নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৫

0
991

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৫।।
নীরা আপু গোসলে গেছে, ঘরে একাই ছিল মীরা, টেবিলে বসে পড়ছিল। ফুপি এসে দড়াম করে আমার ঘরের দরজা খুলে বলল, “খবর শুনেছিস?”
বই থেকে মুখ তুলে তাকাল মীরা। ছোট চাচা বলেছিল যে কেউই নাকি খবর জানে না।
এখন দেখা যাচ্ছে ফুপিও জানে। কে জানে হয়ত সবাই জানে।
তারপরও মীরা যে খবরটা জানে সেটা ফুপিকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। মীরা তাই সন্তর্পণে বলল, ‘কী খবর ফুপি?”
ফুপির নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। কেঁদেছে নাকি?
“ঘটক হারামজাদাটা একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে, এক বাচ্চার বাপ। ছবি দেখলাম, মাথার সামনের দিকে চুল নাই।“
মীরা হাই তুলে বলল, “ভালো তো। টাকে টাকা আনে, শোনোনি?“
ফুপি কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “মানে আমি কি এমনই পানিতে পড়ে গেছি যে আমার এখন এক বাচ্চার বাপের গলায় ঝুলে পড়তে হবে?”
মীরা একটু বিব্রত হল। ঠাট্টা করাটা ঠিক হয়নি।
“এর চেয়ে আমাকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও তো পারে!”
“নদীর পানিতে এখন আর আগের মত ফ্লো নাই ফুপি। দেখা গেল কেটে ভাসিয়ে দেওয়ার পরে তুমি না ভেসে এক জায়গাতেই আটকে আছ। তখন যে কেটেছে সে মার্ডার কেসে ফেঁসে যাবে। বিষয়টা ঠিক হবে না।“
ফুপি ঠাস করে মীরার গালে চড় বসিয়ে দিল। গাল ডলতে লাগল মীরা।
চড়টা একটু বেশিই জোরে হয়ে গেছে মনে হয়। গাল কি লাল হয়ে গেছে নাকি?
আয়না দেখলে বোঝা যেত। এখন উঠে আয়নার সামনে দাঁড়াতে সাহস হচ্ছে না মীরার।
দ্বিতীয় গালেও চড় খাওয়া লাগতে পারে। চার বছর আগে ফুপির সাড়ে ছয় বছর ধরে প্রেম করা বয়ফ্রেণ্ড বিসিএস চাকরি পাওয়ার পর দুম করে মা বাবার পছন্দে দশ বছরের ছোট এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল।
সেই শোকে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পড়ে গিয়েছিল ফুপি। সারাক্ষণ কাঁদত আর ওই লোককে গালিগালাজ করত, “হারামজাদা, কচি মালের খায়েশ সামলাতে পারলি না?”
আরো বিশ্রী সব গালিগালাজ। মীরা এসব গালাগালি ভালো বুঝত না।
ফুলি ছিল মীরা আর নীরা আপুর মাস্টার। সে কান পেতে শুনত আর খুব ভালো মত এইসব বুঝিয়ে দিত তাদেরকে।
তার নিজের জামাইও যে কচি মেয়ে পেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে গেছে সেটাও বলত। মনোযোগী শ্রোতার মত হাঁ করে শুনত নীরা মীরা দুই বোন।
এক সময় অবশ্য ফুপি খুবই সুন্দর ছিল। তখন বেশ ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাবই আসত।
সে সময়ে ফুপি এটা সেটা ছুতো দেখিয়ে সব নাকচ করে দিত তার ক্লাসমেট প্রেমিকের জন্য। এরপর তো সেই লোক যথাসময়ে চম্পট দিয়েছে।
দুঃখে যে মানুষের চেহারা খারাপ হয়ে যায় ফুপি তার চাক্ষুস প্রমাণ। সেই লোকের বিয়ের পর হারিয়ে গেল ফুপির মুখের লাবণ্য।
শুধু তাই না, তার মুখে ছোট ছোট ব্রণের মত কী যেন উঠতে শুরু করল। চুল পড়ে যেতে লাগল।
তারপরও দুই বছর বিয়ের নামই শুনতে পারত না ফুপি। দুই বছর আগে সেই লোকের সাথে দেখা হয়েছিল রোজার ইদের আগের দিন রাতে বড় রাস্তায় মার্কেটে।
প্রেগন্যান্ট বউকে চাঁদ রাতের শপিং করে দিচ্ছে। টিউব মেহেদি আরো কী কী যেন।
ওদের সামনে পড়ে যাওয়ার পর কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও দ্রুতই সামলে নিয়ে বলেছিল, “আরে নীরা মীরা ভালো আছ?”
ফুপি কোনো কথা বলেনি। শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল মনে হয়।
সেই লোক নিজেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার বউয়ের সাথে, “মিতা, ও হলো নাইমা, আমার সাথে পড়ত। আর ও হচ্ছে নীরা আর মীরা, নাইমার ভাইয়ের মেয়েরা। এই তোমরা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসো কেমন?”
কোনো একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যায় কিনা, সেই ভয়েই ওরা ফুপিকে টানতে টানতে ওই লোকের সামনে থেকে টেনে নিয়ে এসেছিল। সেই ইদে কোথাও যায়নি ফুপি।
নিজের ঘরেই বসে ছিল দরজা বন্ধ করে। কষ্ট পাওয়ারই কথা।
সেই লোক দিব্যি প্রেগন্যান্ট বউ নিয়ে ইদের শপিং করছে, আর ফুপি কিনা এখনো তার জন্য একা থেকে গেছে, একা একা শোক পালন করছে! শোকের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে ইদের পরের দিন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ইদের সেমাই বেড়ে নিয়ে খেতে খেতে বড় চাচীকে জানিয়েছিল ফুপি, সে এখন বিয়ে করতে রাজি আছে।
বড় চাচীই খবরটা জানিয়েছিল বড় চাচাকে, আর তারপর থেকেই চলছে ফুপির জন্য ছেলে দেখা। কিন্তু এরপরই শুরু হলো আসল বিপদ।
একে তো এই মফস্বল শহরে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় বয়স পঁচিশ পেরোবার আগেই, আর এই ছোট শহরে পরিচিত মহলের সবার এখন মোটামুটি জানা হয়ে গেছে যে ফুপির কারো সাথে লাইন ছিল। এর মধ্যে আরো আজেবাজে কথাও রটেছে।
ফুপি নাকি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছিল, এবোরশন করতে গিয়েই তার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব তথ্য ওরা সবই জেনেছিল ফুলির কাছ থেকে।
ফুলি হলো এইসব খবর জানার জন্য ওদের গুগল সার্চার। এলাকার যে কোনো খবর ওর কাছে পাওয়া যায়।
কার বাচ্চা হচ্ছে না, কার বনিবনা হচ্ছে না, কার ডিভোর্স আসন্ন ইত্যাদি ইত্যাদি সব জটিল বিষয়ে ফুলির এন্টেনা খুবই শার্প। মীরার নিজের অবশ্য মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় ফুপির বিষয়ে যেসব আজেবাজে কথা রটেছে সেগুলোতেও ফুলিরই অবদান সবচেয়ে বেশি।
যে অন্যদের রসালো খবরের খোঁজ করে সে নিজেও রসালো খবর তৈরি করতে ওস্তাদ হয়ে যাওয়ার কথা। মীরার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ নেই বলে ফুলিকে কিছুই বলতে পারছে না।
তাছাড়া ফুলির সাথে এইসব নিয়ে প্রমাণ ছাড়া গ্যাঞ্জাম করে লাভও হবে না। উলটো নিজেরই লস হবে, এলাকার খবরাখবর বিষয়ে আর আপ টু ডেট থাকতে পারবে না। মীরা তাই চুপ করে আছে।
বয়স আর জল তো এক জায়গায় বসে থাকে না। ফুপির বয়সও বসে নেই।
ফুপির বয়স এখন তেত্রিশ চলে। এখন আর সেরকম ভালো ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা পেলেও তারা ফুপিকে নাকচ করে দিচ্ছে।
শোকের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিলেও ফুপি এখন খুবই রুক্ষ মেজাজের হয়ে গেছে। ব্যাংকে চাকরি করে বলে সারা সপ্তাহ বাসার মানুষগুলো একটু রক্ষা পায়।
কিন্তু শুক্র শনিবারে রেহাই নেই। হুকুমের পর হুকুম চলতে থাকে।
সেই সাথে কড়া মেজাজ। বড় চাচীও কম যায় না, মেজাজের জবাবে সেও শুনিয়ে দেয় দু চার কথা।
ফুপিও চিৎকার করে, “মাগনা থাকি নাকি আমি? বেতনের পয়সা যা দেই, একটা মানুষের খেতে এত টাকা লাগে নাকি? আমি আলাদা থাকব! একা থাকব!”
“তুমি একা থাকবা নাকি নাং নিয়ে থাকবা আমরা কেউ দেখতেও যাব না!”
প্রতি ছুটির দিনই এক প্রস্থ চেঁচামেচি চলে। মাথা ধরে যায় একেবারে।
কি যে বিরক্তিকর!
ফুপি বলল, “ছবি দেখবি?”
অনেক কষ্ট করেও হাই আটকাতে পারল না মীরা। হাই তুলতে তুলতে বলল, “টাকলা ব্যাটার ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না ফুপি।“
ফুপি চোখ মুখ লাল করে উঠে দাঁড়াল। মীরা বললাম, “এখন কি তুমি ছবি দেখাতেই এসেছিলে? তুমি কি সেই লোকের ছবি সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ নাকি? তাহলে তো কেস সিরিয়াস!”
ফুপি থমথমে গলায় বলল, “ছবি আমার হোয়াটস এপে গাধা! এখন কেউ ছবি প্রিন্ট করে!”
“ওহ আচ্ছা আচ্ছা, তাই তো! আচ্ছা তুমি এক কাজ কর, ছবিটা আমার হোয়াটস এপে পাঠিয়ে দাও! আমি সময় করে দেখে নেব!”
“ঠিক আছে।“
ফুপি চলে গেল।
(আগামী পর্ব রবিবার সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here