#ধোঁয়াশা
#পর্ব_১৯
#Saji_Afroz
.
.
.
নিয়ন্তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে ইরফান। নিয়ন্তা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-
ঠিক আছো তুমি ইরফান?
-হু।
-ভয় করোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-নিয়ন্তা?
-বলো?
-আমরা এই বাসাটা থেকে দূরে কোথাও চলে যাই?
-তোমার কি মনে হয় ওখানে বর্ণের আত্মা আমাদের পিছু নিবেনা? এইখানে যেহেতু আসতে পেরেছে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে যেতে পারবে।
.
খানিকক্ষণ চুপ থেকে ইরফানের উদ্দেশ্যে নিয়ন্তা বললো-
আচ্ছা? এমন কিছু কি আছে যা আমি জানিনা?
.
নিয়ন্তার কথা শুনে তার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে নিলো ইরফান।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো-
কি বলতে চাইছো তুমি?
-রেগে কেনো যাচ্ছো! আমি শুধুই জানতে চেয়েছি।
-কি জানতে চাইছো তুমি?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিয়ন্তা বললো-
কিচ্ছুনা।
.
.
.
বাইরে পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙলো নিয়ন্তার। আড়মোড়া ভেঙ্গে সে উঠে বসলো বিছানার উপরে।
মিটিমিটি চোখে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠার কথা ভাবতেই সঙ্কুচিত হয়ে এল তার চোখমুখ।
তার সাথে যা হয়ে যাচ্ছে এসব কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। আর হেলাফেলা করা ঠিকও হবেনা এসব নিয়ে।
কিন্তু কিইবা করার আছে তার!
.
ভাবতেই ভাবতেই প্রিয়ার কথা মনে আসলো নিয়ন্তার। কাল চা বাগানে প্রিয়া আদৌ ছিলো কিনা তার জানতে হবে।
.
চটজলদি তৈরী হয়ে নিলো নিয়ন্তা।
ইরফানের দিকে তাকিয়ে দেখলো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। সারারার ভয়ে ঘুমোতে পারেনি ইরফান।
ইরফানের চেহারার দিকে তাকাতেই নিয়ন্তার বুকটা ধুক করে উঠলো।
অনেক কিছুর মূল্যে সুখের সন্ধান সে পেয়েছে যা সে হারাতে চায়না। কিন্তু সব সত্যি না জানা পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ও ফেলতে পারছেনা সে।
ইরফানের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো নিয়ন্তা।
আর বিড়বিড় করে বললো-
তুমি ঘুম থেকে উঠার আগেই আমি চলে আসবো সাহেব।
.
.
.
-চা টা ভালো হয়েছে।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে হালকা হেসে প্রিয়া বললো-
রকি ছোট হলে কি হবে! ঘরের সব কাজই সে পারে।
-হুম। তা আপনার হাসবেন্ড আজও কি বাইরে? এখন কিন্তু মাত্র সকাল ৬টা।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলো প্রিয়া।
তাকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে শান্ত গলায় নিয়ন্তা প্রশ্ন করলো-
আপনার স্বামী যে মৃত আমাকে বলেন নি কেনো?
.
চোখের চশমাটা হাতে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতেই প্রিয়া বললো-
সুযোগ হয়নি।
-সুযোগ অনেক ছিলো। আপনি বলেন নি। আপনি বরং বলতে পারেন ইচ্ছে হয়নি।
-বোধহয়।
-আমার সেদিনই বোঝার উচিত ছিলো যেদিন আপনার স্বামী আমাকে না দেখেই পেইন্টিং বানিয়েছিলো।
-মানে?
-মানে আমি যেমন বর্ণ কে দেখতে পাই ঠিক তেমনি আপনি বাবলু ভাইকে দেখতে পান।
-ইরফান বলেছে এসব?
-আমার অনুমান।
-হাস্যকর। মৃত মানুষকে কেউ দেখতে পায় নাকি!
-আমি পাই।
-আমি পাইনা।
-মিথ্যে।
-তুমি যদি মিথ্যে কে সত্যি করতে চাও আমার আর কি বলার আছে!
-আপু আপনি কেনো আমার সাথে এমনটা করছেন?
-কেমন করলাম!
-আপনি গতকাল কার সাথে শ্রীমঙ্গল ছিলেন?
-আমি আর শ্রীমঙ্গল!
.
প্রিয়ার কথা শুনে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিয়ন্তা।
হাঁক ছেড়ে ডাকতে থাকলো আলিনাকে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে প্রিয়া বললো-
আলিনাকে ডাকছো কেনো?
-সেটা এখুনি বুঝবেন।
.
আলিনা ছুটে আসলো নিয়ন্তার কাছে। নিয়ন্তা তাকে কাছে টেনে নিজের কাছে এনে তার মুখে একটা চুমু খেয়ে বললো-
কাল আম্মু আর বাবাই এর সাথে শ্রীমঙ্গল গিয়েছিলে তুমি?
.
মুখ বাকিয়ে আলিনা বললো-
আম্মু আর বাবাই এর সাথে কখনো কোথাও যাইনি। আব্বুসহ আগে যেতাম।
-তা কাল সকালে তোমার আম্মু তোমার সাথেই ছিলো বাসায়?
-না, আম্মু কাজে ছিলো বাইরে।
-ঠিক আছে। তুমি খেলতে যাও।
.
আলিনা যেতেই নিয়ন্তা কর্কশ গলায় প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বললো-
কোন খেলা শুরু করেছেন আপনি? আমি কি জানতে পারি।
.
ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে নিয়ন্তা বললো-
যে খেলাটা আগেই শুরু হয়েছিলো ওটা আমি আর নতুনভাবে কিভাবে শুরু করবো! তবে হ্যাঁ, শেষ করতে পারবো।
-আপনি যা করছেন…..
-ভালো করছি।
.
প্রিয়ার সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বুঝতে পেরে নিয়ন্তা পা বাড়ালো সদর দরজার দিকে।
কিন্তু প্রিয়ার ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
-তুমিও কি সব সত্যি আমাকে জানিয়েছো নিয়ন্তা?
.
প্রিয়ার কথা শুনে ঢোক গিললো নিয়ন্তা। পেছনে না তাকিয়েই আমতাআমতা করে বললো-
কোন সত্যি?
.
মুচকি হেসে প্রিয়া বললো-
সেটা তুমিই জানো।
.
.
.
দুপুর ১২টা….
চুলোতে রান্না বসিয়েছে নিয়ন্তা।
তাই একটা পিড়ি পেতে রান্নাঘরেই বসে পড়লো সে।
.
প্রিয়া আজ কি বুঝাতে চেয়েছে তা মাথায় ঘুরছে নিয়ন্তার।
প্রিয়া কি সবটা জেনে ফেলেছে তার ব্যাপারে? আলিনা যদি কাল বাসায় থাকে তাহলে শ্রীমঙ্গল কে ছিলো? ইরফান যদি বন্ধুদের সাথে থাকে প্রিয়ার সাথে কে ছিলো? এসব কি তবে কারো আত্মা? যারা আলিনা ও ইরফানের রূপ ধরেছিলো!
কিন্তু এতে প্রিয়ার স্বার্থ কি?
.
অনেকগুলো প্রশ্ন জমে আছে নিয়ন্তার মনে।
.
সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনে বর্ণের বলা কথাটি।
কি এমন ইরফান কে স্বীকার করতে বলছে সে?
.
চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো নিয়ন্তা। ভাবতে লাগলো ৩বছর আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো।
.
বর্ণের সাথে সংসার শুরু করলেও তার সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়নি নিয়ন্তা। বর্ণ ও সময় দিয়েছিলো তাদের সম্পর্কটা মজবুত করার জন্য।
বর্ণ যেদিন জানতে পারলো নিয়ন্তা প্রেগন্যান্ট সেদিন সে একটুও হতবাক হয়নি। কেননা সে বুঝতে পেরেছিলো, যে আসতে চলেছে সে ইরফানের সন্তান। তবুও সে এক মুহুর্তের জন্যও নিজের মুখটা মলিন করেনি। বাচ্চাটিকে নিজের বলে মেনে নিয়েছিলো। সেই সময় নিয়ন্তার সাথে ইরফান যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও নিয়ন্তা সুযোগ দেয়নি ইরফানকে। সে তার আর বর্ণের সম্পর্কটা আগাতে আগ্রহী ছিলো। কিন্তু মাঝখানে ইরার আগমনে নিয়ন্তা সারাটা সময় ইরার পেছনেই ব্যয় করতো। বর্ণ মুখে কিছু না বললেও যে নিয়ন্তার একটু সঙ্গ পাওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করতো নিয়ন্তা তা বুঝতে পারতো। কিন্তু যতবারই নিয়ন্তা ইরার মুখের দিকে তাকাতো ততবার মনে হতো, বর্ণের সাথে সম্পর্ক গভীর হলে তাদের মাঝে অন্য একজন আসবে। তাতে করে বর্ণ যদি ইরার প্রতি অবহেলা করে তবে তার মেয়েটা কোথায় যাবে!
.
মনে পড়ছে নিয়ন্তার সেদিনের কথা। যেদিন বর্ণের সাথে তার প্রথম ও শেষ বারের মতো কথা কাটাকাটি হয়েছিলো।
.
-এতকাছে থেকেও কেনো এত দূরে থাকো নিমপাতা?
-দূরে কোথায় থাকি! সবসময় তোমার পাশেই থাকি। তাইনা?
-আমি কি বলতে চাইছি তুমি বুঝছো না?
-কি?
-আমাদের ইরাবতীর জন্য একটা খেলার সাথী চাইছি।
-আমি আর তুমিতো আছিই।
-একটা ভাই বা বোন হলে কি ভালো হতোনা?
.
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো নিয়ন্তার। বিছানার উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে না দেখেই সে কেটে দিয়ে বললো-
না হতোনা।
-কেনো?
.
গম্ভীরমুখে নিয়ন্তা জবাব দিলো-
তোমার রক্তকে তুমি আলাদা ভালোবাসা দিবে। মাঝখানে আমার মেয়েটা কে অবহেলা করবে।
-অবহেলা কেনো করবো!
-ও ইরফানের মেয়ে বলে…
-থামো, আরেকটা কথাও আমি শুনতে চাইনা নিয়ন্তা। এতোকিছুর পরেও এই কথা তুমি বলতে পারলে! এতোটা নিচু মনের ভাবো তুমি আমাকে?
-এটাই নিয়ম। পরের বাচ্চাকে যতই নিজের বলোনা কেনো ভালোবাসা নিজের টাকেই দিবে।
-মানলাম ইরা আমার অংশ নয়। কিন্তু তোমার অংশ তো?
-তাতেই আরো অসুবিধা বেশি।
-কিসের অসুবিধে?
-কি চাইছো কি এখন তুমি? ভোগ করতে চাইছো আমাকে? আসো করো। কিন্তু বাচ্চা আমি আর জন্ম দিতে পারবো না।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে চেঁচিয়ে বর্ণ বলে উঠলো-
আরেকটা ফালতু কথা বললে আমার চেয়ে খারাপ তুমি আর কাউকে দেখবেনা।
.
.
ফোনের রিং বেজে উঠলো নিয়ন্তার। রিং এর শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো সে।
স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো লন্ডন থেকে বর্ণের মায়ের ফোন এসেছে।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
-কেমন আছো বৌমা?
-জ্বী ভালো, আপনারা?
-আছি ভালো। ইরা মারা যাওয়ার পর বর্ণ বলেছিলো তোমাদের যেনো কিছুদিন একা ছেড়ে দেয়। তাই এতোদিন ফোন দিইনি। কিন্তু আজ তার ফোন বন্ধ পাচ্ছি। কোথায় সে?
-কদমহাটার বাইরে গিয়েছে সে বন্ধুদের সাথে। হয়তো নেটওয়ার্ক কাজ করছেনা।
-কথা হলে বলো আমাকে যেনো ফোন দেয় একটা। কতোদিন আমার ছেলের আওয়াজ শুনিনা।
-জ্বী।
-তুমি একা? বুয়া নেই?
-আছে।
-ঠিক আছে সাবধানে থেকো। রাখছি।
.
শ্বাশুড়িকে মিথ্যে কথা বলে নিয়ন্তার চোখ ছলছল করে উঠলো।
একপর্যায়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলতে লাগলো সে-
কেনো বর্ণ কেনো? কেনো তুমি আমার মেয়েকে মারলে সামান্য শারীরিক সম্পর্কের জন্য? এমনটা না করলে আজ হয়তো এই দিনটা আসতো না। তোমার মায়ের বুকটাও খালি হতোনা।
.
(চলবে)৬