“আমাকে দিকে তাকাও না আরাধ্য?”
“তোমাকে এত কী দেখার আছে? দুই বছর ধরে তো দেখছিই। এমনে বলছো যেন তুমি নায়িকা ক্যাটরিনা।” বিরক্তির সুরে উত্তর দেয় নিবেদিতার স্বামী আরাধ্য।
ম্লান হয়ে আসে নিবেদিতার মুখটা। তবুও মেকি হাসি ফুটায় মুখশ্রীতে, সংসার জীবনে না কি এমনই হয়। অতঃপর দুজন পৌঁছায় তাদের বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে।
“আরাধ্য যে কী করে বিয়ে করলি নিবিকে! তোকে মানায়ই না ওর সাথে। একদম মিসম্যাচ! অন্ধ ভালোবাসা।” কিছুটা কৌতুকের মতোন করে বলে আরাধ্য ও নিবেদিতার বান্ধুবী শৈলী।
“হুম, তা যা বলেছিস, আরাধ্য এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভালোবাসায় অন্ধত্বের। নাহলে তোর মতোন ড্যাশিং, সাক্সেসফুল, ক্রাশবয় আর নিবেদিতার মতোন বোকাসোকা, চাশমিশ, আনস্মার্ট, ফ্যাটি, শর্ট, বোরকাওয়ালি মেয়ে একসাথে… তুই আসলেই খুব মহৎ মানুষ, ভালো মনের।”
আরাধ্য কিছু বলে না হালকা হাসে শুধু। অন্যদিকে নিবেদিতার মুখশ্রী, নাকের ডগা রক্তিম হয়ে এসেছে অপমানবোধে। তবুও অশ্রুর সাগরে বাধে আটকে মুখে হাসি ফুটিয়ে আছে সে বটে। দমবন্ধ হয়ে আসছে তার, একটু গলা ফাটিয়ে কাঁদতে পারলে বোধহয় ভালো লাগত। সে খুব করে চাচ্ছিল আরাধ্য একটু পক্ষ নেক তার, এক শব্দেরই পক্ষই নাহয় নেক।
“একটু আসছি।”
কোনোরকম বলেই বড় বড় পা ফেলে ওয়াশরুমের দিকে যায় সে। সাড়ি সাড়ি বেসিন সাজানো করিডোরটি সমাপ্ত হয় দুটো বাথরুম পর্যন্ত যেয়ে। একটি নারীদের জন্য, অপরটি পুরুষদের জন্য।সম্পূর্ণ খালি দেখে বেসিনে হাত রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে নিবেদিতা। আয়নায় ভাসমান নিজের কান্নায় লাল হয়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আনমনেই ভাবে,
“আমি তো সেদিনও এমনই ছিলাম। নীরবে থাকা, কোনো তামঝাম ছাড়া অগোছালো, বই পড়ুয়া এক মোটি। কই তখন তো এমন করেনি, বরং তোমার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা থাকত, আগ্রহ থাকতো চালচলনে, ভালোবাসা থাকতো কথাবার্তায়। আজকাল তো কথাই বলো মাঝেসাঝে।
আগে কত খেয়াল রাখতে আমার, আমার অনুভূতির, আর এখন… এতটা উদাসীনতার স্বাভাবিকতা আমি পারছি না মানতে। একসময় আমি অনুপ্রাণিত হতাম তোমায় পেয়ে, সুখ সুখ লাগত তোমার পাশে থাকতে। এখন বেদনা, হীনমন্যতা, দমবন্ধ অনুভূতি ছাড়া কিছুই হবে না।”
তার ভাবনার মাঝেই কেউ একজন কাঁধে হাত রাখে। সচকিত হয়ে কান্না থামিয়ে নেয় নিবেদিতা।
“আয় ইউ ওখেয়ে, ম্যাম? আই খ্যান হেল্প ইউ। ইফ ইউ নিড সামথিং, জাস্ট ঠেল মি।”
অপরিচিত পুরুষালি কণ্ঠ শুনে চমকিত হয়। স্পষ্ট আমেরিকান এক্সেন্ট! চাকরির জন্য ইংরেজির একটা কোর্স করেছিল, সেখান থেকেই এই এক্সেন্ট সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা। মাথা ঘুরিয়ে মানুষটির দিকে তাকায় নিবেদিতা।
খেয়াল করে এক অদম্য সুদর্শন পুরুষ। বাঙালি চেহারার মাঝেও কেমন একটা বিদেশি ছোঁয়া। মাথার ঝাকড়া কালো চুলে বাদামীর বর্ণের স্পর্শ স্পষ্ট। আমেরিকানই হয়তো।
নিবেদিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“নো আ’ম জাস্ট ফাই। মেবি আমার এখন যাওয়া উচিত।”
“এজ ইউ উইশ প্রিঠি লেডিহ!। বাই দ্য ওয়ে মাই নেম ইজ আবরাহাম সরদার এডউইন। বাসার সবাই অবশ্য প্রণয় বলে ডাকে।”
আরেক দফা চমকিত হলো নিবেদিতা। কী মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে শুদ্ধ বাংলা বলে ছেলেটি! না, না, এতটা পরিস্কার বাংলা জাতের বাঙালি নাহলে বলা সম্ভব নয়। তবে…? জানার আগ্রহ হলেও কথা বাড়ালো না।
“আমি নিবেদিতা, নিবেদিতা সোহরাব।”
বিপরীতে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বড় বড় পা ফেলে বিদায় নিল সে। পিছনে তাকালে দেখতে পেত সুদর্শন এই যুবকের মুগ্ধ চাহনি তার দিকেই স্থির।
___
অনুষ্ঠান শেষ হলে নিবেদিতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আরাধ্য। ফিরে আসতেই দেখে তার মা মোকশেদা বেগম সোফায় বসে বসে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন।
আরাধ্য চমকিত হয়ে মায়ের কাছে ছুটে যায় সে। উৎকণ্ঠা-উদ্বিগ্নতা তার মাঝে।
“কী হয়েছে মা? কাঁদছো কেন?”
“রিজভি ভীষণ মাথা ব্যথা করছে আমার বিকেল থেকেই। একটু খাবার খাবো, তা রান্নার জন্যও উঠতে পারছি না।”
“কেন নিবেদিতা রান্না করে রেখে যায়নি?” রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় আরাধ্য নিবেদিতার দিকে।
“ওর দোষ নেই। আমিই না করেছি।” মোকশেদা বেগম উত্তর দেয়।
নিবেদিতা অবাক ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছে আরাধ্যের দিকে। সে তো রান্না করত রান্নাঘরে ঢুকেছিলই, মোকশেদা বেগম নিজেই তো বললেন তিনি করে নিবেন। তাহলে তার দোষটা কোথায়?
“তুমি রাগছো কেন? আম্মাই তো বলল আমাকে…”
“চুপ! একদম চুপ! সারাদিন করোটা কী বাসায় বসে বসে? একটা অসুস্থ মানুষ আমার মা, তার জন্য খাবারটা অবধি তৈরি করে রেখে যেতে পারোনি? মানে বাবা-মা এতটুকু শিক্ষা দেয়নি? যত্তসব থার্ডক্লাস!”
আরাধ্যের মুখে সবসময়ই অবজ্ঞাসূচক কথা শুনে আসছে নিবেদিত। কিন্তু এমন ভাবে অপমান এই প্রথম। ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে চলে যায় সে নিজের ঘরে।
মোকশেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি মোটেও এমনটা চাননি।
“কাজটা ঠিক করলি না রিজভি। মেয়েটা সারাদিন গাধার মতোন খাটে এই সংসারে।”
“তুমি কোনো কথা বোলো না মা। তোমাদের আস্কারা পেয়েই এই অবস্থা। আমি খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি৷ একটু পর এসে পড়বে।”
___
নিবেদিতা ব্যালকনির রেলিংয়ে ভর দিয়ে উদাস মনে দাঁড়িয়ে আছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলেও বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে। বড্ড আদরের। এতটা কটুবাক্য, বিশেষ করে বাবা-মাকে নিয়ে সে মেনে নিতে পারছে না৷ কিছুতেই না।
আপন মনেই বিড়বিড়ায়,
“একটা সময় তুমি আমার স্বস্তি ছিলে, এখন শুধুই অস্বস্তি। এভাবে সংসার হয় না, এভাবে একসাথে থাকা যায় না। কখনো সমাদর করো না আমার কর্মকে এই সংসারে। এমন কী সবসময়ই আমাকে উপেক্ষা করো!”
নিজের সাথে আরও কিছুক্ষণ বোঝাপড়ার শেষে ফ্রেশ হতে ঘরে পরার শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে নিবেদিতা। কাপড় বদলেই বিছানায় শুয়ে পড়ে কাঁথা মুড়িয়ে।
আরাধ্য বেডরুমে ঢুকে দেখে নিবেদিতে শুয়ে আছে৷ তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে তার মুখশ্রীতে। সে নিজেও ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ এদিকে পাশে যে তারই সহধর্মিণীর নির্ঘুম নোনাজলে ভেজা রাত্রি কাটছে তা একবার জানা তো দূরে থাক জানার আগ্রহও হলো।”
___
সকাল সকাল এর্লামের আওয়াজে ঘুম ভাঙে আরাধ্যের। জেগে উঠে এর্লাম বন্ধ করে। পাশে তাকিয়ে দেখে নিবেদিতা নেই। একটু অবাক হয়। পরক্ষণেই উঠে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
বের হয়ে ‘নিবেদিতা! নিবেদিতা!’ বলে কয়েকবার ডাক দেয়। কোনো সাড়া নেই। গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ।
সারা ফ্ল্যাট খুঁজে সে এবার। না, নিবেদিতা নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।
“তবে কি নিবেদিতা চলে গিয়েছে?” কথাটা বিড়বিড়াতেই বুক কেঁপে উঠে তার।
বেডরুমে ফিরে আসতেই খেয়াল করে ড্রেসিংটেবিলের উপর আটকে আছে স্টিকি নোট। তাড়াতাড়ি তা হাতে নেয়।
-বিয়ে করার সময় খুব করে বলেছিলাম, ‘আমি সুন্দরী নই, বিয়ের পর হয়তো আরও মিটে যাবে সৌন্দর্য, আনস্মার্ট হব আরও। লোকে হাজার কথা বলবে তোমাকে আমাকে একসাথে দেখে, আমি সহ্য করতে পারব না’। তুমি বলেছিলে, ‘আমি তো আছি। ওয়াদা করলাম লোকের সামনে তোমার ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। তাদের কথার বাণ তোমায় স্পর্শ করবে না’। আদৌ ওয়াদাটা পালন করতে সক্ষম তুমি?
নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার