নিরবতা পর্ব-১

0
8321

-“পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছি কী ক্লাস এইটের মেয়ে বিয়ে করার জন্য?”
-“তা আমি কি করে বলবো! তোর মন তুই ভালো জানিস।”
-“আম্মা প্লিজ কথা ঘুরাবে না।”
ছেলের কথায় চোখমুখ কুঁচকে বিছানায় বসলেন মোরশেদা বেগম। চিন্তিত মুখে বললেন,
-“এখন এইমুহূর্তে এসব কথা কেনো উঠছে? তোর আব্বা যা ঠিক করেছে অবশ্যই তা ঠিকভুল বিবেচনা করেই করছে।”
-“এটাই তোমাদের ঠিক? আমি, যে কিনা দেশের বাইরে থেকে পড়ে এসেছি সে শুধুমাত্র তোমাদের উপর সম্মান রেখে তোমাদের পছন্দমতো গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তাই বলে ক্লাস এইটের একটা বাচ্চা মেয়ে? আম্মা, তোমার বিবেকে বাধছে না?”
-“না, বাধছে না। বড়টার জন্য তো বেশ পড়ুয়া ভালো ঘরের মেয়েই আনা হয়েছিল। আজ কই সে? তোর ভাইয়ের কপালে পাঁচ লাথি বসিয়ে অন্য ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে তার তো বুক কাঁপেনি। তোর ভাইয়ের কথা না হয় নাই ভাবলো.. নিজের নাড়ি ছেড়া ধনকেও ফেলে যেতে বেহায়া মেয়ে দু’বার ভাবেনি। আসলে এসব মেয়েদের বুক-পিঠ নেই। সব পারে এরা.. সব।”
-“ভাবিকে এর মাঝে কেনো টানছো? তাছাড়া দুনিয়ার সব মেয়েই তো আর ভাবির মতো হবে না।”
-“তর্ক করিস না, মেসবাহ। রেডি হয়ে নিচে আয়। অর্পা হলুদ নিয়ে অপেক্ষা করছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে, এখন আর কিছুই করার নেই তার। তার মা কোনোভাবেই তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে টু শব্দ করবে না। শুধু মা নয়, এবাড়িতে কারোই সেই সাহস নেই। তবে কিছু একটা করা উচিৎ। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থেকে অজপাড়াগাঁর বাচ্চা এক মেয়েকে বিয়ে করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া মেয়েদের অবস্থাও তো একবার দেখা উচিৎ। পড়াশোনার খাতিরে দেশ বিদেশে তার বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। বিয়ের খবর পেলেই সকলে ঘাড়ে চেঁপে বসবে তার শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াতের জন্য। তখন কোন মুখে ওই ছোট্ট দু’ঘরের ছাপড়ায় নিয়ে যাবে তাদের? কপালের ঘাম মুছে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। চিন্তিত মনে আবারও ফিরে এল বিছানায়। মোরশেদা বেগম এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন বেশ খানিক্ষন হলো। তবে তার সেই সুগন্ধি পানের ঘ্রাণ এখনো রয়েই গেছে। পানের এই ঘ্রাণ পেলেই মাকে খুব করে মনে পড়ে তার। পেশার খাতিরে তার নানান শ্রেণির লোকের সাথে উঠাবসা হয়। তবে তার মায়ের মত পানের ঘ্রাণ এখনো কোথাও পায়নি সে। এ যেন উপরওয়ালা শুধু তার মায়ের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছেন! মৃদু হেসে মেসবাহ বিছানায় শরীর মেলে দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই তার সামনে ভেসে উঠলো তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম। ছোট বেলা থেকেই যার কাজ নিজের সকল দোষ তার উপরে চাপিয়ে দেয়া। -“বিয়ে তাইলে করেই ফেললি!”
-“করার তো ইচ্ছে নেই। তবে ভাবসাব তো বলছে বিয়ে আমার হয়েই যাচ্ছে।”
-“শালা প্যাচাইস না। ঝেড়ে কাশ।”
ঘরের বাইরের দিকে নজর দিল মেসবাহ। তারপর হালকা কেশে বললো,
-“এসেছি কাল রাত দু’টোর পর। ভাবলাম অনেকদিন পর জব্বব একটা ঘুম দিব। কিন্তু ভোর না হতেই আব্বার চেচামেচিতে ঘুম গেল আমার আকাশে। উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে বসতেই আব্বা জানালেন, আমার মেয়েকে একবার দেখে আসতে হবে এবং তা এখনি। আমি দ্বিমত জানিয়ে বললাম, কোনো দরকার নেই। আপনি তো দেখেছেনই। তাতেই হবে। তবে কে শোনে কার কথা! যাকগে.. অবশেষে গেলাম মেয়ে দেখতে।”
-“আচ্ছা.. তারপর?”
-“তারপর তো তারপরই। আমি হতবাক! এনি আইডিয়া আমার হবু বউ কীসে পড়ে? ক্লাস এইটেরে… ক্লাস এইটে।”
খানিকক্ষণ থেমে ওপাশ থেকে লিমন বললো,
-“আর ইউ কিডিং মি?”
-“উহু.. আই অ্যাম সিরিয়াস।”
-“তাইলে তো ভালোই.. কচি মেয়ে পাচ্ছিস। একদম কচি। সেইরাম খেলা হবে।”
-“এত কচি মেয়ে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোর শখ হলে না হয় তুইই রাখ সেইরাম খেলার জন্য।”
মেসবাহর কথা শেষ হতেই গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করলো লিমন। যেনো এর চেয়ে হাস্যকর কথা তার জীবনে শোনেনি সে।
-“এই তুই বন্ধু? চিন্তায় চিন্তায় আমি কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। আর তুই নির্দ্বিধায় হেসেই যাচ্ছিস!”
-“কী করবো বল? তোর যে বাপ! তার উপরে কারো সাধ্য আছে কিছু বলার? বাপ তো না যেনো আগুনের গোলা। কেউ কিছু বলতে গেলে তার আগুনের গোলার মাঝে থেকে এক মুঠো আগুন ছুঁড়ে দুনিয়া ছেড়ে তাকে পরকালের রাস্তা ধরিয়ে দেবে।”
বলে আবারও সমানতালে হাসতে শুরু করলো লিমন। তার হাসির জবাবে তাকে কড়া কিছু কথা শোনানোর ইচ্ছে থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়ে কল কেটে চোখজোড়া বুজলো মেসবাহ। আপাতত তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে হবে। পাঁচ ভাই বোনের মাঝে বড় ভাই মাজহারুল এবং বড় বোন অর্পাসহ তার নিজের তাদের বাবার মুখের উপরে কিছু বলার সাহস নেই। বাদ থাকলো মুবিন এবং অনা.. মুবিনের কথা বাবা উপেক্ষা করলেও অনার কথা ফেলার মত মন এখনো হয়ে উঠেনি তার। তাহলে কী একবার অনাকে দিয়েই চেষ্টা করিয়ে দেখবে? ভাবামাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। এগুলো লম্বা বারান্দা ধরে। দোতালার দক্ষিণের একদম কোণার ঘরেটি অনার। বেশ বড়সড় সেই ঘরটিতে বইপত্রের উপস্থিতি না মিললেও সাঁজগোঁজের জিনিসের অভাব নেই।

-“অপেক্ষা হলো শুদ্ধতম ভালোবাসার একটি চিহ্ন। সবাই ভালোবাসি বলতে পারে। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করে সেই ভালোবাসা প্রমাণ করতে পারে না…”
চৈতালির কথায় পাশ ফিরে তার হাতে হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসের বইটি দেখে কপাল কুঁচকে গেল অনার। হাতের কাজল রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে সে বললো,
-“তুই কবে এসব গল্প উপন্যাস পড়া বন্ধ করবি বল তো? এসব তোকে শুধু মধুর স্বপ্ন দেখাবে কিন্তু তোর বাস্তব জীবন এসবের মতো সুন্দর করে তুলতে পারবে না। তখন আফসোস বিহীন বিকল্প কিছু থাকবে না তোর জীবনে।”
বই থেকে চোখ না উঠিয়েই চৈতালি বললো,
-“আফসোস করতে কিন্তু আমার ভালোই লাগে। এই যেমন ধর, আমি তোর মতো সুন্দরী হতে পারলাম না এই আফসোস আমার আজীবনই রয়ে যাবে।”
-“মজা করছিস?”
-“মোটেও না।”
ঠোঁট বাকিয়ে অনা বললো,
-“সৌন্দর্যের উদাহরণ দিতে গেলে সকলেই সেখানে তোকে টানে। এখন বল.. এনিয়ে কী বলার আছে তোর?”
বই বন্ধ করে অনার দিকে তাকালো চৈতালি। মিটিমিটি হেসে সে বললো,
-“অনেক কিছু বলার আছে আমার। শুনতে চাস? তাহলে কাছে আয়। আমার কপাল ছুঁয়ে দেখা।”
বলেই দৌড়ে ঘরের বাইরের দিকে এগুলো চৈতালি। ইশ! মেয়েটি কী দারুণ রূপবতী! কোমর সমান কোঁকড়াচুল নিয়ে যখন দৌড়ানো শুরু করলো তখন এক পলক দেখে মনে হচ্ছিল রূপকথার রাজ্য ছেড়ে কোনো পরী যেনো নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়ে জন্মালে নির্ঘাত এই মেয়ের প্রেমে পড়ে এতদিনে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেত। ভেবে মুচকি হেসে অনাও দৌড়ে এগুলো চৈতালির পিছুপিছু। আজ তাকে চৈতালির কপাল ছুঁতেই হবে। মেয়েটি এভাবে একেকদিন একেক খেলা দিয়ে তাকে হারিয়ে দিতে পারবে না। কখনোই না..

-“এই অনা? এভাবে কোথায় যাচ্ছিস? দৌড়াচ্ছিস কেন? কথা আছে তোর সাথে। দাঁড়া না!”
মেসবাহর ডাকে থেমে গেল চৈতালি। পেছন ফিরে অনাকে দেখামাত্রই সে ঠোঁট টিপে হেসে তার সামনে দাঁড়ানো মেসবাহর উদ্দেশ্যে বললো,
-“বরকে বর বর লাগছে না। কিছু একটা কম কম লাগছে। কী হতে পারে? মুখের হাসি নয় তো?”
-“কচু.. আমার ভাইকে সবসময়ই বর বর লাগে। তার বিয়ে থাকুক বা না থাকুক।”
খিলখিল করে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। তাদের দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“শুধুশুধু হাসবি না। কথা আছে তোর সাথে। ঘরে আয়।”
অনা বললো,
-“বয়েই গেছে আমার! তোমার কথা থাকলে তুমি আসবে আমার ঘরে। আমি কেনো যাবো?”
-“আচ্ছা। তোর যেতে হবে না। চল, তোর ঘরেই চল।”
মেসবাহর কথা শেষ হতেই চৈতালির কপাল ছুঁয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে এগুলো অনা। কেনো যেনো প্রচুর আনন্দ হচ্ছে তার। কেন? চৈতালির খেলায় সে জিততে পেরেছে বলে?

-“তোর ওই মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?”
-“কোন মেয়ে?”
-“আমার সঙ্গে যার বিয়ে। কী যেন নাম…”
-“উল্লাসী..”
বোনের কথার পিঠে কিছু বললো না মেসবাহ। অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে তার মন। উল্লাসী আবার কেমন নাম? এমন নামও বুঝি মানুষের হয়?
-“আমার তো খারাপ লাগেনি। তবে অনেক ছোট। আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।”
-“এটাই তো সমস্যা। তুই জাস্ট ভাব তাহলে আমাদের মাঝে বয়সের পার্থক্য ঠিক কত হতে পারে! তবে এসব কথা আব্বাকে কে বোঝাবে? সে তো কিছু শুনতেই নারাজ।”
চিন্তিত গলায় অনা বললো,
-“এসব আমাকে কেনো বলছো? নিশ্চিত আমাকে আব্বার কাছে পাঠানোর পায়তারা করছো তুমি!”
-“তুই তো আমার একমাত্র ছোট আদরের বোন। তুই না বুঝলে এসব আর কে বুঝবে বল?”
-“অসম্ভব। আমি এসব নিয়ে আব্বার সাথে কথা বলতে পারবো না।”
বোনের হাত চেপে ধরলো মেসবাহ। অসহায় গলায় বললো,
-“প্লিজ.. তুই আমার শেষ ভরসা।”
ভাইয়ের হাতের মাঝ থেকে হাত ছাড়িয়ে দরজার দিকে এগুতে এগুতে অনা বললো,
-“এতবড় একটি বিষয় নিয়ে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমি পারবোও না কিছু বলতে। তোমার বিয়েতে অমত থাকলে তুমি আব্বাকে সব খুলে বলো। আব্বা এতটাও পাষাণ না যে তোমার সমস্যা বোঝার চেষ্টা করবে না।”
অনা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই হতাশ মনে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। উল্লাসী নামের মেয়েটির চেহারা বারবার ভেসে উঠছে তার সামনে। বাচ্চাসুলভ আচরণ তার মাঝে আছে কিনা তা জানা নেই। তবে মেয়েটির দুধে আলতা গায়ের রঙের মাঝে চিকন স্বাস্থ্যের লম্বা চওড়া গড়নের চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা ভাব রয়েছে। বড় বড় দুটি চোখ, তড়তড়া নাক, চিকন ঠোঁট যেনো তার বয়সের অপরিপক্কতা বোঝাতে উঠে পড়ে লেগেছে। তবে জোর করে মেয়েটি চলনে এক অস্বাভাবিক মন্থরতা এনেছে তার অপরিপক্কতা ঢাকার চেষ্টায়। যদিওবা তা আদৌ কোনো কাজে দিয়েছে বলে মনে হয়না। লম্বা কিছু দম ছেড়ে দরজা টেনে নিজের ঘরে ঢুকে টিশার্ট খুলে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে নিল মেসবাহ। তারপর খুব ধীরেসুস্থে এগুলো নিচতলার দিকে।

একটি পাটি বিছিয়ে তার সামনে হলুদ সহ নানান ফলমূল সাজিয়ে অপেক্ষা করছে অর্পা। তার পাশের চেয়ারে তিনবছরের মেয়ে মৌমিকে কোলে নিয়ে বসে বোনের কার্যক্রম দেখছে মাজহারুল। সাতমাসের বাচ্চাকে রেখে জ্যোতি যেদিন চলে গিয়েছিল মাজহারুলকে ফেলে সেদিন বুকটা ফেঁটে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল তার। শ্বাস নেয়া ভুলে গিয়েছিল, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তার। জ্যোতি কীভাবে পারলো এতবড় একটি পাপ করতে? বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। মেনে নিতে পারছিল না। দীর্ঘদিন যাবৎ বাস্তবতা ছেড়ে দূরে পালিয়ে বেরিয়েছে। তবে সবশেষে ছোট্ট মৌমির মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতে হয়েছে তাকে। কঠিন কিছু বাস্তবতা মেনে তাকে এগুতে হয়েছে পৃথিবীর বুকে। সব কিছুকে ভাষায় প্রকাশ করা গেলেও কষ্টকে তেমন একটা প্রকাশ করতে পারা যায় না। কারণ, কিছু কষ্ট থাকে যা কখনোই কাউকে বলা যায় না। নিজের মাঝেই চেপে রাখতে হয় দিনের পর দিন। আপন মানুষের দেয়া কষ্টও হয়তো এর মাঝেই একটি।

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here