#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৫
কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে মেসবাহ। রাগের মাথায় সত্যিটা এভাবে বলে দিল সে? একবারো ভাবলো না পরবর্তীতে এটি কতবড় আকার ধারণ করবে? সাথে ফলস্বরূপ বাঁশ বাগান তো রয়েছেই। কপালের ঘাম মুছে সোফায় বসে পড়লো সে। করুণ দৃষ্টিতে তাকালো মুন্নি সরকারের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যে তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে।
-“উল্লাসী তোমার বউ?”
মুন্নি সরকারের কথার পিঠে কোনো জবাব দিল না মেসবাহ। ভাবতে লাগলো ভয়ংকর এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার একটি উপায়…
-“কথা বলছো না কেনো? উল্লাসী তোমার বউ?”
-“জ্বি..”
-“তাহলে এতদিন বউকে বোন বলেছো কেনো?”
ঢোক গিলে পরিস্থিতি সামলাতে আবারও উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। গলা খাকড়ি দিয়ে সামান্য এগিয়ে এল মুন্নি সরকারের দিকে। তারপর স্থির গলায় বললো,
-“বোন বলিনি। দুঃসম্পর্কের বোন বলেছি। দুঃসম্পর্কের বোনও তো মাঝেমাঝে বউ হয়। তাই না?”
-“হলে হয়। তবে তুমি মিথ্যে বলেছো। সকলের কাছে নিজের বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছো।”
-“আলাদা করে আমি কারো সাথেই উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেইনি আপনি ছাড়া। আপনার জোরাজুরির সাথে না পেরে উঠে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আর বাদবাকি ছড়ানোর কাজটা আপনি করেছেন। তাহলে এখানে মিথ্যে কে বলেছে.. বলুন?”
ফুসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“একদম কনফিউজড করো না আমাকে। একদম না। এই আম্মা ওঠো তো। এসবের শেষ আজ আমিই দেখেই ছাড়বো।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে শায়লা বেগম বললেন,
-“তুই চুপ করতো। তোরে বারবার আমি কইছি, আগে ভালো করে খোঁজ খবর নে। কিন্তু তুই শুনলে তো! প্রত্যেক বিষয়েই এত নাচানাচি করলে চলে?”
-“না চললে নাই। মেসবাহর মনের ভেতর কি আমি বসে রইছিলাম যে ওর মিথ্যে কথা আমি ধরতে পারবো?”
পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“আমি তো মিথ্যে বলিনি।”
-“আবারও বলছো মিথ্যা বলোনি?”
-“হ্যাঁ.. উল্লাসী আমার দুঃসম্পর্কের বোনও হয়।”
-“তো? বিয়ের পর বউকে তুমি বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিবা?”
আবারও কপালের ঘাম মুছলো মেসবাহ। এ কেমন অবস্থায় পড়লো সে! কী দরকার ছিল উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করে দেয়ার? সত্যিটা বললে আর যাই হোক আজকের মতো পরিস্থিতিতে তো পড়তে হতো না!
-“বিয়েই তো আমাদের হয়নি। না মানে গ্রামে হয়েছে। এখানে তো হয়নি। তাই গ্রামে উল্লাসী আমার বউ। আর এখানে দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“মানে? তুমি আবারও আমাকে কনফিউজড করছো!”
-“মোটেও না, ভাবি। এই যেমন ধরেন আপনি হাসান ভাইয়ের ওয়াইফ। কিন্তু আপনারা বিয়ের আগে একে অপরকে চিনতেন না। তাই বিয়ের পর আগের সেই পরিচয় নিজেদের মাঝে বাঁচিয়েও রাখতে পারলেন না। কিন্তু এদিকে আমি আর উল্লাসী তো দুঃসম্পর্কের ভাইবোন। তাই না? তাই আমরা সেই সম্পর্কের ছিটেফোঁটা নতুন জীবনে হালকার উপর ঝাপসা হলেও রাখার চেষ্টায় আছি। বলুন, ঠিক করছি না?”
বিষয়টি বোধগম্য হলো না মুন্নি সরকারের। চিন্তিত মুখে সে বললো,
-“হ্যাঁ.. তবে বউকে বোন?”
-“বোন না বোন না। দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“ওই হলো! উহু.. কোথাও ঘাপলা আছে। অবশ্যই আছে। সত্যিটা বলো মেসবাহ। আসল কাহিনী কী?”
মুন্নি সরকারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চুপ করানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিপাকে পড়লো মেসবাহ। আকাশ পাতাল ভেবেও এর জবাব না পেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“এক সেকেন্ড! একটু ওয়াশরুমে যাবো আর আসবো। আপনি যাবেন না। বসুন। আমি আসছি।”
কোনোরকম দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে লিমনের নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। দুইবারের মতো রিং বাজতেই ওপাশ থেকে লিমন ফোন ধরতেই তাকে সংক্ষেপে সবটা খুলে বললো সে। তারপর অস্থির গলায় বললো,
-“কী করবো এখন?”
-“আমি আগেই বলছিলাম তোরে! কী দরকার ছিল এসব বলার?”
-“এখন ওসব ভেবে হবে টা কী? এই মহিলাকে কিভাবে চুপ রাখবো সেটা বল। নয়তো এই মহিলা আমার মানসম্মান আর কিছু রাখবে না। পুরো সোসাইটিতে ব্যাপারটি নানানভাবে ছড়িয়ে দেবে।”
-“সময় দে একটু..”
-“সেই সময়টাই তো নেই।”
একদন্ড ভেবে লিমন ফোনের ওপাশ থেকে শীতল কন্ঠে বললো,
-“সময় যেহেতু নেই সেহেতু কমন কাহিনীই শুনিয়ে দে। সময় থাকলে না হয় আনকমন কিছে ভেবে দিতাম!”
-“কমন কাহিনীটাই কী?”
-“তুই উল্লাসী একে অপরকে পছন্দ করিস। কিন্তু উল্লাসীর বাবা ছোট মেয়ে বিয়ে দেবে না। প্লাস ওর বাবা গ্রামের সনামধন্য একজন ব্যক্তি। অনেক পাওয়ার আছে। তাই কোনো উপায় না পেয়ে তুই উল্লাসীরে নিয়ে ভাগছিস।”
লিমনের কথা শুনে বিস্ময়ের শেখরে পৌঁছে গেল মেসবাহ।
-“অসম্ভব!”
-“সম্ভব।”
-“মোটেও আমি এই কাজ করবো না। এতে আমার মানসম্মান যা আছে তার কাণিকোণাও আর থাকবে না।”
-“আরে শালা! প্রেম পিরিত খারাপ জিনিস না। বউকে বোন বানানোর তোমার এই অপকর্মের কথা ঢাকতে আপাতত একটা টপিক দরকার। আর আমার মনে হয়না এরচেয়ে বেটার অপশন পাবি।”
-“আমি পারবো না।”
-“না পারলে যা! পুরো সোসাইটির কাছ থেকে লুচ্চা উপাধি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যা।”
মেসবাহর স্থানত্যাগের পর থেকেই উল্লাসীর উপর প্রশ্নের হাঁড়ি খুলে বসেছে মুন্নি সরকার৷ একেরপর এক প্রশ্ন করে মেয়েটির কাছ থেকে কিছু জানতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। মেয়েটি জানিনা বিহীন মুখ থেকে কোনো আওয়াজই বের করছে না। ধৈর্যচ্যুত হয়ে আবারও সোফায় বসে পড়লো মুন্নি সরকার। অশান্ত গলায় বললো,
-“মেসবাহ তোমার স্বামী হয়?”
-“জানিনা..”
-“তো জানোটা কী?”
-“জানিনা..”
আগমন ঘটলো মেসবাহর। ঠান্ডা মাথায় উল্লাসীর পাশে দাঁড়িয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলো সে লিমনের বানানো মিথ্যা গল্প। সবশুনে মুন্নি সরকার ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কিন্তু তুমি তো প্রতিষ্ঠিত একজন ছেলে। তোমার সাথে বিয়ে দিতে কী সমস্যা?”
-“উল্লাসীর তো বিয়ের বয়স হয়নি ভাবি।”
-“গ্রামেও এমন চিন্তাধারার মানুষ আছে?”
-“থাকবে না কেনো? অবশ্যই আছে। তাছাড়া ওর মা তো ঢাকাতেই মানুষ। উনার চিন্তাধারা অন্য পর্যায়ের।”
-“অহ.. কিন্তু আমার মাথায় এটা আসছে না, তুমি মেসবাহ কী করে এত ছোট এক মেয়ের প্রেম পড়লে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসবাহ জবাব দিল,
-“আপনার যেমন এক দেখাতেই ওকে মনে ধরেছিল তেমন আমারও ধরেছিল। সুন্দর মেয়ে। অবুঝ মন.. ভাবি।”
সন্তুষ্ট হলো না মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উল্লাসীর দিকে ছুঁড়ে বললো,
-“তাই বলে বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে?”
-“আরে ভাবি! বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে সোসাইটির সবাই জেনে যেত না? এটা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় হতো, নানান আলোচনা হতো। আর যা ওর বাবার কাছে পৌঁছুতেই বেশি সময় লাগতো না। বোঝেনিই তো! পাওয়ারের ব্যাপার। এজন্যই চুপচাপে ছিলাম। তবে একটি মেয়ে যেহেতু নিয়ে এসেছি সেহেতু পরিচয় তো দিতেই হবে। তাই আরকি দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া।”
-“তা ঠিকাছে। কিন্তু ওর বাবা কি তোমার ঠিকানা জানে না? বা কোন হসপিটালে বসো তা জানে না? তার ক্লু ধরেই তো মেয়েকে নিতে এতদিন এখানে এসে পড়বার কথা!”
টনক নড়লো মেসবাহর। যুক্তিযুক্ত একটি প্রশ্ন। এবং প্রশ্নটির কাছে লিমনের দুই পয়সার গল্পটি হার মানতে বাধ্য। মহিলার মাথায় গোবর নয় বরং খাটি সোনা রয়েছে। অদ্ভুত ভুলভাল একটি কাহিনী তার হাতে ধরিয়ে দিলেও সে তার লেজ টেনে ধরেই সত্যতা যাচাই করে নিচ্ছে। আরও একটি দীর্ঘশ্বাস বুকচিরে বেরিয়ে এল মেসবাহর। পরিস্থিতি সামলাতে সে বললো,
-“এখানে আপন বলতে আমার কেউ নেই ভাবি। শুধুমাত্র আপনাকে এবং হাসান ভাইকে আমি কাছের মানুষ মনে করি। আপন মনে করি। আপনার সাথে কাল রাতে এবং কিছুক্ষণ আগে যে ব্যবহার করেছি এর জন্য আমায় ক্ষমা করুন। আসলে মাথা ঠিক ছিল না। ভাবি আপনিই বলেন! কেউ যদি আপনাকেই এসে অন্য মেয়ের সঙ্গে হাসান ভাইয়ের বিয়ে প্রস্তাব দেয়.. তা আপনি চুপচাপ মেনে নিতে পারবেন?”
-“অসম্ভব! তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তবেই আমি মানবো। তুমি ভুল কিছু করোনি। একদম ঠিক করেছো।”
-“বোঝার জন্য ধন্যবাদ ভাবি। আমাকে আপনি না বুঝলে আর কে বুঝবে বলুন!”
-“সেটাই তো। তা তোমরা পালিয়ে আসার পর বিয়ে করেছো তো?”
-“হ্যাঁ.. করেছিলাম। এই উল্লাসী, আমরা বিয়ে করেছিলাম না?”
উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। মেয়েটি চোখেমুখে একরাশ আতংক নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পাশে। মায়া হচ্ছে তার মেয়েটির জন্য। স্বল্প বয়সের এই জীবনে কত মিথ্যার না সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে! তবে আপাতত মিথ্যা ছাড়া সত্য বললে নারীবাদী লোকেরা তাকে পিটিয়ে ছাড়বে। অসৎ চরিত্রের লোক, নারী নির্যাতনকারী এমনকি নারী পাচারকারীর খাতায় নাম ফেলতেও এদের দু’দন্ড লাগবে না। তবে সে আবারও একই ভুল করছে। সম্মান বাঁচানোর ধান্দায় আরও একটি নতুন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। পূর্বের মিথ্যা নিয়েই যেখানে জান রফাদফা হয়ে যাচ্ছে সেখানে নতুন এই মিথ্যা নিয়ে কতদূর এগুতে পারবে সে! প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে।
সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো না মেসবাহ। উল্লাসীর কোচিং-এ আজ তাকে নিয়ে কথা বলতে যাবার জন্য হাসপাতাল ছেড়ে আসলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে বাসা ছেড়ে না বেরুনোই শ্রেয় মনে হলো তার। দুপুরে নানান কথা বলে কোনোমতে বুঝিয়ে শুঝিয়ে মুন্নি সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেলেও অস্থিরতা তার একবিন্দুও কমছে না। বরং সময় বাড়ার সাথেসাথে তা ক্রমে বাড়ছে। মহিলা নিশ্চিত এতক্ষণে পুরো সোসাইটিতে কথা ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে কথা কিভাবে ছড়িয়েছে ভালো না মন্দ.. তা কেবল সেই জানে! তবে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।
-“আপনার চা..”
চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল মেসবাহ। তারপর তাতে একবার চুমুক দিয়ে বললো,
-“আমাকে কি খুব খারাপ একজন মানুষ মনে হয় তোমার?”
-“উহু…”
-“সত্যি করে বলো।”
একমুহূর্ত ভেবে উল্লাসী বললো,
-“আপনাকে আমি বুঝি না। মাঝেমাঝে চেষ্টা করি, তবে আমার এই ছোট মাথায় আপনাকে ঢোকাতে পারি না।”
মৃদু হেসে আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিল মেসবাহ। মাঝেমাঝে মেয়েটি সহজ সরল, মাঝেমাঝে মেয়েটি চঞ্চল, আবার মাঝেমাঝে একেবারেই নীরব। তবে যেমনই হোক, মন্দ নয়। যার সঙ্গে বেশ সুখে-শান্তিতেই দিনের পর দিন পাড় করা যায়। তবে মেয়েটি যে ছোট! হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো মেসবাহর। ভ্রু কুঁচকে সে পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকাতেই উঠে পড়লো উল্লাসী। ধীর পায়ে এগুলো সদর দরজার দিকে। এবং দরজা খোলামাত্র হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো মুন্নি সরকার সহ কিছু মহিলা। মুখে তাদের অজস্র হাসি।
-“এই তোমার শাড়ি আছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় শাড়ি টাড়ি এনেছিলে কী?”
মুন্নি সরকারের প্রশ্নের জবাবে মুখ ঘুরিয়ে মেসবাহর দিকে তাকালো উল্লাসী। শাড়ি তো তার আছেই৷ তবে বলে দিলে যদি উনি রেগে যান!
-“ওর দিকে তাকাচ্ছো কেন? আর মেসবাহ তুমিও যাও। পাঞ্জাবি পড়ে তৈরি হয়ে নাও।”
পুরো ব্যাপার বুঝে উঠতে পারলো না মেসবাহ। এভাবে মুন্নি সরকার তার দলবল নিয়ে বাসায় ঢোকার সাথেসাথেই তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। তবে পরবর্তীতে সকলের মুখে হাসি দেখে অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমেছিল। কিন্তু এসব কী? হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো পড়বে সে?
-“নাকি তোমার বউয়ের মতো তোমারও পাঞ্জাবি নেই!”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো উপস্থিত সকলেই। তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“আছে। কিন্তু হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো?”
-“তো কী পড়ে বিয়ে করতে চাও তুমি? টিশার্ট পড়ে?”
কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। প্রশ্নসূচক চোখে মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কিসের বিয়ে?”
-“তোমার আর উল্লাসীর।”
-“আমাদের বিয়ে তো হয়েই গেছে।”
-“বেশ ভালো কথা। তাহলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে তো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। তাছাড়া আমাকে যেহেতু কাছের মানুষ ভাবো.. সেহেতু আমার কথাটা রাখো। আমাদের সকলের সামনে আবারও বিয়েটা করে ফেলো। আমি সবাইকেই তোমার সমস্যার কথা বলেছি। আমরা আছি তোমাদের পাশে। উল্লাসীকে কেউ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। আর না উল্লাসীর বাবার ভয়ে তোমার নিজের বউকে দুঃসম্পর্কের বোন বলতে হবে!”
আবারও উপস্থিত সকলেই খিলখিল করে হেসে উঠতেই তাদেরকে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। মেসবাহকে তাড়া দিতে বললো,
-“হাসানকে পাঠিয়েছি কাজী ডাকতে। এলো বুঝি ও! যাও তাড়াতাড়ি তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমরা এদিকে উল্লাসীকে তৈরি করে দেই। বাচ্চা মেয়ে! সবটা সামলে নিতে পারবে না।”
নড়লো না মেসবাহ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। নতুন বলা মিথ্যেটি আবারও কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে?
পুরো ফ্ল্যাটজুড়ে লোকজনের সমাগমে গমগম করছে। কিছুক্ষণ হলোই পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে এসে বরবেশে নীরবে বসে সকলের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে যাচ্ছে মেসবাহ। বিয়ে করা বউকে আরো একটিবার বিয়ে করাই যায়। এ আর তেমন কী কঠিন কাজ! তবে একটি বিষয় প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে। যে মেয়েকে কিছুদিন আগেই একরকম বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছে সে, ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাকে আরও একটিবার বিয়ে করতে হচ্ছে। তবে সেদিনের মাঝে এবং আজকের মাঝে প্রচুর তফাৎ। সেদিন মনে বাবাকে নিয়ে একরাশ ভয় কাজ করলেও আজ তা কাজ করছে না। আজ শুধুই কাজ করছে একরাশ ভালোলাগা। উপভোগ করছে সে সময়টিকে। যদিও খানিকক্ষণ আগে এর ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। হ্যাঁ, সে মুখোমুখি হতে চায়। দেখতে চায়, এবারের বলা মিথ্যেটি কোথায় নিয়ে যায় তাকে।
-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসী, আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখের সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।”
আঁড়চোখে পাশে বসা উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি পড়েছে সে। মাথায় গুঁজে দিয়েছে ঘোমটা। যার দরুন উল্লাসীর মুখটা নজরে আসছে না তার। কী চলছে মেয়েটি মনে? নিশ্চয় ভয় পাচ্ছে সে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে সকলের চোখের অগোচরে উল্লাসীর হাত আঁকড়ে ধরলো মেসবাহ। তারপর তাতে হালকা চেপে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“বলো, উল্লাসী। আমি তো আছিই।”
ভরসার হাতের সন্ধান পেয়ে মনের ভেতরে চলা আতংক কমে গেল উল্লাসীর। জোরে চেপে ধরলো সে মেসবাহর হাত। তারপর ধীর গলায় বললো,
-“কবুল..”
মেয়ের মুখে তিনবার কবুল শুনে এবারে কাজী এলেন মেসবাহর দিকে। সময় নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,
-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখ, রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসীর সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।
সময় নিল না মেসবাহ। সাথেসাথেই জোর গলায় বললো,
-“কবুল স্কয়ার। কিন্তু কাজী সাহেব মাইনাসে মাইনাসে যেমন ‘প্লাস’ হয়ে যায় তেমন এক মেয়েকে দুইবার বিয়ে করলে কবুলে কবুলে কি তা ‘না কবুল’ হয়? বা বিয়ে ভেঙে যাবার কোনো চান্স থাকে?”
(চলবে)