নিভৃতে_যতনে পর্ব ১০

0
2761

#নিভৃতে_যতনে
#Part_10
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

রাত প্রায় নয়টা ছুঁই ছুঁই৷ আমি বিছানায় গালে এক হাত দিয়ে বসে আছি৷ সামনে বই আর কতগুলো শিটের ছড়াছড়ি। এদের মাঝেই কলম, পেন্সিল ও রাবারের লুকোচুরি খেলা। পাশেই রোয়েন ল্যাপটপে কি যেন করছে। আমি একবার আড়চোখে রোয়েনকে দেখছি আরেকবার বইখাতা গুলোর দিকে। মাঝে মধ্যে দুই একটা বই নেড়ে চেড়ে দেখছি। কিন্তু বুঝতেই পারছি না পড়াটা শুরু করবো আসলে কোথা থেকে? যাই দেখছি সব নতুন লাগছে। এমনকি ডেবিট ক্রেডিটের বিষয়টাও নতুন লাগছে। ফিন্যান্সের সাধারণ সুদ আসলের সূত্র ও যেন এখন জাগাখিচুড়ি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন এইগুলো আমি জীবনে চোখেই দেখিনি। করা তো দূরের কথা। এইগুলো এখন কিভাবে কভার আপ করবো? হাও?
মাঝে মাত্র ১ মাস গ্যাপ গিয়েছে আর এতেই আমার অবস্থা যাচ্ছে তা। অবশ্য এই এক মাসে আমার উপর দিয়ে কম ধকল যায়নি৷ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক চাপে ছিলাম, ডিপ্রেসড ছিলাম। তার উপর এই বিয়ে৷ এক কথায় এইসবের মাঝে পড়ালেখা আমার পিছনের জানালা দিয়ে পালিয়ে চান্দের দেশে চলে গিয়েছে কিন্তু এখন আমার কি হবে? এত মোটামোটা বই, শিট আমি আড়াই মাসের মধ্যে কিভাবে শেষ করবো? হাওওওও? হৃদিপুকে এখন উল্টিয়ে পিটাতে ইচ্ছে করছে। কে বলেছিল আমার এক কথাই বিকেলের দিকেই বইগুলো পাঠিয়ে দেওয়ার? বই যদি আজ না পাঠাতো তাহলে এটলিস্ট আজ এই খাটাশ ব্যাটা জোর করে আমায় পড়াতে বসাতে পারতো না৷ হুহ!

কথাগুলো ভেবেই আমার ভিতরের সকল দুঃখ উপচে পড়ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঠুস করে চোখ চিরে দুঃখ বেরুবো আর ঠাস করে গালে ছাপ বসাবে। কিন্তু এই প্রসেস চালু করার আগেই রোয়েন ফুল স্টোপ লাগিয়ে দিয়ে বলে,

— বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে বুঝি পড়া হয়ে যায়?

কথাটা শুনে আমি রোয়েনের দিকে তাকাই। দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— আমি বলেছি পড়া হয়ে যায়?

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তাহলে এইভাবে উল্লুকের মত বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? পড়া শুরু করো।

শেষের কথাটা তিনি আদেশের সুরেই বললেন। আমি রোয়েনের কথা শুনে ব্যঙ্গ করে বলি,

— পড়া শুরু করো! বললেই হয় নাকি? আরেহ ভাই আমার আগে তো বুঝতে হবে কোথা থেকে শুরু করবো।

উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— আমি তোমার ভাই লাগি?

আমি একটু ভেবে বলি,

— হ্যাঁ লাগেন এই তো। জামাই ভাই!

কথাটা শুনে রোয়েনের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে৷ সে একটু গম্ভীর গলায় বলে,

— হোয়াট রাবিশ! জামাই ভাই কি আবার?

আমি আমতা আমতা করে বলি,

— সংজ্ঞা আপাতত জানি না। জেনে বলবো নে।

রোয়েন এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— জেনে আমাকে উদ্ধার করিও৷ এখন পড়া শুরু করো।

আমি মুখ ফুলিয়ে আগে ফিন্যান্স বইটা হাতে নিলাম। তা দেখে রোয়েন বলে,

— আগে সহজ কোন সাবজেক্ট থেকে পড়া শুরু করো। লাইক বাংলা, ইংরেজি ওর ম্যানেজমেন্ট।

আমি উনার দিকে সুরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— কোন খুশিতে?

উনি নিজের ল্যাপটপে দিকে মনোযোগ দিয়ে বলেন,

— প্রথমেই সহজ কোন সাবজেক্ট দিয়ে পড়া শুরু করতে হয়। এতে ব্রেনে চাপ কম সৃষ্টি হয় আর সহজেই পড়া মনে রাখতে পারে। সেই সাথে মনোযোগ ও সৃষ্টি হয়৷ যার ফলে পরবর্তীতে হার্ড সাবজেক্টগুলো বুঝতে বেগ পেতে হয় না। ডাফার! না সরি তুমি তো আবার বুঁচি।

আমি নাক ফুলিয়ে হুট করে উনার নাক টেনে ধরে বলি,

— আরেকবার যদি বুঁচি বলেছেন না আপনার নাক আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। আমি মোটেও বুঁচি না। হুহ!

আমার এই এহেন কান্ডে রোয়েন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। উনি আমার দিকে গোলগোল চোখে তাকায়। অতঃপর এক ঝাটকায় আমার হাত সরিয়ে টান দিয়ে আমায় একদম তার কাছে নিয়ে যান। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলেন,

— তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার নাক ধরার? আর বুঁচিকে বুঁচি বলবো না তো কি বলবো ডাইনি?

প্রথমে তার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। তার থেকে সরে আসার চেষ্টা করি কিন্তু পরক্ষণেই তার কথা শুনে আমি কটমট চোখে তাকাই। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— আমার নাক বুঁচা না বুঝলেন। একদম কিউট একটা নাক আমার। একে অপমান করার কোন অধিকার নাই আপনার।

আমার কথা শুনে রোনের ঠোঁটের এক কোনে সুরু এক হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ উনি আমার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে বলে,

— তাই নাকি?

উনি আমার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। সেই সাথে মুহূর্তেই আমার বুক কিঞ্চিৎ ধক করে উঠে। প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আমার। নয়ন দুইটি চঞ্চল হয়ে আসে আর ঠোঁট ও গলা শুকিয়ে আসে। আমি কোন মতে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলি,

— হু..ম! এ..খন স..ড়ু…ন প্লি..জ!

কথাটা বলেই আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম তার নয়ন দু’টি মাধুর্য বেশ গভীর। কিছু তো একটা আছে এই নয়ন যুগলের মাঝে। যা আমাকে গভীর ভাবে এক ঘোরের মাঝে ফেলে দিচ্ছে। আগে জানতাম মেয়েদের চোখ নাকি সর্বনাশী চোখ হয়৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছেলেদের চোখও সর্বনাশী হয়। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের লিখা গানের দুটো’ লাইন মস্তিষ্কে টনক নেড়ে উঠে,

” প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস—
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”

আমার তার প্রতি এমন চাহনি দেখে উনার ভ্রু কুটি কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে। উনি আমার নাক টেনে দিতেই আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি আর আমি তার থেকে ছিটকে দূরে এসে পড়ি। রোয়েন নিজের কাজের দিকে মন দিয়ে বলে,

— পড়া শুরু করো মিস বুঁচি।

কথাটা শুনে রাগ হলেও আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ ম্যানেজমেন্ট বইটা নিয়ে জোড়ে জোড়ে পড়া শুরু করলাম। মূল উদ্দেশ্য রোয়েনকে জ্বালানো। মায়ের কাছে শুনিছি তিনি নাকি কাজের সময় শব্দ পছন্দ করেন না। তো আমি সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করছি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রম হওয়ার পরও যখন রোয়েনের কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না তখন পাশে ঘুরে দেখি খাটাশ মহাশয় কানে হেডফোন লাগিয়ে কাজ করছে। সেটা দেখার সাথে সাথে আমি নিজের কপালে চাপড় মেরে বিরবির করে বলি,

— ভুলে যাস কেন এই ব্যাটা একটা আস্ত খাটাশ। একে সায়েস্তা করা এত সোজা না।

কথাটা বলে পাশে তাকিয়ে দেখি রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখ ‘প’ টাইপ উচ্চারণ করতেই নিবে তার আগেই আমি বলি,

— উফফ! পড়ছি তো ভাই। এতবার বলা লাগে?

কথাটা বলে বইয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। এমন একভাব করলাম যে, এখনই আমি টুপ করে বইয়ের ভিতর ঢুকে যাব।

_____________________

সকালে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছি এমন সময় রোয়েন তাড়া দিয়ে বলে,

— সময় কি তোমার জন্য বসে থাকে?

আমি আয়নার মধ্য দিয়েই রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,

— মানে?

— কয়টা বাজে খেয়াল আছে? ১০ টায় ক্লাস তোমার আর এইখানে অলরেডি নয়টা বাজে। রাস্তায় যে কি পরিমাণ জ্যাম থাকে সেইদিকে খেয়াল আছে?

আমি নাক ফুলিয়ে বলি,

— হয়েই গিয়েছে।

কথাটা বলে মিনিট পাঁচেকের মাঝেই ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে একবারে পরিপাটি হয়ে গেলাম। রোয়েন আমার দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়৷ আমিও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসি। বাবা-মাকে বলে রওনা দিয়ে দেই।

পার্কিং এরিয়াতে এসে দাঁড়াতেই দেখি রোয়েন কোথাও যেন চলে যায়। অতঃপর মিনিট দুয়েকের মাঝেই উনি এক বাইক নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়৷ বাইক দেখে আমি তার দিকে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাই। অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— এইটা কোথা থেকে টপকালো?

রোয়েন হাতে থাকা দুইটা হেলমেট খুলতে খুলতে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়৷ শীতল কন্ঠে বলেন,

— মানে?

— বাইকটা কার?

উনি বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে,

— চালাচ্ছি যেহেতু আমি সেহেতু কার হওয়ার কথা এইটা?

আমি তার উত্তর শুনে থমথম খেয়ে বলি,

— আপনারই। কিন্তু এতদিন দেখলাম না যে?

— সার্ভিসিং এ ছিল।

হঠাৎ মুখ ফোসকে বেরিয়ে আসে,

— কিন্তু আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার মত খাটাশের বাইকও থাকতে পারে।

কথাটা বলেই আমি অস্বস্তিতে পরে যাই। নয়ন দুটি আমার চঞ্চল ভঙ্গিতে এইদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইদিকে রোয়েনের আমার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। অতঃপর আমার দিকে একটা হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

— উঠো!

রোয়েনের কথা শুনে আমি আরেক দফা বিপাকে পড়ে যাই। কেন না এর আগে আমি বাইকে উঠি নি। কিভাবে উঠে তাও জানি না। আমি তাকে ইতস্তত সুরে বলি,

— আমি বাইকে উঠতে পারি না।

সে আমার কথা শুনে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণের মত করে উঠে। অতঃপর এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

— তা পারবে কেন? পারো তো খালি আমার মাথা খেতে। ডিসগাস্টিং!

কথাটা বলেই তিনি আমায় আগে হেলমেট পড়তে বললেন এবং বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে উঠতে হবে৷ আমিও তার কথা মত হেলমেট পড়ে উঠে পড়ি বাইকে। সেই সাথে রোয়েনের কোমড়ের দিকে শার্ট আঁকড়ে ধরি। রোয়েন একবার কিছু বলতে গিয়ে বললো না। চুপচাপ বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল।

_________________________

দেখতেই দেখতে চার দিন কেটে যায়। আজ বাবা-মা দেশের বাড়ি চলে গিয়েছেন। বেশ খারাপই লাগছে। কেন না এই কয়েকদিনে তাদের সাথে অনেক ভালো এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। যে ভালবাসাটা আমি ওই বাসায় পায়নি তা তাদের কাছে পাচ্ছিলাম। বাবার ভালোবাসাটাও আমি পেয়েছে শ্বশুর নামক বাবাটির কাছ থেকে। এক মায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছিলামই এইখানে এসে দ্বিতীয় মায়েরও ভালোবাসা পেয়েছিলাম। বলতে গেলে দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম তাদের উপর। এখন তাদের চলে যাওয়ায় বুকের ভিতর চাপা এক কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কিন্তু তা মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছি না।

পড়ন্ত বিকেলের সময়। আকাশ আজ সমুদ্রের নীলের মত স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছ আকাশের বুকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তুলোর মত পেঁজো পেঁজো মেঘ। রোয়েনদের বাসা রাস্তার ধারে না হওয়ায় পরিবেশটা বেশ নিরব। বারান্দার কার্নিশের উপর বসে এক জোড়া চড়ুই পাখি সুরে তুলতে বিভোর। আমি বারান্দার এক কিনারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বাইরে। উদ্দেশ্য প্রকৃতির মাঝে থেকে নিজের মনের বিষন্নতা দূর করার। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে একটা ফ্রেশ মুড নিয়ে রুমে চলে আসি। রুমে এসে মোবাইল নিয়ে গেম খেলতে বসে পড়ি। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই রোয়েন হাতে একটা কাগজ নিয়ে রুমে ভিতর প্রবেশ করে। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এরপর অতি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

— হোয়াট ইজ অল দিস সিয়াশা?

#চলবে

গল্প সম্পর্কে বেশি না হোক দুই লাইন কি লিখা যায় না? গল্প কি এতই খারাপ হচ্ছে যে আপনারা মন্তব্য করতে অনিহা প্রকাশ করছেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here