নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-২

0
1396

নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২য় পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

আমার মেজ আপার নাম নীতু। আমাদের বাসার সবচেয়ে ভালো ও মেরুদণ্ড ওয়ালা মানুষ। অবশ্য বড় দুলাভাই ও খুব ভালো। মেজ আপা এক চান্সে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের প্রথম ধাপ পার হয়ে গেলো। পার হওয়ারই কথা। মেজ আপা খুব মেধাবী, খুব পরিশ্রমী আর স্বল্পভাষী। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই আম্মুর পড়া নিয়ে কড়া শাসন। মেজ আপাকে অবশ্য বেশি শাসন করার দরকার হয়নি। আম্মু বললেন,”একবারে পাশ করে গেছো দেখে আবার হাতীর পাঁচ পা দেখোনা। পড়ার স্পীড যেন না কমে।”

“আম্মু,তুমি কি পড়া ছাড়া কিছু ই বুঝো না?”

“না,বুঝিনা। পড়তে হবে,মানুষ হতে হবে।”

“শুধু পড়ালেখা করলেই মানুষ হওয়া যায়?জীবনে আর কোনো কিছুর মূল্য নেই? ”

আম্মু চিৎকার করে বললেন,”না,নেই। পড়াশোনা করতে হবে,টপ রেজাল্ট করতে হবে,সমাজে টপ পজিশনে থাকতে হবে।এটাই আমার শেষ কথা।”

” আম্মু,ক্যারিয়ার আমি নিজের ইচ্ছেতেই করবো,তোমার ভয়ে বা চাপে নয়। তবে তোমাদের কাছে শীঘ্রই একটা বিয়ের প্রস্তাব আসবে,আমার জন্য। পাত্রের বাবা-মা নিজেরাই আসবেন। ছেলেটি আমার ইয়ারমেট। আমরা রিডিং পার্টনার। ও খুব ভালো ছেলে।”

আম্মু মেজ আপার গালে প্রচন্ড জোরে একটা চড় কষালেন। আপার ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।

“অসভ্য, জানোয়ার। লেখাপড়া না করতে যেয়ে প্রেম করতে যাও?”

মেজ আপা ঠোঁটের রক্ত মুছে বললো,”লেখাপড়া না করলে পাশ করলাম কি করে? তুমি আমাকে বিনা কারণে চড় মারলে কেন?তোমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে।”

আম্মু আরেকটা থাপ্পড় মেরে বললেন, “তুই আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করিস?ইয়ারমেটের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছো, ক্যারিয়ারের বারোটা বাজাচ্ছো,তোমাকে মাথায় তুলে নাচবো?একটা বেকার,লোফার ছেলের বাপ-মা বিয়ের প্রোপোজাল নিয়ে আসবে আর আমাকে আহ্লাদে আটখানা
হয়ে তাদেরকে মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে হবে? গায়ের রক্ত পানি করা টাকা দিয়ে তোমাদের খাইয়েছি,বেস্ট স্কুল -কলেজে পড়িয়েছি, বেস্ট টিচারদের দিয়ে পড়িয়েছি,তার প্রতিদান এই? এই বয়স নিজের ক্যারিয়ার গড়ার বয়স,এই বয়সে এত পিরীত আসে কেমন করে?”

” জীবনে পাঠ্যবই এর গুরুত্ব আছে,এটা আমিও মানি। কিন্তু তোমাদের দেখলে মনে হয় পুঁথিগত বিদ্যার তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। এর জলজ্ব্যান্ত উদাহরণ হলে তুমি,আব্বু,আপা, আমার দেখা আরও কিছু মানুষ। এতো এতো লেখাপড়া করেও তোমার মুখের কি ভাষা! এতো শিক্ষিত হয়েও তুমি নিজের প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের মারধোর কর। কাজের মেয়েদেরতো কথাই নাই। তোমার সাথে আমার কোনো ভালো স্মৃতি নেই। আমার কাছে মা মানে এক ভয়ংকর পাষাণ মূর্তি যার কাছে অন্যের ইচ্ছা, মতামত, খুশির কোনো দাম নেই। যার কাছে সবাই খারাপ। যে নিজের মেয়ের সংসারে নাক গলিয়ে গলিয়ে মেয়েকে আরও নষ্ট করে ফেলছে।যে কাউকে কোনোদিন ভালো কোনো উপদেশ দেয়নি।”

মেজ আপার আরও অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু আম্মু এমন উন্মাদিনীর মতো আপাকে মারতে থাকলেন যে আব্বুর মতো স্ত্রীর ভয়ে ভীত ব্যক্তিও ছুটে এসে আম্মুকে ধাক্কা দিয়ে আপাকে ছাড়িয়ে নিলেন।

বড় আপাও দুদিনের জন্য এখানে এসেছিল। এখন সে শ্বশুর বাড়িতে থাকতে বেশি পছন্দ করে। কারণ ঐখানে এখন সুবিধা এখানের চেয়ে বেশি। ওইখানে সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি আপার জন্য। ওর যা যা খেতে ভালো লাগে, সব ওখানে মজুদ থাকে। আমাদের বাড়িতে সারাজীবন গৃহকর্মীরা রান্নাবান্না করেছে,এখন যে দুজন আছে বেচারারা একদমই ভালো রাঁধতে পারে না। তাছাড়া আমাদের বাড়ির খাওয়া-দাওয়া বরাবরই খুব সাধারণ, বৈচিত্র্য নেই। আমরা এতেই অভ্যস্ত। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে ভালো মন্দ খেয়ে খেয়ে আপার মুখের রুচি পরিবর্তন হয়েছে। এই বাসায় এখন তার পোষায় না। আগের মতো ফাস্টফুড ও খেতে পারে না,বুক পেট জ্বলে। মেজ আপা বা আমি মাঝে মাঝে রান্নাঘরে ঢুকি, টুকটাক খাবার বানাতে পছন্দ করি। আম্মু এতে রাগ করে। এতে পড়াশোনার নাকি বহুৎ ক্ষতি হয়।

আপার এমনিতেই মেজ আপার উপরে চাপা একটা রাগ ছিল। আপার বিবাহ পরবর্তী ফ্যান্সি প্রেমটা মেজ আপার দূরদর্শিতার জন্য ই ধরা পড়েছিল এবং প্রেমের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। তাছাড়া মেজ আপা বড় আপার মুখের উপরে অনেক সত্যি কথা বলে দেয়। সুতরাং, আপা নানা উস্কানিমূলক কথা বলতে লাগলো। যেমন,”চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। একবার ভাবলোও না ইয়ারমেটকে বিয়ে করার পরিণতি কি। দুজনেই বেকার বসে থাকবে আর আম্মু, তুমি যে নীতুর এতো পচা আম্মু,তোমার ঘাড়েই বসে বসে খাবে জামাইসহ। ইয়ারমেট বিয়ে করলে মেয়েটা আগে আগে বুড়োটে হয়ে যায়,ছেলেটা ইয়াং থাকে, বিয়ের কয় বছর পরেই আর বৌকে ভালো লাগে না। অন্য ফুলে মধু খুঁজে। ”

মেজ আপা স্হির চোখে এবং শান্ত গলায় বললো,”তোমার বর্তমান বস যেমনটা তোমার মধ্যে মধু খুঁজে? ”

বড় আপা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। আম্মু এতোক্ষণ রাগে কাঁপছিলেন। এখন কাঁপার মধ্যে ই চমকে উঠলেন। মেজ আপা স্বাভাবিক পায়ে তার নিজের ঘরে চলে গেলো।আমিও ওর পিছু নিলাম।রাগের মাথায় যদি কিছু করে বসে।

আব্বু পরদিন মেজ আপার সাথে কথা বললেন এবং ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। ছেলের দুর্দান্ত রেজাল্ট, বাবাকে এক নামে দেশে সবাই চেনে,মেডিসিনের নামকরা বিশেষজ্ঞ। মাও কম যান না। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনিও খুব নাম ডাকওয়ালা। উনাদের একটাই মেয়ে, বুয়েট থেকে পাশ করা, এম.এস এর জন্য আমেরিকায়। জামাই নিউইয়র্কের একটা নামকরা মেডিকেল কলেজে বিভাগীয় প্রধান। গুলশানে বিশাল বাড়ি। ছেলে ও মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট উত্তরায়।ছেলে যেমন ব্রাইট, সে যে অতি সুপ্রতিষ্ঠিত হবে বেঁচে বর্তে থাকলে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মেজ আপা হবু শ্বশুর -শাশুড়ি দুজনের ই ডিরেক্ট ছাত্রী ছিলেন, দুজনেই আপাকে খুব পছন্দ করেন এবং সব ঘটনা জানেন।

আম্মু সব শুনে নরম হলেন। তবে তাঁর টেনশন,মেজ আপার ক্যারিয়ারের যদি ক্ষতি হয়। প্রভাবশালী পরিবার যদি বাধা সৃষ্টি করে? পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা হলো, ছেলের দাদী নাত বৌএর মুখ দেখে যেতে চান।তাঁর এই একটিই নাতি। আর সাত নাতনি তিন ছেলেমেয়ের ঘরে। তাঁর এই ইচ্ছের অবমাননা করা হবে না।

মেজ আপার বিয়ে হয়ে গেলো। ঐ পক্ষ যা ধুমধাম করলো, তা সারাজীবন মনে রাখার মতো। আম্মু অবশ্য বড় আপার বেলায় যতোটুকু করেছিলেন, মেজ আপার বেলায় ততোটুকুই করলেন। বড় আপাকে বললেন,”প্রেম করলে এমন প্রেমই করতে হয়। তুমি ফালতু জায়গায় প্রেম করে এখন পস্তাচ্ছো,আমিও পস্তাচ্ছি কেন তোমার কথামতো ওইখানে বিয়ে দিলাম।”

এরপরে বড় আপা আরও ডেয়ারিং হয়ে গেলো। দুলাভাইকে পাত্তা দেয়না,শ্বশুর -শাশুড়িকে তো নয়ই। শ্বশুর বাড়ি থেকে শতভাগ সুবিধা নিতো, পছন্দসই খাওয়া, ট্রান্সপোর্ট, দুলাভাই এর কাছ থেকে টাকা নেওয়া
সবই চলতো, কিন্তু তাদের জন্যও যে তার কিছু করার আছে,সেটা সে বেমালুম ভুলে থাকলো। সকাল-সন্ধ্যা হাসপাতাল,প্রতিদিনই এই পার্টি, ওই পার্টি, এখানে বেড়াতে যাওয়া,ওখানে বেড়াতে যাওয়া, এমনকি স্কুলের বন্ধুদের সাথে সাতদিনের জন্য ইন্ডিয়ার বিভিন্ন স্টেট ঘুরে আসা।

অবশেষে বড় আপার মেয়ে, আমাদের নয়নমনি নাতাশা জন্ম নিলো। দুই বাড়িতে আনন্দ দেখে কে! তিথি ভাবীর দুই মেয়ে,তবু নাতাশার আগমনে দুলাভাই বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা কেউ হতাশ হলেন না। আম্মুর পছন্দ মতো ডাক্তারের হাতে,পছন্দসই নামীদামী কর্পোরেট হাসপাতালে বাবু হলো। অথচ আপা যে হাসপাতালের ডাক্তার,সেখানে ডেলিভারি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আম্মুর কারণে তা হলোনা। সবচেয়ে ভালো হাসপাতালে আপার ডেলিভারি হতে হবে।

আপা চারদিন হাসপাতালে থাকলো। আম্মু দিনের বেলায় আসেন, এটা নাই কেনো,ওটা হোলো না কেন, আপার যত্ন ঠিক মতো হচ্ছে না,এসব কথা বলেন,তবে কাজের কাজ কিছু করেন না। প্রথম রাতে মেজ আপা জোর করে থাকলো। খালাম্মা আর দুলাভাই ও থাকতে চেয়েছিলেন, মেজ আপা সবিনয়ে বললো,”খালাম্মা,আপনি আজ ভোর থেকে দৌড়াদৌড়ি করছেন,আপনার হাই প্রেশার, ডায়াবেটিস। রাতে ঘুমের দরকার। কাল আপনার সুবিধামতো সময়ে আসবেন। আর দুলাভাই, আপনার গায়ে এখনো হালকা জ্বর,আপনার থাকার প্রশ্নই উঠে না।”

ভোরে উঠে আমি রেডি। আমি এখন ছোট খালা। ক্ষীরের পুতুলটার মুখ সারারাত ভালো করে ঘুমাতেই দেয়নি। আম্মু না বলে দিলেন।”সামনে তোমার অ্যাডমিশন টেস্ট। গতকাল কোচিং, টিউটর সব বাদ দিয়েছো।আজ ওসব চলবে না। তোমার টিউটরকে বলে দিয়েছি আজ বেশি সময় ধরে পড়াবেন।কোচিং ঠিক মতো করো।কালকে কোচিং এ যা যা পড়ানো হয়েছে, সেগুলো ভালো করে তুলে নিয়ে দয়া করে পড়ে ফেলো। ডেইলি হাসপাতালে যাওয়ার দরকার তোমার নেই। ”

“আম্মু, বাবু। বাবুকে খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। ”

“বাবুকে বহুৎ দেখতে পাবে,কিন্তু এই সময় আর ফেরত আসবে না।”

আমার ভয়ংকর মন খারাপ হয়ে গেলো। সাত দিন আগে আমার আপন ফুপাতো বোনের বিয়ে হলো। সবাই গেলো আমি ছাড়া।অ্যাডমিশন টেস্টের আগে কোনো আনন্দ করতে নেই, সব নাজায়েজ, লেখাপড়াটা ছাড়া।

একটা বিষয় আম্মু সম্পর্কে বলবো,ভীষণ লজ্জার। আম্মু আমাদের নামাজ পড়তে দেন না,রোজা রাখতে দেননা। এতে সময় নষ্ট হবে, স্বাস্থ্য নষ্ট হবে।ছাত্র জীবনে লেখাপড়াটাই একমাত্র ইবাদত। আমাদের বাড়ির বিদ্রোহী কন্যা মেজ আপা এই নিষেধ মানে নি। সে দাদীর দেখাদেখি ছোটবেলা হতে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। এরজন্য মার বেচারা কম খায়নি, কিন্তু হাজার মেরেও আম্মু ওকে নামাজ-রোজা থেকে ফেরাতে পারেননি।আম্মু দাদীর সাথে খুব ঝগড়া করতেন, ” আমি নিষেধ করেছি,তাও আপনি ওদের নামাজ-রোজা করতে বলেন কেন?রোজা রেখে ভালো করে পড়া যায়?আপনি কি চান না ওরা ভালো করুক? ওদের রোজা রাখতে বলবেন না।আমি ওদের মা।আমার কথাই ফাইনাল।”

দাদীও কম যেতেন না,”হ্যাঁ, তুমিইতো মা।কোকিল মা। মেয়েদেরকে একটু সময় দাও? মিষ্টিমুখে দুটা কথা বলো? শুধু পড়া আর পড়া। শুধু লেখাপড়া দিয়ে জীবন চলে না,বুঝেছো? লেখাপড়া জীবনের একটা পার্ট মাত্র। ”

“এই পার্টটাই ওদের একটু ভালো করে করতে দিন না। সারাজীবন তো এক ছেলের ঘাড়েই থাকলেন, আপনার আর কোনো ছেলে মেয়ে নেই? তাদের বাড়ি যেতে পারেন না?”

“এখনতো তাই বলবে।রীতু হওয়ার আগ দিয়ে কে আমাকে জোর করে বাড়ি থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলো? বুড়ো লোকটা শহরে বেশি দিন থাকতে পারতো না, আসা যাওয়ার মধ্যে থাকতো,কতো কষ্ট হতো লোকটার, আমিও নাত্নির মুখ দেখে দুনিয়া ভুলে গেলাম,আর কারোর কথা ভাবলাম না। তোমার তিন তিনটা মেয়েকে বড় করেছি, নিজে নাওয়া খাওয়ার সময়টুকু পাইনি দিনের পর দিন, অন্য ছেলেমেয়েদের বাড়িতে দুটা দিনও থাকতে দাওনি আমাকে,” আম্মা,আম্মা” করে অস্হির, এখন মেয়েরা বড় হয়েছে, বিশ্বাসী কাজের লোক পেয়েছো,আমার শরীর ভেঙেছে, এখন আমি তোমাদের বোঝা। বাচ্চা কাচ্চা বাসায় ফেলে ফ্রী বার্ডের মতো আরাম করে স্বামী-স্ত্রীতে চাকরি করেছো, বাইরে বাইরে ঘুরেছো,এখন আসছো মহা দায়িত্বশীল মা হিসাবে? মেয়েদেরকে শুধুমাত্র বইএর পাতা গিলিয়ে অপদার্থ বানানো ছাড়া মায়ের আর কোন দায়িত্ব পালন করেছো তুমি? ”

আমরা মোটামুটি বড় হয়ে গেলে আর নানীর দূর সম্পর্কের বোন ময়না বুবু এলে বুড়ো এবং অশক্ত দাদীকে আব্বু-আম্মু পাঠিয়ে দিলেন গ্রামে।যুক্তি হলো, আব্বু-আম্মু দুজনেই অফিসের প্রয়োজনে সারাদিন বাইরে থাকেন।দাদীর ইমারজেন্সি অবস্থা হলে আমরা ছোট ছোট তিনটা মেয়ে কি করবো,দাদীরই বা কি হবে? দাদীকে নিয়ে গেলেন বড় চাচা-চাচী। ভালোই হয়েছিল সেটা দাদীর জন্য। জীবনের শেষ তিন বছর শারীরিক কষ্ট থাকলেও চাচা-চাচীর আদর আর সেবা যত্নে মানসিক কষ্ট ছিলো না। আমাদের বাসায় চাচা-ফুপুরা দাদীকে দেখতে খুব একটা আসতে পারতেন না, আব্বু-আম্মুর নিস্পৃহ, মাঝেমধ্যে বিরক্ত আচরণের জন্য। আম্মু শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন,”সারাদিন চাকরি করে বাসায় এসে একটু বিশ্রাম নিতে পারিনা।বড্ড কাহিল লাগে। মেয়ে তিনটার লেখাপড়ার যে কি হবে! মেহমান আসলে আসুক,তোমরা তোমাদের কাজ করো, লেখাপড়া ফেলে এদিকে ঘুরঘুর করার কি দরকার?” চাচা-ফুপুরা দাদীকে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতে চাইলে আম্মুর কি দুশ্চিন্তা! “বাসায় তিনটা মেয়েকে রেখে অফিস করা যে কি অনিরাপদ। তোমরাতো বাসায় থাকো, তোমরা আমার টেনশন বুঝবে না।” চাচা-ফুপুরা মাঝে মাঝে বলতেন,” আমাদেরও তো একটু মা’কে কাছে রাখতে ইচ্ছা হয়। তাছাড়া মায়েরতো একদম একঘেঁয়ে জীবন। তাঁরও তো একটু চেঞ্জ দরকার।”

“তারমানে বলতে চাচ্ছো মা এখানে খুব কষ্টে থাকেন?কি মা,আপনিই বলেন, এই ছেলের বাসায় আপনার খুব কষ্ট হয়?আমরা আপনার দেখাশোনা করি না?”

আম্মুর কথার তোড়ে কেউ আর কথা বেশি বাড়াতেন না। সেই দাদী একসময় হয়ে গেলেন অবাঞ্ছিত। আব্বু কয়েকবার ক্ষীণ কন্ঠে দাদীর জন্য নার্স রাখার কথা বলেছিলেন, আম্মুর ধমকে নিজের ইচ্ছাকে তাড়াতাড়ি মাটিচাপা দিয়েছেন।
“বুদ্ধির বলিহারি! জমিদারের বাড়ি নাকি এটা?কয়টা ঘর তোমার? এক ঘর দখল করে থাকবে তোমার মা আর নার্স, দল বেঁধে প্রতিদিন আত্মীয় স্বজন দেখতে আসবে, দেখতে আসার নামে চলবে হৈহৈ, আড্ডাবাজি,খাওয়া দাওয়া। মেয়েদের লেখাপড়া মাথায় উঠবে। বহুদিন আমি তোমার মা’কে দেখেছি, এবারে তোমার অন্য ভাই বোন দেখুক। ”

মেজ আপা তখন ক্লাস এইটে পড়ে। সে বলে উঠল,”তুমি দাদীকে দেখে রাখোনি আম্মু, দাদীই আমাদের বাসার সবাইকে দেখে রেখেছে। ”

দাদীর চলে যাওয়ার দিন আমরা খুব কেঁদেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হয়,দাদী যদি অনেক অনেক আগেই আমাদের বাসা থেকে চলে যেতেন,তাহলে তাঁকে এতো কষ্ট আর অপমান সহ্য করতে হোতো না, দাদাভাই এরও বাস অ্যাকসিডেন্টে মরতে হোতো না। বড় চাচার বাসায় দাদী আর সব চাচা-ফুপুদের খুব আনন্দে সময় কেটেছে।

বলছিলাম আমার ক্ষীরের পুতুলের কথা। সারাদিন কোচিং করলাম, টিচারের কাছে পড়লাম, কিন্তু মন পড়ে রইলো বোনঝির কাছে।

দ্বিতীয় রাতেও মেজ আপা থাকতে চাইলো। দুলাভাই এর আম্মার ব্লাড প্রেশার খুব বেড়ে গিয়েছিল। দুইবার বমি হয়েছে। তাঁকে প্রায় জোর করেই বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। দুলাভাই এর ও জ্বর বেড়েছে। আম্মু মেজ আপাকে থাকতে দিলেন না।

“গতকাল দিন রাত এক করে এখানে পড়ে ছিলি,আজকেও তুই কেন? শরীর খারাপ করবে। আমারতো মনে হয়না তোমার দ্বারা ক্যারিয়ার হবে। আগেভাগে বিয়ে করলে, এখন লক্ষী বৌ হওয়ার জন্য শ্বশুর -শাশুড়ির কথায় উঠো-বসো, প্রতিদিন ই দাওয়াত খেয়ে বেড়াও, এমন করলে তো মা ডিগ্রি কপালে জুটবে না। এখানে তোমাকে থাকতে হবে না। বরং বাসায় যেয়ে বিশ্রাম করো,বইএর পাতাগুলো একটু নাড়োচাড়ো।”

“এখানে কে থাকবে তাহলে,তুমি?”

“থাকার লোকের অভাব আছে নাকি? যাদের বাড়ির মেয়ে,তারা থাকবে না? বাচ্চার দাদী আর বাপ না হয় পড়ে আছে এক্কেবারে সময় মতো, তা চাচী-ফুপুরা নেই? ”

“আমি থাকি আম্মু।আমার কোনো সমস্যা নেই। ”

“আমার সমস্যা আছে।যা বলি তাই করো।বাসায় যাও।আর দয়া করে ক্যারিয়ারকে ফোকাস করো। আল্লাহর দোহাই লাগে।”

“তাহলে তুমি থাকো।”
“আমার কাল অফিস আছে। রাত জাগতে পারবো না। তোমাকে এতো ভাবতে হবে না। ওদের বাড়ির কেউ থাকবে।”

বাবুর চাচী-ফুপিরা সবাই থাকতে চায়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো,তিথি ভাবী থাকবেন।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here