নিভৃতে_যতনে পর্ব ১৮

0
2179

#নিভৃতে_যতনে
#Part_18
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

আঁধারের মায়া কাটিয়ে ফুটতে শুধু করেছে ভোরের আলো। স্নিগ্ধ সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠেছে পরিবেশটা। খাগড়াছড়ির আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে এঁকেবেঁকে চলছে গাড়িটি। বিস্তৃত সরু রাস্তার দু’ধারে যেন সবুজের সমারোহ। ঝোপঝাড়ের মাঝে যেন বুনোফুলের রাজত্ব৷ নীলাভ আকাশের মাঝে পেঁজো পেঁজো মেঘের হাতছানি। স্নিগ্ধ পরিবেশে মনোরম এক সকাল।
ঘড়িতে ছয়টা প্রায় বেজে এসেছে। পূব দিকে জানালা হওয়ায় আলোর তীব্রতা একটু বেশি। পর্দা দেওয়া সত্ত্বেও আলোর তীক্ষ্ণ রেশ এসে বারি খাচ্ছে আমার চোখে মুখে। যা ক্ষণেই বিঘাত ঘটিয়ে দেয় আমার নিদ্রায়। আমি পিটপিট করে চাই। একটু নড়েচড়ে উঠতে চাইলে বুঝতে পারি আমি কারো উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ। ঘটনাক্রমে নিজের অবস্থান বুঝে উঠতে কিছু প্রহর কেটে যায়। অতঃপর নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে আমার গাল দুইটি লালাভ হয়ে উঠে। সারা জাহানের লজ্জা যেন ঝেঁকে ধরে আমায়। রোয়েনের এক হাত আমার কোমড়ে। সে আলতো হাতেই আমায় তাঁর সাথে চেপে ধরে শুয়ে আছেন আর আমি দুই হাত দিয়ে রোয়েনের কোমড় জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছি। ব্যাপারটা যে আমার কাছে আকস্মিক কিছু তা কিন্তু নয়। অতি সাধারণ বিষয়। কেন না আমি যে এইসবে অবগত ছিলাম। আমার ঘুম খানিকটা পাতলা। যার ফলে আমি যখন গতরাত্রে রোয়েনের উপর ঝুঁকে পড়েছিলাম তখনই আমার ঘুম ছুটে যায় কিন্তু চক্ষুলজ্জার ভয়ে ঘুমের ভাণ ধরে রাখি। আমি তখন মোটেও আশা করি নি যে, রোয়েন আমায় আগলে নিবে। সে যখন আমায় আগলে নিলো আর আমার মাথাটা তার বুকের মাঝে রাখলো তখন বোধহয় আমার হৃদস্পন্দন হাজারগুণ বেড়ে গেলো। শরীর বার বার শিহরণ দিতে শুরু করলো। মনের মাঝে জাগ্রত হলো এক অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি। যা আমার কাছে ছিল একদম নতুন আর ভিন্ন অনুভূতি। মূহুর্তেই তীব্র এক শান্তি ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গ জুড়ে। খুঁজে পেলাম এক নিরাপদ আর নির্ভরযোগ্য স্থান। তখন আমার কি হলো আমি জানি না, যেখানে আমার সরে আসার কথা সেখানে আমি বেহায়ার মত লজ্জা-শরম ভুলে তার বুকের মাঝে পড়ে রইলাম। ঠোঁটের কোনে সরু হাসির ঢেউ খেলিয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে শান্তির ঘুম ঘুমালাম। কিন্তু এখন! আমি যে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। লজ্জার সাগরে ডুবে মরছি। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে রক্তিম আভার বিস্তৃত ঢেউ। কিভাবে দেখাব আমি এই মুখ তাকে? হাও!

বেশ কিছু প্রহর এইভাবেই অতিক্রম করার পর আমি খুব সাবধানে তার থেকে সরে এসে মাথা উঁচু করে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নেই কেউ সজাগ আছে কি-না আর আমাদের এইভাবে দেখে নিয়েছে কি-না। কাউকে সজাগ না দেখতে পেয়ে আমি হাত ছেড়ে বাঁচি। অতঃপর নিজের সিটে গা এলিয়ে বসি। বার দুয়েক দম ফালানো নিঃশ্বাস নিয়ে স্থির হই। বুক আমার এখন ধুকপুক ধুকপুক শব্দ করছে। এই বুঝি আমার হার্টফেল হলো। ইশশ কি বিচ্ছিরি অবস্থা। উফফ! না জানি রোয়েন ঘুম থেকে উঠলে কি বলে উঠে। হাইরে কি লজ্জা! কি লজ্জা! লজ্জায় আমার বুড়িগঙ্গায় ডুবে মরে যাওয়া উচিৎ।

___________________

পরিবেশ কিছুটা তপ্ত হয়ে উঠতেই সকলের ঘুম ছুটে যায়। সেই সাথে ধীরে ধীরে বেরে উঠে কোলাহল। কম বেশি সকলেই মোটা পর্দার আবরণ সরিয়ে মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় বাহিরের পানে। কেউ কেউ মুঠোফোন বের করে তা বন্দী করে নিচ্ছে স্মৃতির পাতায়। বেশ কিছুক্ষণ আগে রোয়েনও উঠে পড়েছে। আমি আড়চোখে তার দিকে তাকাতেই দেখি সদ্য ঘুম থেকে উঠার ফলে চোখ-মুখ কিছুটা ফোলা। চুল তার এলোমেলো, বিধস্ত। সরু ঠোঁট প্রায় শুকিয়ে কাঠ। শ্যামবর্ণ মুখমণ্ডলটি তেলে কিছুটা চকচক করছে। রোয়েনের মুখশ্রীর আকৃতি সাধারণ হলেও কিছু একটা অসাধারণ ব্যাপার আছে। তার দিকে একবার চোখ পড়লে চোখ ফিরানো দায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এইটার রহস্য কি তা আমি এখনো ধরতে পারি নি। রোয়েন হঠাৎ আমার দিকে ঘুরতে তাকাতেই আমি হকচকিয়ে যাই। একটু নড়েচড়ে বসে বাহির দিকে তাকিয়ে রই। এমন এক ভাব করি যে, আমি কিছু জানিই না। আমি এখন সুইট ইনোসেন্ট ভোলাভালা এক নাদান বাচ্চা৷ কিন্তু তাও আমার এমন অসাধারণ এক্টিং পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে রোয়েন আমার কানের সামনে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

— দৃষ্টি যতই সরিয়ে নাও কেন, শত দৃষ্টির মাঝেও তোমার দৃষ্টি আমাতেই সীমাবদ্ধ।

কথাটা শোনা মাত্র আমার পশম দাঁড়িয়ে যায়। এই ব্যাটা আমার সব বুঝে কিভাবে ভাই? হাও? আমি শুকনো গলায় ঢুক গিলে যেই না কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই রোয়েন স্বগতোক্তি গলায় বলে উঠেন,

— রেডি হয়ে থেক। একটু পরই আমরা নেমে যাব।

কথাটা শুনে আমি সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— খাগড়াছড়িতেই?

— হ্যাঁ৷

— সাজেক না রাঙ্গামাটিতে? তো আমরা এইখানে নেমে কি করবো?

সে আমার দিকে ভ্রুকুঞ্চন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— খাগড়াছড়ি হয়েই সাজেক যাব। ডাফার!

______________________

খাগড়াছড়িতে নেমেই প্রথমে এক রেস্তোরাঁয় উঠে ফ্রেশ হয়ে নেই। এরপর সকালের নাস্তাটা সেড়ে নিয়ে খাগড়াছড়ির প্রাণ শাপলা চত্ত্বর থেকে উঠে পড়ি চাঁন্দের গাড়িতে। মোট পনেরোটা চাঁন্দের গাড়ি রিজার্ভ করা হয় সকলের জন্য। সারি সারি সকল গাড়ি চলতে থাকে বাগেরহাটের পথে। রাস্তার দুপাশে রাবার বাগান। সাজানো সবুজ মিশ্র ফলের বাগান। পাহাড়ের বুকে বসবাস করা আদিবাসীদের বসতি। নীলাভ আকাশ ভর্তি শুভ্র শুভ্র মেঘের কুন্ডলী। মন ভোলানো পরিবেশ। আমি মুগ্ধ হয়ে সবকিছু দেখছি। এই প্রথম প্রকৃতির বুকে আসা আমার। সবকিছুতেই যেন কেমন ঘোর লাগা কাজ করছে আমার। হঠাৎ আঁধার নেমে এলো। আঁকাবাঁকা সর্পিল পথের বাঁক পেরোতে পেরোতে দেখা মিললো পাহাড়ি-বৃষ্টি। মূহুর্তেই প্রকৃতি হয়ে উঠলো প্রাণবন্ত ও নির্মল। এ যেন আরেক চোখধাঁধানো সৌন্দর্য।

গাড়িতে নিজের বৈষম্য রাখতে আমার বেশ বেগ পেতে হলো। চাঁন্দের গাড়ি তো নয় এ জেনো রোলারকোস্টার। চোখের পলকেই তীব্র গতিতে এঁকেবেঁকে পথ পেরিয়ে এক পাহাড় পেরিয়ে উঠে যাচ্ছে অন্য পাহাড়ে৷ এমন মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাব। আমি ভয়ে রোয়েনের এক হাত খামচে ধরে বসে থাকি৷ রোয়েন প্রথমে আমার এমন কান্ডে ভ্রু কুঁচকে তাকালেও পরে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হঠাৎ বায়ের দিকে মোড় ঘুরাতেই আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। ঝুঁকে পড়তে নেই বাইরের দিকে। পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ার আগে রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আর তাঁর রক্তচক্ষু দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে কর্কশ কন্ঠে বলেন,

— এতটা কেয়ারলেস কেন তুমি?

আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বলি,

— না ইয়ে মানে… প্রথমবার উঠছি তো তাই৷

বলে মুখ ছোট করে ফেলি। রোয়েন আর কিছু না বলে আমার কোমড় চেপে ধরে বসে রয়।

__________________

প্রায় দেড় ঘন্টা জার্নি করার পর আমরা এসে পৌঁছাই বাগেরহাট বাজারে। সেখানেই সকলে নেমে পড়ি। অপেক্ষা করতে থাকি পরের চান্দেরগাড়ির৷ অনেকে আবার ঘুরে দেখতে শুরু করে বাজারটি। তখন রোয়েন আমায় জিজ্ঞেস করে উঠে,

— কিছু খাবে?

আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,

— কি খাবো?

রোয়েন কিছুক্ষণ আমার দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

— ওয়েট!

কথাটা বলেই উনি সামনের দিকে হাটা শুরু করে। অতঃপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনি কাগজে মুড়ানো কিছু একটা নিয়ে হাজির হন। আমার হাতে সেই কাগজটা তুলে দিতেই আমি উৎসুক দৃষ্টিতে সেটা খুলি। সেখানে লেবুর মত কিছু একটা দেখে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে। আমি কৌতহুলী চোখে তাঁর দিকে তাকাতেই উনি বলে উঠেন,

— এইটাকে মিষ্টি লেবু বলে। খেয়ে দেখো ভালো লাগবে।

কথাটা শুনে আমি লেবুটা খেয়ে দেখি। আসলেই স্বাদটা অসাধারণ। কিছুটা মাল্টার মত খেতে কিন্তু আসলে মাল্টা না। রোয়েন যদি এই জিনিসটা না খাওয়াতো তাহলে হয়তো মিস করে যেতাম এইটা। আমাকে দেখাদেখি আরও অনেকে মিষ্টি লেবু এনে খাওয়া শুরু করে। মিনিট দশেকের মাঝেই আমরা উঠে পড়ি চান্দের গাড়িতে। দ্বিতীয় বারের মত রওনা দেই সাজেকের উদ্দেশ্যে।

_____________________

দুপুর একটা ছুঁই ছুঁই। সূর্য যখন মাথার উপর চড়ে বসেছে ঠিক তখনই আমরা এসে পৌঁছেছি মেঘের রাজ্য সাজেকে। সাজেকের বুকে পা রাখতেই মনে মাঝে খেলে যায় এক রাশ ভালো লাগা। চোখ জুড়িয়ে যায় এই নির্মল পরিবেশে। বাতাসে খেলে উঠে বুনোফুলের স্নিগ্ধ সুবাস আর কাঁচা মাটির তীব্র গন্ধ। এই যেন আরেক প্রশান্তি। সকলেই সকলের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ি পাবলিক রিজোর্টে। সকলে নিজের রুম বুঝে নিতেই হামলে পড়ে যার যার রুমের উপর। এলিয়ে দেয় নিজের ক্লান্ত শরীর বিছানার উপর। আমি আর রোয়েন নিজ রুমে আসতেই আমি ধপ করে শুয়ে বিছানার মধ্যে আর রোয়েন ঢুকে পরে ওয়াশরুমে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নয়ন দুইটির মাঝে এসে ভর করে তন্দ্রা। তন্দ্রাটা যখন গাঢ় হয়ে আসে ঠিক তখনই এক পুরুষালী কন্ঠ এসে বারি খায় কর্ণধারে। সাথে সাথে আমি সজাগ হয়ে যাই। লাফ দিয়ে উঠে বসি বিছানায়। চারদিকে চোখ বুলাতেই যা দেখি তাতে আমার ঠোঁট দুটি আপনা-আপনি কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আসে। চোখে ফুটে উঠে বিস্ময়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here