নিরবতা পর্ব-৯

0
4218

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৯

রাতে খাবার শেষে সব কিছু গোছগাছ করে উল্লাসী ড্রইংরুমে এলো। পাশেই সোফায় শরীর মেলে দিয়ে শুয়ে রয়েছে মেজবাহ। নজর তার টেলিভিশনের দিকে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে সেদিক থেকে নজর সরিয়ে সোফায় বসলো উল্লাসী। উৎফুল্ল চোখে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে তা দেখায় মনোযোগ দিল।
-“পানি গরম দিয়ে এসেছো?”
পাশ থেকে মেসবাহর প্রশ্নে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল উল্লাসী। তারপর মেজবাহর দিকে ফিরে বললো,
-“আপনার লাগবে এখন?”
-“না, যখন লাগবে আমি নিয়ে নেব।”
-“আচ্ছা..”
-“ছোট হিসেবে বেশ ভালো রাঁধো তুমি।”
-“আপনার ভালো লেগেছে?”
-“হ্যাঁ.. ভালো লেগেছে।”
মেজবাহর কথায় খুশির এক দোলা বয়ে গেল উল্লাসীর মনজুড়ে। সোফায় দু’পা উঠিয়ে আরাম করে বসে সে মেসবাহর দিকে সকল মনোযোগ জুড়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললো,
-“আপনি জানেন, আমার বাবার ছোটমার চেয়ে আমার হাতের রান্না খেতে বেশি ভালোলাগে?”
-“জানা ছিল না.. তবে এখন জানলাম। রান্নাবাড়া করতে কী খুব ভালো লাগে তোমার?”
-“খুউউব ভালো লাগে…”
-“বেশ তো.. তা আর কী কী করতে ভালোলাগে তোমার?”
-“ঘুরতে, টেলিভিশন দেখতে, সুহার সঙ্গে সময় কাটাতে, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, বৃষ্টিতে ভিজতে, আর…”
আঙুলে কড় ধরে ধরে একেএকে নিজের ভালোলাগা গুলো মেসবাহর কাছে খুলে বললো উল্লাসী। তারপর আগ্রহী গলায় জানতে চাইলো,
-“আর আপনার?”
-“আমার তো কিছুই ভালোলাগে না। তবে বয়স বলো বা পরিস্থিতি, এসব মেনে সব কিছুকেই ভালো লাগাতে হয়।”
-“তার মানে আপনার ভাল্লেগেনা অসুখ হয়েছে। ডাক্তারদেরও তাহলে অসুখবিসুখ হয়!”
ঠোঁটে হাসি ফুটলো মেসবাহর। শোয়া থেকে উঠে বসে সে বললো,
-“তোমার কী ধারণা ছিল হয় না?”
-“হু… মানে উহু।”
-“ঠিকাছে। ডাক্তারদের নিয়ে আপাতত তোমার আর গবেষণা করতে হবে না। দ্রুত ঘরে চলো। অনেক রাত হয়েছে।”
টেলিভিশন বন্ধ করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। তার পিছুপিছু ঘরে ঢুকে নিচে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো উল্লাসী। তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল মেসবাহ। স্বাভাবিক গলায় সে বললো,
-“বেডেই শুয়ে পড়ো।”
-“তাহলে আপনি কোথায় শোবেন?”
সে প্রশ্নের জবাব আজও উপেক্ষা করলো মেসবাহ। বেড সাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো সে।
-“আপনি আমাকে পছন্দ করেন না, তাই না?”
উল্লাসীর কথায় বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি অনুভব করলো মেসবাহ। তবে পরমুহূর্তেই নিজের সকল মনোযোগ ঘোরাতে গতকালের পড়া ডেভিড কপারফিল্ড বইটি বের করে অবশিষ্ট অংশতে চোখ ডোবালো সে।
-“ছোটমা খোকনকে আমাদের সঙ্গে প্রায়ই ঘুমোতে বলে। কিন্তু খোকন কখনোই আমাদের সঙ্গে ঘুমোয় না। কারণ ওর সুহাকে পছন্দ নয়। সুহার কাছে শুলে নাকি ওর গা ঘিনঘিন করে।”
বলেই থামলো উল্লাসী। আঁড়চোখে মেজবাহর দিকে ফিরে সে আবারও বললো,
-“তেমন আমাকেও আপনার পছন্দ নয় বলে আপনি আমার সঙ্গে ঘুমুতে চান না। আপনার গা ঘিনঘিন করে.. তাই না?”
-“অদ্ভুত সব কথা বলবে না। ঘুমোতে এসেছো ঘুমোও। ঘুমোনোর সময় এত কথা কিসের?”
মেসবাহর ধমকে দমিয়ে গেল উল্লাসী। ঝটপট বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমের পায়তারা শুরু করলো সে। লোকটি বড়ই অদ্ভুত। তাকে বোঝা বড় দায়!

বই বন্ধ করে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিল মেসবাহ। রাত দু’টোর উপরে বেজে গেছে। এমনটাই হয়.. বই পড়তে ধরলেই সময়-জ্ঞান একদম ভুলতে বসে সে! হাই তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকলো সে। তবে অপর পাশ থেকে উল্লাসীর কোনো জবাব না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘরের আলো নিভিয়ে পাশের ঘরে চলে এল মেসবাহ। একটি সিগারেট ধরিয়ে বেতের চেয়ারে শরীর মেলে দিল। উল্লাসীকে কী আসলেই পছন্দ নয় তার? হয়তো.. কিন্তু কেনো পছন্দ করে না সে উল্লাসীকে? গ্রামের মেয়ে বলে, অবুঝ বলে নাকি ছোট বলে? জবাবে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। ভুল ভাবছে সে উল্লাসীকে নিয়ে। পছন্দ না করলেও মেয়েটিকে অপছন্দ করে না সে। মেয়েটির নিষ্পাপ চেহারা, ডাগর ডাগর দু’চোখের চাহনিতে মায়া হয় তার। ইচ্ছে হয় সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে আবারও তার আগের দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিতে। তবে পরিবারের কথা ভেবে তা শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। অস্থির মনে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে আবারও উল্লাসীর চিন্তায় ডুব দিল সে। উল্লাসীর দেখানো যুক্তিগুলো ভুল ছিল। না সে তাকে অপছন্দ করে না তার সঙ্গে ঘুমোতে গা ঘিনঘিন করবে। তবে সব কিছুর উর্ধ্বে সে একজন পুরুষ। কিছু চাওয়া-পাওয়া রয়েছে তার। আছে শারীরিক চাহিদা। সেসব ভেবে নিজের পুরুষত্ব দেখাতে শিকার বানাতে চায় না সে বাচ্চা মেয়েটিকে। বাল্যবিবাহর মতো পাপ করার পর আবারও একই পাপের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় না সে। এ পাপ যে সকল পাপের চেয়ে জঘন্য!

সকাল সকাল মেসবাহকে বেরিয়ে যেতে দেখে খুশি হলো মুন্নি সরকার। খুব দ্রুত হাতের কাজ সেরে ফ্ল্যাট লক করে সে বেরিয়ে পড়লো পাশের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। আজ বেশ জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে মেয়েটির সাথে। ভেবে খুশিতে টগবগিয়ে কলিংবেলে দু’বার চাপ দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল উল্লাসী। বিস্মিত গলায় বললো,
-“আপনি!”
-“কেনো? তুমি কাকে আশা করছিলে?”
-“উনাকে.. মানে ভাইকে।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। ভেতরে প্রবেশ করে ড্রইং রুমের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“তুমি যেন মেসবাহর কেমন বোন হও?”
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে শুরু করলো উল্লাসীর। উনি বারবার বলেছিলেন হাজারো কলিংবেল বাজালেও দরজা না খুলতে। অথচ তার কথার অমান্য করে বসলো সে!
-“কী হলো? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে করছোটা কী? দরজা লাগিয়ে দিয়ে এদিকে এসো।”
মুন্নি সরকারের কথামতো দরজা বন্ধ করে ড্রইংরুমে এলো উল্লাসী। পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে তার। ভুল করে তার মুখের ফাঁক দিয়ে উলোটপালোট কিছু বের হয়ে গেলে আবার ক্ষতি হবে না তো উনার?
-“আরে! বসো তো। বসো।”
জোর করে উল্লাসীকে নিজের পাশে বসালো মুন্নি সরকার। তারপর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“তুমি যেনো কেমন বোন হও মেসবাহর?”
-“ওই যে! কাল উনি.. না মানে ভাই যা বললো।”
-“ও যে কি দিয়ে কি বললো তা বুঝিই নি আমি! তুমি বুঝেছিলে?”
মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিল উল্লাসী। ভালোলাগছে না তার। একদম ইচ্ছে করছে না এই মহিলার পাশে বসে গল্প করতে।
-“আচ্ছা, তুমি আমাকে শুধু এইটা বলো, মেজবাহর বাবা তোমার কী হয়?”
ঢোক গিললো উল্লাসী। ধীর গলায় বললো,
-“জানিনা..”
-“এই মেয়ে বলে কী! তাইলে আবার এই বুড়া ধামড়া ছেলের সাথে তোমার বাবামা তোমাকে থাকতে পাঠিয়েছে কেন?”
-“জানিনা..”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে বললো,
-“কোন রুমে থাকো তুমি?”
-“জানিনা..”
-“কি আশ্চর্য! এভাবে কথা বলছো কেনো?”
-“জানিনা..”
-“কী জানো তুমি?”
-“জানিনা..”
বিরক্তে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“যাচ্ছি আমি.. দরজাটা লাগিয়ে দাও।”
হনহনে পায়ে মুন্নি সরকার ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো উল্লাসী। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে ধীর গলায় বললো,
-“জানিনা জানিনা জানিনা…”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here