নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা ||৩য় পর্ব||

#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||৩য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
আরাধ্যের বিরক্তিমাখা দুঃখী মুখখানা দেখে নিজেই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে কবির। কবির আরাধ্যের কলিগ ও ক্লাসমেট, তবে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাদের মাঝে সমবয়সী ও পূর্বপরিচিত হওয়ায়। আরেক সম্পর্ক হলো নিবেদিতার বেস্টি মালিহার বাগদত্তা সে।

“আরে ভাই, ছোট্ট একটা বিষয়। ভুল তোর। ক্ষমা চেয়ে নে না?”

“ও আমার সরি এক্সেপ্ট করবে তোর মনে হয়? কবেই পাঠিয়েছি, রিপ্লাই দিচ্ছে না। আমি রাগের মাথায় নাহয় একটা কথা বলে ফেলেছি তাই বলে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? ও তো জানে এখন কতটা স্ট্রেসে থাকি আমি।”

“দেখ, নিবেদিতাকে তুই, আমি দুজনেই প্রায় আট-নয় বছর ধরে চিনি। মেয়েটা কত বাবা-মা প্রিয় জানিস না? সেবার আঙ্কেলের যখন একটা এক্সিডেন্ট হয়ে সামান্য হাত কেটে গিয়েছিল। তোর মনে আছে মেয়েটা কেমন কাঁদতে কাঁদতে ভার্সিটি থেকে বের হয়েছিল। তুই সেই বাবা-মায়ের শিক্ষার উপর প্রশ্ন তুলেছিস ওর রাগা কি জায়েজ না?”

“আমি তো সরি। ঐ সময় রেগে গিয়েছিলাম হুটহাট। স্যার রাস্তায় ফোন দিয়ে ঝাড়ি দিল হিসাবে গড়মিল আছে বলে, আবার বাড়ি এসে দেখি মা কাঁদছে। সব টেনশন-ঝামেলা মিলিয়ে… ওরও তো একটু বুঝা উচিত।”

“দেখ ওয়াইফ ইজ নট এ ডাস্টবিন, যেখানে তুই তোর জীবনের সব ফ্রাস্টেশন, রাগ এসে ফেলবি। প্রতিটি সম্পর্কেই একটা রেসপেক্ট আর ডিগনিটি মেইনটেইন করে চলা উচিত। আর নিবেদিতা তোর সাথে মূলত এ কারণে রাগ না। মালিহা কথা বলেছিল নিবেদিতার সাথে। তুই না কি ওকে ইগনোর করিস বিগত একটা বছর ধরে।”

“ঐটার জন্য তো আমি স্বীকার করছি আমার ভুল। হয়ে গিয়েছে, এখন কী করা? আর কীসের ইগ্নোর ভাই? এ ওর আরেকটা সমস্যা। সারাক্ষণ কি এটেনশন দেওয়া সম্ভব? আর এখন কি আমরা স্টুডেন্ট লাইফে আছি বা রিলেশনে আছি? হাজার টেনশন ঘুরে মাথায়। কাজের টেনশন, ব্যাংকের ঋণ আছে, গাড়ির ইএমআই কত কী! আর এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? আমার যদি না-ই রোমান্টিক বোধ হয়, আমি কী করে রোমান্টিক হব?

তুই বল তোর জন্মের পর কখনো তোর মা-বাপকে প্রেমালাপ করতে দেখেছিস? আমি তো আমার বাবা-মাকে দেখিনি। খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। প্রেমে যেই চাকচিক্য থাকে, সেসব কি আর সংসারজীবনে থাকে? প্রেম আমিষ আর সংসার হলো নিরামিষ, এই একটা সিম্পেল বিষয়কেও বড় বানায় ফেলে! যেন আমি পরকীয়া করি।”

“ভালোবাসা থাকলেই হয় না, ভালোবাসা প্রকাশও করতে হয়। নাহলে ভালোবাসা বিলীন হয়ে যায়। যেমন এক ফালি রৌদ্দুর বিলীন হয় ঘোর অন্ধকারে।

তুই ভালোবাসি না বললে পাশের মানুষটি তো অন্তর্যামী নয় যে বুঝে যাবে। মুখ ফুটে তোকে বলতেই হবে তোর মনের অবস্থা। ইনসিকিউর বোধ করারই কথা। আর বললি সংসারজীবন তো আমিষই। এমনই রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বলেছেন শেষের কবিতায়?

বলেছেন, ‘লোকে ভুলে যায়, দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নূতন করে সৃষ্টি করা চাই’। ভালোবাসার মূলকেন্দ্র হলো দাম্পত্য, রিলেশন নয়। সেটাতে আরও যত্নশীল হওয়া উচিত। এটাই ভুলে বসেছি আমরা। তাই তো চারধারে ডিভোর্স, সন্দেহের ছড়াছড়ি।”

ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায় হাতজোড় করে আরাধ্য শুধায়,
“হয়েছে ভাই। মাফ চাই আমি তোর সাথে সমস্যা ডিসকাশন করায়। তোদের যত্তসব কাব্যিক কথাবার্তা। ওসব উপন্যাসেই মানায়।”

“একবার ভাবিস সংসারজীবনটা কী? সংসার…”

“কবির স্যার, আপনাকে স্যার কেবিনে ডাকছে।”

কথার মাঝেই পিয়ন এসে ডাক দেওয়ায় কথা সম্পন্ন করতে পারলো না কবির। ইশারায় আরাধ্যকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।

আরাধ্য সত্যিই ভাবতে শুরু করে সংসারজীবনটার আসল ব্যাখ্যা কী। সাধারণত মানুষের কাছে বৈবাহিক জীবন বা দাম্পত্য জীবনের প্রথম ও সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য উদাহরণ হলো বাবা-মায়ের দাম্পত্য। যা বেড়ে উঠার সঙ্গী।

স্বভাবগতই আরাধ্য নিজের মা ও বাবার সংসারজীবনের কথা ভাবে। তেমন প্রকাশ করার মতোন বিশেষ কিছু ছিল না মোকশেদা বেগম ও রিমন হাওলাদারের সম্পর্কতে। যখন আরাধ্য একদম ছোট তখন তাঁদের সাথে এক বিছানাতেই শুতো সে। নিজের মায়ের সাথে বাবাকে কখনো গল্প-গুজব করতে দেখেনি সে।

কোনো এক রাতের আঁধারে মোকশেদা বেগম যদি রিমন হাওলাদারের সাথে কোনো কথোপকথন শুরু করতে চাইতো, তখন হু-হা এতটুকু পর্যন্ত। অনেক সময় তিনি অতিরিক্ত ক্লান্তিতে স্ত্রীর অযাচিত কথায় বিরক্তিও প্রকাশ করতেন। সে যদি জিজ্ঞেস করতো, ‘মা, বাবা এমন করে কেন?’
মা অমলিন হেসেই জবাব দিতেন, ‘কত টেনশন তোর বাবার কাজের, আমাদের! টেনশনে মানুষের মেজাজ একটু খিটখিটে থাকেই।’

আরাধ্য তখন মায়ের মুখে দেখতে পারতো একজন স্ত্রীর স্বামীর প্রতি নিষ্ঠা। এমন কী বাবা কখনো ঘুরতে গেলেও শুধু আরাধ্যকে নিয়েই যেতেন রিমন হাওলাদার। মোকশেদা বেগম একটু হতাশ হতেন তা তার চেহারাতেই স্পষ্ট থাকতো।

তবে মাঝে মাঝে কোনোদিন না বলেই তার বাবা মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিংবা কাজল এনে কিছু না বলেই হাতে ধরিয়ে দিতেন। তখন মায়ের মুখশ্রীতে যেন রাজ্যের আনন্দ ভেসে উঠতো। বাবার আনা শাড়ি, চুড়িতে রঙিন প্রজাপতির ন্যায় নিজেকে সাজাতেন তিনি। যদিও বাবা কোনোদিনও সেই সাজ মুগ্ধ চোখে অথবা আগ্রহ নিয়ে দেখতেন না।

স্মৃতির মাঝে হারাতেই হারাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাধ্য। ভাবে,
– এটাই তো সংসার। এমনই তো দেখেছে সে। একজন মানুষের নীরবতাকে, নীরব ভালোবাসাকে বুঝি বোঝা নেওয়া যায় না? মেনে নেওয়া যায় না?

___

আবরাহামের কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে নিবেদিতা। বারবার হাতে হাত ঘষছে সে। কিছুটা অস্বস্তিপূর্ণ তার অবস্থা। যতোই হোক বসের সম্মুখে তার মানসিক ভাঙন হয়েছে, কেঁদেছে ব্যাপারটা যেন মেনেই নিতে পারছে না সে।

“ম্যাম, আর কত হাত ঘষবেন? চামড়া তো উঠে যাবে একদম!” ফাইল দেখতে দেখতে শব্দের তীর ছুঁড়ে দেয় যুবক। মুখে তার কুটিল হাসি।

নিবেদিতা বড় বড় চোখ করে তাকায়। মানুষটাকে তো একবারও ফাইল থেকে চোখ উঠাতে দেখলো না। তবে বুঝলো কী করে ভেবেই পাচ্ছে না।

“চোখ তো বেরিয়ে যাবে কোটর থেকে মিস যেভাবে তাকাচ্ছেন। পরে মানুষ তো বলবে মিস আইলেস!”

বিদ্রূপার্থে দুটো বাক্য উচ্চারণ করেই বেশ চওড়া হাসি দিল আবরাহাম। এতে যেন ঠোঁটের এক ইঞ্চি নিচের তিলটা আরও চমকে উঠলো।

“সরি মিস আই ওয়াজ জাস্ট খিডিং। বাট প্লিজ ডোন্ট লুখ এ্যাঠ মি উইথ দ্যাঠ লুখ ইন ইউর আইজ। ইট’জ ডিস্ট্র‍্যাক্টিং মিহ্।”

কথাটা শ্রবণগোচর হতেই মাথা নত করে ফেলে। লজ্জায় তার মরিমরি দশা। এখন তার মা জননী সামনে থাকলে নির্ঘাত তার পেটেই আবার ঢুকে পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতো সে।

আমতা আমতা করে বলে,
“সরি স্যার। আসলে…”

“ঐদিনের জন্য আনইজি ফিল করছেন তাই তো? লেট বাইগোনস্ বি বাইগোনস্। ট্রাস্ট মি, আ’ম নেভার গোয়িং ঠো ঠক এবাউট দ্যাট ইন্সিডেন্ট।”

“থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি যে আমাকে কী একটা মানসিক স্বস্তি দিলেন না! স্যার, তাহলে কি আমি যেতে পারি এখন?”

“ইয়াহ্! বাট আই নিঢ ঠু ঠেল ইউ দ্যাট ইউ লুখ আমেজিং। স্পেশালি তুমি যখন কাঁদছিলে না এতটা মায়াবতী মনে হচ্ছিলো!” গম্ভীর কণ্ঠ আবরাহামের।

চলে যেতে এগিয়েছিল নিবেদিতা, শেষ দু’বাক্যে লজ্জায় নিবেদিতার দুই গাল লাল হয়ে উঠে। ভালোও লাগে। প্রসংশা কার না ভালো লাগে? তবে পিছনে ঘুরে না। না শুনার ভঙ্গিমায় বেরিয়ে যায়।

তীক্ষ্ম দৃষ্টি আবরাহামের নিবেদিতার দিকে। অতঃপর কিছু ভেবেই সে একগাল হাসি দিয়ে কাজে ডুবে যায়।

___

সুখ ঘরে প্রবেশ করতেই চোখ যেয়ে পড়ে সোফার দিকে তার বাবা আরিফ মোতাহাব জড়িয়ে ধরে আছেন নিজের অফিস কর্মী পারভিনকে। কয়েক মুহূর্ত গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুখ নিজের বাবার দিকে। একজন সদ্য বুঝপ্রাপ্ত মেয়েআরিফ মোতাহেব মেয়েকে খেয়াল করতেই সরে দাঁড়ান। এমন একটা ভাব করে হাসি দেন যেন কিছুই হয়নি।

সুখও খাপছাড়া ভাব নিয়ে বেডরুমে চলে যায়। এ তো বর্তমানে প্রায় রোজকারই বিষয়, নতুন কিছু না। বড় সরকারী কর্মকর্তা বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা সুখ। তবে তার নাম সুখ রাখলেও ললাটে হয়তো সুখ নামটা লিখা হয়নি। কারণ বাবা-মা প্রায় ভুলেই বসেছেন তাদের একখানা রক্ত-মাংসের জীবিত মেয়ে আছে। তাঁরা ব্যস্ত অবৈধ অর্থ উপার্জনে, অবৈধ সুখ প্রাপ্তিতে।

সুখ উদাসীন ভঙ্গিমায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকেলের শান্ত, ঘোলাটে আকাশটা দেখতে দেখতে বিড়বিড়ায়,
“আমার বাবা-মা কেন আর আট-দশটা সাধারণ দম্পতির মতো নয়? এত অর্থের মাঝেও কেন নামমাত্রই সুখ আমার ভাগ্যে জুটেছে?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here