রাই করতে যাচ্ছি। পরে অবশেষে রিম্মি নিজেই এক্সপেরিমেন্টের জন্য রাজি হয়েছিল। আর আমি আমার এক্সপেরিমেন্টে কতটা সফল সেটা তো আপনাদের চোখের সামনে, রিম্মিকে দেখলেই বুঝতে পারেন। অথচ রিম্মি যখন বুঝলো সে সুপার গার্ল হয়ে গেছে তখন আবারও গাদ্দারি করলো। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এলো। মেয়েটাকে যতই আপগ্রেড করি না কেন, বুদ্ধিটুকু মনে হয় হাটুর নিচেই থাকবে সারাজীবন। ও জানেইনা, আমার ইশারা ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রান্তে গিয়ে শান্তি পাবে না। ওকে খুঁজতে বাংলাদেশে চলে এলাম। অবশ্য বাংলাদেশে আসার অন্য আরেকটা কারণ ছিল। পৃথিবীর আটটি দেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমাদের একটা সংস্থা ইংলিশ ডিবেট কম্পিটিশন অর্গানাইজ করেছিলো। আমার দায়িত্ব পড়ে জাপানে। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই বাংলাদেশ চুজ করে। যেন এক ঢিলে দুইপাখি ধরা যায়। যেকোনো দেশে এলে আমি ওই দেশের সাধারণ জনগণের সাথে খুব গভীরভাবে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করি। সেজন্য ওদের আদব-কায়দা, চাল-চলন, সব নতুন নিয়মে শিখতে হয়। এটাও আমাদের রিসার্চের অংশ। আপনাদের কলেজ থেকে ডিবেট কম্পিটিশনে আপনি সিলেক্ট হয়েছিলেন। উইনারও হয়েছিলেন। আপনার স্পিচ জাস্ট মারভেলাস ছিল। ব্রাভো! তারপর যখন জানলাম ওই স্পিচ আপনি নিজে তৈরী করেছেন, আমি আরও ইম্প্রেসড হই। সেদিন থেকেই আপনাকে গোপনে ফলো করতে শুরু করি। আপনি কিন্তু খুব উদাসীন মানুষ। পাবলিক বাসে চলার সময় আশেপাশে খেয়ালও করেন না৷ একদিন একটা হাফ সাইজের ইডিয়েট বারবার আপনার চিকন কোমরে হাত বুলাচ্ছিল। আর আপনি লোকটাকে স্যরি বলছিলেন। হাউ সিলি! আপনার কি ধারণা? বাসে ধাক্কাধাক্কির কারণে এমন হচ্ছিল? না মিস তোহা৷ আসলে ইডিয়েটটা আপনাকে টাচ করার কৌশল খুঁজছিল। এটা না বুঝেই আপনি বাস থেকে নেমে গেলেন। কিন্তু আমার শরীরের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছিল৷ মেয়েমানুষের অসম্মানে জন্মগতভাবে আমার এ্যালার্জী। এটা আমি কখনোই মানতে পারিনা। বাস থেকে নেমে যখন আপনি রিকশায় উঠলেন আমি তখন ওই লোকটাকে তুলে নিয়ে রেললাইনের অপর পাশে ওয়েট করছিলাম। ওইখানে প্রতিদিন সিগন্যাল পড়ে। ঘণ্টাখানেক বসে থাকতে হয়। ইচ্ছে ছিল আপনাকে মজা দেখাবো। ভেবেছিলাম জানোয়ারটার হাত কেটে দিবো। কিন্তু পরে ভাবলাম হাত কাটলে ব্যাপারটা নরমাল হয়ে যায়। কান কাটলে একটু ইউনিক হবে। আপনাকে দেখানোর জন্যই ওর কানটা কেটেছিলাম। কিন্তু আপনি ভালো করে না লোকটার চেহারার দিকে তাকালেন আর না আমার দিকে। ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। হয়তো বুঝলেনও না আহত জানোয়ারটা কিছুক্ষণ আগেও আপনাকে দেখে মুখের লালা ফেলছিল। সেই উপযুক্ত শাস্তিটাই ওকে দেওয়া হয়েছে। আপনি কিছু তো বুঝলেনই না উল্টো আমাকেই ভয় পেতে লাগলেন। পরদিন কলেজের অডিটোরিয়ামে প্রাইজ নিতে এসে ভয়ে অজ্ঞানই হয়ে গেলেন। কি অদ্ভুত মেয়ে মানুষ! ধ্যাত! যাইহোক, সেদিন যদি রিম্মি কিডন্যাপ হতো তাহলে আপনাকে আজ এইদিন দেখতে হতো না। রিম্মিকে সেন্সলেস করার জন্য যে মেডিসিন সেটা কোনো সাধারণ মানুষের কাছে গেলে অন্তত একমাস সেন্সলেস থাকার কথা। আপনি হয়তো সাধারণের চেয়েও দূর্বল। পুরো তিনমাস সেন্সলেস ছিলেন। তাই তিনটি মাস আপনাকে যত্ন করে আমার কাছেই রাখতে হয়েছিল। তারপর যখন অনেক প্রতিক্ষা,অপেক্ষার পর আপনার সেন্স ফিরে আসে, আমি হয়ে যাই আপনার একবছরের প্রেমিক আর তিনমাসের স্বামী। তারপর আপনাকে নিয়ে রিম্মির ফ্ল্যাটে চলে আসি। রিম্মি তো আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওর উপর নজরদারি করা আমার অধিকার! আর আপনি ছিলেন আমার হেল্পিং হ্যান্ড। মাথায় কি কিছু ঢুকেছে? না ঢুকলে আবার প্রথম থেকে পড়া শুরু করুন। আস্তে আস্তে সব ক্লিয়ার হবে।
এখন আসল কথাটা বলি। আপনাকে এতোবড় চিঠি লেখার উদ্দেশ্য একটাই। চিঠিটা যখন আপনি পড়ছেন তখন আমি এ পৃথিবীতে নেই। আছি, তবে বেঁচে নেই। আমার দেহটা শুধু পড়ে আছে নির্দিষ্ট কোনো জায়গায়। এই আমার মতো মানুষের জন্য কষ্ট পাওয়ার কারণ দেখি না। আমি নিজেই আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছি না অতএব আপনিও পাবেন না। আমি সুইসাইড এটেন্ড করেছি। এর পেছনেও স্বার্থগত কারণ আছে। আমার মৃত্যুর মাধ্যমে পৃথিবীকে আমি বিরাট কিছু উৎসর্গ করে যাচ্ছি। আমার সেই উৎসর্গ আপনি হয়তো নিজচোখে দেখতে পাবেন না। পরবর্তী প্রজন্ম পেলেও পেতে পারে। কিছু বুঝেন নি? আচ্ছা বিগ ব্যাং থিউরিতে বিশ্বাস করেন আপনি? একটা উৎসহীন বিন্দু। প্রচন্ড ভর আর তাপ ছিল এই বিন্দুতে। এই তাপের কারনে সেটি একসময় বিস্ফোরিত হয় এবং তা থেকেই সব গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র সব কিছু সৃষ্টি হয়। এটাই বিগ ব্যাং থিউরি। এখন ধরে নিন ওই বিন্দুটা আমি। আমার সুইসাইড করাটা হলো বিস্ফোরণ। তারপর আমার থেকে সূচনা হবে হাজার হাজার সৃষ্টির!

এতো সহজে আপনাকে বিদায় দিচ্ছি না। খুব শীঘ্রই দ্বিতীয় চিঠিতে দেখা হবে। সেই চিঠি অবশ্য ড. রিব সিকেন্টের পক্ষ থেকে আসবে না। আপনার হারানো নকল স্বামী আপনাকে চিঠিটা দিবে। মানে আমার দ্বিতীয় সত্তা। ওই চিঠি ঠিক একমাস পর এমন সময় আপনি পাবেন। চিঠিটা এই বাসাতেই আছে। কিন্তু এখন হাজার খুঁজলেও পাবেন না। একমাস পর পাবেন। ততদিন, ভালো থাকুন। আর আমাকে ঘৃণা করতে শিখুন। ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য আমি হতে চাইনা।

~শাহভীর আমীর হোসাইন খান

চিঠিটা বন্ধ করতেই তোহা আবিষ্কার করলো তার শরীর ভয়ংকরভাবে ঘামছে। দ্বিতীয় চিঠি মানে? তোহার কাছে এখন আমীরের দুইটা চিঠি। যেটা সে এইমাত্র পড়ে শেষ করলো সেটা আসলে প্রথম চিঠি। আর যেটা একমাস ধরে ওর কাছে আছে, সেটাই দ্বিতীয় চিঠি। এই চিঠি একমাস পর মানে আজকে পাওয়ার কথা ছিল। আর যে চিঠিটা সে এইমাত্র পেয়েছে, এটা একমাস আগে পাওয়ার কথা ছিল! এইটুকু ক্লিয়ার। কিন্তু এতোবড় ব্লেন্ডার হলো কিভাবে? তোহা যদি একমাস আগে ঠিক এই চিঠিটাই পেতো তাহলে ওর জীবনটা এমন দূর্বিষহ ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যেতো না। সে হয়তো আমীরের মৃত্যুটা আরও সহজভাবে মানতে পারতো। কারণ তখন সে ধরে নিতো আমীর তাকে ভালোই বাসেনি। শুধু ব্যবহার করেছে। এই যুক্তিতে আমীরকে সে ঘৃণা করতে পারতো। তারপর একমাস পর মানে আজকে তোহা আগের চিঠিটা পেতো। যেটায় আমীর ওর ভালোবাসার কথা লিখেছে। তখন হয়তো তোহার খুব খারাপ লাগতো, কান্না পেতো। কিন্তু ওর জীবনটা এমনভাবে অগোছালো হয়ে যেতো না। সে সামলে নিতে পারতো সব ধাক্কা। আমীর আসলে চেয়েছিল তোহাকে কোনো কষ্ট না দিয়ে সব সত্যি প্রকাশ করতে। কিন্তু সত্যিগুলো এতোই নির্মম যে কষ্ট পেতেই হবে। তাই তোহার কষ্টগুলো যেন কোনোভাবে কিছুটা হলেও লাঘব করা যায় তাই আমীর এই প্রথম চিঠি- দ্বিতীয় চিঠির খেলাটা খেলেছে। কিন্তু ওর ওই পরিকল্পনা কেউ ভেস্তে দিতে চেয়েছে হয়তো। তাই প্রথম চিঠির জায়গায় দ্বিতীয় চিঠি এনে রেখেছে। যে কারণে আজকে তোহা জীবন্ত লাশ! কে তোহার এতোবড় ক্ষতি করলো? মৃত আমীরের এই সূক্ষ্ম চাল কে এতো সহজে উল্টে দিল?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here