নিশুতি_তিথি পর্ব ১৬

0
605

#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১৬
___________

৩৮.
রাগে আলীর শরীর থরথর করে কাঁপছে। অবশ্য বিষয়টা আঞ্জুমানের করা ভুলের। মেয়েটা তার কোনো কথাই মানতে নারাজ। আলীকে রাতের খাবার তো দিতেই যায়নি, খাওয়ানোর বিষয় তো সেই কোনকালেই ভুলে পগারপার। তাই শাস্তিস্বরূপ আলীর রুমে তাকে শিফট করতে হবে। আত্মা যেন দেহ নামক খাঁচা থেকে বের হওয়ার উদ্বেগ নিলো সেই কথায়। এরমধ্যে লিমা আজ নেই বাড়িতে। কতোদিন ধরেই তো মেয়েটা তাকে দেখাশোনা করে যাচ্ছে। মা’কে, ভাইকে দেখার জন্য মেয়েটারও তো মন কেমন করে, তাই চলে গেল বাড়িতে। কিন্তু আজ-ই যেতে হলো, আজ যে কত বড়ো বিপদে পড়েছে আঞ্জুমান। এখন উদ্ধার হবে কীভাবে আর করবেই বা কে? উপায়ন্তর না দেখে গেস্ট রুমের দরজায় খিল দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে চুপসে। তাও যদি শান্তি মিলতো দু’মিনিট। দরজা ধাক্কানোর শব্দে ভয়ে গণ্ডদেশে পানিশূন্যতা টের পেল। না খুললে অপরপাশে থাকা ব্যক্তি বোধহয় আক্রোশ দরজা ভেঙে ফেলবে এবার। কাঁপানো হাতে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল আলী। ততক্ষণে প্রবেশপথ থেকে সরে অদূরে নিরাপদ জায়গা করে নিয়েছে আঞ্জুমান। সেটা খেয়াল হতেই নিরাপদে জায়গাকে আপদ বানিয়ে এগিয়ে গেল আঞ্জুমানের সামনে। বেখেয়ালি রাগের বশে আঞ্জুমানের বাহুদ্বয় চেপে ধরল নিজ হস্তে আলী। ব্যথাসূচক শব্দে বের হলো তার মুখ থেকে। তাও সেটা কানে তুলল না আলী। নিজের ভেতরে রাগের উত্তাপে জ্বলছে সে। কোনদিকে হুঁশ আছে বলে মন হয় না। তাই বাহু চেপেই নিজ কক্ষে নিয়ে বিছানায় ফেলল আঞ্জুমানকে। আলীর ব্যবহারে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল সে। অশ্রুরা ভিড় জমাতে শুরু করল অক্ষিপুটে। ষোড়শী যৌবনা আঞ্জুমান বিয়ের ক’দিন আগেই সতেরোতে পদার্পণ করেছিল। কিন্তু সেই হিসেব বা জন্মদিন পালন, দু’টোই করার মতো কেউ-ই নেই। তবে সেদিন কথায় কথায় বান্ধবী লিমা বলেছিল একবার। কারণ সে তখন জানতে চেয়েছিল, আঞ্জুমান ও আলীর মধ্যে কিছু হয়েছে কি না। আঞ্জুমান বুঝেনি কথাটা। তাই অবুঝের মতো চেয়ে থাকায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে দেখেছে লিমাকে। অতঃপর বুঝিয়ে বলেছিল, স্বামী-স্ত্রী মিলনের সম্পর্কে। অবগত করেছিল, আলীর কোনোপ্রকার উস্কানিতে না মাততে। কিন্তু সেটার লাভ কী হলো? জোরজবরদস্তিতে আলী তো তার থেকে এগিয়ে। সেখানে তার মতো ছোট্ট শরীরে কতোটুকুই বা শক্তি কাজে দেবে। রাগান্বিত, থরথর করে কাঁপন্ত আলীর দেহ হাতে থাকা ফোনটাও আছড়ে ভেঙে শান্তি পেল না। এগিয়ে গিয়ে সামনে থাকা আধশোয়া আঞ্জুমানের গাল চেপে ধরল প্রবলতর আক্রোশের সহিত। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কী করছে না করছে বোঝা দায় হয়ে পড়ছে আলীর কাছে। সে শুধু হিসহিসিয়ে বলল,

‘সমস্যা কী তোর? আমাকে এতো ভয় পাস কেন? কী করছি কী তোরে?’

ক্রোধের আলীর জ্বলন্ত আগুনের মতো লালচক্ষু দেখে আঞ্জুমানের জ্ঞান হারাবার দশা। এখন যদি সে হুঁশে থাকে তাহলে হবে ভয়াবহ তাণ্ডবতা। এবার তার শরীর কাঁপছে ভয়ের চোটে থরথরিয়ে। সেটা দেখে আলীর রাগের মাত্রা আকাশচুম্বী। মেয়েটার ভয় কাটাতেই পারছে না, সেটা আরো বেশি তাকে রাগিশে দিচ্ছে। নাহ, মাথা ঠান্ডা করতে হবে। নিজেকে ঠান্ডা করার নিমিত্তেই রুমের বারান্দায় চলে গেল। যেখান থেকে বাগানটা দেখা যায়। আজ চাঁদ এতো আলো ছড়াচ্ছে কেন? এত কেন পূর্নিমার আলোয় হলদেটে আভা ছড়াচ্ছে আকাশে? তার মন তো আজ ভালো নেই৷ সেটা কি বুঝল আকাশের বুকে থাকা চাঁদ? সেজন্যই বোধহয় আলোর পসরা সাজিয়ে বসেছে আজ সে। এসব ভাবতে ভাবতে মাথা ঠান্ডা করে রুমে এলো। দেখল আঞ্জুমান ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানার বাহিরে পা ঝুলিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজেকে ঠিকমতো গুছাতেও শিখেনি মেয়েটা। আঞ্জুমানের সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর নেওয়া শেষ আলীর তাও বিয়ে হওয়ার আগেই। একাকীত্বের জীবনে মেয়েটা কতোটা যে একা সেটা বেশ ভালো জানে আলী। এগিয়ে গিয়ে আঞ্জুমানকে সোজা করে শুইয়ে দিলো বিছানায়। নিজেও পাশে গিয়ে তার মুখী হয়ে শুয়ে পড়ল। বারান্দা থেকে আসা পূর্ণিমার আলোয় আঞ্জুমানের মুখশশী অপার্থিব সৌন্দর্য মণ্ডিত হলো। এই মেয়েটাকে আলী কীভাবে যে ভালোবাসার জালে আটকাবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা তো তাকে দেখেই ভয়ে অজ্ঞান হারানোর দশা দলিত হয়। সেখানে কাছেই বা টানবে কীভাবে তাকে? ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে আঞ্জুমানের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের তারায় ঘুমের হানায় ঢলে পড়ে একসময়। এই সময় হয়তো পরিবর্তিত হওয়ার নতুন ভোর নিয়ে আসবে নাহয় প্রলয়ঙ্কারী ঝড়।

৩৯.
বিয়ে বাড়ি যাওয়ার তাড়নায় তরান্বিত গতিতে রিমা নিজের ও আলীর জন্য পোশাক নিতে শপিং-এ চলে গেল। সাথে নিলো ছোটো ভাবি সামিয়াকে। আসলে সামিয়ার কথাতেই যাওয়ার তাগিদ অনুভব করল। পোশাক আছেই, তবে আলীকে প্রাধান্য দিয়েই শপিং-এ যাওয়া। ভালোবাসার মানুষটাকে নতুনভাবে, নতুন পোশাক পরিধানে বরাবরই ভালো লাগে তার। অবশ্য আলী প্রায়ই বলে রিমাকে এমমটা না করতে। মেয়েটা শুনলে তো। ভালোবাসায় পাগলামি দেখতে চাইলে, রিমাকে দেখা উচিত। আলীর জন্য নিজের বাড়িতে একগাদা পোশাক কিনে ড্রয়ার ভর্তি করে রেখেছে। আবার ড্রাইভারকে হয়রানি করে, গ্রামে আলীর বাসায়ও পোশাক-টোশাক, আরো বাজার-সদাই দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। মুখে মুখে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও মন-ই মনে আনন্দিত হয়ে হাসে আলী। আর ভাবে, এত বড়োলোক মানুষ তাঁরা এভাবে টাকা ওড়াবে না তো কে ওড়াবে? আর এত টাকা-ই বা কে খাবে? এজন্যই তো আলীর মতো মানুষের আগমন তাঁদের মতো ধনীদের জীবনে। আলীর জন্য আগে ড্রেস কিনলো রিমা। পাঞ্জাবি-পাজামা, টি-শার্ট, শার্ট মিলিয়ে প্যান্ট। এসব কিনতে গিয়ে সাথে কিনলো ঘড়ি, পারফিউম। অতঃপর নিজের জন্য কেনাকাটা শুরু করল। শপিং শেষে এসেও ফোন দিলো আলীকে। সেই একই কথা, নট রিচেবল। রাগে-দুঃখে পণ করল, আলীকে সামনে পেলে তার ফোনটাকে আছাড়ে ভাঙবে আগে। এসব ভেবে পরক্ষনেই ভাবল, ভাঙার আগে আরেকটা ফোন কিনা তো জরুরি। সেই তাগিদে আবার শপিংমলে ঢুকল ফোন কিনতে সামিয়াকে সাথে নিয়ে।

‘জামাই যে অপরপক্ষ ঘরে তুলছে খবর আছেনি কোনো?’

মোবাইলের দোকানে রিমার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন এটা বলে উঠল। রিমা অবশ্য সেটা কানে তুলল না। কারণ তার নাম নিয়ে তো বলেনি। কে না কে, কাকে বলেছে। সেখানে তার কান দেওয়ার মতো সময় নেই। হাতে থাকা ভিভো’ সেট’টা নেওয়ার ইচ্ছে জাগছে। তাই সামিয়াকে প্রশ্ন করল,

‘এটা কেমন হবে?’

সামিয়া উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই সেই কণ্ঠস্বরের ব্যক্তিটা আবার বলে উঠল,

‘তুমি আলীর বউ না?’

রিমার নাম না নিলেও কথা ছিল একটা, কিন্তু যেহেতু আলীর নাম এসেছে আবার আলীর স্ত্রী হিসেবে তাকে চিনে, তাহলে তো আর ইগনোর করা যায় না বিষয়টা। তাই ঘুরে পেছনের ব্যক্তির দিকে তাকালো। মুখে পান চিবুচ্ছে, ফিচলেমি হাসি বিদ্যমান তাতে। গায়ে লুঙ্গি আর শার্ট পরা।

‘আপনি কে? চিনলাম না তো।’

রিমার অবাক হওয়ার প্রশ্নের উত্তরে লোকটি পরিচয় দিয়ে বলল,

‘আমি আজগর। আলীর গাঁয়ের লোক। তোমারে আমি চিনি।’

‘ওহ্, আই সি। তা কিছু কী বলতেন?’

লোকটার সুরতের সাথে নিয়তেরও বাজেহাল অবস্থা যেটা রিমা কৌশলগতভাবে টের পেল। তাই কথার ইতি টানতে চাইল। হয়তো আজগরও বুঝল। তাই আবারো অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলল,

‘হ, কইতাম তো। আলীর খবর রাহনি?’

‘সেই কৈফিয়ত কি আপনাকে দেব?’

ঠান্ডাস্বরের কথা শুনে আজগর সম্মতি দিয়ে বলল,

‘আরে না, না। আমি তো এমনেই কইলাম। তয় শোন নাই যে, আলী তোমার দ্বিতীয় পক্ষরে ঘ…’

বলা আর হলো না আজগরের। এরমধ্যে রিমার ফোন এলো অচেনা নম্বর থেকে। রিসিভে আলীর গলারস্বর শুনল বোধহয়। শিওর হতে পারছে না রিমা। মলে মানুষের গিজগিজ করা ভিড় আর শব্দ। তাতে স্পেস প্রয়োজন তাই ইশারায় ভিভো সেটটা প্যাক করে দিতে বলল আর সামিয়াকে রিসিভ করতে বলে বাইরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। এদিকে বেচারা আজগর রাগ-ক্ষোভে ফোঁসফোঁস শব্দ ছাড়ছে; আলীর ভাণ্ডা ফুটতে না পেরে। কীসের জন্য যে চেষ্টা করে ভাষায় শুদ্ধতার শব্দ প্রয়োগ করতে গেল। যার জন্য এখন বলাই হলো না। ধ্যাত!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here