#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||৬ষ্ঠ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিবেদিতা বাসায় ফিরেছে মোকশেদা বেগমের সাথে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই মোকশেদা বেগমের ফোনে কল আসে। একটু দূরে যেয়ে রিসিভ করে সে।
ফিরে এসে নিবাদিতাকে আবেদন করে,
“সোনা মা, তুমি একটু বাসাটা সামলে নিয়ো। আমার তোমার ফুপি শ্বাশুড়ির বাসায় যেতে হবে। ডেকেছে।”
নিবেদিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চাবি হাতে গুঁজে চলে যান তিনি। পানসে মুখে দরজা খুলে নিবেদিতা।
ঘোর অন্ধকার ভিতরে। নিবেদিতা স্বভাবগতই ভীতু, বিশেষ করে জ্বীন-পরীর বিষয়ে তো তার মুখশ্রী কেন দেহও রক্তশূণ্য হয়ে পড়ে।
ভয়ে ভয়ে কোনোরকম দরজার পাশের সুইচবোর্ডের দিকে যায়। সুইচে ক্লিক করতেই লাইট জ্বলে উঠে। পিছনে ঘুরতেই হতবাক সে। গোটা ফ্লোর লাল আর সাদা রঙের গোলাপ ও বেলুন দিয়ে জুড়ে আছে। সোফা-টোফা সব সরানো মাঝে একটা দুই জনের বসার মতো সাদা টেবিলম্যাট বিছানো টেবিল।
“সারপ্রাইজ!” বলে চেঁচিয়ে বেডরুম থেকে বের হয় আরাধ্য। পরনে তার রেমন্ডের গ্লিটারি পার্পেল রঙের ব্লেজার, নীল রঙের শার্ট-প্যান্ট।
নিবেদিতার যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে নিজের প্রেমিক, জীবনসঙ্গীকে এই রূপে দেখে। উজ্জ্বল গায়ে কী অদ্ভুৎ সুন্দর মানিয়েছে পোশাকটা! পরিচিত কড়া পারফিউমের ঘ্রাণে নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। মনে তার প্রণয়ের, উত্তেজনার, অভিলাষের ঝড় উঠছে।
“ওগো রমণী এমন কাজল নয়নে দেখো না আমায়,
মনের আকাশে প্রেম কামণার রঙ ছেয় যেত চায়।”
ঘোর ভাঙে নিবেদিতার। মান-অভিমানের বরফ অনেকটাই গলনাংকের কাছাকাছি তাপে আছে। কখন যেন বাষ্পপোত হয়ে বাতাসে হারিয়ে যায়।
নারীদের প্রিয়জনের প্রতি অভিমান-অভিযোগ হয় ঝড়ো হাওয়ার ন্যায়। যার প্রকাশ ভয়ানক ও বিশাল, কিন্তু স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। যদিও এরও এক সীমা আছে।
নিবেদিতাও তেমনই নারী। তবুও নিজের মাঝে রাগ, অভিমান, ক্ষোভ ধরে রাখার অদম্য চেষ্টা তার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে নিপীড়িত করার ঠিকা যে সে নিয়েছে।
“এসবের মানে কী, হ্যাঁ? কী প্রমাণ করতে চাও এসবের দ্বারা? আমার কেয়ার করো তুমি? এসবে মিটে যাবে আমার সব অভিযোগ, কষ্ট, পোড়ন?”
কাছে আসে যুবক। যতোটা কাছে আসলে প্রতিটি নিঃশ্বাস গণা যায়, ততোটা কাছে। কোমর আঁকড়ে ধরে রমণীর।
“না, ভালো আমি বাসি। তা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। আর যতটুকু মান-অভিমানের বরফের কথা, তা তো আমার উষ্ণতাতেই গলে যাবে।”
অভিমানের বাধ যেন ভেঙে পড়ে। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেই দেয় রমণী। এ তো নোনাজল নয়, বরং অভিমানের বরফ গলা জল।
“স্টুপিড, গাধা, বলদ, ইডিয়ট…”
আরাধ্যের কলার ধরে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে নিবেদিতা। আরাধ্য চোখ বুজে সয়ে নেয়।
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে নিবেদিতা থামে, লুটিয়ে পড়ে যুবকের বক্ষে। আরাধ্যও শক্ত করে নিজের মাঝে আবদ্ধ করে নেয় তাকে।
“অভিমানের দেয়ালের পতন হলো তবে অবশেষে?”
বুকে নাক ঘষে মুচকি হাসে নিবেদিতা৷ আরাধ্য দুই হাতের মাঝে নিবেদিতার মুখশ্রী ধরে ললাটে অধর ছুঁয়ে দেয়।
“শুধু ললাটে নিজের স্পর্শ আঁকিনি প্রিয়তমা, তোমার ভাগ্যরেখায় নিজেকে মিশিয়ে নিলাম জন্ম-জন্মান্তরে জন্য।”
___
মালিহা ও কবির দূর থেকে নিবেদিতাকে বাসায় ঢুকতে দেখে সন্তুষ্ট মুখে বের হয়ে যায়৷ হাতে হাত রেখে হাঁটছে দু’জন। সামনের দোকান থেকে মালিহাকে এক প্যাকেট রুচি চানাচুর কিনে দেয় কবির।
“অবশেষে ওদের ঝামেলা মিটলো।” কোকা কোলার বোতলে ঠোঁট ডুবায় কবির।
“যা তা ঝামেলা মিটলো। ঐ শালায় আমার বান্ধুবীকে জ্বালায়া রাখে না। আর ঐ গাধিটা যে কোন কুবুদ্ধি পেয়ে ঐ ব্যাটার প্রেমে পড়েছিল!”
“তুমিই তো নিবেদিতাকে বুঝালে। এখন আবার তুমিই এসব বলছো।”
“মগা রে আমি ওকে বুঝাইসি যাতে ও শান্তি পায়৷ আরাধ্যকে ছাড়া নিবেদিতা এক মুহূর্তও ভালো থাকে না। মনে আছে আমার, ভার্সিটি লাইফে আরাধ্য মাত্র কয়েকদিন ওকে উপেক্ষা করে চলায় ও কতটা নির্জীব হয়ে গিয়েছিল, সুইসাইড করতে গিয়েছিল।”
একটু বিষণ্ণ দেখালো মালিহাকে। কবির কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। মালিহার ধ্যান ভঙ্গ হলো। আবারও পূর্বের ন্যায় গুণ্ডি অবতারে।
“আমি বারবার বলেছিলাম সুন্দর, সফল, ধনী ছেলের সাথে প্রেম করিস না। সুন্দর ছেলে মানেই অহংকারী নার্সিসিস্ট হয়।”
“এজন্যই বুঝি আমার সাথে প্রেম করেছো? আমি সামান্য কর্মচারী, আরাধ্য জিএম, সামনে এমডি হবে। আমি দেখতেও অত সুন্দর না।”
মালিহা হাঁটা থামিয়ে, আশেপাশে তাকায়। জনমানবশূন্য চারিপাশ। পায়ে পা রেখে গলা জড়িয়ে ধরে সে যুবকের।
“সরো, সরো, এত কাছে এসো না মেয়ে। আমি সুন্দর নই।”
“ওহে যুবক, তুমি যেমন তেমনের জন্যই তোমার প্রতি আসক্ত এই মালিহা। এই কালো, স্বল্প আয়ের কেয়ারিং মানুষটিই আমার অতিপ্রিয়।”
___
রাত বারোটা বাজে, সুখের জন্মদিন আজ। ফেসবুকের নোটিফিকেশন দিয়ে ফোন ভরে যাচ্ছে। অথচ, ভাগ্যের এমনই পরিহাস, বাবা-মায়েরই মনে নেই।
দুঃখ মাখা সুখ নিয়ে বালিশ মুখ চেপে শুয়ে আছে সুখ। মায়ের উষ্ণতা পাওয়ার তৃষ্ণায় বেড ছাড়ে সে। মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। বাবা আরিফ মোতাহেব তো কাজে ঢাকার বাহিরেই গিয়েছেন।
দরজার লক ঘুরাতেই চক্ষু বাহিরে বের হওয়ার উপক্রম তার। তার মা মিথিলা আজমেরি নিজের সিনিয়র অফিসারের সাথে এক বিছানায় অন্তরঙ্গ অবস্থায় যে। লজ্জায় নাক-মুখ কাটা যাচ্ছে তার। দৌড় লাগায় নিজের ঘরের দিকে।
মিথিলা আজমেরি মেয়ের যাওয়ার দিকে একপলক বিরক্তির চোখে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়েন রতিক্রিয়ায়।
সুখ বেডরুমের দরজা লক করে মুখে হাত চেপে কেঁদে দেয়। আপন মনেই বিড়বিড়ায়,
“তোমরা যখন এতোই দুঃখ দিবে, তবে নামটা সুখ রাখলে কেন? দুঃখই রাখতে নাহয়। না, এই বাড়িতে এই মানসিক অত্যাচারের মাঝে আমি আর থাকবো না। চলে যাবো আমি। অনেক দূরে যাবো, যাতে তোমাদের ছায়াও কখনো আমার উপরে না পড়ে মম-ড্যাড।”
সিদ্ধান্তে অটল হয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিমায় নোনাজলে সিক্ত চোখ-মুখ দুই হাতের তালুর দ্বারা মুছে নেয় সে। নিজের মিনি ট্রলিতে প্রয়োজনীয় পোশাকাদি, মোবাইল-ল্যাপটপ, নিজের কাছে থাকা টাকা ভরে নেয়। গৃহ ত্যাগের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেয় সে।
মায়ের অগোচরে বাড়ি থেকে বের হয় সে। বাড়ির সদরদরজার সম্মুখে পৌঁছাতেই দেখতে পায় দারোয়ান ঘুমাচ্ছে। তাতে আরও সহজেই বাড়ির বাহিরে চলে যায় সে।
অভিজাত আবাসিক এলাকায় বসবাস তাদের। এমনিতেই নীরব সর্বদা, রাত নামলে তো আরও বেশিই। অন্ধকারচ্ছন্ন, পিনপতন নীরব পরিবেশে একাকী হেঁটে যাচ্ছে সুখ। দু’চোখ তার অশ্রুতে টইটম্বুর। এক হাত দিয়ে অশ্রু মুছছে আরেক হাত দিয়ে ট্রলি টানছে।
বাসা অনেকটা দূর চলে যাওয়ার পর একটা গাড়ি এসে থামে তার পাশে। গাড়ি থেকে একজন নেশাগ্রস্থ কণ্ঠে বলে উঠে,
“ওরে ফুলটুসি একা রাতে হাঁটছো কেন? আমরা আছি তো আজ রাত সঙ্গ দিতে।”
গায়ে শীতল স্রোত বহে যায় সুখের। আতঙ্কিত মুখে চোখ তুলে তাকায় সেই গাড়ির দিকে। সাদা রঙের দামী গাড়ি, ভিতরে পাঁচ-ছয়জন নেশাগ্রস্থ ছেলে অভুক্ত কুকুরের মতোন তাকে দেখছে।
যেই ছেলেটাকে ডাক দিল সে গাড়ি থেকে নামতেই জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলো সুখ। ছেলেটিও হেলে-দুলে তার পিছন পিছন আসতে শুরু করে,
“ও মেয়ে, কোথায় যাচ্ছো? ভালো সার্ভিস চার্জ দিবো তো ডার্লিং।”
ছেলেটা একদম কাছে চলে আসছে সুখের। ভয়ে গোটা দেহ কম্পিত হচ্ছে তার। সত্যিই কি তবে আজ রক্ষে নেই তার!
মতিভ্রষ্ট হয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় সে। চোখ উঠিয়ে দেখে আবরাহাম। আবরাহাম হাত ধরে উঠায় তাকে।
“তুমি এখানে এত রাতে কী করে?”
বলে ভ্রু কুঁচকে তাকায় পিছনের ছেলেটির দিকে। ছেলেটি তাকে দেখে উলটো দিকে ঘুরে চলে যায়।
এমন অসহনীয় পরিস্থিতিতে পরিচিত ও প্রিয় একজন মানুষকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক যুবক
আবরাহামের ঘুম আসছিল না বিধায় সে হাঁটতে বেরিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে ধাক্কা খায় সুখের সাথে।
একটু অস্বস্তি নিয়ে সে সুখকে সরিয়ে দেয় নিজের থেকে।
“ইট’স ওকে। ওরা চলে গিয়েছে।”
সুখেরও ঘোর ভাঙে। লজ্জা, ভয়, আতঙ্ক সবকিছু মিলিয়ে আলাদা রকমের অনুভূতির সংমিশ্রণ আঘাত করছে তাকে।
আবরাহাম ট্রলির দিকে খেয়াল করে জিজ্ঞেস করে,
“বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলে? তোমরা আজকালকার ছেলে-মেয়েরা একটু থেকে একটু হলেই বাড়ি ছাড়ো। ব্যাপারটা খুবই খারাপ। চলো বাড়ি ফিরবে এখন।”
সুখ সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবরাহামের সাথে নিজের বাসার দিকে অগ্রসর হয়। তার আসলেই কিছু করার নেই। বাঁচার সব উপায়ই ক্ষণিকের স্বস্তি মাত্র।
আবরাহাম সুখকে সদরদরজার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে শুধায়,
“নাম যেমন সুখ, তেমন অনেক সুখেও আছো। খালি খালি এসব বাচ্চামি কোরো না।”
সুখ হাসে। তীব্র তাচ্ছিল্য মাখামাখি এক হাসি। যেতে যেতে উত্তর দেয়,
“কিছু কিছু সুখের গল্পগুলো খুব দুঃখময় হয়। আচ্ছাদন ও নামটাই সুখ হয় শুধু।”
___
এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে নিবেদিতার ফিরে আসার। বর্তমানে নিবেদিতা ও আবরাহাম ইংল্যান্ডের এক ক্লায়েন্ট এনা গোমেজের সাথে মিটিং করতে বাংলাদেশের সুনামধন্য এক হোটেলে এসেছে। তাদের সম্পর্ক এখন অনেকটা বন্ধুসুলভ। একটা টেবিলে বসে কফি পান করতে করতে প্রজেক্ট নিয়ে ডিসকাস করছে তারা।
একটু বাদেই কেউ একজন নারী কণ্ঠে বলে উঠে,
“হ্যালো মিস্টার এডউইন সরদার?”
আবরাহাম ও নিবেদিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এনা গোমেজকে দেখে। ত্রিশ বছর বয়সী তেজস্বী নারী সে।
“Is she your wife? You two look amazing together. সুন্ধর ধম্পহতিহ!”
একদিকে এনা গোমেজের হাস্যকর ভাঙা বাংলা, অপরদিকে তার বিব্রতকর প্রশ্ন। কিছুটা কনফিউজ অবস্থা আবরাহাম ও নিবেদিতার।
“No, I am Nibedita, just an employee of his office.”
“Oh sorry! আহমি ভুজতে পাহরিনি। But I have a gift for you guys.”
বলে নিজের সাথে আসে লোকটির দিকে ইশারা করতেই সে টেবিলে লাল পানীয়ের একটি কাচের আ রাখে। নিবেদিতা দেখেই বুঝতে পারে তা রেড ওয়াইন। একপলক আবরাহামের দিকে তাকায় সে।
“Let’s drink.”
আবরাহাম ওয়েটারকে ডাকিয়ে বোতল খুলে সার্ভ করতে বলে। নিবেদিতাকে দিতে নিলে সে নাকোচ করে।
“আমি ড্রিংক করি না এসব।”
আবরাহাম নিজেও পান করে না। তারপর প্রজেক্টের কথাবার্তা শুরু হয়। এনা গোমেজকে খুব সহজেই মুগ্ধ করে ফেলে আবরাহাম। সে ডিল সাইন করে অনেক প্রসংশাও করে আবরাহাম ও নিবেদিতা।
চলে যাওয়ার সময় এও বলে আবরাহামের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে যায়,
“I’ll be free from one o’clock at night. If you want you can come to my house. I am massaging my address.”
আবরাহাম উত্তর দেয় না শুধুই মায়াময় হাসিই প্রদর্শন করে। তাতেই যেন ব্যক্ত হয় সব।
এনা গোমেজ চলে যেতেই নিবেদিতা রসিকতার সুরে শুধালো,
“স্যার, ভালোই তো অবস্থা আপনার। এত সুন্দরী সুন্দরী সাক্সেসফুল মেয়েরা নিজে থেকেই ফ্লার্ট করে আপনার সাথে। সবাই ফেঁসে যায় আপনার জালে।”
“অওরাটাই এমন মিস নিবেদিতা। তবুও তুমি কোথায় আর ফ্লার্ট করলে, আর কোথায় বা ফাঁসলে?”
“ভেরি ফানি।”
“আমি জানি।”
দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দেয়।
“মিথ্যে বলবেন না আবরাহাম সাহেব। আপনার কিন্তু ওয়াইন টেস্ট করতে মন চাচ্ছিল এবং আপনার খুব পছন্দ রেড ওয়াইন, তাই না?”
সচকিত হয়ে নিবেদিতার দিকে তাকায় আবরাহাম। “তুমি জানলে কী করে নিবেদিতা?”
“আমি তো এটাও জানি আপনি চেইন স্মোকার ছিলেন এক সময়। হয়তো রিহাব সেন্টারের সহায়তায় বা নিজে থেকেই ছেড়েছেন।”
“হোয়াদ্দা হেল! তুমি জানো কী করে এসব?”
“বেশি কিছু না, জাস্ট এ লি’ল বিট অবজারভেশন। আপনি যেভাবে রেড ওয়াইনের দিকে তাকাচ্ছিলেন, কোয়াইট অভিয়াস। আর পাশের টেবিলের লোকটার সিগরেটের ধোয়ায় সবারই কাঁসি আসছিল, কিন্তু আপনি একদম কমফোর্টেবল ছিলেন। আবার কালচে ঠোঁট।
বারবার লোকটার স্পেসিফিক ভাবে সিগরেটের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে, অস্বস্তি বোধক ভঙ্গিমা, ঠোঁট ভেজানো সব মিলিয়ে… উইদাউট দ্যাট আপনার সাথে অলওয়েজ একটা লাইটার সাথে স্মোকিং না করার পরও। মানে এক্স স্মোকার হওয়াটা অভিয়াস। তবে ভালোই করেছেন ছেড়ে।
যেসব জিনিস ক্ষণিকের স্বস্তি দিয়ে সারা বছর অন্তর পুড়ায়, তাদের দূরে সরানোই উচিত। হোক তা ভালোবাসা।”
আবরাহাম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রমণীর দিকে। সে এমনই এক মেচ্যুউর্ড মেয়ে চায়। যে বলার আগেই সব বুঝে যায়, তাকে বুঝায়, অনুপ্রেরণা জাগায়। কিন্তু এ পর্যন্ত যতবার সম্পর্কে জড়িয়েছে, প্রতিবারের মেয়েগুলোই ছিল বাচ্চামো তো ভরপুর। যা তার চাহিদার বাহিরে।
খাণিক ক্ষণ গল্প করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে দুজনে।
___
আরাধ্যের বাড়ি ফেরার সময় হুট করেই তার বস তাকে ডাকায়। জানায় প্রেজেন্টেশন অফিসের কেউই লিক করেছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে। যার কারণে একটি দুই কোটি টাকার ডিল হারাতে চলেছে কোম্পানি।
“তুমি আমাকে এই আসল অপরাধী খুঁজে এনে দিবে। আর পরশুর মধ্যে নতুন প্রেজেন্টেশন রেডি করাবে। তোমাকে প্রজেক্ট হেড করেছিলাম৷ তোমার দায়িত্ব ছিল। যদি প্রজেক্ট হারাই, তুমি চাকরিচ্যুত হবে মনে রেখো!”
আরাধ্যের মাথায় হাত। দুদিনের মধ্যে কীভাবে নতুন করে প্রেজেন্টেশন তৈরি করে দিবে?
সে ফাইলপত্র গুছিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বাড়ির জন্য রওনা হয়। রাত-দিন জেগে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করেও যদি চাকরিটা বাঁচাতে পারে!
বেল বাজাতেই নিবেদিতা এসে দরজা খুলে দেয়। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আরাধ্যের ঘামে সিক্ত দেহ। আজ একটু বেসামালই হয়ে পড়েছে রমণী গুরুজন মানে মোকশেদা বেগম বাড়ি না থাকায়।
আরাধ্যে ছিটকে সরিয়ে দিয়ে অফিস ব্যাগ সোফায় ফেলে বেডরুমে চলে যায়। নিবেদিতা আরাধ্যের হুট-হাট এমন আচারণের অর্থ বুঝলো না। কারণ এই এক সপ্তাহ আরাধ্য নিবেদিতাকে একদম আগের মতোই আগলে রেখেছে।
তবুও বেশি মাথা না ঘামিয়ে আরাধ্যের জন্য ঠাণ্ডা পানি দিয়ে লেবুর শরবত করে ঘরে নিয়ে যায় সে। আরাধ্য তখন ফ্রেশ হয়ে এসেছে। তাকে খুব বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে। নিবেদিতা শরবত ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দেয়।
“কিছু হয়েছে আরাধ্য? কেমন যেন দেখাচ্ছো তোমাকে।”
“যেমন আমি, তেমনই তো দেখাবে। এত আজাইরা কথা বলো কেন?” বিরক্তের সুরে জবাব দেয় আরাধ্য।
নিবেদিতা কষ্ট পেলেও তা গায়ে লাগায় না। বরং, আরাধ্যের খাবার বেড়ে দিতে যায়। খাবারের প্লেট নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখে আরাধ্য সোফাউ ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে পড়েছে।
“আগে খেয়ে নেও, তারপর কাজ কোরো।”
“আরে বাবা বললাম তো খাবো না!”
একটু জোরালোই হয় আরাধ্যের কণ্ঠে। নিবেদিতা তাও রাগে না। বরং, আরাধ্যকে স্বস্তি দেওয়ার কথা ভাবে।
সে কোথায় যেন শুনেছিল, প্রিয়জনের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হলে না কি তপ্ত দুপুরেও স্বস্তি দেয়। নিবেদিতা আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আরাধ্যকে।
“কী সমস্যা আমাকে বলবে তো এমন রাগারাগি না করে? অফিসের কিছু হলে যদি আমি হেল্প করতে! পারি।”
ঝটকা দিয়ে নিবেদিতার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আরাধ্য।
“সবসময় গা ঘেঁষাঘেঁষি ভালো লাগে না। এত গায়ে পড়া স্বভাব তোমার! আর ডিস্টার্ব কইরো না। এক কাজ করো কালকে তুমি তোমার বাসায় যাও, একটু ঘুরে আসো। আমিও একটু মুক্তি পাবে।”
এতগুলো তিক্ত বাণী শুনেও হাসে কিংবা কাঁদে না নিবেদিতা। বরং, খুব স্বাভাবিকতার সহিত “ঠিক আছে” বলে খাবার টি-টেবিলে রেখে বেডরুমে চলে যায় সে।
সারারাত জেগে ভোর পর্যন্ত কাজ করায় দুপুরে ঘুম ভাঙে তার। উঠে দেখে পাশে নিবেদিতা নেই। স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ভাবে,
– ভালোই হয়েছে মেয়েটা বাপের বাড়ি গিয়েছে। শান্তি পাওয়া যাবে।
ঠিক তখনই নিবেদিতার টেক্সট আসে তার ফোনে।
-আমি যে ঐ বাড়ি থেকে চলে এসেছি, তা যেন আমার মা-বাবা না জানে। আম্মু হার্টের রোগী টেনশন করবে।
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে আরাধ্য। সাথে সাথে রিপ্লাই করে,
– এগুলো কোন ধরনের কথা? তুমি বাবার কাছে না গেলে, কোথায় গেলে?
-আমি না কি বন্দীত্ব, তুই মুক্তিকামী পক্ষী।
আমার থেকে মুক্তি চাস তো তুই?
যা তবে মুক্তি দিলাম। এক আকাশ মুক্তি!
খোলা আকাশেই ডানা মেলে উড়বি তুই,
আমার স্মৃতিতে ধুকেধুকে মরবিও তুই!
(বিঃদ্রঃ অনেক দিন পর ফিরে এলাম জ্বর থেকে সুস্থ হয়ে। জানি এতদিন গ্যাপ পড়ায় এখন গল্পের রিচ ও পাঠক কমে যাবে। তবুও আপনাদের সাপোর্ট আশা করছি। আপনাদের দোয়ায়ই আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেকটাই সুস্থ, নাহলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ডেঙ্গু হলো কি না…)
চলবে…