#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১৫
___________
৩৪.
‘তুমি তো জানোই সামনে ইলেকশন। কীভাবে কী করব বলো তো?’
করুণ শুনালো আলীর কণ্ঠস্বর। আসলেই তো আলী কীভাবে যাবে তার সাথে সামনের নির্বাচনের তার কতো কাজ। রিমা চাইছিল, ছোটো ভাবির মামার বিয়েতে তার সাথে আলীকেও নিতে। পুরো পরিবার যাচ্ছে, সেখানে মেয়ে জামাই না গেলে কেমন দেখায় না। তবে আলীর সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে হবে তাকে। অগত্যা শুধু বিয়ের দিন আলীকে অবশ্যই সেখানে থাকতে হবে বলে জানালো রিমা। অতঃপর টুকটাক কথোপকথন সেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। মা’কে সামনে পেয়ে বলল,
‘তোমাদের জামাই বিয়ের দিন থাকতে পারবে শুধু।’
রান্না করা থেকে অব্যাহতি নিয়ে তার মা বললেন,
‘জামাই বলছে তোকে?’
সায় জানিয়ে রিমা বলল,
‘সেটাই তো বলল। সামনে তার ইলেকশন। ব্যস্ততা থাকবে খুব, দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। এসময় বিয়ে-শাদির দাওয়াতে সময় নষ্ট করতে পারবে না।’
মনঃক্ষোভের সহিত গ্যাসে বসানো তরকারি নাড়তে নাড়তে রিমার মা বললেন,
‘বুঝি না বাপু কিছু। এত বড়ো ব্যবসা আমাদের, মানুষ লাগে। সেখানে কাজ করতে পারে না। গ্রামের ওসব ইলেকশন-টিলেকশন দিয়ে কাজ কী তার?’
মায়ের রাগ বুঝতে পেরে রিমা তাঁকে বোঝ দেওয়ার সুরে বলল,।
‘বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে মানুষটা কীভাবে এখানে এসে পড়ে থাকবে বলো তাে? মন তো টানবেই। আমাকে তো সময় দেই-ই। থাকুক না সেখানে।’
‘যা না বাপু আমি। যা মন চায় করো গিয়ে তোমরা মিয়া-বিবি।’
রিমা বুঝল মা’র মেজাজ খিঁচড়ে আছে, তাই আপাতত স্থান ত্যাগ করাই শ্রেয় মনে করল।
৩৫.
‘নে খাইয়ে দে।’
কী নিঃসংকোচ আবদার! আলীর রাশভারি গলারস্বর খাইয়ে দেওয়ার অভ্যস্ত আঞ্জুমানের লোকমা তোলা হাতটাকে টালমাটাল করে দিলো। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত আঞ্জুমানের হাতে লোকমা নিতে গিয়ে দেখল, খাবার মুখের চেয়ে বাইরে পড়ছে বেশি। ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে গরম মেজাজ ও পরিবেশকে ঠান্ডা করার নিমিত্তে শান্ত স্বরে বলল,
‘খাওয়াতে জানিস না?’
নত মাথা নেড়ে সায় জানালো আঞ্জুমান। সে তো খাওয়াতে জানেই।
‘তাহলে খাওয়াতে পারছিস না কেন?’
এখন আঞ্জুমান কী উত্তর দিবে? সে যে যমের মতো ভয় পায় আলীকে। হয়তো যমের চেয়েও বেশি হবে। এসব বলতে তো পারবে না। বললে হয়তো তাকেই আস্ত রাখবে না, সামনে থাকা দানবীয় আকৃতির ব্যক্তিটি। আগে যদিও আলীর তিনবেলার খাবার রুমেই দিয়ে যেত। কিন্তু নতুনত্বভাবে আবদারের ভাগিদার হয়ে এলো, খাইয়েও দেওয়া লাগবে। সামনে যেতেই তো হাত-পা কাঁপাকাঁপি অবস্থা। এখন খাইয়ে দেওয়া! কঠিন থেকেও ভয়ংকরতম কাজ মনে হচ্ছে আঞ্জুমানের কাছে! আলীকে প্রথম লোকমা আলগাভাবে দিলেও দ্বিতীয় লোকমা যেন না পড়ে, সেদিকে খেয়াল দিতেই আলী তার হাত ধরে লোকমাসহ আঙুল মুখে পুড়ে নিলো। চোখের মনি স্থির রাখল, হকচকিয়ে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আঞ্জুমানের আঁখিদ্বয়ে। আলী যখন হাত ছাড়ল সম্বিত ফিরে এলো আঞ্জুমানের। আলীর ঠোঁটের স্পর্শে না জানি কী ছিল কে জানে। আপাতত সে জানে, তার এই গরমেও শীত শীত অনুভব হচ্ছে, লোম কাটা দিয়ে উঠছে। সারা গা হুল ফুটাচ্ছে। এই মুহূর্তে আলীর সম্মুখ থেকে না বেরোলে সে মারা পড়বে, দমবন্ধ অনুভূতের তাড়নায়। সেই চিন্তায় কম্পিত স্বরে আলীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘আ..আমি যাই। খারাপ লাগতাছে।’
আলী বোধহয় বুঝল পরখ করা নজরে মৃদুমন্দ কাঁপন্ত শরীর আঞ্জুমানের। মেয়েটা এখন না গেলে নির্ঘাত কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারাবে। ভেতর থেকে বড়সড় শ্বাস বেরিয়ে এলো। এই মেয়েটাকে সে কাছে টানবে কীভাবে? ভাবতেই জল্পনা-কল্পনার খেলাঘর ত্রাসিত হতে দেখতে পায় সে। এদিকে আলীর উত্তর পাওয়ার আশায় খানিকক্ষণ অপেক্ষাকৃত আঞ্জুমান আর অপেক্ষায় রইল না। দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগে উদ্যত হতেই আলী বলল,
‘এগুলো নিয়ে যা। আর রাতের খাবার খাওয়ানের প্রস্তুতি নিয়ে আসবি সাথে।’
বুকটায় ধক করে উঠল আঞ্জুমানের। কান্না পেল খুব করে৷ এত অসহায় বোধ কাজ করছে তার মাঝে, শেষে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে মন চাইছে। রাতেও খাওয়াতে হবে! অসুস্থ না হওয়া স্বত্বেও কেন খাইয়ে দিবে তাকে? দুপুরের খাবার খাওয়াতে গিয়ে যা ঝামেলায় পড়ল রাতের তো আশা করাই বেকার। এখন পালাতে পারলেই হলো। রাতেরটা রাতে দেখা যাবে।
৩৬.
রাতের আঁধারে নিমজ্জিত শহুরের ঘুমন্ত পুরীর মানুষগুলো। উন্মুক্ত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হিম করা বাতায়নে দেহের সর্বাঙ্গে কাঁপুনিতে মগ্ন। সেখানে উষ্ণতা খোঁজার ব্যর্থতা কেবল। একান্ত মানুষটা তো দূরে, খুবই দূরে। সময় হলে আসে, ধরা দেয়; এই তো। এইযে একান্ত কাছে পাওয়ার আকুলতা তারমাঝে কাজ করে, অথচ দেখ, মানুষটা তখনি ধরাছোঁয়ার বাইরে স্পর্শ সেখানে তুচ্ছতম। মন খারাপি নিয়ে রিমা ফোন লাগাল আলীর ফোনে। নট রিচেবল। আছড় মারতে মন চাইছে ফোনটাকে। নিজেকে শান্ত করল। মাঝে মাঝে না কেমন বোকার মতো কাজ করে ফেলে। ওপাশের মানুষটার সুবিধা-অসুবিধার কথা বুঝেও যেন বাচ্চামো করে ফেলে। কিন্তু মানুষটা তো তাকে আগলে রাখে, খেয়াল করে, বোঝে। সে-ই শিশুসুলভ আচরণ ছেড়ে পূর্ণাঙ্গভাবে স্ত্রী হয়ে স্বামীর খেয়ালটা রাখে না আর না বোঝেশোনে কাজ করে। হেসে ফেলল ভাবনাগুলো আসতেই।
৩৭.
‘আবারো আপনে আমারে হুমকি দিতাছেন?’
ক্রুর হাসি টেনে ঠোঁটে আলীর উত্তর,
‘যা ভাবিস তাই। তবে মানিস না কি তুই?’
‘ছাইড়া দেন না।’
অসহায় গলা লিমার। সেটা গোণায় ধরল না আলী। নিষিদ্ধ গলায় বলল,
‘উহুম, তাকে আমার প্রয়োজন। খুব করে, অধিকতর। সে আমার নেশাতে পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন।’
শেষবাক্য বিড়বিড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বলায় লিমা সেটা বুঝল না। সে গো ধরা গলায় একই অনুরোধ আবারো করল। কিন্তু সেটা শুনে ধমক দিয়ে হুমকি দিলো আলী।
‘মা-ভাইরে কি ভালো লাগে না, না কি?’
বুঝল লিমা সম্মুখে থাকা এই পাষণ্ড হৃদয়য়ের অমানুষটাকে বুঝিয়ে বা অনুরোধ কোনটাই করে লাভ হবে না। অগত্যা আলীর কথায় রাজি হয়ে মা’য়ের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য রওনা দিতে নিজ রুমে ফিরে গেল। কারণ যাওয়ার আগে একবার সে আঞ্জুমানের সাথে দেখা করে যাবে। সেটা অবশ্য আলী জানে না। জানলেই বা কী? চোখে চোখে নজর গেঁথে তো রেখেছে। লিমা উলটাপালটা কিছুও বলার মতোও সুযোগ পাবে না। শুধু বাড়ি যাচ্ছে বলার জন্য আঞ্জুমানের সাথে দেখা করা। তাকে পাওয়া গেল ফলের বাগানের মধ্যে দোলনায় দোল খাওয়া রত অবস্থাতে। লিমাকে দেখে একগাল হেসে পাশে বসতে ইশারা করল সে। লিমা মন খারাপি নিয়ে পাশে গিয়ে বসল। তার মন খারাপের দরুণ মুখের মধ্যে থাকা উদাসীন ভাবটা হয়তো আঞ্জুমানের খেয়ালে এলো। তাই সে লিমার থুতনিতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘মন খারাব ক্যা?’
মন খারাপের রেশটা বেড়ে কান্নার হিঁচকি তুলতে রত বোধহয়। তবুও সেটা ঢোক গিলে ফেলার মতো করে আঁটকে যাওয়া গলায় লিমা উত্তরে বলল,
‘বাড়িত যাইতাছি।’
অবাকান্বিত হওয়ার জোগাড় এবার আঞ্জুমানের।
‘তাই বইলা কানতাছস ক্যা?’
মুখ তুলে চেয়ে দেখল একবার লিমা তাকে। কাজলটানা চোখে, হাঁটুসমান দোল খাওয়া খোলা চুলে মেয়েটাকে দেখতে স্বর্গের অপ্সরাদের মতো লাগছে। অথচ মেয়েটার জীবন যে নরকে ডুবো ডুবো, হয়তো ডুবন্তও। তাকে বলবে কীভাবে সেসবের কারণ? শুধু বলল,
‘তোরে রাইখা যামু দেইখা ভাল লাগতাছে না।’
হেসে জড়িয়ে ধরল আঞ্জুমান তাকে আর বলল,
‘ধুর পাগল মাইয়া! সামনেই তো বাড়ি। যহন খুশি আইসা দেইখা যাবি।’
পারতপক্ষে আঞ্জুমান জানে না যে, লিমাকে এখানে আনা হয়েছিল নজরবন্দি রাখার জন্য আর সাথে তখন আঞ্জুমান অসুস্থ থাকার কারণে দেখেশুনে রাখার জন্যও। জানে শুধু দেখে রাখার কথাটা’ই। এখন ফেরত যাবে বুঝল লিমার কথা শুনে। মনটা তার-ও খারাপ হয়ে গিয়েছিল তবে একই গাঁয়ে বসবাস, দেখা করা কঠিন বিষয় না ভেবে মন খারাপটাকে ওড়িয়ে দিলো। কিন্তু লিমা মনে মনে বলল, এটাই যে তোর সাথে শেষ দেহা আঞ্জুমান।
চলবে…