নাটাই ঘুড়ি পর্ব-১৪

0
654

#নাটাই_ঘুড়ি
।।১৪।।
ছয়তলা মার্কেটের টপ ফ্লোরে খাবারের দোকান। নাম বিগ বাইট।
নাইমা বসে আছে প্রায় বিশ মিনিট যাবত। তার বিরক্তি আকাশ স্পর্শ করছে।
সে ভেবেছিল লোকটাকে আজকে বিরক্ত করে মারবে। সময় দেওয়া ছিল সাড়ে ছয়টায়।
নাইমা ইচ্ছে করেই এসেছে সাতটায়। আধা ঘন্টা বসে থাকুক ব্যাটা।
এসে নিজেই বোকা বনে গেছে। সাতটা বিশ বাজে।
এখনো বেকুবটার আসার নামগন্ধ নেই। বড় ভাবি নাম্বারটা দিয়েছিল বটে তাকে, মেজাজ খারাপ করে সেভ করতেই ইচ্ছা করেনি।
এখন মনে হচ্ছে ভুলই হয়ে গেছে সেভ না করাটা। নাম্বারটা থাকলে আর কিছু না হোক একটা মেসেজ ড্রপ করে চলে যেতে পারত।
নাইমা যখন মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে অভদ্রতা হলে হোক, এখন সে চলে যাবে ঠিক তখন দোকানের গ্লাস ডোর ঠেলে ভদ্রলোক ঢুকলেন। নাইমা ঘড়ি দেখল। সাতটা বেজে তেইশ মিনিট।
ভদ্রলোককে সুন্দর লাগছে, ধবধবে সাদা ফুল স্লিভ শার্ট সাথে ফর্মাল প্যান্ট পরনে। নাইমা লক্ষ্য করল ভদ্রলোককে ছবিতে যতটা বয়স্ক মনে হচ্ছিল, বাস্তবে ততটা মনে হচ্ছে না।
ভদ্রলোক মোটামুটি ইন্টারভিউ লুক নিয়ে এসেছেন। ইন্টারভিউ দিতে মানুষ যেমন টেনসড চেহারায় থাকে অনেকটা সেরকমই বিব্রত ভাব।
একটা মানুষের ওপরে যতই বিরক্তি থাকুক, মুখের ওপরে খারাপ ব্যবহার করা যায় না। নাইমা চুপ করে রইল।
লোকটা এগিয়ে এসে বললেন, “স্যরি, আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।“
ভদ্রলোকের গলার স্বর সুন্দর। ভরাট, পুরুষালী। নিউজ প্রেজেন্টারদের মত।
এসব পরিস্থিতিতে সাধারণত ভদ্রতা করে হলেও বলতে হয়, “না না ঠিক আছে”, কিন্তু নাইমা সেসব কথার ধার দিয়েও গেল না।
“কষ্ট হয়েছে অপেক্ষা করতে?”
“সারাদিন অফিস করে এসে বসে থাকতে কষ্ট তো না হওয়ারও কথা না!”
“আয়্যাম সো স্যরি, আসলে ছেলেটা ছাড়তেই চাচ্ছিল না!“
নাইমা এতক্ষণ পর লক্ষ্য করল লোকটার সাথে একটা চার বছরের বাচ্চাও এসেছে। এতক্ষণ লোকটার পেছনে লুকিয়ে থাকায় তাকে দেখা যায়নি।
“আহনাফ আন্টিকে সালাম দাও।“
ছেলেটা ভয়ার্ত গলায় বলল, “আসসালামু আলাইকুম।“
ভদ্রলোক বিরক্ত গলায় বললেন, “ওর মাথায় কে যেন ঢুকিয়েছে সৎ মা এসে ওকে মারবে, মাটিতে ঘুমাতে বলবে, খেতে দেবে না এসব উলটাপালটা কথা। আজকালকার দিনে এসব হয় বলেন?”
নাইমা হেসে ফেলল। আহনাফ নামের বাচ্চাটা চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, “অবশ্য ভালোই হলো এক দিক থেকে, আপনাদের দুজনের আলাপ পরিচয় হয়ে গেল। আপনারও ডিসিশন নিতে সুবিধা হবে।“
“আমার…ডিসিশন?”
“হ্যাঁ, আমি তো যতদূর জানি আগের পক্ষের ছেলের উপস্থিতিতে বিয়ে করতে কোনো মেয়ের খুশি হওয়ার কথা নয়। আপনার মনে কোনো দ্বিধা থাকলে সেটাও কাটিয়ে উঠতে পারবেন। ইয়েস নো বলতে সুবিধা হবে আপনার।“
নাইমার এই প্রথম ভালো লাগল, অন্তত তার যে না বলতেও ইচ্ছে করতে পারে, এই লোকটা সেটা মনে রেখেছে বলে। বাকি সবার ভাব দেখে তো মনে হচ্ছিল যে নাইমা পানিতে পড়েছে, ঘাটের মড়া ধরে এনে দিলেও তার গলাতেই কবুল বলে লাফাতে লাফাতে ঝুলে পড়তে হবে নাইমার।
ওয়েটার এসে মেন্যু কার্ড দিয়ে গেছে, নাইমা সেটা আহনাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও তুমিই অর্ডার কর, তোমার যা খুশি।“
একটু বোধ হয় সহজ হলো আহনাফ, মেন্যু কার্ড দেখে দেখে পছন্দ করতে লাগল। লাল শার্ট পরে এসেছে বাচ্চাটা, প্যান্টটা বোধ হয় এক সাইজ বড়। বার বার টেনে টেনে ওপরে তুলছে।
“আপনার জন্য?”
“আমি অফিস করে এসেছি, আমার খিদে পেয়েছিল। আপনি আসার আগেই আমি খেয়ে নিয়েছি।“
“ওহ আয়াম সো স্যরি…”
‘সমস্যা নেই, আমি এখন শুধু লাচ্ছি নেব।“
এখানে প্রথমেই বিল পে করে খাবার নিতে হয়, লোকটা উঠে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। এক মিনিট পরেই ফিরে এসে বিব্রত মুখে বলল, “মিস নাইমা একটু বসুন, আমি দুই মিনিটের মধ্যেই আসছি।“
নাইমা অবাক হয়ে বলল, “কেন কী হয়েছে?”
উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। আহনাফ উসখুস করছিল।
“আন্টি, আমি কি প্লে জোনে খেলতে যেতে পারি?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।“
বাচ্চাটাকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে কিনা ভেবে, নাইমা বাধ্য হয়ে উঠল। ছোট শহরের প্লে জোনে তেমন বেশি কিছু নেই।
একটা বড় প্লে গ্রাউণ্ড, সেখানে অনেকগুলো রঙিন বল ছড়ানো। এক পাশে একটা গাড়ির মত, সেখানে কয়েন ঢোকানোর স্লট আছে, কয়েন ঢোকালে গাড়ীটা চলতে শুরু করবে।
“গুড ইভিনিং ম্যাম!”
নাইমা ফিরে তাকাল। একজন স্টাফ এগিয়ে এসেছে তাদেরকে কিড জোনে আসতে দেখে।
“আপনি কি কয়েন নেবেন?”
নাইমা তাকাল আহনাফের দিকে। বাচ্চাটা অসম্ভব ভদ্র, কয়েন দিতে হয় বুঝে গাড়িটা একবার ছুঁয়ে অন্য দিকে চলে গেছে।
নাইমা কী ভেবে কয়েন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কী আর হবে, গত মাসে প্রমোশন হয়েছে নাইমার।
বেতন বেড়েছে, বাসায় জানায়নি সে। ইচ্ছা করেনি।
তার টাকা তো পড়েই থাকে ব্যাংকে। একশো টাকায় আর কীইবা এমন ক্ষতি হবে।
একশো টাকা লাগল দুটো কয়েন কিনতে। আহনাফকে গাড়িতে বসিয়ে স্লটে কয়েন ঢুকিয়ে নাইমা জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের বাসায় কে কে থাকে আহনাফ?”
“আমি, আব্বু, দাদা, দাদু, আর সেলিনা আপা।“
“সেলিনা আপা কে?”
“আমাদের রান্না করে, আমাকে খাওয়ায়।“
“ওহ আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তুমি কার সাথে ঘুমাও?“
“আব্বুর সাথে। আচ্ছা আন্টি আব্বুর সাথে তোমার বিয়ে হলে কি তুমি আর আমাকে আব্বুর সাথে ঘুমাতে দেবে না?”
অকারণেই গাল লাল হয়ে গেল নাইমার। কিছুটা কড়া স্বরেই বলল, “তোমার আব্বুর সাথে আমার বিয়ে হবে না আহনাফ।“
“তাহলে বুয়া যে বলল…”
“ভুল বলেছে। আর কী বলেছে বুয়া?”
আহনাফের চোখ ছলছলে হয়ে এল।
“তুমিও কি আমার জন্যই আব্বুকে বিয়ে করবে না আন্টি?”
“আর কে বিয়ে করতে চায়নি তোমার আব্বুকে?”
“জাফরিন আন্টি, রুমাইসা আন্টি, মুর্শেদা আন্টি…”
“বাহ, মেয়ে তো মনে হয় অনেক দেখা হয়েছে!”
আপন মনেই বলল নাইমা।
“কেউ আমার আব্বুকে পছন্দ করে না, আন্টি।“
“তাহলে তো ভালো, তুমিই তোমার আব্বুর সাথে থাকবে!”
“কিন্তু আব্বু যে সময়ই পায় না?”
“তোমার আম্মু কি দেখতে অনেক সুন্দর ছিল?”
“আমি তো জানি না, আন্টি!”
“সে কী! তুমি তোমার আম্মুর ছবি দেখোনি?”
“না।“
“তোমার আম্মুর কোনো ছবি নেই তোমাদের বাসায়?”
“না তো!”
কথা বলতে বলতে দুটা কয়েনের সময়ই ফুরিয়ে গেছে। নাইমা বলল, “আরো কয়েন কিনব?”
“না।“ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল আহনাফ।
এক পাশে বাস্কেট বলের গোল পোস্ট, আর একটা বাস্কেট বল পড়ে আছে নিচে। নাইমা এগিয়ে গিয়ে বলটা তুলে গোল পোস্টে ছুঁড়ে মারল।
বল গোল পোস্টে পড়ে নেটের ফাঁক গলে নিচে পড়ল। আহনাফ ছুটে গিয়ে বলটা এনে আবারও এনে দিল নাইমার হাতে।
নাইমা কী মনে করে আবারও বলটা গোল পোস্টের দিকে মারল।
“বুয়া আর কী কী বলেছে?”
“দাদুকে বলেছে, ঢাকার মেয়েরা সব চালু। এবার টাউনের বাইরে মেয়ে দেখা লাগবে।“
প্রাণ খুলে হেসে উঠল নাইমা। অনেক দিন পর এভাবে হাসছে সে।
হাসতে হাসতেই বলটা আবার গোল পোস্টের দিকে ছুঁড়ে মারল নাইমা।
শাহীন তাড়াহুড়ো করে এসেছিল, মানিব্যাগে টাকা আনতে ভুলে গিয়েছিল। ভেবেছিল কার্ড দিয়ে পে করবে, কিন্তু এদের কার্ডের মেশিনটাও নষ্ট থাকায় বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়েছিল।
ফিরে এসে অবাক হয়ে গেল সে। আহনাফ আর নাইমা প্লে জোনে মিলে মিশে খেলছে!
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here