ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১
ছোটবেলায় আমি প্রচন্ড ত্যাড়া প্রকৃতির ছিলাম। আমার যেটা ভালো লাগতো আমি তাই করতাম। আমাকে যখন কোন কিছু করতে নিষেধ করা হত তখন আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়াতাম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হত পারে আমি হয়ত কাজটি করবো না কিংবা নিষেধ শুনেছি। কিন্তু আমি তার উল্টোটাই করতাম। তাই বাবা মা ছোটবেলা থেকে শাসন, অনুশাসন কায়দা কৌশলে আমার এই বদ অভ্যেসটা তাড়িয়েছেন। এখন যদিও ছোটবেলার মত অত জেদ নেই, কিন্তু এখনো বাবা মা মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না কোন কাজটি আমি করবো, কোনটি করবো না।
যাইহোক, বর্তমানে আমাদের সুখি পরিবার। আমি বাবা মায়ের দুইমাত্র কন্যা। বড় বোন বিয়ের পরে হাজবেন্ডের সাথে বিদেশে স্যাটেল। আর আমি সবে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। সবাই আমাকে ভালো মেয়ে বলেই জানে। মানে বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে বলতে যা বোঝায় সেই টাইপ আরটি।
আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজকে চারদিন। মুক্ত জীবন উপভোগ করছি। ভালোই লাগছে।
আমাদের নিজেদের বাসা। পাঁচতলা বিল্ডিং।আমরা থাকি পঞ্চমতলায়। তার কারণ ছাদ। ছাদ আমার খুব পছন্দ। আমার মুখ চেয়েই বাবা মাকে পাঁচ তলায় থাকতে রাজী হতে হলো। বিকেলবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে গল্প করছিলাম মা জানালো এই মাসে আমাদের দোতলায় নতুন ভাড়াটিয়া আসছে। আসুক, সেটা কোন ব্যাপার না। কারণ নতুন, পুরাতন কোন ভাড়াটিয়া নিয়েই আমার কোন মাথাব্যথা নেই, কোনরকম দখলদারি আমি পছন্দ করি না। ঠিক সেই কারনে তাদের সাথে আমার মেলামেশাও কম। সো কে এলো, কে গেলো তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
ঠিক এক তারিখেই নতুন ভাড়াটিয়ারা বাসায় উঠলো। মা গিয়ে দেখা করে আসলেন। ফিরে এসে জানালেন আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া আন্টির ইয়াং একটা ছেলে আছে। নাম ধ্রুব। ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ার। ছয়মাসের ছুটিতে দেশে এসেছে। তাই আমাকে কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করা হলো আমি যেন সাবধানে থাকি। তার সাথে যদি কদাচিৎ দেখা হয় আমি যেন তাকে এড়িয়ে যাই। আমি এক কান দিয়ে শুনলাম অপর কান দিয়ে বের করে দিলাম।
কিন্তু সমস্যা হলো মা প্রায় দুই একদিন বাদেই আমাকে এই নিয়ে সাবধান করতে শুরু করলেন।।
আমি মনে মনে রাগ হলেও চুপচাপ শুনে যেতাম। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে থাকলে সব বাবা মায়েদেরই একটা চিন্তা থাকে। মেয়ে কখন, কোথায়, কীভাবে কার সাথে জড়িয়ে যায়।আমার বাবা মাও তার ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং এসব নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।
একদিন সন্ধ্যাবেলা আমার এক বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় প্রথমবারের মত সেই ছেলেটার সাথে আমার দেখা হয়ে গেলো। আমি তাকে দেখা মাত্রই চোখ সরিয়ে নিলাম। সেও একঝলক তাকিয়ে ব্যস্তভাবে নিচে নেমে গেলো। কিন্তু ঐ একঝলকেই আমার যা হওয়ার হয়ে গেলো। রহস্যজনক ভাবে ঐ একঝলকেই আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম! তার সাথে তার মা মানে আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া আন্টিও ছিলো। আমি তার সাথে কুশল বিনিময় করে উপরে উঠে গেলাম। কিন্তু সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। পুরো একটা রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম। পরেরদিন মা আমার চেহারা দেখে চিন্তিত গলায় বারবার জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। আমি এড়িয়ে গেলাম।
তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ছাদে উঠতে শুরু করলাম। মায়ের কাছে শুনেছিলাম সে নাকি রোজ ছাদে উঠে। আমি তাঁকে ছাদে উঠতে দেখলেই কিছুক্ষন পর নেমে যেতাম। কখনো কখনো মাকেও সাথে নিয়ে উঠতাম। মাকে সাথে নেওয়ার কারণ তার মনে যেন আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরী না হয়। এতে অবশ্য লাভই হয়েছে। খেয়াল করলাম আমার প্রতি তার কিঞ্চিৎ ইন্টারেস্ট দেখা দিয়েছে। আড়চোখে প্রায়ই আমাকে লক্ষ্য করতো। আমি চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নিতাম। আর বাহ্যত অর্থ,”আপনার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। আমি হাওয়া খেতেই ছাদে আসি।”
কিন্তু একদিন আমার মনোভাবকে সম্পূর্ণ উল্টো করে দিলেন তিনি। আমি ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম আর প্রহর গুনছিলাম কখনো তিনি আসবেন। তিনি এলেন, আমাকে দেখলেন এবং নেমে গেলেন। খানখান হয়ে গেলো বুকের ভেতরটা। এরপর থেকে যতদিন আমাকে দেখেছেন প্রতিদিনই ছাদ থেকে নেমে গেছেন। আমি অবাক হতাম। তার এভাবে চলে যাওয়ার মানে ‘হি ডাজেন্ট কেয়ার এবাউট মি!’ কিন্তু আমার বোকা মাথায় এটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি তার প্রতি ইন্টারেস্ট বাড়ানোর জন্যই তিনি উল্টো চাল দিয়েছেন। আমি একটু একটু করে তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম! উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদর্শন পুরুষ! ফিট বডি! হাসলে গালে টোল পড়ে। সম্মোহিত চাহনী! নিজেকে কতক্ষন ধরে রাখা যায়?
তবে আশার কথা হলো মা বাবা আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ করছেন না। তার কারণ আমার নির্লিপ্ত স্বভাব। ঠিক এই কারণেই আমি মাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম ঐ ছেলের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই।
একদিন বিকেলে আমি ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছিলাম তিনি তখন উপরে উঠছিলাম। পাশাপাশি যখন দুজনে ক্রস করে গেলাম তখন তিনি আমাকে ডাক দিলেন,”এক্সকিউজমি?”
—“জি?”
—“আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?”
উনার প্রশ্নের জবাবে আমি একেবারে ইনোসেন্ট একটা ফেইস বানিয়ে ঢং করে বললাম,”কেন ভাইয়া?”
আমি যতটা আশা নিয়ে ভাইয়া ডেকেছিলাম ততটা রিয়েক্ট তার কাছ থেকে পাই নি। আমার ভাইয়া ডাকটা তিনি খুব সহজেই হজম করে নিলেন। হাসিমুখে বললেন,”না মানে, প্রথমদিন থেকেই চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে করতে পারছি না। ডু আই নো ইউ?”
আমি তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে নিচে নেমে গেলাম। সেদিনের পর থেকে অনেক দিন আর তার কোন দেখা সাক্ষাৎ পায় নি। কারণ আমি ছাদে উঠা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। একদিন মায়ের কাছে শুনলাম তাঁর ছোটবোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের পরপরই নাকি স্বামী স্ত্রী দুজনেই দেশের বাইরে চলে যাবে। বিয়ের আয়োজন খুব ধুমধাম করে করা হলো। বিয়ে উপলক্ষ্যেই আমাদের বিল্ডিংটা খুব জাঁকজমকভাবে সাজানো হলো। হিরো মহাশয় নিজে দাঁড়িয়ে সব কাজ তত্ত্বাবধান করলেন।
বৃহস্পতিবার, হলুদের দিন আমি সেজেগুজে আন্টির রুমে বসে রইলাম। চারদিকে সুন্দরী রমনীরা সব তাঁদের ড্রয়িংরুমে আনাগোনা করছিলো। সবার ছবি তুলে দিচ্ছিলেন হিরো মহাশয়। আমি ভেতরের রুমেই বসে রইলাম। ছবি তোলা শেষে তিনি বারবার এটা সেটা নেওয়ার জন্য ভেতরে আসছিলেন। আমি বসেছিলাম দরজার দিকে মুখ করে, তার ঘনঘন আসা যাওয়া দেখে উলটো দিকে ফিরে বসে রইলাম। কারণ বারবার তার সাথে চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছিলো। যেটা আমার জন্য বড়ই অস্বস্তিকর ব্যাপার! হঠাৎ তিনি ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক কি যেন খুঁজলেন তারপর একেবারে আমার পেছন বরাবর এসে দাঁড়ালেন। আমি যেই চেয়ারে বসেছিলাম, তিনি তার হাতল চেপে দাঁড়িয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলছিলেন! তিনি কি বলছিলেন তা আমার কানে গেলো না। ধরা পড়ে গেলাম,পড়ে গেলাম, টাইপ অনুভূতি! বুকের ভেতর ডামাডোল বাজচ্ছিলো। এত জায়গা থাকতে তাকে কেন আমার পেছনে দাঁড়িয়েই কথা বলতে হবে?
তিনি জানালেন মেহমানদের জন্য ব্যবস্থা করা চেয়ারের শর্ট পড়েছে, বাড়তি চেয়ারের প্রয়োজন। আশেপাশে কারো বাসা থেকে ধার করতে হবে।
আমি মনে মনে ভাবলাম তার সামনে আমি স্বাভাবিক আছি সেটা প্রমাণ করতেই হবে। তাই নিজেকে স্বাভাবিক জাহির করার জন্য আমি আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমাদের বাসায় বাড়তি চেয়ার আছে। আমার কথা শুনে আন্টি উনাকে নিয়ে আমাদের বাসায় থেকে চেয়ার নিয়ে আসতে বললেন।
অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে উনি আগে আগে হাঁটছিলেন আমি পেছন পেছন। আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো। তিনি সেটা বুঝতে পেরে আমাকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ড্রয়িংরুম তাঁর চারবছরের ভাগনীর সাথে কিছুক্ষন দুষ্টুমি করলেন। সেই ফাঁকে আমি বেরিয়ে পাঁচতলায় উঠে গেলাম। কিন্তু আবারো ইম্প্রেসড হলাম। যদিও আমি জানি, হি ইজ নট মাই টাইপ!” কিন্তু তবুও আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম। তাঁর সবকিছুই আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করছিলো। কিন্তু সেটা তো তার সামনে প্রকাশ করা যাবে না। উলটো এমন ভান করে থাকতে হবে যেন আমি তার প্রতি ইন্টারেস্টেড নই। আমি চেয়ার বের করে বাইরে দরজার সামনে রেখে দিলাম। নিজে বেরোলাম না। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে কতক্ষন টিভি দেখলাম। তারপর প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে নিচে নামলাম। আন্টি মানে উনার মা আমাকে বললেন হলুদ প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, সবাই ছাদে।
ছাদে উঠে দেখলাম হলুদ প্রোগ্রাম আসলেই শুরু হয়ে গেছে। আমি মাকে খুঁজতে শুরু করলাম। কারণ এনাদের আত্মীয়স্বজন কাউকেই আমার চেনা নেই। আর বাকি ভাড়াটিয়া যারা আছে তাদের সাথেও আমার তেমন মেলামেশা নেই। স্টেজের সামনে সারিবদ্ধভাবে চেয়ারে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মা আমাকে দেখে হাত নেড়ে ইশারা করলেন তার কাছে যাওয়ার জন্য। আমি ভিড় ঠেলে চিপাচাপা জায়গা বের করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মা যেখানে বসেছেন তার দুসারি পেছনে ফাঁকা জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োর কারণে আমি কারো পায়ে পাড়া দিয়ে ফেলি। আমার হিলের পাড়া খেয়ে কঁকিয়ে উঠলেন আহত ব্যক্তি। তাকে সরি বলতে গিয়ে খেয়াল করলাম তিনি আর কেউ নয়, হিরো মহাশয়। ব্যথায় মুখ কালো করে ফেলেছেন। মুহূর্তেই তার দুপাশের সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার বিব্রতমুখে বললাম,” সরি ভাইয়া আমি খেয়াল করি নি। বেশি লেগেছে?”
—“না ঠিক আছে।”
আমি কিছুক্ষন দুঃখিত মুখ করে তার পায়ের দিকে চেয়ে রইলাম। এর মানে ‘আপনাকে ব্যথা দিয়ে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।’ দুঃখ প্রকাশ শেষে মায়ের কাছে চলে গেলাম। পুরো অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত জায়গা থেকে নড়লাম না। অনুষ্ঠান শেষে সব গোছানোর আয়োজন চলছিলো। হিরো মহাশয়কে দেখলাম স্যু খুলে স্যান্ডেল পায়ে হাঁটছেন। আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ। আমার একটু খারাপ লাগলো। এতটা ইনজুর্ড হবে ভাবতে পারি নি।
আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কাজকর্ম দেখছিলাম এমন সময় আমাদের নিচতলার ভাড়াটিয়া দুটো মেয়ে এগিয়ে এলো। সীমা এবং সুমাইয়া। এরাও নতুন। খুব বেশিদিন হয় নি এসেছে। হাসিমুখে বললো,”আপু এসেছেন? আমরা তো ভেবেছিলাম। আপনি আসবেন নি।”
আমি সম্মতিসূচক মুচকি হাসলাম। কারণ মেলামেশা নেই, পরিচিত কেউ নেই এমন কারো অনুষ্ঠানে যেতে আসলেই আমার অস্বস্তি হয়। এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া মানে পুতুলের মত একজায়গায় বসে থাকা নতুবা মায়ের পেছন পেছন ঘোরা। দুটোই খুব বিরক্তিকর।
কথা বলতে বলতে সুমাইয়া এবং সীমা ওদের দুজনের সাথে বেশ ফ্রি হয়ে গেলাম। আমরা ছাড়াও ছাদের আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো। ধ্রুব এবং তার বন্ধুরা তখন ছাদ থেকে সোফা, চেয়ার এসব নামাচ্ছিলো। সুমাইয়া আর সীমা সেদিকে তাকিয়ে হাসছিলো আর নানারকম কথাবার্তা বলছিলো। আমি খুব বেশি তাকাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝে তাদের কাজকর্ম দেখছিলাম। এরমাঝে একটা মেয়েকে দেখলাম চেইঞ্জ করে ছাদে উঠে এলো। সুমাইয়া ফিসফিস করে বললো,”ধ্রুব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড।” আমি ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। মনে হলো মেয়েটাকে আমি চিনি।
.
.
.
চলবে