ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ২৮

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৮

রাত দুটোর দিকে আমার ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো। সন্ধ্যা থেকেই শরীর খারাপ ছিলো, প্রেগন্যান্সির কারনে পায়ে পানি এসে গেছে! কোমরেও হালকা ব্যথা! তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। রিংটনের উচ্চশব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সাদেক ভাই ফোন করেছে। এত রাতে তাঁর ফোন দেখে ঘাবড়ে গেলাম! বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শুরু হলো। যদিও আমেরিকার সময়ের সাথে আমাদের ছয়ঘন্টার ডিফারেন্স তবুও সচরাচর এই সময়ে ফোন আসে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো! মা আমার পাশে শুয়ে ছিলো। হালকা ঝাঁকুনি দিতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলো।

আমি ভয়ে ফোন রিসিভ করতে পারছিলাম না! উত্তজনায় হাঁত অনবরত কাঁপছিলো! মা আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করলেন! আমি নিশ্বাস চেপে রেখে কান খাড়া করে রইলাম! মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম! দুশ্চিন্তায়, আতংকে মাথার ভেতর নানারকম খারাপ চিন্তাভাবনার উদয় হচ্ছিলো। সেগুলো মাথা থেকে সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম!

ওপাশ থেকে সাদেক ভাই কিছু একটা বলার পর মায়ের মুখ পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলো! ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলে সজোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলেন। আমার পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো! ধ্রুবর কি কিছু হয়েছে? আকস্মিক কেঁদে দিলাম, মায়ের হাত ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে পাগলের মত চিৎকার করে বললাম,”ধ্রুব? মা ধ্রুব কি ঠিক আছে?”

মা আমাকে শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,”ধ্রুব অপারেশন টেবিলে মারা গেছে নিশাত! লাশ নিয়ে আসা হচ্ছে!

আমি স্তব্ধ, নির্বাক, হতভম্ভ! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কয়েক মুহূর্তের জন্য অনুভূতিশূন্য হয়ে গেলাম! পায়ের তলার মাটি সরে গেলো! চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এলো! এটা সত্যি হতে পারে না! আমার সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার করে দিয়ে, জীবনের সমস্ত আলো নিয়ে ধ্রুব এভাবে চলে যেতে পারে না! আমি ভুল শুনছি! ভুল শুনছি! ভুল শুনছি! মানসিক উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে মায়ের হাতের ওপরেই ঢলে পড়লাম!

জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম বাসাভর্তি লোকজনের সমাগম! কান্নার রোল পড়ে গেছে! লাশের খাটিয়ায় ধ্রুবকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। চোখ বন্ধ, মুখ সামান্য খোলা! যেন হাসতে হাসতে ঘুমাচ্ছে! নিয়তির নিষ্ঠুর, কঠিন, পরিহাস আমার সমগ্র দেহকে নিথর, নিশ্চল করে দিলো! নির্মম আঘাতে রক্তাক্ত করে দিলো আমার সমস্ত সত্তাকে! বাঁধ ভাঙা উদ্বেলিত ক্রন্দনে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম! “ধ্রুব..” বলে আকাশ পাতাল, ধরনী কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে আবারো মূর্ছা গেলাম। পাশ থেকে রাফি ভাই ‘ধর, ধর’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো।”

ঘড়িতে এখন সময় রাত তিনটা দশ! এটুকুই ছিলো স্বপ্ন! আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ, লোমহর্ষক দুঃস্বপ্ন! ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম পাশে মা ঘুমিয়ে আছে। আমার সারা শরীর থেকে আগুনের মত উত্তাপ বেরোচ্ছে। ঘামে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেছি! প্রথমে কিছুক্ষন কোথায় আছি, কি করছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না! ধীরে ধীরে হুঁশে ফিরলাম! স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললাম! এ কি নিষ্ঠুর বিদ্রুপ! কান্নার আওয়াজে মা ধড়ফড় করে উঠে বসলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল,”কি হয়েছে মা কাঁদছিস কেন?”

আমি আচ্ছন্নের মত মাথা নিচু করে পড়ে ছিলাম! বহু কষ্টে কান্না থামিয়ে আকুল কন্ঠে বললাম,”এক্ষুনি ধ্রুবর কাছে একটা ফোন করো মা! আমার খুব খারাপ লাগছে।”

মা সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো “খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?”

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালাম। সমস্ত শরীর থর-থর করে কাঁপছিলো! মা বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করলো। জোর করে পানি খাওয়ালো। তারপর আন্টির কাছে ফোন করলো। সংক্ষেপে তাঁকে সব ঘটনা খুলে বলে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো,”নে ধর কথা বল!” আমার বুক তখনো কাঁপছিলো! হৃদস্পন্দনের ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম!

ধ্রুবর গায়ে হস্পিটালের পোশাক। নীল রংয়ের ঢিলাঢালা একটা টি-শার্ট আর নীল ট্রাউজার। হাতে ক্যানুলা ফিট করা! বেডের ওপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ছাই রংয়ের নার্সের পোশাক পরিহিতা ঝকঝকে সাদা চামড়ার এক তরুনী ওর প্রেশার চেক করছে আর ধ্রুব শান্ত ছেলের মত চুপচাপ বসে আছে! আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছিলাম! গোটা পৃথিবীর সমস্ত সুখ এই মুখটাতে! নার্স বেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম!

পাঁচসাতমিনিট বাদে নার্স বেরিয়ে গেলে ধ্রুব ফোন হাতে নিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,”কেমন আছো?”
আমি নিঃশব্দে, পলকহীনভাবে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম! ফোনের স্ক্রিনে হাত রেখে ওকে ছোঁয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম!
আমার উদ্ভ্রান্ত চোখমুখের অবস্থা দেখে ধ্রুব গম্ভীর হয়ে গেলো! বেদনার গাঢ় ছায়া নামলো ওর সুন্দর, সৌম্য, মুখটাতে! কিছুক্ষন চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর নরম, মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন তোমার? কি হয়েছে?”

নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বিফল হলাম। মৃদুস্বরে ফুঁপিয়ে উঠলাম! ধ্রুব অস্থির হয়ে গেলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বারবার জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে নিশাত? আমাকে বলো? খারাপ লাগছে?”
ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে মন চাইছিলো! মিনতিভরা কন্ঠে ফিসফিস করে বললাম,” ফোনে তোমাকে একটু চুমু খাই?”

কথাটা হয়ত খুব ছেলেমানুষির ধরনের কিংবা নাটকীয় মনে হতে পারে কিন্তু আমার অবস্থায় দাঁড়িয়ে অনুভব করলে বোঝা যায় কতটা অন্তরবেদনায়, নরকযন্ত্রণায় দিনানিপাত করছিলাম আমি! ধ্রুবকে হারানোর অমানুষিক ভয় প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা সেকেন্ড কতটা অসহায়, কতটা কাঙাল বানিয়ে দিয়েছে আমাকে!

ধ্রুব ফোন ঘুরিয়ে নিলো। মুচকি হেসে বললো,”ঠিক আছে।”
কিন্তু ফোনে মন ভরলো না! খুব করে মন চাইছিলো শক্ত করে ওকে একবার জড়িয়ে ধরি! কতদিন জড়িয়ে ধরি না! ওপাশের ফিলিংসটাও যে আমার মত সেটা ধ্রবর অসহায় মুখ দেখে আমার বুঝতে বাকি রইলো না। নিঃশব্দে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। ধ্রুব ব্যাকুল গলায় বললো,”দোহাই তোমার আর কান্নাকাটি করো না নিশাত! কেঁদে কেঁদে শরীরের কি হাল হয়েছে তোমার! চেনাই যাচ্ছে না! কতবার করে বলেছি এই সময়ে এত স্ট্রেস নিও না, সহ্য হবে না। কিন্তু তুমি শুনছো না! কেন? সারাদিন আমার কথা না ভেবে নিজের শরীরেরও তো একটু যত্ন নিতে পারো!”

আমি অশ্রুসজল কন্ঠে বললাম,”নেবো। আগে আমার বরটা ভালো হয়ে ফিরে আসুক তারপর!”

ধ্রুব মৃদু হাসলো। স্নেহমাখা কন্ঠে বলল,”খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো ইনশাআল্লাহ!” তারপর হাসিটা আরেকটু প্রশস্ত করে বলল,”একটা গুড নিউজ আছে!”

আমি ওর বলার অপেক্ষা না করে ধৈর্যহারা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,কি?”

—“এখানকার ডায়াগনোসিসে একটা ভুল ধরা পড়েছে।”

খুশিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো! আশার আলো খুঁজে পেলাম! শুভ কিছু শোনার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব আমার অস্থিরতা বুঝতে পেরে দেরী করলো না। বলল,” টেস্টের রিপোর্ট দেখার পর আমার সার্জন জানিয়েছে আমার টিউমারটা ননক্যান্সারাস! ইট’স আ বিনাইন টাইপ টিউমার! সারভাইবাল রেইট অনেক বেশি।”

আমি হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। অতিরিক্ত খুশিতে বাক্যহারা হয়ে গেছি!
হাসির মাঝেই ঝরঝর করে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো। পাশ থেকে আন্টি হেসে উঠে বললেন,”নিজে তোকে বলবে বলে আমাকে বলতে দিচ্ছিলো না।” আমি তখনো হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম! দুষ্টুটা আমার রিয়েকশন দেখে মিটমিট করে হাসছিলো। ওর আনন্দশ্রী মুখিখানা দেখে সমস্ত শরীর, মন প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। ওর এই হাসিটা আমার জন্য ডাবল সারপ্রাইজ!
খুশিতে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে বাবা মাকে ডেকে খবরটা দিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত রেখে হাসতে হাসতে বললেন,”তোমার জয় হয়েছে মা! আল্লাহ তোমার ডাক শুনেছে! এবার শুধু অপারেশনের অপেক্ষা!” ফোনের ওপাশ থেকে বাবা মাকে দেখে ধ্রুব সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। আমি ওদের থামিয়ে দিয়ে ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলাম,”আরো আগে বললে না কেন?”
ধ্রুব লাজুকমুখে জবাব দিলো,”পুরোপুরি সিউর হওয়ার আগে তোমাকে জানাতে চাইছিলাম না!”
প্রশান্তিতে বুক ভরে গেলো। মা, বাবা, আন্টি, ধ্রুব সবাই হাসছে! কি নির্মল, আত্মবিশ্বাসী হাসি! আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া! তিনি আমার ধ্রুবর প্রতি সহায় হয়েছেন! এখন শুধু একটাই ভয় অপারেশন! স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই বুক কেঁপে উঠলো! চোখবন্ধ করে মনে মনে প্রার্থণা করলাম,”আল্লাহ তুমি আমার ধ্রুবকে হেফাযত করো। তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না!”
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here