নাটাই ঘুড়ি পর্ব-১৫

0
638

#নাটাই_ঘুড়ি
।।১৫।।
নাইমা বলল, “সাবধানে লাফ দে, তোর প্যান্ট যে ঢিলা, দেখা গেল খুলে পড়ে গেছে! একদম খুল যা সিম সিম হয়ে যাবে কিন্তু!”
আহনাফ হেসে কুটি কুটি হতে লাগল। অনেক দিন পর অনেক ফান হচ্ছে আজকে।
এমন সময় পেছন থেকে শোনা গেল, “আমাদের খাবার কিন্তু সার্ভ করে দেওয়া হয়েছে।“
নাইমা কিছু বলার আগেই আহনাফ বলল, “প্লিজ আব্বু, আর একটু খেলি?”
“হ্যাঁ তুমি একা একা খেলো, আন্টিকে বিরক্ত করো না। আন্টিকে ছেড়ে দাও, আন্টির সাথে কথা বলব আমি।“
কথাটা বলেই লোকটা টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। নাইমা এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও এই লোকের নাম মনে করতে পারছিল না।
সে কিছু না ভেবেই পেছন থেকে ডাকল, “আহনাফের আব্বু!”
শাহিনের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আনিকা মারা যাওয়ার পর মনে হয় প্রায় এক যুগ ধরে এই ডাকটা সে শোনেনি।
সে ফিরে এসে বলল, “কী বলছেন?”
নাইমা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কথা বলার তেমন কিছু নেই আসলে। আমি আসলে বিয়েটা করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু এই কথাটা আমি আমার বাসায় জানাতে পারব না। আপনি কোনো একটা ছুতো দেখিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিলে ভালো হয়।“
“কারণটা কি আহনাফ…?”
“না না, আহনাফ হতে যাবে কেন? আমার আসলে একা একা থেকেই অভ্যাস হয়ে গেছে, অন্য কারো সাথে এডজাস্ট করতে পারব না। এটা আসলে বাসায় বলতেও পারছি না। ভেবেছি আর দুয়েক বছর পর এই পেইন সহ্য করে নেব। আর দু বছর পর আর কেউ বলবেও না আমার বিয়ের কথা।“
“ও আচ্ছা।“
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি আহনাফের সাথে আরেকটু খেলি? আমার খেলতে ভালো লাগছে!”
“আচ্ছা।“
শাহিন টেবিলের দিকে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকাল। বাস্কেটবল হাতে আহনাফ আর নাইমাকে ছোটাছুটি করতে দেখতে বেশ লাগছে।
কিন্তু এটা ভুল দৃশ্য, মিথ্যা দৃশ্য। এটাকে আর বেশিক্ষণ ধরে চলতে দেওয়া ঠিক হবে না।
শাহিন চোখ সরিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কঠিন গলায় বলল, “আহনাফ চলে আসো।“
নাইমা অবাক হয়ে বলল, “সে কী? আমি যে বললাম আমরা আরেকটু খেলব?”
“আমরা এখানে খেলতে আসিনি মিস নাইমা। আমার বাচ্চাটা লোনলি। যাকে পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে। আপনি তো আপনার ডিসিশন জানিয়েই দিয়েছেন। সুতরাং আর টাইম স্পেণ্ড করে বাচ্চাটার কষ্ট আর বাড়ানোর কোনো মানে নেই।“
আহনাফ প্লে জোন থেকে চলে এসেছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বাবার দিকে।
শাহিন কঠিন গলায় বলল, “যাও, আটটা বাজে। টেবিলে খাবার দিয়েছে, খেয়ে আমরা বাসায় যাব।“
আহনাফ চলে যেতে নাইমা তীব্র স্বরে বলল, “আমার কী মনে হয় জানেন আহনাফের আম্মু কেন আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে? আপনার এই রুড বিহেভিয়ারের জন্য!”
শাহিন চমকে উঠল। “আপনি কীভাবে জানেন আহনাফের আম্মু মারা যায়নি, আমাকে ছেড়ে চলে গেছে?”
“সিম্পল! সে যদি মারা যেত তাহলে বাসায় তার ছবি থাকত। আহনাফ কখনো ওর আম্মুর কোনো ছবি দেখেনি। আপনার বাচ্চার লোনলিনেসের জন্য আপনি নিজেই দায়ী, মিস্টার।“
তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাইমা।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ইদানীং মুশফিকের যে মুখটা চোখের সামনে ভাসে সেটা রিম্মির মুখ। মুশফিক বুঝতে পারে বিষয়টা ভালো হচ্ছে না।
ব্যাপারটা ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রিম্মি প্রথম দিনেই জানিয়ে দিয়েছে সে বিবাহিত, শ্বশুরবাড়িতে থাকে।
রিম্মির দিক থেকে এমন কিছুই আসেনি যাতে মনে হতে পারে যে সে তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু মুশফিক ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে।
রিম্মির হাসি, রিম্মির গাম্ভীর্য সবই চুম্বকের মত টানছে তাকে। অথচ রিম্মি বিবাহিত, অন্য ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র।
প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে মুশফিক ঠিক করে ঘুমায় পরদিন কী ছুতোয় রিম্মির সাথে দেখা করতে যাওয়া যাবে। আজকে মেডিকেলে যাবে মুশফিক, সেদিনের ব্লাড দেওয়া পেশেন্টটাকে দেখে আসতে।
আর যেহেতু একা যাওয়া যাবে না, মুশফিক হারিয়ে যেতে পারে, তাই রিম্মিকে জানিয়ে রেখেছে। এই সুযোগে আরেকবার দেখা করা যাবে।
ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেছে, তাড়াহুড়ো করে নিচে নামল মুশফিক। নিচে গেটের সামনেই রিকশা পেয়ে গেল।
“যাবেন মামা?”
“ভাড়া বাকি আছে মামা!”
“কেউ আসছে নাকি?”
“আসছে এক আপা, ভাঙতি ছিল না! ভাঙতি আনতে উপরে উঠছে।“
“কয় টাকা ভাড়া?”
“তিরিশ টাকা!”
মুশফিক অনুমান করল ছয়তলার ডাক্তার মেয়েটি হয়ত নাইট করে ফিরেছে।
“আপনি চলেন, আমি দিয়ে দিব!”
মেডিকেলে গিয়ে রোগীটা খুঁজে পাচ্ছিল না মুশফিক। রিম্মি এখনো এসে পৌঁছায়নি।
এমন সময় মুশফিকের দেখা হয়ে গেল তাদের বাসার ডাক্তার মেয়েটির সাথে।
“আপনি? আপনি আমাকে ফলো করে এখান পর্যন্ত চলে এসেছেন?”
মুশফিকের খুব রাগ উঠে গেলেও প্রকাশ করল না সে। ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আপু, আপনি নিজেকে কী মনে করেন বলেন তো? আমি আপনাকে ফলো করে আসিনি, আমি পেশেন্ট দেখতে এসেছি!”
পপি একটু বিব্রত বোধ করল। গলা নামিয়ে বলল, “স্যরি। কী নাম আপনার পেশেন্টের?”
মুশফিক নাম বলল, বয়স বলল। তারা দুজন যখন রোগীটাকে খোঁজাখুঁজি করছে তখন রিম্মি এসে উপস্থিত হলো।
রিম্মি সরাসরি রোগীর কাছে গিয়ে ব্যাগ খুলে রোগীর ছোট বাচ্চাটাকে একটা কেক ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই ডাক্তার আপু তোমার পরিচিত? ভালোই হলো।“
পপি একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “জি আমি এই ওয়ার্ডেই আছি।“
“বাহ তাহলে তো ভালোই হলো। আমাদের পেশেন্টটাকে একটু দেখবেন।“
“পেশেন্ট কী হয় আপনাদের?”
মুশফিক বলল, “আমাদের কিছু হয় না।“
রোগীর হাজব্যাণ্ড পাশ থেকে বলল, “এই স্যার রক্ত না দিলে বাঁচানোই যাইত না!”
রিম্মি এসব শুনে অভ্যস্ত, সে খুব একটা বিগলিত হলো না। গম্ভীর মুখে বলল, “বাঁচানোর মালিক আল্লাহ্, আল্লাহ্ না চাইলে কেউ বাঁচাতে পারত না। আপনি এই টাকাটা রাখেন, উনার শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে, ভালো মন্দ কিছু কিনে খাওয়ান। আপাদের জিজ্ঞেস করে নিয়েন কী খাওয়ালে শরীরে রক্ত হয়। এই চলো।“
লোকটার হাতে পাঁচশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল রিম্মি। পেছনে পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মত বেরিয়ে এল মুশফিক।
“ক্লাস নাই আজকে?”
“আছে বারোটায়। তোমার নাই?”
“সকালের ক্লাসটা বাংক করলাম তোর জন্য।“
আপনি থেকে তুমিতে নেমেছিল আগেই, এবার রিম্মি অনায়াসে তুমি থেকে তুইতে নেমে গেল। কিন্তু তার মুখে একটুও বেমানান শোনাল না সেটা।
“তুমি যে এত টাকা খরচ কর, কেউ কিছু বলে না?”
“কে কী বলবে?” রিম্মি তাকাল গম্ভীর মুখে।
প্রশ্নটা করেই মুশফিকের মনে হলো নিজের পেছনে নিজেই কষিয়ে একটা লাথি দিতে পারলে ভালো লাগত। সে এমন কিছুই বলতে বা করতে চায় না যাতে রিম্মি রেগে যায়।
“তুই অনেক টাকার হিসাব করিস, তাই না?”
মুশফিক চুপ করে রইল।
“দাঁড়া, তোর জন্য টিউশ্যনি দেখছি। তার আগে তুই হলে উঠে আয় তো। প্রত্যেকদিন এই বাসে ঝুলে ঝুলে আসতে ভালো লাগে তোর?”
এটা মুশফিকেরও মনের কথা। কথা বলতে বলতে রিম্মির মেডিকেল থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা।
“কালকে তো শুক্রবার, কী প্ল্যান তোর?”
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল রিম্মি। এই সকালে গোসল সেরে এসেছে রিম্মি, আধভেজা খোলা চুল থেকে ভেসে আসছে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। মেয়েদের শ্যাম্পু নিয়ে জীবনে কোনোদিনও মাথা ঘামায়নি মুশফিক, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই শ্যাম্পুর নামটা তার জানতেই হবে।
“কোনো প্ল্যান নাই।“
“ফ্রি আছিস?”
মুশফিক ফিসফিস করে বলল, “তোমার জন্য সবসময় ফ্রি আছি!”
“কী বলিস কানে কানে, বুঝি না! গলায় জোর নাই কেন তোর?”
মুশফিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “ফ্রি আছি আপু!”
“শুক্রবার করে আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমে যাই গাজীপুরের দিকে, যাবি?”
যাবে না মানে? রিম্মি বললে জাহান্নামেও যেতে রাজি আছে সে।
“যাব আপু!”
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here