নাটাই ঘুড়ি পর্ব-১৭

0
657

#নাটাই_ঘুড়ি
।।১৭।।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম যে কথাটা মনে পড়ল মুশফিকের তা হলো আজকে রিম্মি আপুর সাথে দেখা হবে। আজকে তাদের গাজীপুর বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার কথা।
মুশফিক যদিও পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারেনি যে সেখানে তাদের আসলে কাজটা কী? রিম্মির বাসা থেকে ফোন আসায় সে তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিল গতকাল।
রাতে কল করেছিল মুশফিক, কেটে দিয়েছিল রিম্মি। এমনিতেও বাসায় থাকলে ফোনে কথা বলে না সে।
অন্যান্য দিন ক্লাস থাকে, এলার্ম শুনেও ঘুম ভাঙতে চায় না মুশফিকের। আর আজকে শুক্রবার, ক্লাস নেই তবুও অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশি ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে উত্তেজনায়।
ঘুম ভাঙা চোখেই বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করল মুশফিক। সাথে সাথেই দারুণ আশাভঙ্গ হলো।
গভীর রাতে টেক্সট পাঠিয়ে রেখেছে রিম্মি, “আমি আসতে পারব না আজকে, বাসায় কিছু গেস্ট আসবে। রুবেলকে পাঠাচ্ছি। তোরা দুজন মিলে সামলে নিস।“
মুশফিকের মনে হলো তার হৃদয়টাই যেন ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে। এই একটা দিনের জন্য কত প্রস্তুতি নিয়েছিল সে।
ফোন করল মুশফিক, ধরল না রিম্মি। ঘুম থেকে ওঠেনি হয়ত এখনো।
সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে। ভাঙা মন নিয়েই রেডী হয়ে বের হলো মুশফিক।
রুবেল নামের ছেলেটার সাথে ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। রুবেল মুশফিকের ব্যাচমেট, রিম্মির ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র।
ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়কে অনেক সময় ৫-৬ ঘন্টা পর্যন্ত আটকে থাকতে হয়। তাই ট্রেনে যাবে তারা।
ফেরার সময় বৃদ্ধাশ্রম থেকেই গাড়ি দেওয়া হবে। সকালে গাড়ি পাঠানো সমস্যা, তাছাড়া গাড়ী গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে ঢাকায় এসে তাদের নিয়ে যেতে যেতে অনেক দেরিও হয়ে যাবে, তাই ট্রেনে যেতে হয়।
রুবেল জানাল একজন ডাক্তারও নাকি যাবে। মাসে দুই শুক্রবার নাকি একটা সেবামূলক সংস্থা থেকে বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোর চেক আপের জন্য ডাক্তার পাঠানো হয়।
কিছু সাধারণ ওষুধও পাঠানো হয়। যেমন প্যারাসিটামল, কিছু ব্লাড প্রেশারের ওষুধ, ডায়াবেটিসের ওষুধ, ওরস্যালাইন, আয়রন, জিংক, ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ট্যাবলেট।
রুবেলের সাথে দেখা হলো রেল স্টেশনে। সকাল সাতটা পনেরতে প্রথম ট্রেন। এটা মিস করলে পরের ট্রেন আটটা বিশ মিনিটে।
শুক্রবার সকাল হওয়ায় জ্যাম ছিল না, ঠিক সময়েই স্টেশনে পৌঁছাতে পারল মুশফিক। রুবেল আর সেই ডাক্তারও চলে এসেছে সময়ের মধ্যেই।
ডাক্তারটির নাম আতিক, বয়সও কম, মনে হয় সদ্যই পাস করা। পাস করেই জয়েন করেছে এই এন জি ওতে।
এই এন জি ওর সাথে বৃদ্ধাশ্রমটার কোলাবোরেশন করা, এই বৃদ্ধাশ্রমকে খরচের খাত হিসেবে দেখিয়ে বেশ ভালো পরিমাণ ডোনেশন আনে তারা। লাভ করে প্রায় দ্বিগুণ।
পথে যেতে যেতে আতিক মুখ সুচালো করে বলল, “আমাদের বেতন ডোনারদের কাছে যা বলে, আমাদের দেয় তার অর্ধেক। ওষুধের বাজেটেও একই অবস্থা। ওষুধের খরচ যা দেখায়, তার অর্ধেক মেরে খায়।“
কি সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার! মুশফিকের কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল বিষয়টা পুরোপুরি বুঝে উঠতে।
“আমি থাকব না এখানে, চলে যাব। বিসিএসটা হোক একবার, কিংবা পার্ট ওয়ানটা হোক শুধু!”
মুশফিকের কিছুটা মন খারাপ হলো। উদ্যোগটা তো ভালোই ছিল, এন জি ওটা যদি একটু কম ব্যবসায়িক চিন্তা করতে তাহলে আতিক এরকম অনিচ্ছা নিয়ে আসত না নিশ্চয়ই।
মুশফিক বুঝতে পারছিল না রিম্মির এখানে কী কাজ? রিম্মি এখানে যুক্ত হলো কীভাবে?
ট্রেনে উঠে বসে কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর কিছুক্ষণ উসখুস করে প্রশ্নটা রুবেলকে করেই ফেলল সে। রিম্মি এখানে কেন, কী করছে?
অবাক হওয়ার আরো বাকি ছিল তার।
রুবেল বলল রিম্মি এখানে ভলান্টারি সার্ভিস দেয়। বয়স্ক মানুষগুলোকে সিরিয়াল মেইনটেইন করে ডাক্তার দেখাতে, ওষুধ বুঝিয়ে দিতেও একজন মানুষ লাগে।
কোনো এক ক্লাব থেকে খবর পেয়ে রিম্মি স্বেচ্ছায় এই কাজে নিজের নাম লিখিয়েছে। রুবেল বলল রিম্মি মাঝে মাঝে খাবার রান্না করেও নিয়ে আসে উনাদের জন্য।
রুবেলও এসেছে রিম্মির কথায় অনুপ্রাণিত হয়েই। যতই শুনছিল ততই মুগ্ধ হচ্ছিল মুশফিক।
আজ দিনটা খুব সুন্দর, নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে দুধের ফেনার মত সাদা সাদা মেঘ। আহা রিম্মি থাকলে কি ভালোই না লাগত এখন।
মুশফিকের চোখের সামনেই ঝকঝকে রোদ আস্তে আস্তে কড়া হতে শুরু করল। ট্রেন ভর্তি মানুষ, সামনে বসে কথা বলছে রুবেল আর আতিক, তারপরও মুশফিকের সবকিছু কেমন খালি খালি লাগছে।
বেলা সাড়ে আটটায় আর থাকতে পারল না মুশফিক। একটা ছুতো করে ওদের সামনে থেকে উঠে গিয়ে আবার ফোন করেই ফেলল রিম্মিকে।
এবারও রিসিভ করল না রিম্মি। দ্বিতীয়বার কল করতেই ফোনটা কেটে দিল সে।
এখনো কি ঘুম ভাঙেনি রিম্মির? খুব ঘুমাচ্ছে বুঝি শুক্রবার বলে?
জায়গাটা রেল স্টেশন থেকেও আরো কিছুটা ভেতরে, গ্রামের দিকে। কিছুদূর অটোতে করে যেতে হয়। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। রাস্তায় একটা দোকান পড়ল, ঝোঁকের মাথায় এক কার্টুন টিপ বিস্কিট কিনে ফেলল মুশফিক।
তার মনে হলো রিম্মি আপু থাকলে হয়ত কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসত। সে তো তার জন্যই এসেছে।
আসল জায়গায় পৌঁছানোর পর মন ভালো হয়ে গেল মুশফিকের। লোহার গেটে বড় করে নাম লেখা, “আপনপুর”।
সবাই অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। পৌঁছানোর সাথে সাথেই সাদা শাড়ি পরা একজন মধ্যবয়সী মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন, “আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো?”
যদিও কষ্ট যথেষ্টই হয়েছিল, কারণ রাস্তা খুব একটা ভালো না। অটোর ঝাঁকুনিতে শরীরের পার্টস সব খুলে আসার উপক্রম হচ্ছিল।
তবুও এই মায়া মাখানো কথায় মুছে গেল সেই কষ্টের অনেকখানিই। গেট দিয়ে ঢুকতেই বড় ফুলের বাগান দেখে মন ভালো হয়ে যায়।
গেটের ওপর দুই রঙের বাগান বিলাস, অপরাজিতা আর মাধবীলতার ঝাড় ফুল আর পাতায় নিজেদের মেলে ধরেছে। বাগানেও যত্নের ছোঁয়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
বাগানভর্তি গোলাপ দেখে মুশফিকের প্রথমেই মনে হলো, আহা রিম্মি যদি এখন থাকত এখানে! পরক্ষণেই নিজের মনকে শাসন করল সে।
চেয়ার টেবিল পেতে সব গুছিয়ে রাখাই ছিল। বয়স্ক মানুষগুলো একে একে আসতে শুরু করার পর আর কথা বলার ফুরসত রইল না তাদের।
মুশফিকের ধারণা ছিল যারা পুরনো রোগী, তাদের জন্য কিছুটা সময় কম লাগবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, তাদের জন্য আরো বেশি সময় লাগছিল। ফাইলপত্র দেখা, ব্লাড প্রেশার চেক করা, কমপ্লেইন শোনায় প্রচুর সময় লেগে যাচ্ছিল।
দুপুর আড়াইটায় লাঞ্চ ব্রেক দেওয়া হলো। খিচুড়ি, বেগুন ভাজি আর মুরগির মাংস অমৃতের মত লাগল খেতে।
মুশফিকের মনটা কেবলই উড়ু উড়ু করছে। লাইন ধরে সবাই যখন খিচুড়ি নিচ্ছিল তখনো সে বাম হাতে ফোন কানে ধরে রিম্মিকে কল করে যাচ্ছিল।
এবারও ফোন ধরল না রিম্মি। খেতে বসে দ্বিতীয়বার রিং করতেই কেটে দিল আবারও।
কী হয়েছে, কোনো সমস্যা? এ কথা ভেবেও নিজেকেই নিজে মনে মনে বকুনি দিল মুশফিক।
সমস্যা হতে যাবে কেন, রিম্মি তো বললই ওর বাসায় গেস্ট আসবে। আর সেই বা কেন বোকার মত এত বার বার ফোন করে যাচ্ছে?
বাকিটা সময় রিম্মির কথা মন থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে লাগল মুশফিক।
দুজন রোগীকে হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে, অপারেশন লাগবে বলে। একজনের জরায়ু নিচে নেমে আসছে, আরেকজনের চোখে ছানি পড়েছে। দুজনকেই গত চেক আপের সময়ও হাসপাতালে যেতে বলা হয়েছিল।
তাদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অভিভাবক ছাড়া আসলে হাসপাতালে ভর্তি, অপারেশন করানো যায় না।
অপারেশনের কনসেন্ট দেওয়া, রক্ত জোগাড় করা আরো নানান বিষয় থাকে। তাদের অভিভাবকরা না আসায় ব্যাপারটা নিয়ে কিছু করা যাচ্ছে না।
বুড়ো মানুষ দুজনের ভোগান্তি হচ্ছে। আতিক কিছুটা রাগ দেখিয়ে ফেলল।
জরায়ু বের হয়ে আসছে, ইনফেকশন হয়েছে, এখনো হাসপাতালে না নিলে হয়? অথচ বৃদ্ধাশ্রম থেকে অভিভাবক ছাড়া হাসপাতালে নিতেও পারছে না।
সারাটা দিন কীভাবে কেটে গেল, নিজেও বলতে পারবে না মুশফিক। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পর যখন গাড়িতে করে ফিরছিল তারা, তখন রুবেল কী বলছিল মাথায় ঢুকছিল না তার।
কিছুক্ষণ পরই সূর্য ডোবার পর আলোর শেষ রশ্মিটুকুও মিলিয়ে গেল। রাতের রাস্তায় হেড লাইট জ্বালিয়ে যেতে যেতে অদ্ভুত তোলপাড় হচ্ছিল মুশফিকের বুকের ভেতর।
শহরের রাতবাতিরা বড় বেশিই সরব, তাদের মাঝে চাঁদ নিজের জায়গা করে নিতে পারে না। এখানে সদ্য সন্ধ্যা মিলানো নীলাভ কালচে আকাশে সগৌরবে পূর্ণ দর্পে উঁকি দিল অহংকারী চাঁদ।
পূর্ণিমা না হলেও প্রায় ভরে এসেছে চাঁদটা। কী এক অস্থিরতায় রিম্মিকে আবারও ফোন করে বসল মুশফিক।
রিসিভ হলো না এবারও। কেন যেন তার মন বলছিল হবে না।
তাতে কিছু আসে যায় না। ফোন রেখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিল মুশফিক।
সারাদিনের ক্লান্তিতে দুই চোখ বুজে এল আপনাতেই। আর সেই আঁকাবাঁকা রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির ঝাঁকুনিতে দুচোখের বন্ধ পাতায় নেমে আসা এলোমেলো স্বপ্নের ভুবনে সগৌরবে নেমে এল রিম্মি তার খোলা চুল, বাঁকা হাসি আর ফিরে তাকানো নিয়ে।
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here