নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৬

0
1096

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৬।।
একটু পরেই মীরার হোয়াটস এপে নোটিফিকেশন এল। মীরা ছবিটা খুলে দেখল অতও খারাপ না যতটা ফুপি বলেছে।
মীরার ছবিটা নিয়ে আরো একটু মজা করতে ইচ্ছে হলো। শিহাব ভাইকে ফোন করে বলল, “ভাইয়া নীরা আপুর যার সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে তার ছবি দেখবেন?”
শিহাব ভাইয়া নিষ্প্রাণ গলায় বলল, “পাঠাও!”
মীরা ফুপির পাঠানো ছবিটা পাঠিয়ে দিল শিহাব ভাইয়ার হোয়াটস এপে।
কিছুক্ষণ পর শিহাব ভাইয়া মীরাকে ফোন করে উত্তেজিত গলায় বলল, “মীরু, এই লোকের সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে নীরার?’
“হ্যাঁ, সুন্দর না?”
“সুন্দর! তোমার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে? এই লোকের তো বয়স বেশি!”
“আরে না, ছবিতে ওরকম এসেছে, আসলে উনি দেখতে ততটা ফটোজেনিক নন তো!”
“তুমি দেখেছ তাকে?’
মীরা হকচকিয়ে গেল। দ্রুত চিন্তা করতে লাগল কী বলা যায়।
“আর তাছাড়া বিজনেস ম্যান তো!”
“ও আচ্ছা! নীরা দেখেছে এই ছবি?”
“হ্যাঁ দেখেছে তো!”
“রাজি হয়েছে?”
“হ্যাঁ কেন হবে না? নীরা আপু তো খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে, চাচা চাচী যা করতে বলবে তাই করবে!”
“হ্যাঁ তাই তো! আচ্ছা মীরু আমি রাখি তাহলে এখন, কাস্টমার আসছে!”
ফোন রেখে দিল মীরা। পেট ফেটে হাসি আসতে চাইছে তার, আটকে রাখতে পারছে না।
“কী রে তোর সমস্যা কী, একা একা হাসিস কেন?”
নীরা আপু বেরিয়েছে গোসল করে, চোখেমুখে মিষ্টি স্নিগ্ধতা।
“কিছু না এমনিই, তোর কোচিং নাই আজকে?”
“হ্যাঁ আছে তো, কেন?”
“দোকানে যাবি নাকি?”
“না আমার তো কিছু দরকার ছিল না, তুই যাবি?”
“দেখিস দোকানে গেলে আমাকে নিয়ে যাস, একা যাস না আবার!”
“আচ্ছা”, বলে চলে যাওয়ার উপক্রম করেও আবার থেমে গেল নীরা আপু।
“কেন রে? কিছু হয়েছে নাকি?”
“না”, ঢোক গিলল মীরা, “কী আবার হবে!”
নীরা আপু একা দোকানে গেলে আবার শিহাব ভাইয়া কিছু জিজ্ঞেস করে ফেললেই হবে সর্বনাশ। দেখা গেল ভাইয়া বলে ফেলেছে “নীরা তোমার বিয়ের কী খবর” আপু বলবে “কী বিয়ে কীসের বিয়ে” তখন মীরা আবার ধরা খেয়ে যাবে।
নাহ, আজ দিনটা ভালো থাকতেই পারছে না মীরা। বাম কাঁধের ফেরেশতা মনে হয় খাতা ভরে লিখে কুল পাচ্ছে না।
ডান কাঁধের ফেরেশতা নিশ্চয়ই হতাশ দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা আবার পড়তে শুরু করল।
নীরা কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। এই মেয়ে আবার কোনো বিটলামি করেছে কিনা কে জানে!
একা একা তাকে দোকানে যেতে নিষেধ করেছে, তার মানে নিশ্চয়ই কোনো কিন্তু আছে। নিশ্চয়ই শিহাব তাকে ফোন করে বলেছে নীরাকে দোকানে পাঠিয়ে দিও।
গত মাসে শিহাব বলেছিল আড়ং এর মেহেদির চালান আসবে। যদিও এখন চাচাদের সাথে সম্পর্ক ভালো না, এমন তো হতেই পারে যে তার বিদেশী চাচা চকোলেট নিয়ে এসেছে।
হয়ত চকোলেটের পরিমাণ কম, নীরা মীরা দুজনকে দিতে গেলে কম পড়ে যাবে। তাই হয়ত ইরাকে একাই পাঠিয়ে দিতে বলেছে।
গাধাটা সরাসরি নীরার মোবাইলে ফোন করলেই পারত। কেন করেনি তাও নীরা জানে।
নীরার সাথে কথা বলতে গেলে এখনো ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে যায় শিহাব। কীসের এত ভয় কে জানে!
নীরা তো আর বাঘ ভাল্লুক না। নীরা মনে মনে ঠিক করল, সে বিকালে সুরমা স্টোর্সে যাবে।
একাই যাবে। মীরা সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতে পারে।
ফাজিলটাকে কীভাবে কাটানো যায় ভাবতে ভাবতে আলমারি খুলল নীরা। ঠিক করে ফেলল ফিরোজার ওপরে সাদা বাটিকের জামাটা পরবে আজকে।
বিকেল হতেই ছটফট করতে শুরু করল নীরা। ফুলিকে বলল, “দু কাপ চা বানিয়ে ছাদে নিয়ে যা তো, আমরা আসছি।“
নীরা পাটি হাতে ছাদে উঠল মীরাকে নিয়েই। মীরা কিছু বিস্মিত।
“বিশেষ কোনো কিছু হয়েছে নাকি আপু?”
“এই, একটু কথা ছিল তোর সাথে!”
দুই বোন বসল পাটি পেতে। বাসার লাগোয়া নিম গাছ।
ছাদে এসে দাঁড়ালে নিমগাছের ডাল ছোঁয়া যায়। সাদা সাদা নিমফুল ফুটেছে।
আর কয়েকদিন পরই সবুজ সবুজ নিমফল ধরবে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা নীরা বলল, “মীরা একটু বস, আমি মোড় থেকে পুরী নিয়ে আসছি।“
“চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে আপু।“
“তুই বস, আমি এই যাব আর আসব!”
সিঁড়ি বেয়ে অতি দ্রুত নিচে নামল নীরা। জামা বদলে ঠোঁটে লিপস্টিক ছুঁইয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে গেল দাদির সামনে।
দাদি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “সাইজ্যা পাইরা কই যাস?”
নীরা থতমত খেয়ে বলল, “পুরী আনতে যাই দাদি!”
“পুরী আনতে তো ফুলিকে পাঠালেই হয়!”
নীরা জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল। দাদি ফুলিকে ডেকে বললেন, “এই তুই পিছে পিছে যা তো। কই যায় এইটা শুধু দেখে আসবি!”
মনের মত একটা কাজ পেয়ে খুশি মনেই বের হলো ফুলি। নীরা বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা করল, “সুরমা স্টোর্স যাবেন?’
একটু পেছন থেকে সেই কথা শুনে ফুলির মুখে ফুটে উঠল এগাল ওগাল জোড়া হাসি। বলার মত একটা খবর পাওয়া গেছে আজকে!
ছাদের রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে মীরা লক্ষ্য করল আপু রিকশায় উঠে কোথায় যেন যাচ্ছে। রিকশা মোড় পেরিয়ে গেল অচিরেই।
কোথায় যাচ্ছে নীরা আপু, তাকে না নিয়েই? সুরমা স্টোর্সে যাচ্ছে না তো আবার!
মীরার দুশ্চিন্তার সীমা রইল না।
শেষ বিকেলে তার দোকানে ইরাকে একা একা দোকানে ঢুকতে দেখে শিহাবের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করল। একই সাথে বুকের ভেতর লাফালাফি করতে শুরু করল একটা পিং পং বল।
এই মেয়ে একা এসেছে কেন, বোনকে না নিয়ে? নিশ্চয়ই বলবে, “শিহাব ভাই, আব্বু একটা বুড়ো লোকের সাথে আমার বিয়ের কথা চালাচ্ছে! আমি একটুও রাজি নই!”
শিহাবের আশার বেলুন ফুটো করে দিয়ে নীরা চাপা গলায় বলল, ‘আড়ং এর মেহেদি আসবে বলেছিলেন, এসেছে?”
শিহাব কিছুটা হতাশ হলো। “না, আসেনি এখনো।“
“মীরার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল আপনার?”
“হ্যাঁ হয়েছিল তো!” ডুবে যাওয়া আশার তরীকে আবার একটু একটু ভেসে উঠতে দেখল শিহাব।
“মেহেদি আসেনি, তাহলে কী রেখেছেন আমার জন্য? চকোলেট?”
এবার কিছুটা মরিয়া হয়েই বলে ফেলল শিহাব, “নীরা, তোমাদের বাসায় বিয়ের কথা হচ্ছে?”
নীরা কিছুটা অবাক হয়েই তাকাল শিহাবের দিকে। “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? কে বলেছে, মীরা?”
তারপর নিজে নিজেই বুঝে ফেলার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, “ও বুঝেছি, চাচি আন্টিকে বলেছে নিশ্চয়ই! চাচির সাথে তো আন্টির খুব খাতির!”
“তোমাদের বাসার সবাই রাজি?”
হাজার চেষ্টা করেও “তুমি রাজি?” কথাটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারল না শিহাব।
“হ্যাঁ, রাজি না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই! ছেলের তো বিজনেস আছে, ছেলের মা মারা গেছে, শাশুড়ি নেই, একটা মাত্র বোন, তারও বিয়ে হয়ে গেছে, সংসারে কোনো ঝামেলা নেই!”
শিহাব হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “ছেলের বয়সটা একটু বেশি বলে মনে হয়নি তোমার?”
নীরা অবাক হয়ে বলল, “শিহাব ভাই আপনার কি মনে হচ্ছে না যে আপনি একটু বেশি অনধিকার চর্চা করে ফেলছেন?”
একদম নিভে গেল শিহাব। শুকনো মুখে বলল, “স্যরি!”
“প্রতিবেশী হিসেবে খোঁজখবর রাখা ভালো, কিন্তু বিয়েশাদির ব্যাপারে আমাদের ছোটদের নাক না গলানোই উচিত! আমাদের গার্জিয়ান আছে তো! দাদা দাদি, আব্বু আম্মু চাচা চাচি সবাই আছে যেখানে, ওরা নিশ্চয়ই ভালো কোনো ডিসিশনই নেবে!”
শিহাব আর কথা বাড়াল না। নীরারও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
প্র্যাকটিক্যাল খাতা, বই দাগানোর মার্কার, ক্লিপের একটা সেট কিনে বেরিয়ে এল সে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাসায় ফিরতে হবে।
রিকশায় ওঠার পর শিহাব একটা ব্রাউন পেপারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে গেল তার হাতে। নীরা জিজ্ঞেস করল, “কী এটা?”
“চকোলেট, বাসায় গিয়ে খেও!”
নীরার এত মেজাজ খারাপ হয়েছিল যে, সে বাসায় ফিরে প্যাকেটটা খুলেও দেখল না। সরাসরি মীরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নে, শিহাব ভাইয়া দিল, চকোলেট!”
“তুই আমাকে না নিয়ে সুরমা স্টোর্সে গিয়েছিলি?”
নীরা সে কথার জবাব না দিয়ে ঢুকে গেল ওয়াশরুমে। মাগরিবের আজান দিচ্ছে, দাদি কিছু বলার আগেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
মীরা প্যাকেটটা খুলে দেখল একটা চিরকুট।
“নীরা
তুমি কি কিছুই বোঝো না?”
মীরা অসম্ভব দ্রুততায় লুকিয়ে ফেলল চিরকুটটা। এই চিরকুট দেখানোর সময় এখন না।
এরকম চিরকুট কাজে লাগাতে হবে সঠিক সময়ে। এখন দেখালেই হাজারটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।
সে যে শিহাবের সাথে দুষ্টুমি করেছে সেগুলোও ধরা পড়ে যেতে পারে। কাজেই আপাতত এই জিনিস চুড়ির বক্সের ভেতরে পেতে রাখা কাগজের নিচে চুপচাপ রেখে দেওয়া যাক!
(আগামী পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here