নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-৯

0
999

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
৯ম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

অনার্সে আমি রেকর্ড ব্রেক করা নাম্বার পেলাম। শোনা যাচ্ছে, বিজ্ঞান অনুষদের সোনার পদকটা আমার কপালে জুটবে। মেজ আপার বাসায় এসেছি।খালাম্মা গ্র্যান্ড পার্টি দিচ্ছেন। আব্বু এসেছেন,আমার মামা-মামীরা,খালা-খালুরা,চাচু-ফুপিরা, বড় দুলাভাই, রিংকি আপা,তিথি ভাবী, আমাদের বাবুসোনা। বড় আপার শাশুড়ি -শ্বশুরদেরও দাওয়াত দেয়া হয়েছিল, উনারা আসেন নি। স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য, বাসায় যা কোনোদিন পারিনি, হোষ্টেলে এসে সেই অত্যাবশ্যকীয় কাজটা করেছি।ফুরসত পেলেই মামা,খালা,চাচা,ফুপু সবার বাসায় ঘুরে ঘুরে সম্পর্ক ভালো করে ঝালাই করে নিয়েছি। কারণ,আম্মুতো কারো সাথে যোগাযোগ রাখার সুযোগটা তেমন দিতেন না। চাচা-ফুপিদের বাসায় যেতে টেনশন কাজ করছিলো।উনাদের মা’কে আমার বাবা-মা কি নাজেহালটাই না করেছেন,উনাদেরও কম যন্ত্রণা দেন নি। কিন্তু সবাই যে আমাকে কি আদর করলেন,কতোটা খুশি হলেন, বলার নয়। সবারই এক কথা, উনারা অন্যায় করেছেন আমাদের তিন বোনের খোঁজ খবর না নিয়ে। চাচা-ফুপির কর্তব্য তাঁরা পালন করেন নি।কিন্তু আমরা তিন বোনই তাঁদের অনেক আদরের।বড় আপার পদস্খলনে তাঁরা খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমার আর আম্মুর লড়াইএর কথাও তাঁরা জানেন। প্রায়ই বলেন,”এটা ঠিক করছিস না বুবলি। মায়ের সাথে অভিমান পুষে রাখতে নেই। যা, বাসায় যেয়ে মা’কে জড়িয়ে ধর্।সব ঠিক হয়ে যাবে। ” আমি আর মেজ আপা দাদার বাড়িতেও ঘুরে এসেছি। ওখানে বড় চাচা-চাচী থাকেন। খুব ভালো আর সহজ সরল মানুষ। দাদীর কবর দেখে আমরা দুই বোন ভীষণ কেঁদেছি।

ছোট মামা ছাড়া বাকি মামা-খালারাও আম্মুকে খুব ভয় পেতেন। আমাদের প্রাণ খুলে আদর করতে পারতেন না।যাওয়া-আসাওতো খুব রেস্ট্রিকটেড ছিল। এখন সবার বাসায় যাই,খাইদাই,গল্প করি।সবাই আমাকে আম্মুর কাছে যেতে বলেন।আশ্চর্য! আম্মুর নামে একটা খারাপ কথাও কেউ বলেন না।

মেজ আপার শাশুড়ি আব্বুকে বললেন,”এতো করে বেয়ানকে আসতে বললাম।তাও বেয়ান আমার অনুরোধ রাখলেন না?”

আব্বু বললেন, “কিছু মনে করেন না বেয়ান। মেয়ের অবশ্য কর্তব্য ছিল মায়ের কাছে যাওয়া,মা যতোই অন্যায় করুক। ঘটনার পাঁচ বছর হতে চললো, একবারও মায়ের কাছে গেলোনা।”

সবাই চুপ করে থাকলো। আব্বুর উপরে আমার খুব বিতৃষ্ণা হচ্ছিল, বিবেকবান লোক,কতো লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছ,নিজের মায়ের কতোটুকু সেবা যত্ন করেছো?বউএর কথায় মাকে সংসারের দাসী করে নিয়ে এসেছিলে, মা যখন আর ঘানি টানতে পারছিলো না,তখন বৌএর অর্ডার মতো মা’কে গ্রামের বাড়ি থুয়ে এলে। বাসায় মেয়েদের উপরে এতো অত্যাচার হতো, তুমি মূর্তির মতো বসে থাকতে। ভন্ড নীতিবাগীশ।

খালাম্মা বিশাল আয়োজন করেছিলেন। মেজ অপার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পরও বিরাট পার্টি করেছিলেন। ঐ বার আমি যাইনি আম্মু আসবে বলে।
মেজ দুলাভাই পাশ করার পরেও পার্টি দিলেন। বড় দুলাভাই বিয়ে করার পরে নব দম্পতি, বড় দুলাভাই এর বাড়ির লোকজন, রিংকি আপার মা-বাবা-ভাই-বোনকে আর আমাকে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন। আমার হোষ্টেলে প্রায় খাবার পাঠান খালাম্মা। একজন মানুষ কি করে এতো ভালো হয়? ধূমধাম করে অনুষ্ঠান হলো। আম্মুকে আমি পছন্দ করিনা,কিন্তু তারপরও সব কেমন খালি খালি লাগছিলো।

রিংকি আপার সাথে আব্বুর প্রথম দেখা। রিংকি আপা আব্বুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। দুলাভাই আব্বুকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। সামান্য মাথা ঝুকিয়ে সালাম দিলেন। আব্বু জিজ্ঞেস করলেন,”কেমন আছো বাবা?”দুলাভাই নিস্পৃহ মুখে বললেন,”ভালো।”

“আমাদের উপর তোমার রাগ-ঘৃণা থাকাটাই স্বাভাবিক, তবু বাবা,যদি পারো,এই বুড়োকে মাফ করে দাও। তুমি আমার ছেলের মতো,সেই অধিকারে বলছি, রীতুর মা’কে অভিশাপ দিওনা। ওর প্রতি রাগ পুষে রেখোনা।”

দুলাভাই কঠিন স্বরে বললেন,” উনাকে নিয়ে চিন্তা করার অবসর,ইচ্ছা, মানসিকতা কিছুই আমার নেই। ”

দুলাভাই আব্বুর সাথে কথা বলছেন,মুখের পেশী শক্ত। আর আমার, মেজ আপার,মেজ দুলাভাই এর সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ। একদম আগের মতো, তার থেকেও বেশি। রিংকি আপা প্রেগন্যান্ট। আমি,মেজ আপা খুব খুশি, কিন্তু তারপরেও বুকের ভিতর চাপা অস্বস্তি। রিংকি আপা কি বাবুনিকে নিজের সন্তান থেকে অনেক আলাদা করে দেখবেন?দুলাভাই কি পাল্টে যাবেন অনেকটা? দাদা-দাদী, চাচী-ফুপুর কাছে আগের আদর থাকবে বাবুনির?মানুষের পাল্টে যেতে কতক্ষণ? অবশ্য তেমন কিছু দেখলে মেজ আপা বা আমি বাবুনিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবো।

রাতে মেজ আপার বাসায় থেকে পরদিন হলে ফিরলাম। সন্ধ্যায় আপা এলো।আজ সে বাসায় গিয়েছিল। গতরাতে আব্বুর মুখ থেকে রিংকি আপার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে আম্মু উন্মাদ হয়ে গেছে। চিৎকার করে কান্নাকাটি, প্রলাপ বকা বাবুনি শীঘ্রই মরে যাবে, ভয়ংকর ব্যাপার হলো আম্মু বড় আপার শ্বশুর বাড়িতে আজ সাত সকালে হাজির হয়েছিল। আপার শ্বশুর, শাশুড়ি, দুলাভাই সবার হাত-পা ধরে হাউমাউ করে কান্না,বাবুনিকে যেন আম্মুর কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। আপার শ্বশুর -শাশুড়ি খুবই অপমান করেছেন আম্মুকে, বড় দুলাভাই ও। বাবুনিকে দেখতে দেওয়া হয়নি। অনেকটা জোর করে আম্মুকে বের করে দেওয়া হয়েছে। রাত থেকে আম্মু এখন পর্যন্ত এক ফোঁটা পানিও খান নি।

আমি একটু দুঃখ পেলাম।আম্মুর চিন্তা বড় আপার মেয়েকে নিয়ে,তাও অবাস্তব দুশ্চিন্তা, আমাকে নিয়ে আম্মুর কোনো ভাবনা নেই। এতো বছরে আম্মু আমার নামটাও উচ্চারণ করেননি। আমার রেজাল্ট শুনেও আম্মুর হোলদোল হয়নি।

আপা বললো,”আজ তোকে আমার সাথে বাসাতে যেতেই হবে।কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। ”

“আজ না আপা, আর কয়দিন পরে।”

“কোনো কথা শুনবো না,আজ এখনই আমার সাথে যাবি।”

কি করবো ভাবছি। এমন সময় ছোট মামার ফোন এলো। নানীর অবস্হার অনেক অবনতি ঘটেছে। উনি আমাদের দেখতে চান, বিশেষ করে আম্মুও আমাদের তিন বোনকে। দেরি না করে যেন চলে আসি।

আমার বুক হুহু করে উঠলো।নানী, আমার নানী। আম্মুর কল্যাণে নানীর সঙ্গ তেমন পাইনি। কিন্তু দেখা হলে নানী আমাদের জাপটে ধরে, চুমা খেয়ে, কেঁদে কেটে অস্হির হয়ে যেতেন। আম্মুকে ধরতে গেলে আম্মু আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করতেন,”কেমন আছেন? ”
নানী খুব ব্যাকুল হয়ে থাকতেন আমাদের জন্য, কতো খাবার বানাতেন, কতোকিছু পাঠিয়ে দিতেন আম্মুর কঠিন নিষেধ সত্ত্বেও। নানার ব্যবসায় চূড়ান্ত ধ্বস নামার পরে পুরো পরিবার বিধ্বস্ত হয়ে গেছিলো। হাল ধরেছিলেন আম্মু। আমার স্পষ্ট মনে আছে, নানা মারা যাবার পরে এক সন্ধ্যায় নানী আম্মুকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করছিলেন, “আমরা কি এই বাসা ছেড়ে দিবো,মা? ” আম্মু উত্তর দিয়েছিলেন, “যেমন আছেন,তেমনই থাকবেন।” এসব কথার মানে কি?

নানী বেচারি কোনোদিন আমাদের বাসায় একদিনও থাকতে পারেন নি। নানাও না। আমরা আবদার করলে আম্মা কাঠ কাঠ গলায় বলতেন,”একই শহরে বাড়ি।থাকাথাকির দরকার কি? “এই কঠিন কথাটা অবলীলায় আম্মু নানা-নানীর সামনে উচ্চারণ করেছিলেন। বৃদ্ধ -বৃদ্ধা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলেন মেয়ের মুখে এই কথা শুনে।

নানীর বাড়ি গেলাম। আগের মতোই আছেন। বেড সোর থেকে কেমন গন্ধ আসছে। আম্মু আসেন নি। তাঁর প্রেশার অনেক বেড়েছে। সুস্থ লাগলে আসবেন। বড় মামা,মেজ খালা আর ছোট খালা আছেন।

নানীর চোখ থেকে সমানে পানি গড়াচ্ছে। ছোট খালা মুছিয়ে দিচ্ছেন। ছোট মামা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন,” তোদের নানী আজ কনফেস করবেন।বড় আপা-দুলাভাই থাকলে খুব ভালো হতো। তবে ঘটনা বাড়ির অন্য কোনো জামাই, বৌরা,নাতিপুতিরা কেউ জানে না। আর জীবনে জানবেও না।”

আমরা দুই বোন পরস্পরের দিকে তাকালাম। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।নানী অবিরাম কি যেন বলে যাচ্ছেন। ছোট মামা বললেন,”মা থামো। আমি সব বলছি। তুমি শান্ত হও।”

যা শুনলাম,সব আমার ভাষাতেই খুলে বলি।

আমার নানার বাবা জাঁদরেল ব্যবসায়ী ছিলেন। নানা তাঁর একমাত্র সুযোগ্য
সন্তান। রাজপুত্রের মতো দেখতে,ইন্জিনিয়ার। তীক্ষ্ণ মেধাবী। ভালো ক্রিকেটার। নানার মা তাঁর জন্য ঠিক করলেন নিজের ফুপাতো বোনের মেয়েকে। নাম রেখা।ভারি মিষ্টি চেহারা। সুন্দর আদব-কায়দা। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তবে লেখাপড়ায় মাথা সুবিধার না। কোনোমতে এসএসসি পাশ করা।

রেখাকে নানার মায়ের খুবই পছন্দ। নানা অতি আধুনিকদের সাথে তখন নির্বিচারে মেলামেশা করছেন। উচ্চ শিক্ষিতা,সম্ভ্রান্ত বংশীয়। আজ কেয়া তো কাল কাকলী, নানা এভাবেই জীবন কাটাচ্ছিলেন। নানার মা রেখাকে পুত্রবধূ করতে চাইলেন। নানা বা নানার বাবা আপত্তি করলেন না।কারণ পড়ালেখা কম করলেও রেখার চেহারায় আভিজাত্য ও ব্যক্তিত্ব সুস্পষ্ট। চালচলন,কথাবার্তা খুব ই মার্জিত ও বুদ্ধি দীপ্ত।

নানা রেখাকে বিয়ে করলেন। কিছুদিন ভালোই কাটলো।তারপরে আবার শুরু হলো নানার বিশৃঙ্খল জীবন।নানার বাবা ইতিমধ্যে মারা যাওয়ায় নানার লাগাম টানার আর কেউ রইলো না।

রেখা নানার কাছে পুরানো হয়ে গেলেন। রেখার শাশুড়ি আপন মামাতো খালা হলে কি হবে, ছেলের তালে তাল মিলাতে থাকলেন।নানার বহুল ব্যবহৃত ডায়ালগ ছিলো, “এমন অশিক্ষিত মেয়ের সাথে ঘর করা যায় না।”
তাঁদের একটি কন্যা জন্ম নিলো। নানা বা তাঁর মা মোটেও খুশি হলেন না।
রেখা মেয়ের নাম রাখলেন শিমুল। শিমুলকে তার বাবা বা দাদী কেউই তেমন আদর করেন নি। ইতিমধ্যে রেখার মা-বাবা দুজনেই গত হয়েছেন কলেরায়। রেখাকে নিয়ে তাঁর ভাই -ভাবীদের কোনো মাথাব্যথা ছিলো না।ফলে তাঁর উপরে অত্যাচার করা খুবই সহজ কাজ ছিল। শিমুলের বয়স যখন তিন বছর,তখন তাঁর মা আবার গর্ভবতী হন। আর সেই সময়ে রেখার স্বামী মানে আমার নানা ওমর খান দ্বিতীয় বিয়ে করে শিক্ষিত, সুন্দর বৌকে ঘরে তুলেন। এম.এ পাশ, সরকারি কলেজের টিচার। শিমুলের দাদী অতি আদরে নতুন বৌ রিয়াকে বরণ করে নিলেন। শিমুল আর তার মায়ের জায়গা হলো ছোট্ট একটা ঘরে। রেখা শুধু কাঁদতেন, মেয়েকে ছবির বই দেখাতেন, ফল চিনাতেন,ফুল চিনাতেন, খাতায় লিখে অ,আ শেখাতেন। আর বলতেন,”অনেক পড়ালেখা করতে হবে মা।অনেক বড় হতে হবে।নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।” রেখা দিনে এতোবার এই কথা বলতেন যে ছোট্ট শিমুলের মাথায় এই বাণীটি গেঁথে গেলো। সে আপন মনে বলে বেড়াতো,”আমাকে অনেক পড়তে হবে,অনেক বড় হতে হবে,নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।”

রেখা দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করলেন।ছেলে। টুকটুকে,ফুটফুটে। কিন্তু পা দুটো বাঁকা। স্বামী-সতীন-শাশুড়ির কাছে রেখার গন্জনার অন্ত রইলো না। সেই সাথে ছোট্ট শিমুলকেও সবাই বিষদৃষ্টিতে দেখতো। রেখা তাঁর ছেলের নাম রাখলেন পলাশ।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here