#নিভৃতে_যতনে
#Part_09
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
কফি হাতে নিয়ে রোয়েনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। কিন্তু সে? সে তো এখনো ঘুমে কাঁদা। ঘড়িতে দশটা বেজে সতেরো মিনিট। বাইরে সকলই ইতিমধ্যে উঠে রোয়েনের খোঁজ নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। তাও খোঁজ নিচ্ছে কার কাছে? আমার কাছে। তাদের ভাব এমন যেন আমি তাকে সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরছি। আমাকে তার কথা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে ঠাস করে উত্তর দিয়ে দিব। যতসব!
অতঃপর না আমায় ডেকে রোয়েনের জন্য কফি ধরিয়ে দেয় আর বলে রোয়েনকে দিয়ে আসতে। আমি আর কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে চলে আসি রুমে। এসে দেখি মাননীয় আমার বর মহাশয় এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি। আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রোয়েনকে ডাকতে থাকতাম। কিন্তু না তার কোন সাড়া নেই। আবার ডাকতে গেলেই রোয়েন খ্যাঁক করে ধমকে উঠে অতঃপর আমার গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে যায়৷
মেজাজ আমার আপাতত ফোরটি নাইন হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে এই গরম কফির মধ্যে একে ডুবিয়ে ভূত বানিয়ে ফেলি৷ কিন্তু সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়? আমি দাঁতে দাঁত চেপে রোয়েনকে ডাকতে থাকি।
— এই যে মিস্টার খাটাশ শুনছেন? উঠবেন নাকি বিছানায় লেপ্টে থেকে শহীদ হওয়ার ইচ্ছে আছে?
কিন্তু নো রেসপন্স। এই ব্যাটার ঘুম দেখি কাঁঠালের আঠার মত। একবার লাগলে উঠতেই চায় না। আমি এইবার একটু উঁচু স্বরেই ডাকতে থাকি। একসময় রোয়েনের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে আর সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে তাকায়। তা দেখে আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। রোয়েন উঠে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে বলে,
— হোয়াট?
আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,
— হোয়াট-ফোয়াট ছাড়েন আর উঠেন। কয়টা বাজে সেই খবর আছে? আপনাকে উঠাতে গিয়ে আমি শহীদ হয়ে গিয়েছি। মানুষ এত ঘুমে বিভোর কিভাবে হয়? হাও?
সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
— আমার ও জানা ছিল না মানুষ ভাঙ্গা রেডিও এর মত বাজতে পারে। হেডেক ম্যান!
বলেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে আর ফ্রেশ হতে চলে যায়। আমি সেইদিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে থাকি। বিরবির করে বলি,
— এই ব্যাটা আস্ত এক ঘাড়ত্যাড়া৷
_____________________
খাবার টেবিলে সবাই বসে আছি। সকলেই যে যার মত খাচ্ছে। আমিও এক সাইডে চুপচাপ বসে খাচ্ছি। এমন সময় ওসমান সাহেব বলে উঠে,
— রোয়েন বাবা শুনো!
রোয়েনও চুপচাপ খাচ্ছিল। ওসমান সাহেবের কন্ঠ শুনে সে মাথা তুলে তাকায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— জ্বী বলুন।
— রীতি অনুযায়ী আজ তোমায় বাজার করতে হবে। তা তুমি বাজার করতে পারবে তো।
রোয়েন আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে,
— জ্বী পারবো।
কথাটা শুনে ওসমান সাহেব কিছু টাকা এগিয়ে দিয়ে বলেন,
— তা এই টাকা গুলো নাও আর একটু ভাইজানের সাথে বের হয়ে যেও।
কথাটা শুনে আমি চকিতে তাকাই। রোয়েনও মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অতঃপর বলে,
— টাকা কিসের জন্য?
কথাটা শুনে ওসমান সাহেব থমথমে খেয়ে বললেন,
— বাজারের জন্য।
রোয়েব একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠে,
— বাজারটা যেহেতু আমায় করতে হবে তাই আমি চাই পুরো খরচটা আমি একাই বহন করতে।
— কিন্তু বাবা..
ওসমান সাহেবকে কিছু বলতে না দিয়ে রোয়েন বলে উঠে,
— আমি নিজ থেকে বাজারটা করতে চাচ্ছি। আর কিছুই না। আশা করি এতে কারো কোন ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা না।
কথাটা বলেই রোয়েন আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দেয়। কথাটা শুনে ওসমান সাহেব একটু অপমানিতবোধ করেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের হাত গুটিয়ে নিলেন। সকলে কিছুক্ষণ রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে ফেলে। আর এইদিকে ওসমান সাহেবের চেহেরা দেখে আমার মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো সুরু হাসি। ভিতরে ভিতরে কি যে খুশি লাগছে আমার আজ। মন চাচ্ছে বাচ্চাদের মত উড়াধুরা লুঙ্গি ডান্স দেই৷ কথা না বললেই নয়, আজ প্রথমবারের মত রোয়েনকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে আমার। সে যা করেছে তা যে আমার জন্য মানসিক প্রশান্তি।
_________________
আজ প্রায় দু’দিন হতে চললো সেই বাসা থেকে এসেছি। আসার সময় তেমন কোন ঝামেলা হয় নি। ভালোয় ভালোয় এসে পড়েছি আমরা। এইখানে আসার পর রোয়েনের বাবা-মাকে আপন করে নিতে শুরু করেছি৷ তাদের সাথে মিশতে শুরু করেছি। আর করবোই না কেন? তারা যে আমার অনেক খেয়াল রাখছে। দু’দিনের মধ্যেই মায়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেছে। বাবার সাথেও মোটামুটি। শুধুমাত্র এই খাটাশ ব্যাটার সাথেই আমি সুবিধা করতে পারছি না৷ আর পারবো বা কিভাবে? ঘাড়ত্যাড়া মানুষের সাথে কি সোজা ভাষায় কথা বলা যায়? আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাকে অসহ্য লাগে তার সাথে ভাব জমায় কিভাবে মানুষ? হাও? আমি তো ভাই পারি না আর পারতে চাইও না। হুহ।
বিকেলে রুমে বসে বসে ফেসবুকিং করছি আর পাশেই রোয়েন বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর রোয়েন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
— সিয়াশা শুনো!
রোয়েনের ডাক শুনে যেন আমি আকাশ থেকে পড়ি৷ গোলগোল চোখে তার দিকে তাকাই। বুঝার চেষ্টা কথাটা কি তিনি নিজেই বলেছে নাকি কোন ভূত-প্রেত বলেছে। কেন না এই পর্যন্ত যতবার আমাদের কথাবার্তা হয়েছে তা আমি শুরু করেছি আর তিনি আমার কথার পিঠে উত্তর দিয়েছেন। এছাড়া তো বোমা মারলেও উনার মুখ দিয়ে বলি ফুটানো যায় না। আর সে নাকি আজ নিজ থেকে কথা বলছে। আদৌ বিশ্বাস করা যায়? আমি আমতা আমতা করে বলি,
— আমায় কি ডেকেছিলেন?
উনি আমার কথা শুনে মাথা তুলে আমার দিকে তাকায়। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,
— এইখানে তুমি বাদে দ্বিতীয় সিয়াশা বলে কেউ আছে নাকি?
আমি থমথম গলায় বলি,
— না।
রোয়েন পুনরায় ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,
— কালকে সকালে রেডি থেক।
— কেন?
— বেরুবো!
আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে বলি,
— আপনি বের হলে হবেন,তো আমাকে কেন রেডি হতে হবে?
রোয়েন এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— তোমাকে নিয়েই বের হবো। ষ্টুপিড!
কথাটা শুনে আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি দৃঢ় গলায় বলি,
— আমাকে নিয়ে? কোথায়?
— কোচিং এ ভর্তি করাতে। সামনে না তোমার এডমিশন টেস্ট?
আমি থমথম গলায় বলি,
— হুম কিন্তু আমি আর পড়তে চাই না। তাই এইসব কোচিং টোচিং এ ভর্তি করানোর কোন প্রয়োজন নেই।
রোয়েন ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আরও প্রখর হয়ে আসে। সে গম্ভীর গলায় বলে,
— পড়তে চাও না মানে কি?
আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,
— চাই মানে চাই না। আর বিয়ে-শাদির পর আর কিসের পড়ালেখা? এখন তো আমায় সংসার এই সামলাতে হবে। মেইনলি যেটার জন্য আপনি আমায় বিয়ে করেছেন।
রোয়েন এইবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
— ঠাডিয়ে দিব এক! এক ডিগ্রি বেশি না বুঝলে হয় না? আমি বলেছি সংসার সামলাতে বা বাসার কেউ বলেছে?
আমি থমথম গলায় বলি,
— না কিন্তু….
আমার কথার মাঝে রোয়েন ফোড়ন দিয়ে বলেন,
— কিন্তু কি? যদি ভেবে থাকো তুমি সারাজীবন আমার টাকায় চলবে তাহলে সে গুড়ের বালি। আমি তোমাকে সারাজীবন ঘরে বসিয়ে খাওয়াবো না। তোমাকে পড়ালেখা করতে হবে এবং নিজে আয় করে খেতে হবে।
আমি কাঠ কাঠ গলায় বলি,
— পারবো না আমি। আপনি আমায় খাওয়ান আর নাই খাওয়ান সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আমি আর পড়ালেখা করবো না। পড়ালেখা করার ইচ্ছেটাই এখন আর নেই আমার মধ্যে।
— তুমি পড়বে না মানে তোমার ঘাড় ও পড়বে। আমার ওয়াইফ যেহেতু হয়েছ সেহেতু পড়ালেখা তো তোমায় করতেই হবে।
আমি এইবার রেগে গিয়ে বলি,
— কোন জোড়াজুড়ি আছে নাকি?
রোয়েন নিজের কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে আমার এক বাহুতে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। গম্ভীর গলায় বলে,
— স্বামী যেহেতু আমাকেই মেনেছ সেহেতু তার কথাও তোমার মানতে হবে। এখন সেটা যাই হোক। রাগী না বলে এই না আমি রাগতে জানি না। আমি রাগলে কিন্তু এর পরিনতি খুব খারাপ হবে। তাই বলছি তুমি পড়বে মানে পড়বে। নো মোর আরগিউমেন্টস।
কথাটা বলেই রোয়েন আমায় ছেড়ে দেয় আর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমি একবার রোয়েনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলি।মস্তিষ্কের মাঝে বিচরণ করতে থাকে একটাই ধ্বনি,
— “তোমার উপর টাকা খরচ করাই মানে অপচয়। আমি আর এক টাকাও তোমার উপর অপচয় করতে পারবো না।”
উক্তিটি আমার জন্য ওসমান সাহেবের পক্ষ থেকেই ছিল। আর সেই উক্তিটি যেন আমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে৷ তাই তো আমি আর চাই না কেউ তার টাকা আর আমার উপর অপচয় করুক। হোক সে আপন অথবা পর। কিন্তু ভাগ্য কি আর তা মানে?
_____________________
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আছি। সকলে মিলে একসাথে নাস্তা করছি। এমন সময় সালমা বলে উঠেন,
— রোয়েন তোর আর কত ছুটি আছে??
রোয়েন খেতে খেতে বলে,
— আছে পাঁচ-ছয় দিনের মত।
সালমা বেগম তা শুনে বলেন,
— যেহেতু ছুটি হাতে আছে সেহেতু সিয়াশাকে নিয়ে কোথাও থেকে না হয় ঘুরে আয়।
কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি বিষম খেয়ে যাই। শ্বাশুড়ি আমার কোন দিকে ইঙ্গিত করেছে তা আমার বুঝতে দেরি নাই। মা তারাতাড়ি উঠে এসে আমায় পানি দেন আর পিঠ বুলিয়ে দেন। একটু পর স্বাভাবিক হতেই রোয়েন বলে উঠে,
— এই বিষয় নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত সিয়াশার সামনে এডমিশন এক্সাম তাই আজ ওকে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিতে যাচ্ছি।
সালমা বলে উঠেন,
— এইটার কথা তো মনেই ছিল না আমার। তা আজ ভর্তি করাবি?
রোয়েন ছোট করে “হুম” বলে খেতে থাকে। তৌফিক সাহেব হঠাৎ বলে উঠেন,
— দায়িত্বটা যেহেতু নিয়েছিস ঠিক মত পালন করিস।
কথাটা বলেই তিনি উঠে গেলেন। সালমা বেগম সেদিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ করে বলেন,
— বিকেলে তাহলে বাসায় ফোন করে তোমার বইগুলো দিয়ে যেতে বলো।
আমি কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাই। খাওয়া-দাওয়া শেষে রোয়েন আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে৷
#চলবে
গতকালকে শরীর খারাপ ছিল বিধায় গল্প দিতে পারি নি। এর জন্য দুঃখিত। এখনো অসুস্থ যার ফলে আজকের পর্বটা ঠিক মত সাজাতে পারিনি। কিছুটা ছন্দছাড়া লাগতে পারে। তাই সেটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।