নিশুতি_তিথি পর্ব ১৩

0
420

#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১৩
___________

২৮.
আঞ্জুমানের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে, তার নিজস্ব চক্ষুদ্বয়। একি সে সত্যি দেখছে না কি তার ভ্রম? বেশ ক’বার চক্ষুদ্বয় মুদিত করে আবার উন্মুক্ত করল। কিন্তু নাহ, সবকিছু তো ঠিকই আছে তবে কেন একজনের অস্তিত্ব তার কাছে বেঠিক ঠেকছে? তার ছোট মস্তিষ্ক এতকিছু ধারণ করতে অক্ষম। আপাতত মস্তিষ্ক ও মন দুটোই জানান দিচ্ছে সম্মুখ দন্ডায়মান ব্যক্তিটির ছায়া না মাড়াতে। স্বয়ং আলী আকবরের উপস্থিতিতে সে যারপরনাই অবাকান্বিত এবং বিরক্ত। ভালো না লাগার মানুষকে দেখে তো আর ভালোলেগে মুখশ্রী আরক্ত হয়ে উষ্ণীয় অনুভব করবে না। ঘৃণ্য মন অনুভূত হচ্ছে আঞ্জুমানের। সে আলীকে দেখল গাড়ি থেকে নামতে অতঃপর গাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা ট্রলি বের করল। গাড়ি চলে গেল গেট দিয়ে। ট্রলি এগিয়ে নিতে করিম মিয়াকে হাঁক ছেড়ে ডাক দিতেই আগমন ঘটল তার। আলীর হাত থেকে নিজ হাতে করে ট্রলিগুলো নিয় বাড়ির ভেতরে ঢুকল। আঞ্জুমান যে বাগানের দোলনা সখি লিমার সাথে গল্পগুজব করতে করতে দোল খাচ্ছিল আর আলীকে দেখে অবাকপ্রায় হয়ে বিরক্তিবোধ করছে স্পষ্টভাবে আলীর সেটা চক্ষুগোচর হলো। মুচকি হাসল। সময় যে ফুরিয়ে এসেছে পাখির ওড়ার, বন্দি হওয়ায় সময় হয়ে এসেছে মনপিঞ্জরায়। পাশে থাকা লিমা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুততম দোলনা ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। সেটা দেখে আঞ্জুমান তাকে ধরে বসিয়ে দিতে চাইলেও সে গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। না নড়ল আর না চড়ল। লিমার সাথে খালি বাড়িতে এধারওধার করে আরামসে চঞ্চলাভাবে ঘুরেফিরে বেড়িয়েছিল আঞ্জুমান। এখন আলীর উপস্থিতি সেসবে বাঁধা প্রদান হিসেবে দাঁড়াবে ভেবে মন খারাপের গুঞ্জন ছড়াচ্ছে আঞ্জুমানের মনমস্তিষ্ক জুড়ে। ক্ষানিকের মধ্যেই মনমরা হয়ে গেল শুভ্র হাসিখুশি থাকা আঞ্জুমানের মুখশশী। আলী কয়েকপল দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভেবে মোড় ঘুরালো বাড়ির দিকে নিজ পদচালনা করল। সেটা দেখে আঞ্জুমান বেজায় খুশি। হাসি খেলে গেলে এবার তার মুখে। কিন্তু লিমাকে বেজার মুখো হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।

২৯.
রিমার মন ভালো না, আলীর চলে যাওয়া প্রতিবারই তাকে কাঁদায়। আলী গ্রামে পৌঁছেই তাকে ফোন করল।

‘পৌঁছে গেছ?’

‘এই মাত্রই আমাদের রুমে ঢুকলাম আর তোমাকে ফোন করলাম।’

‘হুম।’

‘এই মন খারাপ?’

‘তা আর বলতে। সাহেব জানে না বুঝি?’

‘জানে দেখেই তো ধরতে পারছে। তাছাড়া সাহেব আরো কিছু জানে বেগম সাহেবা।’

আলীর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল রিমার মুখ। সে কপট রাগের ভান করে বলল,

‘ছি! অসভ্য।’

‘তাই বুঝি। সামনে থাকলে বুঝিয়ে দিতাম অসভ্যতামি।’

ফের মন কেমন খারাপ হয়ে এলো। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি সেটা বুঝল বোধহয়। তাই তো প্রসঙ্গের ইতি টানল।

‘আচ্ছা, শোনো না। আমি ফ্রেশ হব পড়ে ফোন দিচ্ছি। কেমন?’

‘ওহহ! আচ্ছা, আচ্ছা দ্রুত ফ্রেশ হও। আর শোনো টাইমলি খেয়ে নিও।’

‘যথা আজ্ঞা বেগম সাহেবা।’

ফোন কেটে গেলে রিমা সেটা হাত থেকে নামিয়ে ছোটো ভাবি সামিয়ার রুমে যায়। সামিয়ে তখন প্রবাসী স্বামীর সাথে কথায় মশগুল। প্রাইভেসি বলেও একটা কথা আছে যতই বন্ধু সুলভ সম্পর্ক থাকুক না রিমা ও সামিয়ার মাঝে। তাই রিমা নক করল দরজায়। নক করার তীক্ষ্ণ শব্দে কান থেকে ফোন নামিয়ে জিজ্ঞেস করল দরজায় দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে অভিহিত করার উদ্দেশ্য। তখন রিমা বলল,

‘আমি।’

‘আয়, ভেতরে আয়। নক করা লাগে না কি?’

রুমে ঢুকতে ঢুকতে দেখল সামিয়া ফোন কানে নিয়ে ‘পড়ে বলব’ বলে কল কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। এগিয়ে গিয়ে সামিয়ার পাশ ধপাস করে শুয়ে পড়ল। মাথার কাছে বালিশ নিতে নিতে বলল,

‘আছে আছে নক করার বহু কারণ আছে। এখন আমি সেসবের বৃত্তান্ত খোলাসা করলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবা না।’

বাঁকা হাসল রিমা। সামিয়া পাশে থাকা কুশন নিয়ে রিমার ওপর চড়াও হতে উদ্যোগী হলো। কিছুক্ষণ দু’জনের মাঝে তুমুল বর্ষা নামল তুলোর। এরমধ্যে ফোনকল এলো সামিয়ার ফোনে। কথা শেষে ফোন রেখে রিমাকে জড়িয়ে ধরে খুশি প্রকাশ করল। রিমা ভারি অবাক হলো।

‘ব্যাপার কী এত খুশির কারণ?’

‘বইন রে ছোটো মামার বিয়ার খবর আইছে।’

বলেই দন্ত পাটির হাসি দিলো। সামিয়ার বয়স অল্পই। শ্বশুর মশাই নিজের ছেলের জন্য কম বয়সী মেয়ে এনেছেন কি না। আর সামিয়ার মামা আবার প্রবাসী মানুষ বিদেশে থাকা হয়েছে বিদায় বয়স চলে গেছে স্রোতের ন্যায়। বিয়ে করার চান্স মেলেনি খুব একটা। তবে অতটাও বয়সী নয়। এখন সামিয়ার শ্বশুর বাড়ির সকলকে দাওয়াত দিয়েছেন সামিয়ার মা। সাথে বলেছেন, আফজাল সাহেবকে ফোন করেও দাওয়াত করবেন। তবে সামিয়াকে আগেভাগে থাকার কথা বলেছেন। এদিকে সামিয়া চাইছে রিমাও যেন তার সাথে যায় বিয়ের কিছুদিন আগেই। রিমা ভাবছে তখন অন্য কথা। অবশ্য সেটা আলীকে ঘিরেই।

৩০.
রন্ধনের তদারকি করছেন রাহিমা খালা। যদিও আলীর মস্তিষ্কে একবার খেলে গিয়েছিল, তাঁকে ছুটিতে পাঠাতে। একেবারের অবসর ছুটি যেটাকে বলে। কিন্তু অনেকদিনের পরিচায়িকা বলে মন সায় প্রদান করেনি। তবে উল্লেখ করে দিয়েছে, আঞ্জুমান রান্না করার সময় যেন তিনি সেটা তদারকি করে। আঞ্জুমানের হাতে সংসার ন্যস্ত করেছে কি না। অবশ্য এতে আঞ্জুমান বিন্দু পরিমাণ অবাক বা ঘাবড়ে যায়নি। কেবল বিরক্তিকর ও হতাশাজনক নিশ্বাস নিসৃত করেছে। সেটা আলীর আড়ালে-আবডালে। কারণ তার এখন অবসর হয়ে বসে বসে গল্প করার মতো সুযোগটা নেই আর। সাংসারিক কাজে পারদর্শী আছে সে। নানা ও দাদা বাড়িতে কাজকর্ম করতে হয়েছে কি না তাকে। মনে পড়ে গেল সেসেব বিষাদে ভরা বিষাক্ত স্মৃতি। সাথে স্মরণে এলো বিচার দিনের কার্য দিবসের হওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতা। রান্নাঘরের চোখের জল ছেড়ে দিলো। বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে মাংসের ঝোলের সাথে মিশে গেল।

‘কিছু কষ্ট, ব্যথা আছে; যেটার ভাগ না কাউকে দেওয়া যায়, আর না কেউ নিতে পারে। সেটার ভাগ কেবল নিজেরই, একান্ত নিজের।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here