ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ২৫

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৫

সারারাত ধ্রুব সোফায় বসে রইলো। আমি ওর হাঁটুতে মাথা রেখে উপুড় হয়ে মেঝেতে বসে রইলাম। কারো চোখে একফোঁটা ঘুম নেই! বুকের ভেতর নিঃশব্দ হাহাকার! ভোরের আলো ফুটতেই ধ্রুব আমাকে টেনে তুললো। আমি উঠতে চাইলাম না। দুহাতে ওর পা জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম। ও জোর করে টেনে তুলে ঘরে নিয়ে গেলো। আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”খাবে চলো।”

ওর চোখজোড়া বিষন্ন! চেহারায় ঘোর অমাবস্যা! সর্বদা হাস্যজ্জ্বল মুখটায় গভীর দুঃখের ছাপ! তথাপি মলিন মুখে হাসার চেষ্টা করলো। তীব্র ব্যথায় আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। হায় খোদা! এতদিন ধরে যেই মানুষটার অমলিন, শুভ্র, হাসিমাখা মুখখানা দেখে এসেছি আজ আনন্দের দিনে তার চোখ দিয়ে তুমি অনবরত পানি ঝরাচ্ছো, বিশ্বভ্রহ্মান্ডে এর চাইতে বেদনার, এর চাইতে দুঃখের, এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে আমার জন্য! মৃত্যুও যন্ত্রনা কেমন আমি জানি না! বোধকরি, ধ্রুব কষ্ট সহ্য করার চেয়ে ঢের আনন্দের!

দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ধ্রুব শুকনো মুখে চেয়ে রইলো কেবল! ইচ্ছে করছিলো ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর ওপর! চিৎকার করে বলি,”তুমি একটু হাসো ধ্রুব! আমাকে একটু বাঁচতে দাও। তোমার মলিন মুখ আমি সহ্য করতে পারছি না!” কিন্তু পারলাম না, নিয়তির নির্মম পরিহাস আমাকে মূক বানিয়ে দিলো। একমুহূর্তেই আমার পায়ের তলার মাটি সরিয়ে শূন্যে দাঁড় করিয়ে দিলো আমাকে!

তারপর থেকেই অসহ্য, দুঃসহ শূলবেদনায় দিনানিপাত করছিলাম আর ধ্রুবকে নিয়ে পাগলের মত এই হস্পিটাল থেকে ঐ হস্পিটালে দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম। অতলান্তিক সমুদ্রে একফোঁটা জলের ন্যায় আশার আলো খুঁজে বেড়াচ্ছিলা চারদিকে। কারো কাছ থেকে একটু ভরসা পাওয়ার আশায় দিশেহারা হয়ে হস্পিটাল গুলোতে ঘুরলাম। কেউ আশা দিলো। আবার কেউ নিরাশ করলো। নিরাশার কথা শুনলেই ভয়ে বুক সিঁটিয়ে আসে। সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার মনে হয়!

সপ্তাহ খানেক বাদে আন্টি তরুর বাসা থেকে ফিরলেন। আমি তাকে কিছু জানানোর সাহস পাচ্ছিলাম না! কঠিন রোগটার কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতেও ভয় করতো!

দুতিনদিন বাদে একদিন সকালে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। হঠাৎ আন্টি আমাকে টেনে তার রুমে নিয়ে গেলেন। সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”সত্যি করে বল, আমার ছেলের কি হয়েছে? তোরা আমার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছিস? আমি মা! মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়। বল, আমার ছেলের কি হয়েছে?”

নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও বিফল হলাম। আত্মসংবরণ করতে না পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। আন্টি ঘাবড়ে গেলেন। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। দুহাতে আমার বাহুতে ঝাঁকি দিয়ে বারবার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ধ্রুবর কি হয়েছে!

মা হিসেবে সত্যিটা জানার অধিকার তাঁর আছে। আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে আর্তনাদ করে বললাম,”ধ্রুবর ব্রেন টিউমার মা!”

আন্টি বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন! রক্তশূন্য হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর পরই ‘আল্লাহ গো’ বলে মূর্ছা গেলেন। আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরে ধ্রুবকে ডাক দিলাম। ধ্রুব হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে তাঁকে খাটে শুইয়ে দিলো। আমি ডাক্তারকে খবর দিলাম। ডাক্তার এসে বললেন,”সাডেন শক! জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে।” ডাক্তার চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক বাদে তাঁর জ্ঞান ফিরল। সচেতন হতেই পাগলের মত কান্না শুরু করে দিলেন। কোন ভাবেই তাকে থামানো যাচ্ছিলো না।

আন্টির বুকফাটা আর্তনাদ, করুণ আহাজারি পাষাণ হৃদয় পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। ‘আমার ধ্রুব কই, আমার ধ্রুব!’ বেদনার্ত কন্ঠস্বর শোনা গেলো কেবল! ধ্রুব তাঁর পাশেই বসে ছিলো। আন্টির হাতের ওপর হাত রেখে বললো,”এই তো মা, আমি এখানেই আছি। তোমার পাশে। তুমি শান্ত হও!”

আন্টি ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে মর্মভেদী আর্তনাদ করে উঠলেন। ওর বুকে মাথা রেখে মিনতি ভরা কন্ঠে বললেন,”এ কোন অপরাধের শান্তি খোদা আমাকে দিলো ধ্রুব! কি অন্যায় করেছিলাম আমি! তোর বাবা চলে যাওয়া পর তোর মুখের দিকে তাকিয়ে এতগুলো বছর পার করেছি। এখন এই বয়সে এসে আল্লাহ আমার কোল খালি করতে চাইছেন। কেন? কোন অপরাধে? আমাকে কেন তাঁর চোখে পড়লো না! মায়ের কোল খালি করে তিনি ছেলে কেন নিয়ে যেতে চাইছেন।” ধ্রুব দুহাতে তাঁকে আঁকড়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বিরতিহীন ভাবে আন্টি গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,”শান্ত হও মা। তোমার শরীর খারাপ করবে!”

ওর চোখভর্তি পানি টলমল করছে, আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একমুহূর্তের জন্য নিজের চারপাশের সবকিছু অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিলো। এসব কি সত্যি ঘটছে! নাকি দুঃস্বপ্ন! চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও পারি নি। কেউ যেন আমার কন্ঠ রোধ করে রেখেছে! হাসি-উচ্ছ্বলতায়, আনন্দে হৈ-হুল্লোড়ে যাদের মেতে থাকার কথা চোখের সামনে তাদের করুন আহাজারি আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিলো!

আন্টির অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে! সারাদিন পাগলের মত প্রলাপ করে গেলেন তিনি। খবর পেয়ে বাবা মা, তরু আত্মীয়স্বজন অনেকেই দেখতে এলো। সেদিন আর হস্পিটালে যাওয়া হলো না। ধ্রুব পুরোটা সময় আন্টির পাশেই বসে রইলো।

রাতে সবাই চলে গেলে আমি আন্টির ঘরে গেলাম। ঘর অন্ধকার! তিনি আগের চাইতে কিছুটা শান্ত হয়েছেন। একদৃষ্টে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছেন আর একটু পর পর শাড়ির কোনা দিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি মুছছেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে তার করুণমুখখানার দিকে চেয়ে রইলাম। বুক কেঁপে উঠলো। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন,”আয় কাছে আয়!”

ধ্রুবকে হারানোর অদৃশ্য ভয় আমার ভেতরটাকে মুচড়ে সংকুচিত করে দিয়েছে। নতমুখে তার পাশে গিয়ে বসলাম। তিনি নিস্তেজ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”ধ্রুব কি করছে?”

—“শুয়ে আছে।”

—“খায় নি?”

আমি মলিন মুখে না সূচক মাথা নাড়ালাম। আন্টি চোখভর্তি পানি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। ডুঁকরে উঠে বললেন,”আমার ছেলেটাকে কেন আল্লাহ এত কষ্ট দিচ্ছে বলতো? কি অন্যায় করেছে ও! আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না।”
আমার কাছে এর কোন জবাব নেই! কোন অপরাধের শাস্তি খোদা আমাদের দিচ্ছেন আমি জানি না! সত্যিই জানি না! ঠোঁট কামড়ে কান্না রোধ করলাম। আন্টি আমাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ঘরে ঢুকলেন। ধ্রুব শুয়ে আছে। কনুই ভাঁজ করে কপালের ওপর রাখা। চোখ বন্ধ! আমার কিংবা আন্টির কারোই বুঝতে বাকি নেই কতটা ঝড় এই মানুষটার ওপর দিয়ে বইছে! একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছলাম!

আন্টি ওর মাথায় হাত রেখে কোমল কন্ঠে ডাক দিলেন,”ধ্রুব? আয় বাবা খাবি চল!”

ধ্রুব চোখ খুলে প্রথমে কিছুক্ষন উদ্ভ্রান্তের মত চেয়ে রইলো। তারপর উঠে বসলো। আমার চোখ চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেললো।

খাবার টেবিলে কারোই রুচি হলো না। একে অপরকে বুঝ দেওয়ার জন্য খাবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছিলাম। আন্টি-ই প্রথমে আধখাওয়া প্লেট রেখে অশ্রুসজল দৃষ্টি নিয়ে উঠে গেলেন। ধ্রুব চুপচাপ খাবার হাতে নিয়ে বসে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেলো। আমি টেবিলে কপাল ঠেকিয়ে বসে রইলাম। চোখের পানি নিঃশব্দে গাল গড়িয়ে নিচে পড়লো!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here