নিরবতা পর্ব-৩

0
5441

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩

মাথার উপর ফুল স্পিডে ভনভনিয়ে ফ্যান চললেও কুল কুল করে ঘামছে উল্লাসী। তাকে ঘিরে চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। নতুন বউ দেখতে আসা পাড়ার মহিলাদের ভিড়ে গরমের তোপে একদম হাসফাস অবস্থা তার। অপরদিকে শাড়ি এবং গহনার ভাড়.. সবমিলিয়ে নিজেকে পুরো পাগল পাগল লাগছে। সব ছেড়ে ছুড়ে এক দৌড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে নিজের বাড়িতে। তবে সেখানেও বারণ রয়েছে। ছোটমা খুব ভালো করে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এবাড়িতে আসার পর কী কী করণীয় তার। এমন কোনো কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন যে কাজে এবাড়ির লোক অসন্তোষ হয়। তবে আপাতত কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার। চোখজোড়া জ্বলছে ফেলা আসা ছোট্ট বোনটির জন্য। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করছে। ছোট মা নিশ্চয়ই সুহাকে নানান জিনিস বলে কয়ে যত্নসহকারে খাওয়াবে না। তাহলে কী আজ পুরো রাত না খেয়েই কাটাবে সুহা?
-“বৌমা, এটা খাও।”
খুব কাছ থেকে এক মেয়েলী কণ্ঠস্বর কানে আসায় চোখজোড়া তুলে সামনে তাকাতেই বেশ বয়সী এক মহিলাকে দেখতে পেল উল্লাসী। তার দিকে ড্যাবডেবে চোখে তাকাতেই তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-“কী ব্যাপার? নাও। জামাইয়ের খাওয়া দুধ একটু হলেও খাইতে হয়।”
অর্ধপূর্ণ দুধের গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়ে তা এক চুমুক খেয়ে আবারও ফিরিয়ে দিল উল্লাসী। তারপর আঁড়চোখে পাশের মানুষটির দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটায় টিপটিপ করে উঠলো। বেশ উঁচু স্বাস্থ্যবান পুরুষই বলা চলে লোকটিকে। শ্যাম বর্ণের শরীরের রঙের সাথে মুখ ভর্তি খোঁচাখোঁচা কালো দাঁড়িতে তাকে দেখতে কোনো অংশে দানবের চেয়ে কম লাগছে না। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ লোকটির পাশে বসে থাকলেও চোখ উঁচিয়ে তাকে দেখার সাহস হয়ে উঠেছিল না। কোথাও একটি জড়তা কাজ করছিল।
-“ভাবি.. ও ভাবি। আমার ভাবি.. প্রাণের ভাবি। এটা খাও তো।”
চিন্তা রাজ্যের বেড়াজাল ছিঁড়ে বাস্তবে প্রবেশ করতেই মুখের সামনে একটি চামচ দেখতে পেয়ে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো উল্লাসী। এবাড়িতে আসার পর থেকেই এটাসেটা তাকে খাইয়েই যাচ্ছে সকলে। ছোটোমোটো এক পেটে এত খাবার আটবে কিনা তা একবারও ভেবে দেখছে না এরা। খানিকটা বিরক্ত হয়ে চামুচের খাবার মুখে পুড়তেই পুরো মুখ তেতো হয়ে উঠলো উল্লাসীর। চোখমুখ কুঁচকে চামচ আঁকড়ে ধরে তাকে খাইয়ে দেয়া মেয়েটির দিকে তাকাতেই হোহো করে হেসে উঠলো সে। তার দিকে বুড়ো আঙুল মেলে ধরে বললো,
-“লবণের গল্প পড়োনি? লবণের সেই ঐতিহাসিক গল্পের স্মৃতিচারণ করতেই তোমাকে সামান্য লবণ খাইয়ে দিলাম আরকি!”
পাশ থেকে তার সমবয়সী আরও একজন মেয়ে এসে বললো,
-“তুমিও না! এত বোকা মানুষ হয়? চিনি এবং লবণের মাঝেই পার্থক্য করতে পারো না?”
তাদের করা উপহাস উপেক্ষা করে উল্লাসী খুব কষ্টে মুখ ভর্তি লবণ গিলে ফেলতেই দরজা ঠেলে একগ্লাস পানি হাতে ঘরে প্রবেশ করলো অর্পা। অনা এবং চৈতালির করা কার্যকলাপে তাদের সামান্য ঝেড়ে সে এগিয়ে এল ভাই এবং ভাই বউয়ের দিকে। পানির গ্লাস ভাইয়ের বউয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“ইশ কী একটা অবস্থা! মেয়ে দুটো আচ্ছা পাজি হচ্ছে দিনকেদিন! আর মেসবাহ তুইও! দেখছিসই যে ওরা এসব করছে তখন ওদের নিষেধ করবি না?”
এপর্যায়ে মুখ খুললো মেসবাহ। গম্ভীর গলায় বললো,
-“আমি কী করে জানবো ওরা চিনি না লবণ খাওয়াচ্ছে!”
-“তাও তো কথা! এই উল্লাসী? কতটুকো খাইয়েছে রে? খারাপ লাগছে কী?”
অর্পার করা প্রশ্নে মাথা ঝাকালো উল্লাসী। যার অর্থ ঠিক বোধগম্য হলো না অর্পার। তবুও গলা হালকা প্রসস্থ করে ঘরে থাকা সকলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলতেই একেএকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ভিড় জমানো সকলে। তারপর ভাইয়ের হাত ধরে তাকে উঠিয়ে বাইরে টেনে এনে বললো,
-“তুই আপাতত বাইরে থাক। ঘরে আমার কিছু কাজ আছে। কাজ হয়ে গেলেই তোকে ডাকবো।”
-“ঠিকাছে।”
লম্বা বারান্দা ধরে সামনে এগুলো মেসবাহ। বুকের ভেতরটায় প্রচুর ছটফট করছে তার। মনে চলা কথাগুলো দ্রুত গতিতে বারবার কানে এসে ঠেকছে। এমনটা তার সঙ্গে শেষ কবে হয়েছিল মনে করার চেষ্টা করলো মেসবাহ। দেশ ছেড়ে প্রথম যেদিন পা রেখেছিল বিদেশের মাটিতে সেদিন ঠিক এমন অদ্ভুত অনুভূতিই হচ্ছিল তার সঙ্গে। নিজের দেশ ফেলে অচেনা অজানা এক দেশে পাড়ি জমানোয় অদ্ভুত এই অনুভূতি হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে আজ? আজ ঠিক কেনো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে?

বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। খানিকক্ষণ আগের গরমের সেই ভ্যাপসা ভাবটি এখন আর নেই। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পুরো ঘর শীতল করে তুলেছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা না হলেও বাতাসের তীব্রতার কারণে খানিকক্ষণ পরপর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে উল্লাসীর। সাথে মেঘের গর্জনে ভয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুহা কী করছে এখন? মেঘের ডাকে ভয় পাচ্ছে না তো? ভয় পেলেও কী ছোট মা তাকে নিজের বুকে চেপে ধরছে? যেমনটা সে পরম মমতায় বুকে আঁকড়ে ধরতো সুহাকে? হ্যাঁ.. ছোট মা কথা দিয়েছে তাকে। বিয়েটা করলে খোকনের মত সুহাকেও ভালোবাসবেন তিনি। তাহলে আজ নিশ্চয়ই সুহা এবং খোকন দুজনকে একসাথে বুকে আঁকড়ে নিয়ে বসে রয়েছেন ছোট মা।
-“তোমার নাম যেনো কী?”
পুরুষালী কন্ঠ কানে আসতেই সম্মুখে চাইলো উল্লাসী। কাঁপা গলায় জবাব দিল,
-“উল্লাসী।”
-“কে রেখেছে এই নাম?”
-“মা।”
-“তোমার মাকে তাহলে দেখতে হচ্ছে। অদ্ভুত এক নাম রেখেছেন উনি। উল্লাসী.. গ্রামের এক মহিলার মাথায় এমন নাম এল কী করে তা সত্যিই ভাবাচ্ছে আমায়।”
-“আমার মা গ্রামের ছিলেন না। উনার বাবার বাড়ি ঢাকায়। বাবাকে বিয়ে করার পর উনি গ্রামে এসেছেন।”
মেসবাহ একটি চেয়ার টেনে উল্লাসীর মুখোমুখি বসে বললো,
-“ইন্ট্রেস্টিং। লাভ কেস নাকি?”
-“হু..”
-“গ্রেট। কয় ভাইবোন তোমরা?”
প্রশ্নটি প্রচুর কষ্ট দেয় উল্লাসীকে। তবুও জবাব দিতে হয়। যেখানে সকল প্রশ্নের উত্তর আছে সেখানে তার এই প্রশ্নের উত্তর থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এ প্রশ্নটির উত্তর না থাকলেই হয়তোবা ভালো হতো।
-“তিন ভাই বোন।”
-“অহ.. চোখের কাজল লেপ্টে পুরো মুখ ছড়িয়ে গেছে তোমার। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো তুমি। ওপাশটায় ওয়াশরুম।”
মেসবাহ হাতের ইশারা করতেই বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে এগুলো উল্লাসী। লোকটি দেখতে দানব দানব হলেও কথা বলার ভঙ্গি অত্যন্ত মনোরম। ম্লান হেসে আয়নায় নিজের চেহারা দেখেই আঁতকে উঠলো উল্লাসী। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় কেঁদেছিল সে। বাবা এবং সুহাকে বুকে চেপে ধরে প্রচুর কেঁদেছিল। তবে তাতে কাজলের এত ভয়ংকর অবস্থা হবে তা মোটেও ধারণায় ছিল না তার। বালতিতে জমানো পানি থেকে একচোল পানি উঠিয়ে খুব দ্রুত চোখেমুখে দিল উল্লাসী। আশপাশে খুঁজে সাবানের সন্ধান না পেয়ে হতাশ হয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে কাজল মোছার কাজে লেগে পড়লো সে।

-“নীচে শুতে সমস্যা হবে না তো তোমার?”
গামছায় চোখমুখ মুছে মেঝেতে বিছানো চাদরের দিকে তাকিয়ে উল্লাসী ধীর গলায় বললো,
-“না..”
-“গুড। শুয়ে পড়ো এখানে।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে শরীর মেলে দিল মেসবাহ। সারাদিনের চিন্তা এবং ক্লান্তির চোটে ঘুমে চোখজোড়া আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার। তাই বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো সে। অপরদিকে খানিকক্ষণ গামছা হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকার পর অন্ধকার ঘরে হাতরিয়ে হাতরিয়ে সামনে এগুলো উল্লাসী। ছোটমার কথামতো স্বামীর একটি কথাও অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাতে উপরওয়ালা নারাজ হবে। শুধুশুধু উপরওয়ালাকে নারাজ করে কী লাভ? দীর্ঘশ্বাস ফেলে একদন্ড ভেবে পরণের শাড়ি খুলে তার ভেতর সকল গহনাদি খুলে তা মাথার কাছে রাখলো উল্লাসী। তারপর নিশ্চিন্তমনে নিদ্রার আয়োজন করলো। ভয় লাগছে তার। অচেনা এক বাড়িতে এই প্রথম একা রয়েছে সে। না সাথে আছে সুহা আর না বাবা…

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here