#নাটাই_ঘুড়ি
।।১৯।।
গতকাল ইচ্ছে করেই মুশফিকের ফোন ধরেনি রিম্মি। মুশফিকের চোখে তার প্রতি মুগ্ধতা তার চোখ এড়ায়নি।
এটাকে এখনই বিনাশ করতে হবে। এসব জিনিস বাড়তে দিলেই বাড়ে।
আর সত্যি কথা বলতে গেলে রিম্মি নিজেও একটু একটু দুর্বল হয়ে পড়ছে ইদানীং। সারাক্ষণ নিজেকে পাহারা দিয়ে রাখতে রাখতে সে নিজেও ক্লান্ত।
মাঝে মাঝে তীব্র অভিমান হয় তার, কার দিকে সে জানে না। স্কুল কলেজে বরাবর ভালো মেয়ে হয়ে থাকা মেয়েটার যখন বিয়ে হয়ে গেল ফার্স্ট ইয়ারেই, কারো কিছুই মনে হয়নি।
বিয়ের এক সপ্তাহের ছুটি শেষে যখন ক্লাসে ফিরেছিল তখন বুকের ভেতরটা চুর চুর হয়েই গিয়েছিল তার। কে জানত যার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে সে অন্য কারো সাথে লিভ ইনে আছে?
রিম্মি এখন নিজেকে অভিশাপ দেয় খুব করে, কেন সে রিয়াসাতের আগে দেখা করতে গেল না বিয়ের আগে। কেন তার কঠিন ব্যক্তিত্ব রিয়াসাতকে তার সাথে সহজ হতে দিল না।
কেন তার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যার জন্য কেউ তার সাথে সহজ হতে পারে না? ক্লাসে তার কোনো প্রাণের বন্ধু নেই।
ছিল না কখনো। ক্লাসমেট সবাই জানে রিয়াসাতের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক।
কেউই জানে না বিয়েটা আসলে কাগজ কলমেই থেকে গেছে। এক সপ্তাহ তারা দুজন এক ছাদের নিচে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে ঠিকই কিন্তু ওই পর্যন্তই।
রিম্মির আজকাল মাঝে মাঝে ভীষণ অবসন্ন লাগে, নিজের একটা মানুষ পেতে ইচ্ছে হয়। আচ্ছা কী এমন বয়স হয়েছিল তার?
তার তো নিজের একটা মানুষ হতে পারত, ক্লাস শেষে দেখা করবার মত, ফোনে খুনসুটি করবার মত, এক সাথে প্র্যাকটিক্যাল খাতা কিনতে যাবার মত! ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রিকশায় ঘুরবার মত, রাতে ফোন করতে পাঁচ মিনিট অপেক্ষায় বসিয়ে রাখলে দারুণ অভিমান করবার মত!
কিন্তু রিম্মি নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে গাম্ভীর্যের চাদরে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিজেকে নানান কাজে ব্যস্ত রাখতে শিখে নিয়েছে সে।
সকালে উঠেই বারান্দায় গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠতে দেখা, তারপর বারান্দায় রাখা গাছগুলোর পরিচর্যা করা তার অসম্ভব প্রিয় কাজ। মানুষ অকৃতজ্ঞতা করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে কিন্তু গাছ কখনো করে না।
রিম্মির মনে হয় সে যেমন অপেক্ষায় থাকে কখন ভোর হবে কখন সে বারান্দায় গিয়ে গাছগুলোর সাথে সময় কাটাবে ঠিক তেমনি গাছেরাও অপেক্ষা করে রিম্মির আঙুলের স্পর্শের। সকালের প্রথম নরম হাওয়ায় মাথা দোলায় গাছের পাতারা।
রিম্মি আজকে কাঠগোলাপের পাতায় পাতায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “তোমরা কেমন আছ?”
উত্তর এল না। উত্তরের আশাও করে না রিম্মি।
“জানো, আজ আমার মন ভালো নেই।“
একটু কি কেঁপে উঠল কাঠগোলাপের পাতারা? ওদের কি সেই ক্ষমতা আছে?
হৃদয়ের স্পন্দন পড়তে পারবার ক্ষমতা? সেই স্পন্দন পাতার কম্পনে রূপান্তর করবার ক্ষমতা?
রিম্মি মৃদু স্বরে বলল, “আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।“
এক ঝলক বাতাস বয়ে এল বারান্দায়। রিম্মির চোখের কোণা ভিজে উঠতে শুরু করেছে।
জলের পর্দা ভেদ করে ঝাপসা চোখে চারতলার বারান্দা থেকে রিম্মি দেখল নিচে গেটে ছুটা বুয়া এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ জোড়া মুছে নিজেকে সামলে নিল রিম্মি।
তাকে কেউ কিছুই করতে বলেনি, সে নিজে নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছে অনেক দায়িত্বের ভার। রাতে এক মুঠো ভাত সে নিজের হাতে তুলে রাখে ভোর ভোর কাজ করতে আসা এই মেয়েটির জন্য।
সকালে এসেই কাজ করতে লেগে পড়ে মেয়েটা। ওর বাস কড়াইল বস্তীতে।
আসা যাওয়ার পথটা বেশ দূরে। কড়াইল বস্তী থেকে এই গুলশান এক নম্বর পর্যন্ত নৌকায় পারাপার করে সে।
স্বামীর নাম হানিফ। সারাদিন রিকশা চালায়।
রিম্মি আজকে হাসিমুখে দরজা খুলে দিয়ে বলল, “আঁচল ওরকম করে গায়ে জড়িয়ে এসেছ কেন ময়নার মা? শীত পড়ে গেছে নাকি?”
ময়নার মা হাসিমুখে বলল, “এই সকালের দিকে এট্টু থাকে আর কী!”
“আচ্ছা, দেখি আমি ব্যবস্থা করছি। আজকে যাওয়ার সময় মনে করে নিয়ে যেও।“
ময়নার মা কৃতজ্ঞ অনুভব করে মনে মনে। সে জানত এই আপাকে বললেই কাজ হবে।
হানিফের রিকশা ওয়্যারলেস গেটের। সারাদিন কষ্টে সৃষ্টে জমার টাকা তুলতেই হিমশিম অবস্থা।
কাজে হাত লাগিয়ে রিম্মি বলল, “ময়নার মা, কত বয়স হলো ময়নার?”
“চার বছর হইলো।“
“স্কুলে দেবে না?”
“যাক, এই বছর যাক।“
“আচ্ছা, আমাকে জানিও কিন্তু।“
মাথা কাত করল ময়নার মা।
“আজকে পরোটা হবে, আটা বেশি করে নিও। বড় মুরগির পোঁটলাটা ভিজাও।“
“আজকে কিছু আছে?”
“গতকাল বড় খালামণি এসেছে ছেলেকে নিয়ে, মনে নেই?“
ময়নার মা মুখ গোঁজ করে বলল, “এদের এত যত্নের কী আছে? কালকে দুপুরে কী করল আপনার মনে নাই?”
রিম্মি হাতের কাজ রেখে কঠিন গলায় বলল, “তুমি চলে যাও ময়নার মা, আমি একাই পারব।“
ময়নার মা চুপসে গেল। এই আপা কারো আড়ালে বদনাম করা একেবারে পছন্দ করে না।
বার বার নিষেধ করার পরেও মনে থাকে না তার। কী করবে, গতকাল দুপুরে শোনে খালাম্মার ঘরে দুই বোন আসর জমিয়ে বসে ছেলের বউয়ের বদনাম করছে।
অবশ্য বদনাম করার উপকরণ তেমন বেশি কিছু পাওয়া যায়নি। কথার বিষয়বস্তু ছিল প্রবাসী ছেলের বউ নিয়ে বাস করা আর ঘরে আগুনের গোলা থাকা একই কথা।
কখন, কোন সময় কোন অঘটন ঘটে যায়। সারাক্ষণ সাবধানে থাকতে হয়।
আর বউটাও কেমন বরফ টাইপ। এমন বুঝলে আগে এখানে ছেলের বিয়ে দিতেন না।
বিয়ের আগে ছেলে যখন আলাদা দেখা করতে চেয়েছিল আর মেয়ে না করে দিয়েছিল তখন বিষয়টাতে তারা খুশিই হয়েছিলেন। তখন কে বুঝেছিল মেয়ে এমন রসকষ ছাড়া।
এইসব কথার একটাও আসলে মিথ্যা নয়, কিন্তু কারো আড়ালে আসর জমিয়ে বলার উপযোগী গল্পও ঠিক নয়। ময়নার মায়ের ঠিক সহ্য হয়নি।
সে এসে সব বলে দিয়েছিল রিম্মিকে। উলটে রিম্মির চোখ রাঙানি দেখতে হয়েছিল।
রিম্মি একটু চুপচাপ, অন্তর্মুখী, রিজার্ভ প্রকৃতির, এটা তার দোষ নয়, গুণও নয়। এটাই তার স্বভাব কিংবা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
এখন কেউ যদি এটাকে অহংকার হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজের মত করে বর্ণনা করে আনন্দ পেতে চায়, প্রতিবাদ করে তার সেই আনন্দটুকু কেড়ে নিতে চায় না রিম্মি। তার শাশুড়ির বক্তব্য হচ্ছে কী লাভ হলো নিজের জামাইয়ের সাথে দেমাগ দেখিয়ে?
এসব কথা তিনি রিম্মিকে সরাসরিও বলেছেন। রিম্মি প্রতিবাদ করেনি, পলকহীন চোখে তাকিয়ে ছিল সে।
সবাই উচ্ছল হতে পারে না। চেষ্টা করলেও পারে না।
আসলে রিম্মির কী করা উচিত ছিল? রিয়াসাত যদি একা একটা মানুষ হত, হয়ত রিম্মির এই স্বভাবকেই তার কাছে গুণ বলে মনে হত।
কিন্তু হৃদয়ে যার অন্য কারো বাস, তার মনের মধ্যে ঠাই পাওয়াও সহজ কাজ নয়। আর শরীরী আবেগ সৃষ্টি হতেও ন্যূনতম কিছু সময়ের প্রয়োজন।
মানুষ তো আর পশু নয় যে মানসিক যোগাযোগ স্থাপিত না হতেই শরীরে পৌঁছে যাবে। তাও যাওয়া যেত হয়ত যদি না রিয়াসাতের ক্যাথির প্রতি অনুরক্ততা থাকত।
তারপরও ব্যর্থতার দায়ভারটা রিম্মির ওপরেই আসে। রিম্মি পারেনি রিয়াসাতকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে, তার মন জয় করতে।
ইত্যাদি আলোচনা গতকাল চলেছে দিনভর, হয়ত আজও চলবে। অভ্যাস হয়ে গেছে রিম্মির।
খালা শাশুড়িকে দেখা যাচ্ছে, হাত উঁচিয়ে তাকে ডাকছেন। এগিয়ে গেল রিম্মি।
“জি খালামণি, কিছু বলবেন?”
খালা গলা নামিয়ে বললেন, “তোমার নাইটি নাই? নাইটি পরে ভিডিও কল দিয়ে দেখো তো একবার!”
কান গরম হয়ে গেল রিম্মির। রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে ময়নার মাকে বলল, “ময়নার মা, তুমি আজকে যা পারো কর। আমার ক্লাস আছে, এই মাত্র মনে পড়ল। আমি গেলাম।“
নিজের রুমে ঢুকে ট্রাংক খুলে সামনে যে শালটা পেল তুলে নিয়ে ময়নার মাকে দিয়ে বলল, “যাওয়ার সময় এটা নিয়ে যেও!”
(পরের পর্ব দুই তারিখে সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্)