# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭
আশ্চর্যজনকভাবে মায়ের মুখ থেকে এখন আর ধ্রুবর নিন্দে শোনা যায় না। বরং রোজ দুবার করে আমার কানের কাছে ধ্রুবকীর্তন চলে। তাঁর দৌলতেই জানতে পারলাম ধ্রুব এবং তরুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসেই বিয়ে। বিয়ের আগেই ওরা বাসা চেইঞ্জ করে ফেলবে। খবরটা শোনার পর আমার হৃদপিন্ডে খামচি মেরে উঠলো। কলিজায় ধক করে উঠলো, তবুও আমি চুপচাপ মায়ের মুখ থেকে সবটা শুনলাম। আমার ভেতরে কি হচ্ছে সেটা আমি মাকে বুঝতে দিলাম না। এবং সেদিন একটু বেশিই হাসলাম। সবার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম ধ্রুব চলে গেলে ভালোই হবে। ওকে ভুলে যেতে পারবো। সব আবার আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু ভেতরের কষ্টটা কিছুতেই কমাতে পারছিলাম না।
এদিকে আন্টির অসুস্থতার জন্য ধ্রুবদের বাসা চেইঞ্জ করা হলো না। ডাক্তার স্ট্রেট নিষেধ করে দিলেন। বাসা চেইঞ্জ করলে খাটাখাটনি বাড়বে, অসুস্থ শরীরে আন্টির এত ধকল সইবে না। সুতরাং ধ্রুবর বিয়ে পর্যন্ত আন্টিরা এই বাসাতেই থাকবেন। খবর পেলাম গত সপ্তাহে ধ্রুবর বড় বোন তাঁর বরের সাথে আমেরিকা চলে গেছে। সে বিয়েতে থাকতে পারবে না। আন্টি খুব মন খারাপ করলেন। সেই খবর শুনেই নাকি তরু হোস্টেল থেকে বাসায় চলে এসেছে। আমি অবশ্য তরুর আসার খবর জানতাম না। হস্পিটাল থেকে ফেরার পর প্রায়ই আন্টির সাথে দেখা করতে যেতাম। উনার হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দিতাম। তবে সেটা ধ্রুব অলক্ষ্যে। আমি চাই নি ধ্রুব এসব জানুক। কারণ আন্টির সাথে আমার সম্পর্ক সবকিছু বাইরে। এই মানুষটা আমার কাছে একেবারে আলাদা। বিকজ দ্যা লেডি লাভস মি আনকন্ডিশনালি! তিনি আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছেন। একেবারে নিজের মেয়ের মত!
বস্তুত আমি খুব বেশি মিশুক প্রকৃতির মেয়ে না। যদিও সমবয়সীদের সাথে আমার মোটামুটি ভালোই জমে। তবে বয়স্কদের আমি এড়িয়ে চলি। কিন্তু আন্টির সঙ্গে জমে গেলো। অ্যান্ড অফকোর্স দ্যা ক্রেডিট গোজ টু হার। তিনি আমাকে বাধ্য করেছেন তাঁকে ভালোবাসতে। দিনের ভেতর চারপাঁচবার আমাকে ডেকে পাঠান। আমাকে নিয়ে মার্কেটে যান, বাজার করেন। পছন্দমত কিছু রান্না করলে আমার জন্য পাঠান। আমি অসুস্থ শুনলে ছুটে আসেন আমার খবর নিতে। তাই আমি কেবল আন্টির জন্য ধ্রুবদের বাসায় যাই।
সেদিন রান্নাঘরে আন্টি তরকারি কাটছিলেন। আমি তার পাশে বসে গল্প করছিলাম। আন্টি আমাকে ফ্রিজ থেকে মুরগী বের করতে বললেন। আমি তখনো জানতাম না বাসায় তরু আছে। ডাইনিংয়ে ওর সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। কুশল বিনিময় করলো। রান্নাঘরে আমাদের সাথে তারকারি কাটতে বসে গেলো। আন্টির ওর কাছে আমার নানারকম প্রশংসা করছিলেন, ও খুব হাসিমুখেই শুনছিলো। আমি মনে মনে লজ্জা পাচ্ছিলাম। আন্টিকে বারণ করলাম এসব না বলতে। কিন্তু তিনি এবং তরু মিলে আমার মজা নিতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে আমরা তিনজনই হেসে ফেললাম। হাসাহাসির মাঝখানে নয় দশ বছরের একটা মেয়ে এসে বললো ধ্রুব তার পেনড্রাইভ খুঁজে পাচ্ছে না।
তরুকে ডাকছে। তরু উঠে চলে গেলো। আন্টি আর আমি বসে বাকি কাটাকাটি শেষ করে নিলাম। এরপর আমি আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসছিলাম। হঠাৎ মনে হলো তরুকেও বলে যাই। এর আগে ওর সাথে কখনো এই সহজভাবে মেলামেশার সুযোগ হয় নি। কিন্তু আজকে বুঝতে পারলাম মেয়েটা সত্যিই ভীষণ ভালাও। ধ্রুব ঘরের দরজায় টোকা দিতে যাবো তখন তরু আর ধ্রুবর কথোপকথন আমার কানে এলো।
ধ্রুব কম্পিউটার টেবিলে বসে কি যেন টাইপ করছে। তরু ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছুটা উপেক্ষার স্বরে বললো, “আচ্ছা নিশাতের সাথে ফুপুর এত ভাব কি করে হলো? ফুপু কি ওকে আগে থেকেই চিনতো।”
ধ্রুব টাইপ করতে করতেই পালটা প্রশ্ন করলো,”তাই নাকি? ভাব? কই আমি জানি তো না। হলেও হতে পারে। মা প্রায়ই ওর কথা বলে।”
আমি বুঝতে পারছিলাম না তরু হঠাৎ কেন এই কথা জিজ্ঞেস করলো। দরজায় দাঁড়িয়ে এভাবে আড়িপেতে কথা শুনতে খুব অস্বস্তি লাগছিলো। কিন্তু কৌতূহল দমন করতে পারলাম না। তরু ধ্রুব চুলে খুব যত্ন করে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,”না মানে, ও যে এত ঘনঘন তোমাদের বাসায় আসে কেউ কিছু মনে করে না? আফটার অল সি ইজ ম্যারিজেবল! এভাবে যখন তখন বাসায় চলে আসাটা কি ঠিক? বাসায় তুমি থাকো…”
ধ্রুব কন্ঠে বিস্ময়ের আভাস পেলাম। অবাক হয়ে বললো,”ঘন ঘন আসে? কই আমি তো ওকে দেখি না। তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?”
—“না। কিন্তু বলতে কতক্ষন। বদনাম রটলে সত্য মিথ্যে তো কেউ যাচাই করবে না। ”
আমার বুকটা দুরুদুরু করছিলো ধ্রুব কি বলে তা শোনার জন্য। নতুন অপমানের আশঙ্কায় মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। ধ্রুব টাইপ শেষ। উরুতে একটা চাপড় মেরে নিজের কাজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো। তরুর কথার জবাবে বললো,”তোমার সাথে কি ওর কিছু হয়েছে?” তরুর কৌশলে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললো,”তোমার কি ধারণা আমি ওর সাথে ঝগড়া করে তোমার কাছে নালিশ করতে এসেছি?”
ধ্রুব কথা বাড়ালো না। বললো,”ঠিক আছে আমি ওকে আসতে বারণ করে দেবো।”
তরু বাধা দিয়ে বলল, “ছি!ছি! তুমি বারণ করতে যাবে কেন? তোমার সঙ্গে তো ওর ভালোমত পরিচয়ই হয় নি। তাছাড়া তুমি বললে বেচারি মনে কষ্ট পাবে।”
—“তাহলে মাকে বলবো ওকে আসতে বারণ করতে? মা কি আমার কথা শুনবে?”
তরু বোধহয় মনে মনে এটাই চাইছিলো। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি আর একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ছুটে বেরিয়ে গেলাম। একটা মানুষের সহজ, সরল, ভালো সেজে থাকার মাঝেও যে কতটা দুমুখোপনা থাকতে পারে তা ভেবে খুব কষ্ট পেলাম। এর চাইতে তরু যদি সামনাসামনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো তাহলেও বোধহয় আমার এতটা খারাপ লাগতো না। প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছিলো ওর প্রতি। কতটা কুরুচিপূর্ন মনমানসিকা! কিন্তু একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো ও ধ্রুবকে এসব কথা কেন বললো? ও কি আমার এবং ধ্রুবর সম্পর্কের কথা জানে? জেলাসি নাকি অন্যকিছু!
তারপর থেকে আজকে পাঁচদিন আমি ধ্রুবদের বাসায় যাই নি। আন্টি কয়েকবার তাদের কাজের লোককে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি যাই নি। তারপর দিন আন্টি নিজে এলেন। ধ্রুব হলুদের জন্য কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাবেন আমাকে সাথে নিয়ে। আমি তাঁর মুখের ওপর বারণ করতে পারলাম না। পাছে কেউ কিছু সন্দেহ করে। মা এমনিতেই বারবার জিজ্ঞেস করছিলো আন্টি এতবার করে ডেকে পাঠাচ্ছেন আমি যাচ্ছি না কেন? তাই রেডি হয়ে আন্টির সাথে শপিং করতে বেরোলাম। শপিং শেষে আন্টি আমাকে জোর করে তাঁদের বাসায় নিয়ে গেলো দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। আমি মনে মনে দোয়া করছিলাম আল্লাহ তরু যেন বাসায় না থাকে। আমার প্রার্থনা কবুল হলো। তরুর পরীক্ষা। গতকাল বিকেলে হোস্টেলে ফিরে গেছে। দরজা খুললো ধ্রুব। ওকে দেখ সংকোচ আরো বেড়ে গেলো। ও হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলো,”কেমন আছো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,”ভালো।” আন্টি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। ধ্রুব সোফায় আমার পাশে বসে বললো,”কি কি শপিং করেছো দেখাও এবার? দেখে তো মনে হচ্ছে পুরো মার্কেট কিনে নিয়ে এসেছো !” আমি হাসিমুখে একএক করে সব জিনিসপত্র ধ্রুবকে দেখালাম। ধ্রুব আগ্রহ নিয়ে দেখলো। দেখানো শেষে একসাথে তিনজনে খেতে বসলাম। খেতে বসেও ধ্রুব আমাদের শপিং নিয়ে করলো।
খাওয়া শেষে আন্টি তার ঘরে রেস্ট নিতে চলে গেলেন। আমি আর ধ্রুব সোফায় বসে ছিলাম। জানিনা কেন আজকে ধ্রুবকে একটু বেশিই ভালো লাগছে। এতদিনের আড়ষ্টতা অনকেখানিই কেটে গেছে। মনে মনে ওর প্রতি খুশি হলাম। তরুর কথা সে কানে নেয় নি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষন গল্প ধ্রুব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। বলল,”তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো নিশাত।”
আমি সহজ সরলভাবেই বললাম,”বলোনা!”
কিন্তু ধ্রুব ইতস্তত করছিলো। বললো,”বুঝতে পারছি না কীভাবে বলবো?”
আমি ফের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললাম, “এত সংকোচ করছো কেন? বলো কি বলবে?”
ধ্রুব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,”মা তোমাকে খুব বিরক্ত করছে তাই না? আসলে মা এমনই যাকে তার পছন্দ হয় সারাক্ষণ তাকে জ্বালাতে থাকেন।” আমি ওকে বাধা দিয়ে বললাম, “এভাবে কেন বলছো? আন্টির সাথে গল্প করতে বেশ ভালোই লাগে।”
ধ্রুব আমার কথা গ্রাহ্য করলো না। তরুর তার মনে যে বিষাক্ত আভাস ঢুকিয়ে দিয়েছে তার পথ অনুসরণ করেই বললো,”আমি জানি তোমার মায়ের সাথে গল্প করতে ভালো লাগে। হয়ত তিনি আমার মা বলেই তুমি তার প্রতি বিরক্ত হচ্ছো না। কিন্তু আমি জানি মা খুব জ্বালান। তাই বলছিলাম এবার থেকে মা ডাকলে তুমি কোন কাজের অযুহাত দিয়ে তাঁকে না বলে দিও। কথাগুলো আমি মাকেই বলতাম, কিন্তু বলে কোন লাভ হবে না। তিনি তোমাকে বেশ পছন্দ করেন।”
রাগে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। জ্বালাভরা কন্ঠে বললাম,”সেটা কি আমার দোষ?” ধ্রুব আমার রাগের পরোয়া না করে বললো,”আমি বলছি না তোমার দোষ। কিন্তু তুমি তাকে এত বেশি স্পেস দাও বলেই তিনি পেয়ে বসেছেন। এমনকি আমাদের হলুদের শপিংয়ে তিনি তরুকে নিয়ে না গিয়ে তোমাকে নিয়ে গেলেন? তরু খুব মন খারাপ করেছে। মাকে খুব ভালোবাসে তাই কিছু বলে নি। কিন্তু ব্যাপারটা তো সত্যিই খারাপ হলো তাই না? তাছাড়া আমি চাই না তোমার সম্পর্কে তরুর কোন খারাপ ধারণা হোক। ”
আমার মনে পড়লো আন্টি শপিংয়ে যাওয়ার সময় নিজে আমাকে বলেছেন তরুর সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো। তার পরীক্ষা, সে যেতে পারবে না। অতএব ঘটনা পরিষ্কার। ধ্রুবকে এসব কিছুই জানায় নি সে। এবং ধ্রুবকে দিয়ে এসব কথা সে-ই বলাচ্ছে। এইমুহূর্তে লজ্জায়, অপমানে জর্জরিত হয়ে গেলাম। আন্টিকে ডেকে ধ্রুবর সামনে তরুর কুৎসিত রুপটা প্রকাশ করে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কিচ্ছু বললাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,”তুমি কি আমাকে আসতে বারণ করছো?”
ধ্রুব নরম গলায় বললো, “না। তুমি আসবে। অবশ্যই আসবে। তবে মা যদি ভুলভাল কিছু করে তাহলে একটু দেখো। এসব নিয়ে কোন মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হোক আমি চাই না।”
আমি দাঁতেদাঁত চেপে রাগ ঠেকালাম। বললাম,”ঠিক আছে। এবার কি আমি যেতে পারি?” ধ্রুব লজ্জিত কন্ঠে “তুমি কি আমার কথায় দুঃখ পেয়েছো?”
আমি হাসলাম। বললাম,” না। কিন্তু তুমি একটা কথা খুবই ভুল বলেছো, আন্টিকে পছন্দ করি কারণ তিনি তোমার মা বলে এটা তোমার সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আন্টি যদি তোমার মা নাও হতো তাহলেও আমি তাকে ঠিক এখনকার মতই পছন্দ করতাম। তাই আন্টি যতদিন নিজে আমাকে বারণ না করবেন ততদিন আমি আসবো। পারলে তুমি কথাগুলো আন্টিকে বলো।”
এরপর থেকে আমি আন্টি ডেকে পাঠালে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে যেতাম যেন ধ্রুবর সাথে দেখা না হয়। আমি গেলেই আন্টি বিয়ের কেনাকাটা, আয়োজন নিয়ে গল্প শুরু করে দিতেন। আমি চুপচাপ শুনে যেতাম। কোনপ্রকার উৎসাহ দেখাতাম না। মনে মনে চাইতাম আন্টি বুঝুক আমি আসতে চাই না। কিন্তু আন্টি বুঝতেন না। আমিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতাম না। উনি আমার সাথে এতটা আপনভাবে কথা বলতেন যে ধ্রুবর সাথে সম্পর্ক না থাকলেও উনাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না।
দুই তিনদিন বাদে একদিন সন্ধ্যায় সুমাইয়া এসে হাজির। বললো, ধ্রুব এবং তরুর বিয়ে উপলক্ষ্যে ধ্রুব সবাইকে ট্রিট দিচ্ছে। আন্টি আমাকে যেতে বলেছেন। পরশু ধ্রুবর ছুটি শেষ। কাল চলে যাচ্ছে সে। তাই আজকে সবাইকে ট্রিট দিচ্ছে।” আমি সুমাইয়াকে বললাম আমি যাবো না। কারণ আমি জানি, আমি গেলে তরু খুশি হবে না। এতসব কিছুর পর নতুন করে আর কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইলাম না। কিন্তু আন্টির জন্য কিছুই সম্ভব হলো না। কিছুক্ষন পর আন্টি নিজেই এলেন আমাকে ডাকতে। মাও বারবার ফোর্স করছে যাওয়ার জন্য। না গেলে অসামাজিক দেখাবে। জোর করে আমাকে রেডি করালেন। আমি রেডি হয়ে গিয়ে দেখলাম শুধু আমি না সীমা,সীমার বর ওরাও আছে। বেশ কয়েকটা ছেলেও আছে। একজনকে আমি চিনি। রাফি ভাই,ধ্রুবর বন্ধু। বাকিদের কাউকে চিনি না। ধ্রুবর বন্ধুবান্ধবই হবে।
ড্রয়িংরুমে বসে সবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম না। ধ্রুব আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। বোধহয় ভাবতে পারে নি আমি যাবো! তবে বিরক্ত হলো না। মনে মনে শান্তি পেলাম। ওর চোখে চোখ পড়তেই খেয়াল করলাম ওকে বেশ সুন্দর লাগছে। কালো শার্টের ওপর ব্রাউন জ্যাকেটে দারুণ মানিয়েছে। তার সাথে হাতে কালো ঘড়ি! দুহাতের আঙ্গুল দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। আর শব্দ করে তরুর নাম ধরে ডাকছিলো। মিনিট পাঁচেক বাদে তরু বেরিয়ে গেলো। ও আমাকে দেখে খুশি হয়েছে নাকি বিরক্ত হয়েছে বুঝতে পারলাম না। আমিও এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না।
রেস্টুরেন্টে ঢোকার পথে একটা অঘটন ঘটে গেলো। প্রচন্ড জোরে আমি হোঁচট খেলাম। পায়ের ব্যথা ভুলে তাড়াতাড়ি আশেপাশে খেয়াল করলাম কেউ দেখেছে কি না! কিন্তু না, সবাই যার যার মত ব্যস্ত। আমি দ্রুত হাঁটছিলাম। দোতলা বেয়ে উঠতে গিয়ে মনে হলো আমার জুতোর পাট্টা আলগা হয়ে গেছে। হাঁটার গতি মন্থর হয়ে গেলো। পা টেনে টেনে হাঁটছিলাম। যার ফলে আমি বাকি সবার থেকে পিছিয়ে পড়লাম। আমার অবস্থা তখন খুব খারাপ। খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম। ওয়েটার দুজন আমার দিকে চেয়ে আছে।
আমার সামনে ধ্রুব আর রাফি ভাই কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো। বাকিরা সবাই টেবিলে বসে গেছে। কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে ধ্রুব এবং রাফিও বাকিদের সাথে যোগ দিয়েছে। সামনে তাকাতেই ধ্রুবর চোখ চোখ পড়ে গেলো। আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললাম। চোখ নামিয়ে ফেললেও ধ্রুব যে আমার দিকেই চেয়ে আছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম। ও চুপচাপ আমার পায়ের দিকে লক্ষ্য করছিলো। ওর দেখাদেখি রাফি ভাইও খেয়াল করলো। দুজনেই উঠে এলো। ধ্রুব আমার পায়ের দিকে ইশারা করে বললো,” কি হয়েছে?”
সেদিনের ঘটনার পর থেকে ধ্রুবর সাথে আমার কথা বন্ধ ছিলো। কিন্তু এইমুহূর্তে চুপ করে থাকা অসম্ভব। অসহায় কন্ঠে বললাম,”আমার জুতো ছিড়ে গেছে।”
রাফি ভাই উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”কীভাবে?” আমি বললাম, ভেতরে ঢোকার সময় হোঁচট খেয়েছিলাম।”
ধ্রুব আমার কথার পুনরুক্তি করে বলল,”হোঁচট খেয়েছিলাম। না দেখে হাঁটলে এমনই হবে।”
ওর কন্ঠে সূক্ষ্ম অবজ্ঞাটুকু টের পেতে আমার অসুবিধে হলো না। খুব লজ্জা লাগছিলো।
এত অস্বস্তিকর অবস্থায় বোধহয় আর কখনো পড়তে হয় নি। সামান্য জুতো ছিড়ে যাওয়াটাও যে মানুষের কতবড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে নিজে এই অবস্থায় না পড়লে বুঝতে পারতাম না। আমি করুন মুখে রাফি ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,”আমাকে বাসায় যাবো ভাইয়া।”
বলেছি ঠিকই কিন্তু এই অবস্থায় বাসায় যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ ছেঁড়া জুতো নিয়ে দোতলা বেয়ে নামার অবস্থায় আমি নেই। নিজের ওপর রাগ হলো। সত্যিই তো, এতগুলো মানুষ কারো কিছু হলো না। আমার সাথেই এসব হতে হলো! রাফি ভাই আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,” রিলেক্স নিশাত। এত ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন? অ্যাক্সিডেন্ট তো অ্যাক্সিডেন্টই! ” আমি তবুও গোঁ ধরে বললাম, “আমার ভালো লাগছে না রাফি ভাই। আমি বরং বাসায় চলে যাই।” ধ্রুব আমার পায়ের কাছে বসে কিছুটা বিরক্ত স্বরে বলল,” দেখি, জুতা খোলো।”
আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব আবারো তাড়া দিলো। অবশেষে জড়তা নিয়ে জুতোটা খুলে দিলাম। ও জুতোর আলগা হয়ে যাওয়া অংশটা টেনে আলাদা করে দিলো। রাফি ভাই আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আশেপাশের সবাই ধ্রুবর কান্ড দেখছে। এত লোকের সামনে রেস্টুরেন্টের মাঝখানে বসে জুতো নিয়ে টানাটানি করাটা খুবই লজ্জাজনক। কিন্তু ধ্রুব এসব কিছুরই কেয়ার করলো না। নিঃসংকোচে আমার অস্বস্তি দূর করে দিলো। আলগা পার্টটা নিয়ে বাইরে বিনে ফেলে দিলো। আমি রীতিমত অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে ছিলাম। ওর স্বচ্ছতা, সুন্দর মনটা আবারো আমাকে ওর প্রতি দুর্বল করে দিছিলো। ধ্রুব হাত ধুয়ে এসে বললো,”নিচের পার্ট খুলে দিয়েছি। একটু উঁচুনিচু লাগবে। করার কিছু নেই। বাসায় না যাওয়া পর্যন্ত এভাবেই থাকতে হবে।”
টেবিলে বসে সীমা আমার জুতোর কন্ডিশন দেখে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,” জুতোর অবস্থা তো বেশি ভালো নয়। ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছে।”
আমি অসহায় চেহারা নিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব সীমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,” ছিঁড়বে না।” কিন্তু আমার চিন্তা গেলো না। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর সময় যদি ছিঁড়ে যায়! তাহলে হয় আবার আমাকে টেনে টেনে হাঁটতে হবে নতুবা খালি পায়ে! রাফি ভাই আমার চেহারা দেখে হেসে ফেললেন। বললেন,”সিরিয়াসলি জুতোর টেনশনে তোমার চোখমুখ একেবারে ছোট হয়ে গেছে নিশাত। এত টেন্সড হওয়ার কিছু নেই নিশাত। ছিঁড়ে গেলে আমি আর ধ্রুব পালা করে তোমাকে কোলে নিবো নামবো। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।”
.
.
.
চলবে