#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১৪
___________
৩১.
‘তুই তো দেখছি মনিবের খুব অবাধ্য হয়ে চলছিস। কী, হ্যাঁ? কী জানাতে চাইছিস আঞ্জুকে?’
‘আপনের আসোল রূপটা দেখাবার চাই আঞ্জুরে। দেহুক আপনে যে ক…’
ভারি পুরুষালি হাতের চপেটাঘাতে গালে ব্যথার তীক্ষ্ণতা অনুভব করে লিমা। বাক্যের বাণ আলীর দিকে ছুঁড়ার আগে নিজের ওপর পায় খুব করে। চক্ষুজোড়া জ্বলজ্বল বিন্দু বিন্দু জলে টইটুম্বুর হয়ে উঠল। এত কষ্টের না খাওয়া না ভালো পাওয়া জীবনেও থাপ্পড় খাওয়ার মতো অনুভূতি হয়নি তার। আজ কি না খেতে হলো, তাও আবার মিথ্যার বিষয়বস্তুর কারণে। ভেতরটা পুনরায় অপরাধের দহনে দগ্ধ হলো, যাও আঞ্জুমানের শুশ্রূষা করে কমে গিয়েছিল। আঞ্জুমানকে সংসারের ভেতরে টেনে এনে মিথ্যার সংসারকে সত্যি করে তুলতে চাইছে আলী। অথচ আঞ্জুমানকে পাওয়ার পেছনে আলীর কুটনৈতিক বুদ্ধির কারবারি যেখানে, সেখানে তার মতো অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের সাথে প্রিয় সখি আঞ্জুমানকে রাখতে চাইছে না লিমা। মেয়েটাকে যে স্বার্থের জন্য এনেছে, সেটা হাসিলে ছুঁড়ে ফেলবে। তারপর তার সখি কই যাবে? তাহলে কেন মেয়েটার মনে ভালোবাসা, মোহ-মায়ার বীজ বপন? তাই এখনই চারাগাছ সমূলে উপড়ে ফেলতে চাইছিল লিমা। যেন পরে সেটার শিকড় না বেরিয়ে আসে। কিন্তু বিধিবাম! কড়া পাহারাদারির নজর আঁটকে ছিল আলীর। উহুম, আঞ্জুমানের ওপর না লিমার ওপর। সত্য প্রকাশে ভীতু কি না। সেই নজরে ধরা পড়ল লিমা আর উপহারসুত্রে থাপ্পড়ের কষাঘাত।
‘বেশি বাড় বাড়লে, মনে রাখবি শুধু মা-ভাই কিন্তু তোর এখনো বেঁচে। খালি মরতে কতক্ষণ?’
লিমার কোনো কথা শোনার প্রয়োজনবোধ করল না আলী। খটখট শব্দ পদচারণে নিজ রুমের দিকে ধাবিত হলো। কী নিষ্ঠুর, পাষণ্ড হৃদয়ের মনুষ্য আলী! মিথ্যার বেড়াজালে একদিন দমবন্ধকর অনুভূতিতে পড়তে হবে। সকলের দুঃখের-কষ্টের অনুভূতির অভিশাপ কাল হবে তার জন্য কালের প্রবর্তনে।
৩২.
নতুন আবদার আলীর। রুমে খাবে এখন থেকে। তাও আবার আঞ্জুমানকে’ই নিয়ে যেতে হবে। আঞ্জুমান দুরুদুরু বুকে, স্থিরচিত্তের পদচারণ এগিয়ে নিলো রুমের দিকে। এতদিন এই ভয় কোথায় ছিল? ভাবল খানিকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে। পরক্ষণেই দরজার ওোশ থেকে ভারি স্বরে আওয়াজ এলো রুমের ভেতরে যাওয়ার। লোকটা বোধহয় টের পেয়েছে তার আগমনের। কপাট ঠেলে এগিয়ে গেল ভেতর রুমে। হিম করা ঠান্ডা রুম। এই প্রথম আসা আলীর রুমে তার। ঠায় দাঁড়িয়ে আশপাশে চোখ ঘুরাচ্ছে মেয়েটা। তাকে পরখ করতেই আলী হালকা কেশে নিজের অবস্থানের জানান দিলো। হকচকিয়ে গিয়ে বিছানায় তাকাল আঞ্জুমান। অর্ধ শায়িত আলী নির্দেশ দিলো, সোফার টেবিলের সম্মুখে খাবারের প্লেট রাখতে। রাখতে গিয়ে আঞ্জুমান খেয়াল করল তার ভীষণ ভয় হচ্ছে, ভয়ংকর রকমের কঁপাকাঁপি করছে হাত-পা। চোখ ছাপিয়ে জল আগমনী সংকেত দিচ্ছে তাকে। কাচের পানির গ্লাস রাখতে গিয়েও অবস্থা শোচনীয়। হাত ফসকে পানিসহ গ্লাস নিচে পড়ে ভেঙে গেল। আর সেই সাথে শব্দ করে ডুকরে কেঁদে উঠল আঞ্জুমান। হতভম্ব আলীকে আরো বেশি বিস্মিত করে দিয়ে আঞ্জুমান রুম ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। আলী ঠায় বসে ভাবতে লাগল, খুঁজতে লাগল; আঞ্জুমানের কান্নার আর এভাবে চলে যাওয়ার কারণ।
৩৩.
‘আমার না তারে খুব ডর লাগে। তারে দেখলেই মনে হয়, এই বুঝি সে আমারে মারব।’
কান্না করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কাজের লোকের কোয়ার্টারে লিমার রুমে গেল। লিমাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। লিমা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে উপরোক্ত বাক্য দ্বারা আঞ্জুমান ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করল। লিমা বুঝল আলীকে নিয়ে আঞ্জুমানের ভেতরে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এটা দেখে বেশ খুশিই হলো লিমা। নিশ্চয় এখন আর আলীর বাড়িতে থাকতে চাইবে না। পরক্ষণে ভাবনা এলো, আলী সহজে ছাড়বে না কি আঞ্জুমানকে? তবে ছাড়তেও পারে আঞ্জুমান যদি নিজের সিধান্ত অটল রাখে। কিন্তু চলে গেলে, মেয়েটা থাকবে কই? কারণ থাকার মতে তো আর কোনো স্থান নেই মেয়েটার। লিমা নিজ বাড়িতেও নিতে পারবে না। নিজেদেরই পেট চলে না আবার আরেকজন নিয়ে জুটলে তো তার মা তাকেই বাড়ি ছাড়া করাবে। আঞ্জুমান এখনো কেঁদে চলছে। তাকে স্বান্তনার বাণী শুনাতে লিমা বলল,
‘ডরানের কী করছে তোরে হেয়? তুই যে তারে ডরাছ?’
আসলেই তো আঞ্জুমানের সাথে এপর্যন্ত আলী কখনো অসদাচরণ করেনি। শুধু সেদিন পুকুরে ডুব দেওয়ার দিন থাপ্পড় দেওয়া ছাড়া। কারণবশতই থাপ্পড়টা খেয়েছিল সে। অতিষ্ঠ জীবন থেকে রেহাই পাওয়ার নিমিত্তেই সেই দুঃসাহসিক কাজটা করেছিল। কিন্তু সেটা তো হলোই না প্রেক্ষাপট বদলে ঘটনা ঘটল অন্যটা। কলঙ্কের দাগের সাথে বিয়ের সিলও পড়ল গায়ে। তারপর আকস্মিকভাবে দূর্ঘটনার পরে ক্লিনিকে কাটিয়ে এলো, তারপর বাড়িতে। কিন্তু এরমাঝে আলীর ছায়াও দেখা যায়নি তার আশেপাশে। তাহলে ভয়ের কারণটা কী? সে নিজেও জানে না। ভাবনার দ্বারপ্রান্ত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো লিমার হাতে ধাক্কা খেয়ে।
‘বললি না, ডরানের কারণ কী?’
অসহায়, হতাশামিশ্রিত মুখ নিয়ে বলল,
‘আমি নিজেও জানি না। তয় এট্টুক জানি খালি, তারে দেখলেই আমার ডর লাগে। মুখে তো হাসেই না, কেমন কেমন কইরা জানি চায়।’
হাসিবিহীন গম্ভীর আলীকে দেখলে স্বাভাবিক ভয়কাতর অবস্থা হবেই। সেই হিসেবে আঞ্জুমানের কথাও ঠিক। তবুও তার ভয়ের মাত্রা একটু বেশিই। সেটা না কাটুক কখনোই, নাহলে যে কাজের শেষে মেয়েটার অবস্থান কোথায় যে হবে, জানা নেই লিমার।
চলবে…