ধোঁয়াশা পর্ব-২

0
1210

#ধোঁয়াশা
#পর্ব_২
#Saji_Afroz
.
.
.
দরজা খুলেই ইরফানের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো নিয়ন্তা।
নিয়ন্তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইরফান প্রশ্ন করলো-
কি হয়েছে?
.
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিয়ন্তা জবাব দিলো-
ওখানে…..
-কি?
-ওখানে টিকটিকি।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো ইরফান।
তার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
মজা লাগছে তোমার খুব বেশি?
এতো সুন্দর বাসায় টিকটিকি রেখেছো। লজ্জা করেনা?
-আমি কেনো টিকটিকি রাখবো!
-তাহলে আসলো কি করে?
-আরে টিকটিকি কি মানুষ লালন পালন করে নাকি!
.
নিজের বোকা বোকা প্রশ্নের কথা ভেবে খানিকটা লজ্জাবোধ করলো নিয়ন্তা।
আঁড়চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে বললো-
ক্ষিদে পেয়েছে। খাবার কই?
-নিচে রেখেছিলাম প্যাকেট টা।
দুহাতেই দরজায় কড়া নাড়ছিলাম সমান তালে।
এতোক্ষণ কি করছিলে তুমি?
-আমাকে দেখে বুঝতে পারছোনা কি করছিলাম?
-নাহ।
-ভালো করে দেখো।
.
নিয়ন্তার কথায় ইরফান তাকে পা থেকে শুরু থেকে আপাদমস্তক দেখতে থাকলো।
চোখ জোড়া বড় বড় করে বললো-
অপরূপা!
.
মুচকি হেসে নিয়ন্তা বললো-
এই শাড়ি পরার চক্করেই এতো খানি দেরী হলো।
-তোমাকে এভাবে দেখতে আমি ১২মিনিট কেনো ১২বছর মানে ১যুগ অপেক্ষা করতে পারবো।
-কিন্তু আমি পারবোনা একটা শাড়ি এতো সময় নিয়ে পরতে।
আর এখন সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার ক্ষুদায় পেটে মোচড় দিচ্ছে।
.
সিড়ির উপর রাখা প্যাকেট টা হাতে নিয়ে ইরফান বললো-
চলেন সাহেবা। খাবেন চলেন।
.
ইরফানের কথায় বুঝা যাচ্ছে সে প্রায় ১২মিনিট যাবৎ দরজায় কড়া নেড়েছে। কিন্তু আমি একটুও শুনতে পেলাম না।
সাজগোজে এতোটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম আমি!
.
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আপনমনে এসব ভাবছে নিয়ন্তা।
.
.
.
পান চিবুতে চিবুতে রিজাউল কবিরের উদ্দেশ্যে পারভীন কবির বললেন-
মেয়েটাকে অনেক দূরে বিয়ে দিয়ে দিলাম।
-এখন এসব বলে কি লাভ?
-হুম।
-এ ছাড়া কোনো উপায় ছিলোনা। যা হয়েছে নিয়ন্তার ভালোর জন্যই হয়েছে।
-ভালো কই হলো আর! আমাদের ইরা…..
-আহ পারভীন! সবসময় ভালো লাগেনা একই বিষয়ে কথা বলতে।
-হুম।
-কিন্তু মনে পড়ছে নিয়ন্তার কথা খুব। আমিতো মা। মায়ের মন তুমি বুঝবেনা।
.
স্ত্রীর কথা শুনে মনে মনে বলছেন রিজাউল কবির-
বাবাদেরও একটা মন থাকে। তারাও সন্তানদের জন্য ভাবেন, সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন। এসব তুমিও বুঝবেনা পারভীন।
.
.
.
এক টুকরো পরোটার মাঝে সামান্য আলুভাজি নিয়ে নিয়ন্তার মুখের দিকে এগিয়ে নিলো নিজের হাত ইরফান।
নিয়ন্তা খেয়ে বললো-
তোমার জন্য নানরুটি আর ঝোল আনোনি?
-নাহ। অন্যদিন খাবো।
.
হঠাৎ নিয়ন্তার ফোন বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো তার বাবার ফোন।
ইরফানের দিকে তাকাতেই সে বললো-
কে?
-বাবা।
-স্বাভাবিকভাবেই কথা বলো।
.
ফোন রিসিভ করে শান্ত গলায় বললো নিয়ন্তা-
হ্যালো বাবা?
-কেমন আছিস মা?
-ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?
-আমিতো ভালো আছি। তোর মা…
-কি হয়েছে মায়ের?
-কিছু হয়নি। তোর জন্য তার মনটা অস্তির লাগছে।
.
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিয়ন্তা বললো-
মাকে ফোনটা দাও বাবা।
.
পারভীন কবিরের হাতে ফোন দিতেই সে বলে উঠলো মেয়ের উদ্দেশ্যে-
তুই ঠিক আছিস?
-আছি মা।
-জামাই তোর খেয়াল রাখছেতো?
-রাখছে। তুমি এতো ভেবোনা মা।
-ভাবনা তো আর এমনিতেই আসেনা। যা ঘটে গেলো তোর সাথে…
-জানো মা? কাল মনে হয়েছে ইরা আমায় ডেকেছে।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে বুকটা ধুক করে উঠলো পারভীন কবিরের।
ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো-
ভুল ধারণা তোর।
-মা হয়ে ভুল ধারণা হবে?
-মা বলেই হচ্ছে।
-কিন্তু…
-কিভাবে সম্ভব তুই বল?
-হুম।
-আমাদের মাঝে আরেকটা ইরা নিয়ে আয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আমি যদি মরে যেতাম আরেকটা নিয়ন্তা আসলে সব ঠিক হয়ে যেতো মা?
.
মেয়ের কথা শুনে ধমকের সুরে পারভীন কবির বললেন-
নিয়ন্তা! এসব কি বলছিস তুই!
-ঠিকই বলছি যা বলছি। ফোন রাখো এখন। ভালো লাগছেনা আমার।
-মারে….
-রাখতে বললাম না? রাখবেনা তো? আমিই রাখছি।
.
ফোনের লাইন কেটে দিলো নিয়ন্তা।
টেবিলের উপর মাথাটা রেখে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকলো।
.
নিয়ন্তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় ইরফান বললো-
এভাবে কেনো কথা বললে মায়ের সাথে?
.
মাথা উঠিয়ে নিয়ন্তা বললো-
আমার মা আমি বলবো। তোমার কি!
-আমার অনেককিছু। তারা তোমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকলে অনেক সমস্যা আছে। তাদের বিশ্বাস করাতে হবে তুমি ভালো আছো। নাহলে…..
.
ইরফানের কথা শেষ না হতেই দাঁড়িয়ে পড়লো নিয়ন্তা।
দাঁতে দাঁত চেপে ইরফানের উদ্দেশ্যে বললো-
আমি ভালো নেই। শুনেছো তুমি? ভালো নেই আমি।
.
আর কোনো কথা না বলে হনহন করে ছুটে যায় সে নিজের রুমের দিকে।
.
.
.
-আপা?
.
রকির গলার আওয়াজ পেয়ে হাতে থাকা বইটা বন্ধ করে প্রিয়া বললো-
ভেতরে আয়।
.
রুমের ভেতরে প্রবেশ করে মাথা নিচু করে রকি বললো-
ইরফান ভাই ফিরে আসছে।
.
চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে প্রিয়া জিজ্ঞাসা করলো-
কবে?
-কাল। আমি এখুনি জানছি।
-ওহ!
-সাথে নাকি একটা আপাও আসছে।
-কিভাবে জেনেছিস?
-আমার এক বন্ধু দেখছে, এক আপাকে নিয়ে ইরফান ভাই ঘরে ঢুকছে।
-ওহ। ঠিক আছে, তুই যা।
.
রকি বের হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়া।
.
নিয়ন্তার সাথে আসেনিতো ইরফান? নাকি আর কেউ?
.
আপনমনে এসব ভেবে প্রিয়া পা বাড়ায় ইরফান এর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
.
.
.
রুমের সাথে জোড়া লাগানো বারান্দায় গিয়ে বারান্দায় পাতা ইজি চেয়ারটাতে বসলো নিয়ন্তা।
হাতের তালু গুলো ঘামে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে নিয়ন্তার। কপালে ঘামের বিন্দু জমছে তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানার ন্যায়। অস্থির লাগছে তার ভীষণ। অথচ প্রচুর বাতাস বইছে বাইরে।
এমন অস্থির কেনো লাগছে তার?
কার জন্য? ইরা? নাকি…..
নাহ, আর কিছু ভাবতে চায়না সে।
.
কিছুক্ষণ নিশ্চুপভাবে বারান্দার পাশের পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকলো নিয়ন্তা।
কিন্তু মনের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছেনা সে।
চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে ইরার মুখ খানি। না চাইতেও তার চোখ বেয়ে পড়ছে অনবরত পানি।
.
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ জোড়া বুজে ইরার ভাবনায় তলিয়ে যায় সে।
-আম্মুই?
-ওলে আমার সোনা মনিটা! কি চায় তোমার?
-আব্বুইকে বলো একটা বড় টেডিবিয়ার এনে দিতে।
-তোমারতো ৩টে বড় টেডিবিয়ার আছে মামুনি।
-আরেকটা চাই। ওই যে পিং কালার।
-পিংক কালার?
-হুম।
-ঠিক আছে। তোমার আব্বুইকে বলবো আমি। আমার মামনির জন্য পিংক কালারের টেডিবিয়ার আনতে। এবার আম্মুইকে পাপ্পি দাওতো দেখি?
.
নিয়ন্তা মুখ এগিয়ে দিতেই ইরা তার মুখে ঠোঁট ছুইয়ে শব্দ করে বললো-
উম্মাহ।
.
-নিয়ন্তা?
.
ইরফানের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো নিয়ন্তা।
মুখ ভার করে বললো সে-
কি হয়েছে?
.
তার সামনে এসে তার হাত টেনে ইরফান বললো-
উঠো, এটা আমার চেয়ার।
.
নিয়ন্তাকে সরিয়ে ইরফান বসে পড়লো ইজি চেয়ারের উপরে।
.
নিয়ন্তা মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো-
আমি চললাম।
.
নিয়ন্তার এক হাত ধরে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে তাকে টেনে নিজের কাছে আনলো ইরফান।
খুব সহজেই যেনো নিয়ন্তার মুখটা দেখতে পারে সেভাবে নিজের কোলের উপর বসিয়ে আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরলো তাকে।
নিয়ন্তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললো-
উফ্ফ।
ছাড়ো আমাকে।
-ছাড়বোনা। তোমার জন্য নাস্তা অর্ধেক করে চলে আসতে হয়েছে।
-এসেছো কেনো? নাস্তা করেই চলে যেতে কোথাও।
-১মাসের ছুটি নিয়েছি সাহেবা, তোমার সাথে থাকার জন্য।
-আমার মাথাটা খাওয়ার জন্য বলো।
.
নিয়ন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে নাকের সাথে নাক লাগিয়ে ইরফান বললো-
অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করছে এখন।
.
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিয়ন্তা বললো-
কি?
.
ইরফান মুখটা আরো কাছে নিতেই চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো নিয়ন্তা।
তার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে।
ইরফান তার চোখের পানি জ্বীভ দিয়ে শুষে নিলো।
তারপর ফিসফিস করে বললো-
এতো মজাতো আগে জানতাম না! এখন থেকে রোজ তোমায় কাঁদাবো। তারপর চোখের পানি খাবো।
.
চোখ জোড়া খুলে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে নিয়ন্তা বললো-
শুধু পানি না সাহেব। সাথে ঘামও খেয়েছেন।
-ওহ! ঘামও মজা!
-আচ্ছা তাই!
-জ্বী তাই। কিন্তু এতো বাতাস বইছে চারদিকে। তুমি এভাবে ঘেমেছো কেনো? শরীর ঠিক আছে তোমার?
.
নিয়ন্তা কোনো কথা বলার আগেই কলিং বেল এর শব্দ পায় তারা।
.
ইরফান মুখে বিরক্তিভাব এনে বললো-
উহু! এই সময় আবার কে এলো! একটু শান্তিতে প্রেমও করতে দিলোনা।
.
ইরফানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ন্তা বললো-
দেখে আসি কে এসেছে।
.
নিয়ন্তাকে থামিয়ে ইরফান বললো-
এই না। তুমি থাকো। আমি দেখছি। হয়তো আমার পরিচিত কেউ….
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমিই যাও।
.
ইরফান এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে।
দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে দেখে চমকে যায় সে।
চোখ জোড়া বড় বড় করে বললো-
তুমি এখানে প্রিয়া!
.
চোখের চশমা ঠিক করতে করতে প্রিয়া বললো-
কেনো কোনো সমস্যা?
-নাহ। কিন্তু তুমিতো হুসাইন পুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলে?
-ফিরে এলাম আবার।
-ওহ।
-জিজ্ঞেস করবেনা কেমন আছি?
-হুম বলো?
-ভালোই।
.
এপর্যায়ে ফিসফিস করে ইরফান বললো-
-বাসায় কিন্তু আমার স্ত্রী নিয়ন্তা আছে। তোমার ব্যাপারে ও কিছু না জানলেই খুশি হবো।
-কেনো?
-সবটা তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলবো আমি।
-হুম।
.
পেছন থেকে নিয়ন্তা দেখলো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অতি সুন্দরী এক মেয়ে। তাঁতের শাড়ি পরা, চুলে বেণী করা, চোখে চশমা পরা, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে অনেক জ্ঞানীগুণী একটা মেয়ে। কিন্তু কে এই মেয়েটি?
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here