#নাটাই_ঘুড়ি
।।১৩।।
কামরান ওয়ালটাচ্ ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে ঢাকা রিজিওনাল অফিসে “ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার” হিসেবে কর্মরত আছে। নামেই গালভরা পোস্ট। আসলে বেতন খুব একটা বেশি না। ঢাকা শহরে মোটামুটি ভালোভাবে চলতে গেলেও অনেক টাকার দরকার হয়।
পায়ে বড়সড় একটা ব্যান্ডেজ নিয়ে ক্যাম্প খাটে শুয়ে আছে ইমরুল৷ রাস্তা পার হওয়ার সময় অটো চলে গেছে পায়ের ওপর দিয়ে।
কামরান বিরক্ত হয়নি। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছে শুধু। কিন্তু ইমরুল নিজেই নিজের ওপরে বিরক্ত।
ইমরুল ঠিক করেছে পা টা ঠিক হলেই কোনো একটা মেসে উঠে যাবে। এখন যেখানে আছে সেটা খুব একটা আরামদায়ক ব্যবস্থা নয়।
নতুন সিম কিনেছে সে। বিকাশ একাউন্ট খুলেছে।
নাসিমকে ফোন করেছে। উত্তরের জমিটা থেকে যে টাকাটা পায় সেটা তার একাউন্টে বিকাশ করতে বলেছে।
নাসিম জানিয়েছে ইমরুলের বাসার লোকজন তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিছুতেই যেন তার সাথে যোগাযোগের কথা স্বীকার না করে কিংবা তার ফোন নাম্বার না দেয় এই মর্মে বার বার সতর্ক করে দিয়ে ফোন রেখেছে ইমরুল।
ফুলবাড়িয়া গ্রামের শেষ প্রান্তে টিনশেডের একটা লম্বা বাড়ির একটা ঘরে ইমরুলের নিজের মা থাকে। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরেও যখন তার গর্ভে সন্তান আসছিল না তখন বংশ রক্ষার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল তার বাবা।
বছর ঘুরতেই সন্তান এসেছিল দ্বিতীয় বউয়ের কোলে। একে একে বড় ভাইয়া নাজমুল, মেজ ভাই কামরুল, নাইমার জন্ম।
নাইমা পেটে আসার পর কোন কুক্ষণে ওদের বাবা গ্রামে জমিজমা দেখতে গিয়ে থেকে গিয়েছিল গ্রামে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, বহু বছর ধরে একত্র বাসের ফলে যা হয়নি, সেই এক রাতের এক সাথে থাকায় ইমরুলের মা হয়ে পড়েছিল অন্তঃসত্ত্বা।
অবশ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে বিষয়টা খুব একটা আশ্চর্য কিছুও নয়। এমন বিলম্বিত মাতৃত্ব অনেক নারীর জীবনেই এসে থাকে।
আর নিন্দুকেরা বলে শেখ আলিমুল হাসান নাকি দ্বিতীয় বিয়ের পর কিছুদিন ডাক্তারবাড়িও হাঁটাহাঁটি করেছিলেন। সুতরাং সন্তান না জন্মানোর দায় তারও থাকতে পারে।
হয়ত ডাক্তারের ওষুধেই কাজ হয়েছিল কিংবা সুফিয়া বেগমের ভাগ্য, যেভাবেই হোক, ইমরুলের জন্ম ঘটে গিয়েছিল। ইমরুল পেটে আসার খবর জানতে পারার সাথে সাথেই দ্বিতীয় স্ত্রী জাহান বেগমকে রেখে এসেছিলেন তার বাবার বাড়িতে।
জাহান বেগম সেখানেই ছিলেন নাইমার বয়স ছয় মাস হওয়া পর্যন্ত। গ্রামে ভালো পরিবেশ, পড়াশোনার ভালো স্কুল দিতে পারবেন না, এই অজুহাত দেখিয়ে ইমরুলকেও ছয় মাস বয়সে শহরে নিয়ে গিয়েছিলেন শেখ আলিমুল হাসান।
অল্প কিছু মানুষ ছাড়া মোটামুটি সবাই জানে ইমরুল আর নাইমা জমজ ভাইবোন। জমজ দুই ভাইবোনের মধ্যে যেমন মিল থাকার কথা, তেমন কোনো মিল তাদের মধ্যে দেখা যায়নি বটে, তবে কিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে সেটাও খুব একটা বিরল নয়।
ইমরুল ঠিক সময়ের প্রায় এক মাসেই পৃথিবীতে চলে আসায় দুজনের বয়সের ফারাক পনের দিন। সেটাও ধর্তব্যের মধ্যে নয়। একটা বয়সের পর পনের দিনের বয়সের পার্থক্য চোখেই পড়ে না।
সুতরাং এতদিন ইমরুল তার গর্ভধারিণী মায়ের কথা না জেনে ভালোই ছিল। জাহান বেগম সৎ মা হলেও কোনো অনাদর করেননি তাকে।
জানার পর থেকেই তার পৃথিবী মোটামুটি এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজের মায়ের ওপরে এত বড় অন্যায় জানতে পেরে তার সহ্য হচ্ছিল না।
সবকিছু থেকে দূরে পালিয়ে আসার জন্যই তার এই স্বেচ্ছা নির্বাসন। সে ঠিক করেছে খুব দ্রুত এই রাজধানী শহরে একটা চাকরি জোগাড় করে মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে।
বেচারি সারা জীবন বিনা দোষে শাস্তি পেয়ে গেছে। অন্তত শেষ বয়সে কিছুটা আরাম করুক।
ইমরুলের সামনে পায়ের কাছে দুই বার্নারের চুলায় রান্না করছে রূম্পা। কামরানের মুখরা শ্যালিকা।
এই মেয়েটিকে দেখলে অদ্ভুত অস্বস্তি হয় ইমরুলের। মেয়েটি গড় পড়তা বাঙালি মেয়েদের চেয়ে কিছুটা বেশি লম্বা।
সরু কোমর, চিবুকের নিচে একটা কাটা দাগ। যদিও সেই দাগ মেয়েটার বুনো সৌন্দর্যকে এতটুকুও মলিন করতে পারেনি।
এই মেয়ের সাথে নাকি তার স্বামীর বনিবনা হয় না। ইমরুলের ধারণা কথার জ্বালায় হয় না।
কোনো শ্বশুর শাশুড়ি এমন মুখরা মেয়েকে ছেলের বউ করে রেখে স্বস্তিতে থাকতে পারার কথা নয়। দু’পাশে দুটো ঘর হলেও পাশের ঘরে এমন একটা মেয়ের অস্তিত্ব নিয়ে ইমরুল নিজেও যথেষ্ট অস্বস্তিতে ভোগে।
এই মুহূর্তে ইমরুলের সবচেয়ে বড় সমস্যা টয়লেট নিয়ে। পাশাপাশি দুটো বাসার মানুষের জন্য একটা টয়লেট, একটা গোসল খানা৷
এটা আসলে একটা বিল্ডিং ছিল। শরীকে শরীকে ভাগ হয়েছে।
তাই এই সমস্যা। দুই বাসার আটজন মানুষের জন্য একটা টয়লেট।
দুই বাসার কোনো একজন মানুষ বড় বাথরুম করলে সেটা গোটা পাড়া জানাজানি হয়ে যায়। কারণ সবসময়ই এখানে সিরিয়াল লেগে থাকে।
বড় বাথরুম করতে যেটুকু অতিরিক্ত সময় লাগে সেটুকু সময় সিরিয়ালের পরের মানুষটি মধুবাক্য বর্ষণ করতে থাকে। কার বড় বাথরুমে কত বেশি উৎকট গন্ধ, কে টয়লেট সেরে বেরিয়ে আসার পর টয়লেট যাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে সেটাও মোটামুটি জানা হয়ে যায় সবার।
আর এই রান্নাঘর৷ রান্নাঘরে রুম্পার রান্নাবাড়া করা, তার মধ্যেই ক্যাম্প খাটে মটকা মেরে পড়ে থাকার মত শাস্তি আর নেই।
ইমরুলের মনে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন কাঁটার মত খোঁচাচ্ছে বার বার। এতদিন রূম্পা রান্নাঘরের এই ক্যাম্প খাটে শুত।
এখন ইমরুল এই খাটে শুচ্ছে। রূম্পা শম্পা আর বাচ্চাটা খাটের ওপরে, কামরান মাটিতে শুচ্ছে।
কিন্তু এই ব্যবস্থায় কতদিন? রূম্পা এরই মধ্যে যথেষ্ট বিরক্ত।
বাইরে অন্তর্বাস শুকাতে দেওয়ার জায়গা নেই, আব্রু থাকে না। এতদিন রান্নাঘরেই দড়ি টানিয়ে শুকাতে দেওয়া হত।
এখনো তাই দেওয়া হচ্ছে, শুধু উপরে একটা ওড়না দিয়ে আব্রু রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করা হচ্ছে। এটাও আরেক আতান্তর।
সব মিলিয়ে, এখানে বেশিদিন থাকা যাবে না। খুব তাড়াতাড়ি থাকার অন্য জায়গার ব্যবস্থা করে উঠে যেতে হবে।
এই সরু গলির দু’পাশে নানান রকমের মানুষ থাকে৷ এখন বাজছে সকাল দশটা৷
কামরান নাস্তা করে বেরিয়েছে। বেরিয়েছে আশেপাশের কর্মজীবী মানুষগুলোও।
এলাকা তুলনামূলকভাবে নীরব৷ রুম্পার রান্না করা শেষ।
মেয়েটা যথেষ্ট কাজের, সেই কাকভোরে উঠেই কাজে লেগে পড়ে। বোনের সংসারে থাকতে এসেছে বলে গতর খাটিয়ে পুষিয়ে দেয় সব রকমে।
রূম্পা রান্না করে চলে গেছে, ইমরুল মটকা থেকে উঠে বসে ব্যাগটা খুলল। কারেন্ট এফেয়ার্সের কয়েকটা পাতায় চোখ বুলানো যাক।
কালো কালো অক্ষরগুলো কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে। একটা এক্সহস্ট ফ্যান এই ঘরের গরম দূর করতে পারছে না।
“আপনার বাড়িতে কে কে আছে?”
চমকে উঠল ইমরুল। রূম্পা এসে দাঁড়িয়েছে রান্নাঘরের দরজায়!
গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, “আব্বা, আম্মা, বড় দুই ভাই, ভাবি, তাদের বাচ্চারা, বোন…”
“আপনি বিয়ে করেন নাই?”
“না।“
“গার্লফ্রেণ্ড আছে আপনার?”
“হ্যাঁ”, বলতে গিয়ে ইমরুলের মনে পড়ল দুটো দিন ধরে তিথির কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। কি আশ্চর্য, এটা কীভাবে পারল সে!
“ঢাকায় কোনো কাজে আসছেন?”
“চাকরি খুঁজতে এসেছি!”
রূম্পা জিভ দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, “চাকরি তো এভাবে হয় না! আর আপনি শিক্ষিত মানুষ, আপনি কি আর ছোট চাকরি করতে পারবেন?”
“আপনার কাছে আছে কোনো ছোট চাকরি?”
“ওমা”…খিল খিল করে হেসে উঠল রূম্পা, “আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?”
মেয়েটা শুধু মুখ দিয়ে হাসে না, সারা শরীর দিয়ে হাসে। ইমরুলের অস্বস্তি তীব্রতর হতে লাগল।
“তোমার কাছে কোনো ছোট চাকরি আছে?”
“আছে তো। আমি তো আপার পিচ্চির জন্য জয়েন করলাম না। আপার একা একা কষ্ট হয়ে যাবে। পিচ্চিটা আরেকটু বড় হলেই জয়েন করে ফেলব। ঢাকায় চাকরি পাওয়া যায় না কথাটা সত্য না। পাওয়া যায়। আপনি যদি বেতন নিয়ে বেশি চিন্তা না করেন, চাকরি পাবেন। আর যদি ভাবেন এত কম বেতন, এত ছোট পোস্ট, তাহলে আপনার জীবনেও কিছু হবে না।“
রুম্পার নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে সে আচমকা বলল, “আপা ডাকছে, যাই।“
যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই বিনা নোটিশে চলে গেল রূম্পা।
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্)