নিরবতা পর্ব-৭

0
3618

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৭

-“তুমি শাড়ি বদলে কামিজ পরে নাও। আমি এতক্ষণ তোমার বাসায় পরার জন্য আরও কিছু কামিজ দেখছি।”
উল্লাসীকে ট্রায়াল রুম দেখিয়ে আরও কিছু সালোয়ার কামিজ তার জন্য নিল মেসবাহ। তারপর ধীরেসুস্থে এগুলো ট্রায়াল রুমের দিকে। স্টেশন থেকে সরাসরি শপিংমলে এসেছে তারা। উল্লাসী যে সাজসজ্জায় ছিল তা নিয়ে বাসায় ঢুকলেই সকলের মনে সন্দেহ ঢুকে যেত। তাই কোনো উপায় না পেয়ে সরাসরি শপিংমলে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে।
-“শুনছেন? আমার হয়েছে।”
উল্লাসীর ডাকে পেছন ফিরে তাকে একনজর দেখলো মেসবাহ। তারপর শান্ত গলায় বললো,
-“কানের দুল খোলো.. সাথে গলার হারটাও।”
কোনো প্রশ্ন না করে কাঁপা হাতে উল্লাসী স্বর্ণের হার এবং দুল খুলে বাড়িয়ে ধরলো মেসবাহর দিকে। মেসবাহ সেগুলো নিয়ে একটি শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে বললো,
-“হাতের বালা দুটো খোলো।”
বাঁধ সাধলো উল্লাসী। বিয়ের আগে এই বালা তার হাতে পরিয়ে দেবার সময় ছোটমা বলে দিয়েছে, বিয়ের পর হাত কখনোই খালি রাখবি না। এতে স্বামীর অকল্যাণ হয়। আর একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে স্বামীর অকল্যাণ চাওয়া কোনো স্ত্রীর কাম্য নয়। একদন্ড ভেবে দু’কদম পিছিয়ে উল্লাসী বললো,
-“আপনার অকল্যাণ হবে।”
বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“লেইম কথা রেখে বালাজোড়া খুলে ফেলো।”
-“ছোটমা বারন করেছে। আপনার অকল্যাণ হবে।”
-“আমার কল্যাণ অকল্যাণ নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি আপাতত আমার কথা মতো কাজ করো।”
-“উহু..”
মেজাজ চওড়া হয়ে এল মেসবাহর। কড়া গলায় সে বললো,
-“সিনক্রিয়েট করো না। যা বলছি দ্রুত করো।”
ঢোক গিলে আরও কয়েক কদম পেছালো উল্লাসী। এই লোককে কোনোভাবেই বুঝতে পারে না সে। মাঝেমাঝে এত মনোরম ভাষায় কথা বলে আবার মাঝেমাঝে প্রচুর রাগ দেখায়। একজন মানুষের দুই রূপ কীভাবে হয়?

কথা বাড়ালো না মেসবাহ। দ্রুত পায়ে উল্লাসীর দিকে এগিয়ে এসে সজোরে চেপে ধরলো তার হাত। সময় নিয়ে বালাজোড়া খুলে তা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে চারিপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিল। লোকজনের আনাগোনা এদিকে খুব একটা না থাকলেও দু’একজনের উপস্থিতি রয়েছে। যারা সকলেই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে। সেদিক থেকে নজর সরিয়ে সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করেই উল্লাসীর হাত ধরলো মেসবাহ। তারপর তাকে টেনে দ্রুত বের হয়ে এল শপিংমল ছেড়ে। শহরে পা ফেলতে না ফেলতেই যে মেয়েকে নিয়ে একদফা ঝামেলায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, সেই মেয়েকে নিয়েই পুরো জীবন কাটাবে কী করে সে? জবাবে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। খুব দ্রুত একটি রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসে উল্লাসীর দিকে দৃষ্টি দিতেই তার নজরে এলো মেয়েটির কান্নামাখা মুখ। নিরবে কাঁদছে সে। অঝোরে ধারায় যা টপাটপ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে…

বাড়ির আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মুবিনের দেখা না পেয়ে অনার ঘরে এল চৈতালি। হাতে থাকা একটি বাটি টেবিলে রেখে এগিয়ে এল অনার কাছে। চোখমুখ কুঁচকে বললো,
-“তুই পড়ছিস?”
চমকে উঠে বই বন্ধ করে উঠে বসলো অনা। আতংকে তার চোখমুখ নীল হয়ে উঠেছে। থমথমে গলায় সে বললো,
-“কী সমস্যা তোর? ঘরে নক করে ঢুকবি না?”
-“নক করে কেন ঢুকবো? তাছাড়া আমাকে দেখেই বা তুই এত ভয় পেলি কেন!”
কথার মোড় ঘোরাতে অনা বললো,
-“কোথায় ভয় পেলাম? ঠিকই তো আছি আমি। কী এনেছিস তুই ওই বাটির ভেতরে? দেখি…”
-“নারিকেলের নাড়ু…”
-“তুই জানিস না আমি নারিকেল খাই না? আচ্ছা.. এনেছিস যখন থাক। ছোটভাইয়ের খুব পছন্দ নারিকেলের নাড়ু।”
-“একদমই না.. তুই ওনাকে মোটেও দিবি না। যে ছেলে আমার নামই মনে রাখতে পারে না তাকে আর যাই হোক নিজ হাতে নারিকেলের নাড়ু বানিয়ে খাওয়াবো না আমি।”
উঠে দাঁড়ালো অনা। টেবিলের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“বললেই হলো! তুই এটা আমায় দিয়েছিস। এখন আমি যাকে খুশি তাকে দেব।”
-“তুই কিন্তু বড্ড পাকামি করছিস! তা কী দেখছিলি ওই বইয়ের ভেতর? পড়ছিলি না সেটা তো নিশ্চিত।”
বলেই চৈতালি হাত বাড়ালো বইয়ের দিকে। হঠাৎ চৈতালির এমন কাজে দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে এল অনা। বইটি একপাশে চেপে ধরে চেচিয়ে বললো,
-“অন্যের ব্যক্তিগত জিনিসে এভাবে হাত দিতে নেই। চৈতালি.. ছাড় বলছি।”
বইয়ের অপরপাশ ধরে নিজের দিকে টেনে চৈতালি বললো,
-“তোর আবার ব্যক্তিগত জিনিসও আছে? দেখি ছাড়। কি আছে এতে দেখতে দে আমায়।”
-“ভালো হবে না একদম চৈতালি।”
-“সব কিছুতেই ভালো কেনো হতে হবে?”
-“ছাড় বলছি..”
-“তুই ছাড়।”
-“উফফ.. ছাড় না!”
এক ধাক্কায় চৈতালিকে বিছানায় ফেলে বই নিয়ে দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। বুকের ভেতরটা এখনো অনবরত কেঁপে যাচ্ছে তার। চৈতালির হাত থেকে আজ নিস্তার নেই। যতক্ষণ এবাড়িতে থাকবে ততক্ষণ প্রশ্ন করতে করতে একদম জ্বালিয়ে মারবে তাকে।

রাতের খাবার কিনে ফুটপাত ধরে এগুচ্ছিল মেসবাহ। হঠাৎ ফোনে লিমনের কল আসায় তাকে সবটা খুলে বললো সে। সব শুনে লিমন ফোনের ওপাশ থেকে বললো,
-“শেষমেশ বউকে বোন? বড় অন্যায়!”
-“এসব রাখ…”
-“রাখলাম। তবে আমার মনে হচ্ছে কাজটা তুই ঠিক করিসনি।”
-“তাহলে কী করতাম আমি? তুইই বল।”
-“যেটা সত্যি সেটাই বলতি।”
-“আর আমার মানসম্মান?”
-“কিছুদিন পর যখন সবাই সবটা জানতে পারবে, তখন তোর এই মানসম্মান কোথায় যাবে সে নিয়ে ভেবেছিস? তাছাড়া তুই একা বাসায় দুঃসম্পর্কের এক বোনকে এনে তুলেছিস। এ নিয়ে সমালোচনা হবে না মনে করেছিস?”
-“হ্যাঁ, এনিয়ে সমালোচনা হবে না। উল্লাসী বাচ্চা একটা মেয়ে। আমাকে এবং ওকে এক করে এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মত বয়স এখনো হয়নি ওর। তাছাড়া ওর ক্লাস, ওর চালচলন, কথাবার্তা দেখেও মানুষ তেমন কিছু ভেবে সেসব রটানোর সুযোগ পাবে না।”
-“সকলে তো তোর মতো করে নাও ভাবতে পারে!”
লিমনের কথা একদন্ড ভেবে চিন্তিত মুখে মেসবাহ বললো,
-“পজিটিভ ভাব। নেগেটিভ কেনো ভাবছিস?”
-“কারণ আমাদের সোসাইটি নেগেটিভের উপরই চলে। দুটো দিন শুধু যেতে দে, দেখবি তোর পাশের ফ্ল্যাটের ভুড়িওয়ালা ভাবিই ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দিয়েছে!”
-“বাজে কথা রাখ.. আচ্ছা, আমি এখন রাখছি। কাল তাহলে দেখা হচ্ছে।”
কল কেঁটে সদর দরজার লক খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলো মেসবাহ। হাতে থাকা খাবারের প্যাকেট টেবিলে রেখে ডাকতে শুরু করলো উল্লাসীকে।
মেসবাহর গলার আওয়াজ শোনামাত্র ভয়ে কোঁকড়ানো শরীর নিমেষেই শীতল হয়ে উঠোলো উল্লাসীর। মেঝে থেকে উঠে দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মেসবাহর সম্মুখে।
-“খাবার খেয়ে নাও। বসো।”
মেসবাহর কথায় চেয়ার টেনে হালকা সরাতেই মেসবাহ থামালো উল্লাসীকে। নরম গলায় বললো,
-“শব্দ করে চেয়ার টানতে হয় না। নিচের ফ্লোরেও মানুষ থাকে। শব্দের কারণে তাদের সমস্যা হয়। ওয়েট, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তোমায়।”
মেসবাহ চেয়ার টেনে দেখিয়ে দিতেই উল্লাসী বসলো তাতে। শান্ত দৃষ্টিতে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই বাসাটা কয় তলার?”
-“বারো। আর আমাদের ফ্লোর আটে।”
-“অহ..”
-“হুম… আর শোনো, তুমি কখনোই ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বেরুবে না। তাছাড়া শুধুশুধু বেরুবেই বা কেনো? তোমার কী বাইরে কোনো কাজ আছে?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী নেতিবাচক জবাব দিতেই মেসবাহ আবারও বললো,
-“আর আমি সকালে বেরিয়ে যাবার পর কেউ কলিংবেল বাজালেও দরজা খুলবে না। পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবি আছে। হয়তো আমি যাবার পর বা বিকেলে গল্পগুজব করতে আসতে পারে। তবে হাজার কলিংবেল বাজালেও তুমি দরজা খুলবে না। তারপর যা বলার আমি বলে ম্যানেজ করবো। ঠিকাছে?”
-“জ্বি..”
-“গুড.. নাও। খাওয়া শুরু করো।”

খাবারের কারবার চুকিয়ে উল্লাসীকে ঘর দেখিয়ে দিয়ে ড্রইং রুমে এল মেসবাহ। টেলিভিশন ছেড়ে সোফায় শরীর মেলে দিল সে। অপরদিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর টেলিভিশনের শব্দ কানে আসতেই উঠে বসলো উল্লাসী। কয়েক দন্ড ভেবে বিছানা ছেড়ে নেমে সে ধীর পায়ে এগুলো টেলিভিশনের ঘরের দিকে। তাদের বাড়িতে টেলিভিশন না থাকলেও পাশের বাড়িতে একটি টেলিভিশন রয়েছে। ছোটমার অগোচরে প্রায়ই সুহাকে নিয়ে সেই টেলিভিশন দেখতে যেতো সে। তবে সে টেলিভিশন এত বড় নয়। এত চিকনও নয়। তার শ্বশুর বাড়িতেও যে টেলিভিশন রয়েছে সেটিও দেখতে বেশ মোটাতাজা।
-“কী ব্যপার? ঘুমোও নি?”
পাশ থেকে মেসবাহর কথায় তার দিকে তাকালো উল্লাসী। হালকা মাথা নেড়ে সে বললো,
-“উহু.. ঘুম আসছে না।”
-“নতুন জায়গা তো। একটু সময় লাগবে। বসো, বসে টিভি দেখো।”
উল্লাসীকে মেঝের মাঝবরাবর বসতে দেখে উঠে বসলো মেসবাহ। শান্ত গলায় বললো,
-“উঠে সোফায় বসো।”
মেসবাহর আদেশে সোফায় বসলো উল্লাসী। অপলক দৃষ্টিতে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। আজ তার পাশে সুহা থাকলে সে প্রচুর খুশি হতো। কিছু বলতে না পারলেও টেলিভিশন দেখার সময় তার মুখের উজ্জ্বলতাই বলে দেয় ঠিক কতটা আনন্দিত হয় সে তা দেখে।
-“ব্যথা পেয়েছিলে চুড়ি খোলবার সময়?”
টেলিভিশনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেসবাহর দিকে দিল উল্লাসী। বললো,
-“না..”
-“তাহলে কাঁদলে কেনো?”
-“জানি না..”
-“ঠিকাছে। এই নাও রিমোট। নিজের ইচ্ছেমতো চ্যানেল বদলিয়ে নাও। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।”
খুশি মনে রিমোট হাতে নিল উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই নিজেকে একা আবিষ্কার করে আঁতকে উঠলো তার মন। দ্রুত সে এগুলো ঘরের দিকে। তবে সে ঘরে মেসবাহর উপস্তিতি না পেয়ে ভীত গলায় সে ডেকে উঠলো মেসবাহকে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাত্রই ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেসবাহ। আচমকা পাশের রুম থেকে মেয়েলি গলায় কান্নার আওয়াজ ভেসে এল তার কানে। উল্লাসী কাঁদছে? কিন্তু কেনো? সে তো খুশিমনে বসে টেলিভিশন দেখছিল! ভ্রু কুঁচকে পাশের ঘরের দিকে এগুলো মেসবাহ।
-“কী হয়েছে উল্লাসী? কাঁদছো কেনো?”
চোখ উঁচিয়ে মেসবাহকে দেখামাত্র দৌড়ে তার দিকে এগুলো উল্লাসী। দু’হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে শুরু করলো সে।
নির্বিকারভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মুখ খুললো মেসবাহ। নিজের বাহুডোর থেকে উল্লাসীকে ছাড়িয়ে সে বললো,
-“আমি কোথাও যাইনি। পাশের রুমেই ছিলাম।”
-“মিথ্যা কেনো বলছেন?”
-“মিথ্যা কেনো বলবো! আমি ওঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।”
-“আপনি ওঘরে ঘুমোবেন?”
-“হ্যাঁ..”
-“তাহলে আমিও ওঘরে ঘুমোবো। একা আমি এঘরে থাকবো না।”
-“ভয়ের কিছু নেই উল্লাসী। ঘর থাকতে তুমি শুধুশুধু নিচে শোবে কেনো? তুমি এঘরেই থাকবে।”
-“তাহলে আপনিও এঘরেই থাকবেন।”
উল্লাসীর শরীরের থরথরিয়ে কাঁপুনিই বলে দিচ্ছে ঠিক কতটা ভয় পেয়েছে সে। তবে তাই বলে তার অদ্ভুত চাওয়া তো মেনে নেয়া যায় না! একদন্ড ভেবে গলা খানিকটা গম্ভীর করে মেসবাহ বললো,
-“আমি আমার ঘরেই থাকবো। এবং তুমি এঘরে থাকবে। এনিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।”
মেঝেতে বসে পড়লো উল্লাসী। কাঁপা হাতে মেসবাহর দু’পা আঁকড়ে ধরে সে বললো,
-“আমি একা কখনোই থাকিনি। নতুন এই বাসায় একা এঘরে থাকলে আজ রাতেই আমি মরে যাবো। ওঘরে থাকিনা একটু! আমি নীরবে নিচে শুয়ে থাকবো। সুহার কসম…”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here