নিরবতা পর্ব-১২

0
4639

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১২

-“কথা বলবি না আমার সাথে? সত্যিই কথা বলবি না?”
অপরপাশ থেকে অনার কোনো জবাব না পেয়ে উদ্বিগ্ন হলো চৈতালি। অনা তার উপর রাগ করেছে তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে ঠিক কী কারণে? গতকাল মুবিন যাবার পর মন ভালো না থাকায় আজ সারাদিন এবাড়িতে আসাও হয় নি তার। এরমাঝে কী এমন হলো যে একদম কথাবার্তায় বন্ধ করে দিল অনা? বোধগম্য হলো না চৈতালির। নিজের দু’হাতে দু’কান ধরলো সে। তারপর আবারও অসহায় গলায় বললো,
-“আমি কী করেছি এটা তো আমায় বল! না বললে বুঝবো কী করে? এই অনা? এদিকে একটু তাকা। দেখ তোর রাগ ভাঙ্গাতে তোর চিতৈই পিঠা কান পর্যন্ত ধরেছে।”
একনজর চৈতালিকে দেখে আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিল অনা। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“আমি কারোর উপর কোনো রাগ করিনি।”
-“তাহলে কথা বলছিস না কেন?”
-“কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও কথা বলতে হবে কেন?”
-“তো কথা বলতে ইচ্ছে করবে না কেন?”
-“নাই করতে পারে। তুই যা তো এখন।”
-“কেনো যাবো? আমি আজ আরও আসলাম তোর সাথে রাতে থাকবো বলে!”
-“যা তো তুই। বিরক্ত করিস না।!”
হঠাৎ অনার চিৎকারে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো চৈতালি। মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল তার। এরকম কেনো করছে অনা ভেবে পেল না সে। অনা খানিকটা জেদি স্বভাবের। তবে কখনোই সে নিজের জেদ বন্ধুত্বের মাঝে আনেনি। মনোমালিন্য হওয়া তো দূরের কথা। তাহলে আজ হঠাৎ করেই কী এমন হলো যে তার সঙ্গে এতটা দুর্ব্যবহার করছে অনা! খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো চৈতালি। তবে মাঝপথে এসেই থেমে আরও একবার ধরা গলায় বললো,
-“সত্যিই চলে যাবো?”
-“হ্যাঁ, যা…”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বলে চোখ জোড়া বন্ধ করলো অনা। চৈতালি তার ছোটবেলার বন্ধু। সবচেয়ে কাছের মানুষ। অথচ তার জীবনের এতবড় একটি সত্য কী করে লুকিয়ে রাখলো সে? তাও তার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে! কী দুর্দান্ত অভিনয় তাদের! যেনো একে অপরকে চেনে জানেই না! নাম মনে রাখা তো দূরের কথা। কিভাবে পারলো তারা এসব করতে? এভাবে কয় বছর যাবৎ তারা এ অভিনয় অভিনয় খেলছে কে জানে! কী এমন হতো তাকে সবটা জানালে? সে কী চৈতালির শুভাকাঙ্ক্ষী নয়? তারপরও কেনো চৈতালি জানালো না তাকে? লম্বা করে দম ছেড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আলমারি খুলে ছবির একটি অ্যালবাম বের করলো অনা। তারপর তার এবং চৈতালির সকল ছবি বেছে আলাদা করে একটি মোম জ্বালিয়ে পোড়াতে শুরু করলো ছবিগুলোর একপাশ থেকে চৈতালিকে।

ল্যাবএইডে সন্ধ্যার পর বসার কথা থাকলেও উল্লাসীর কথা ভেবে চেম্বারে বসলো না মেসবাহ। বিকেল থাকতেই বাড়ি ফিরে সময় নিয়ে গোসল সেরে টেলিভিশনের সামনে বসলো সে। তারপর উল্লাসীকে ঢেকে চা চাইলো এক কাপ। স্বামীর আদেশ পাওয়ামাত্র উল্লাসী পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ঝটপট চা বানিয়ে কাপে ঢেলে তা নিয়ে এগুলো ড্রইংরুমের দিকে।

-“তুমি খাবে না?”
-“উহু.. আমি খাই না।”
কথা বাড়ালো না মেসবাহ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারও টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি দিল সে। অপরদিকে মেসবাহর দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর উল্লাসী উৎসাহী গলায় বললো,
-“আজও উনি এসেছিলেন।”
-“কে?”
-“ওই যে উনি। মুন্নি ভাবি।”
চোখমুখ কুঁচকে গেল মেসবাহর। টেলিভিশনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালো সে। কড়া গলায় বললো,
-“তুমিও আজও দরজা খুলেছিলে?”
-“হ্যাঁ.. উনি বেল বাজিয়েই যাবে আর বাজিয়েই যাবে! আর আমি ভেতরে থেকেও সাড়া দিব না?”
-“না, তুমি দেবে না। তোমাকে নিষেধ করিনি আমি?”
মেসবাহর মেজাজ খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে মুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। মেঝের দিকে চেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“আমার একা বাসায় ভয় করলে একটু সময় উনার সাথে কথা বললে কী এমন হবে?”
-“একা বাসায় তোমার ভয় করবে কেন? একা তো একা। ভয় দেখানোর মতো কেউ আছে কি?”
জবাব দিল না উল্লাসী। এক বেলা তরল তো এক বেলা কঠিন। এই লোককে বোঝা সত্যিই বড় দায়!
-“তাছাড়া দিনের বেলায় আবার কিসের ভয়? পৃথিবীর সব ভুতপ্রেত কি নিজেদের সব কাজকর্ম ফেলে সারাদিন তোমায় ভয় দেখানোর চাকরি নিয়ে রেখেছে?”
-“হ্যাঁ, আপনার চাকরি যেমন ডাক্তারগীরি করা তেমন ওদের চাকরিও ভুতগীরি করা।”
হঠাৎ উল্লাসীর এমন কথায় থেমে গেল মেসবাহ। একদন্ড নীরব থেকে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ভুতগীরিটা কী?”
-“কেনো জানেন না? ভুতগীরি হলো ভয়দেখানো। ভুতের একমাত্র কাজ। আমাদের ভয় দেখাতে সফল হলেই তো ওদের সরদার খুশি হয়ে ওদের টাকা দেয়।”
উল্লাসীর ভুতগীরির সঙ্গা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মেসবাহ। এই মেয়ে পারেও বটে!
-“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন না?”
ঠোঁট চেপে হাসি থামানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হাসতে হাসতেই মেসবাহ জবাব দিল,
-“করি তো।”
-“তাহলে শুধুশুধু হাসছেন কেনো?”
-“কোথায় হাসছি? হাসছি না তো!”
-“এই তো.. এই যে হাসছেন!”
হাসির বেগ আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে দিল মেসবাহ। মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দর এক সঙ্গা দিয়েছে ভুতগীরির!

-“এই মেসবাহ.. এই দাঁড়াও।”
সিগারেট কিনতে নিচে এসেছিল মেসবাহ। হঠাৎ পেছন থেকে মহিলা কন্ঠের কারো ডাক শুনে থেমে গেল সে। ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে উঠলো তার সামনে লিমনের ভাষ্যমতের ভুড়িওয়ালা ভাবির ছবি। খানিকটা অস্বস্তি হলো তার। এই মহিলা কেনো ডাকছে তাকে? উল্লাসী আবার উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেনি তো!
-“কেমন আছো?”
-“জ্বি, ভালো। আপনি ভালো?”
-“আছি কোনোরকম! জানোই তো.. একদম সময় দেয় না তোমার ভাই আমায়।”
কী বলবে ভেবে পেল না মেসবাহ। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
-“আপনি এখানে কেনো? কোনো কাজে এসেছেন?”
-“হ্যাঁ.. মাসের বাজার নিতে এসেছিলাম। শফিক আছে না? ওর দোকান থেকেই নেই। তা তুমি কোত্থেকে নাও?”
-“ওখান থেকেই।”
-“ভালো করো। ছেলেটা বেশ ভালো।”
-“হুম..”
মেসবাহর দিকে কিছুটা এগিয়ে এল মুন্নি সরকার। গলা খানিকটা নামিয়ে বললো,
-“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। এখানে দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে। আসলে সব কথাই তো আর উল্লাসীর সামনে বলা যায় না!”
জোর করে ঠোঁটে হাসি ফোঁটালো মেসবাহ। হালকা মাথা নেড়ে বললো,
-“জ্বি..”
-“আমার ভাইকে তুমি তো দেখেছো। কেমন লেগেছে উনাকে তোমার?”
ঠিক মনে করতে পারলো না মেসবাহ। তবুও এক গাল হেসে সে বললো,
-“খুবই ভালো।”
-“আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তো সব হয়েই গেলো। উল্লাসীর সঙ্গে…”
কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ মাঝপথে হাসান সরকার এসে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকারকে। তার কাঁধে হাত রেখে হাসান সরকার বললো,
-“তুমি যে চুলোয় তরকারি দিয়ে বেরিয়েছিলে তা তো পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। কী একটা অবস্থা! তাড়াতাড়ি চলো..”
-“আমি তরকারি কখন চড়ালাম? তুমি ভুল ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওনি তো? আমি ফেইসবুকে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। ফোন টিপতে টিপতে কোনো হুশ না পেয়ে অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল এক লোক!”
-“না না.. তুমি এসো তো। মেসবাহ তুমি যাও। পরে দেখা হবে।”
একরকম জোরপূর্বক মুন্নি সরকারকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরলো হাসান সরকার। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“এক গ্লাস পানি দাও।”
-“বিষ দিব বিষ? বিষ খাবা?”
-“আপাতত পানি…”
-“তোমার পানির মাইরে বাপ। তুমি মিথ্যে বলে আমাকে নিয়ে আসলে কেনো?”
-“তো কী করতাম? দেখা নেই শোনা নেই! দুইদিনের দেখায় একটি মেয়েকে কিভাবে নিজের ভাইয়ের জন্য ঠিক করো তা আমার মাথায় আসে না!”
ফুঁসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“যথেষ্ট দেখাশোনা হয়েছে। এই মুন্নি সরকারের চোখ একবার দেখেই সব বুঝে ফেলে। তুমি আসলে আমার ভাইয়ের সুন্দরী একটা বউ হোক তা চাওনা! কারণ কী বলো তো? আবার নিজেই উল্লাসীকে বিয়ে করার পায়তারা করছো না তো!”
কপাল চাপড়ে সোফায় শরীর মেলে দিল হাসান সরকার। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
-“চাইলেই বা ক্ষতি কী? অন্তত পাগলের হাত থেকে তো বাঁচা যাবে!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here