নিশুতি_তিথি পর্ব ৯

0
517

#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৯
___________

১৮.
আগুনঝরা দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে রিমাদের বাড়ি এসে পৌঁছায় আলী। যদিও-বা এসি গাড়িতেই তার আসা-যাওয়া তা সত্ত্বেও ঢাকা শহরের জ্যামে পড়ে কাহিল অবস্থা। রিমা দ্রুত এসি ছেড়ে দেয় বসার রুমের। বাড়িতে পুরুষ মানুষেরা নেই। এই দুপুরের সময়টা বাড়ির পুরুষরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থানরত। তাই আপাততর জন্য আলীর সাথে দেখা করতে আসেন রিমার মা রান্নাঘর থেকে। হাতে করে ট্রে-তে নিয়ে এলেন ফলের জুস ও হরেক পদের টুকরো করে কাটা ফল। এগিয়ে রাখলেন সেগুলো সেন্টার টেবিলে। ইশারায় মেয়েকে বুঝিয়ে দিলেন আলীর হাতে তুলে দিতে সেসব। রিমা-ও অরেঞ্জ ফলের জুস আলীর হাতে তুলে দিলো। অন্য সোফায় রিমার মা বসে বললেন,

‘আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

ক্লান্ত মাখা গলায় আলী শোধাল,

‘না, না কোনো সমস্যা হয়নি। উলটো আরো বেশি লজ্জিত। আপনারা কেন গাড়ি পাঠাতে গেলেন?’

এটা নতুন কিছু না। আলীর গ্রাম থেকে শ্বশুর বাড়ি আসার জন্য বাস বা ট্রেন জার্নি করতে হয় না তাকে। বড়োলােক শ্বশুর মশাই নিজের গাড়ি বরাদ্দ রেখেছেন মেয়ের জামাইয়ের জন্য। এমন সুযোগ-সুবিধা ভোগে মনে মনে বেশ চাইত আলী, পেলোও। তবে মুখ নিসৃত লজ্জাটা তাঁদের দেখানোর জন্য বজায় রাখল বেশ সূক্ষ্ম অভিনয়ের মাধ্যমে। অভিনয় জিনিসটা আলীর রক্তে রক্তে বহমান। কিন্তু সে-তো অভিনেতা নয়, তবুও জীবন নামক চরিত্রে তার অভিনয় খুব ভালো চলছে। কারণটা কিছু কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণে উচ্চবিত্ত, সম্পদশালী মানুষের কাঁধটা ভীষণ প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাঁধে ভর দিয়েই তো সামনে এগুনোর সিঁড়ি। যাইহোক সল্প আলাপচারিতা শেষে রিমার রুমে এসেই ওয়াশরুমে চলে যায় লম্বা শাওয়ারের প্রয়োজনে। আর রিমা আলমারিতে আগে থেকে বিদ্যমান আলীর ড্রেস বের করে বিছানায় রেখে বাইরে চলে যায় দুপুরের লাঞ্চে কী তৈরি হচ্ছে দেখার জন্য। একে তো আলী জামাই মানুষ, সাদাসিধে খাবার তো পরিবেশন করা যায় না। সে জামাই যত বছরের পর বছর পুরোনো সম্পর্কের হোক না কেন, শ্বশুরালয়ে সে সবসময় নতুন জামাই হিসেবে গণ্য।

ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল পরিধান করে বের হয় আলী। বিছানায় নিজের জন্য আগে থেকে ড্রেস দেখে স্মিথ হাসে। জানে যে, কাজটা কার। বিড়বিড় করে বলে ওঠে তখন,

‘ভাগ্যের পরিহাস—
যে মত্ত আমাতে,
সে আমি মত্ত অনুপমাতে।’

এদিকে রান্নাঘর থেকে তদারকি সেড়ে নিজ রুমের দিকে আসছিলো রিমা। অতঃপর রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশে দেখতে পায়, আলীর হাতে তার রেখে যাওয়া টি-শার্ট। সেটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসিতো ব্যস্ত সে।

‘কী ব্যাপার জনাব, মুখে এ কীসের হাসি?’

মিটিমিটি লজ্জিত হাস্যমুখে রিমার প্রশ্ন। তবে আলী বিচক্ষণতার সহিত ধরতে পারল রিমার লজ্জিত হওয়ার কারণটা। তাই সে উলটে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষে রিমার দিকে এগিয়ে গেল তাকে আরো কুণ্ঠিত, সংকোচগ্রস্ত করতে।

‘এত লজ্জা কীসের, হুম? আমাকে কি এই অবস্থায় প্রথম দেখছ না কি জনাবা?’

অতি নিকটে নিজ একান্ত প্রেমিক পুরুষের মোহনীয় কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলা কথায় শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে কম্পমান হচ্ছে। চক্ষুদ্বয় মুদে আসছে আমুদে। একসময় নিজ মুখমণ্ডল আলীর উষ্ণত্ব অনুধাবনে আহ্লাদিত হয়ে বোজে আসে আঁখিযুগল। খানিক পরেই পায় মুখশ্রীতে পানির ঝাপটা। হকচকিয়ে চক্ষুদ্বয় উন্মুক্ত করলে হো হো করে আলীর হাসি দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে তাকায়। আলীর হাসিমাখা মুখ সবচেয়ে বেশি নজর কাড়া। ভাললাগার এটাই প্রথম দিক, তারপরে আসে হৃষ্টপুষ্ট দেহ যেটাকে বলা হয় সিক্সপ্যাক বডি। আলী গ্রামের ছেলে যার দরুন সে শহুরে ছেলেদের মতো জীম করে না। তবুও তার স্বীয় শরীরের প্রতি সে খুবই যত্নবান। এতই যত্নবান পুরুষ যে, খুব ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে গায়ে রিমাকে ভালোবাসার চিহ্ন দেওয়া থেকে পর্যন্ত মানা করে দেয়। রিমার একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা দেখে তার সম্যক মুগ্ধকরণ কাটাতে আলী তুড়ি বাজাল। থতমত খেয়ে রাগান্বিত হওয়ার ভানে মুখ ভেংচি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল রিমা। তা সত্ত্বেও রুমের দরজা পর্যন্ত থমকে দাঁড়িয়ে পিছু মুখী হয়ে বলল,

‘খেতে আসুন।’

বলেই একছুট লাগাল।

১৯.
লিপি নিজ রুমে আবদ্ধ হয়ে বিছানায় হাঁটুমুড়ে বসে। কয়েকদিন যাবৎ মনের মধ্যে থাকা অনুশোচনা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে সে নিজেকে ঘরবন্দি করে শাস্তি দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও কৃতকর্মের পাপবোধ তাকে বন্দিদশাতেও শাস্তি নামক শান্তি দিচ্ছে না। এরমধ্যে লিমার মা বেশ দুশ্চিন্তায় জড়িয়ে আছেন, মেয়ের এহেন কর্মকাণ্ডে। ক’দিন যাবৎ মেয়ে তাঁর সাথে কারো বাড়িতেই কাজে যাচ্ছে না। এভাবে ঘরে পড়ে পড়ে থাকলে তো আর অন্ন মুখে জুটবে না আর। আজ এর হেনেস্তা করেই ছাড়বেন ভেবে মেয়ের কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেন, তন্মধ্যে করিম মিয়া এসে উঠানে নিজের উপস্থিত জানান দেওয়ার জন্য হাঁক ছাড়ল,

‘লিমার মা! ও লিমার মা বাড়িত আছনি?’

গ্রামের লোকজনের সাথে গ্রাম্য ভাষায় তার যত কথা। সেই হিসেব কষেই আঞ্চলিক ভাষাতে বাক্যের বেশ পালটে ফেলল করিম মিয়া। তার ডাক শুনে লিমার মা আর মেয়ের কক্ষের দিকে পা আগালেন না। ফিরে এলেন করিম মিয়ার ডাকে উঠানের মাঝে।

‘কী হইছে ডাকো যে?’

‘ছোটো সাহেব কইলেন তোমার মাইয়াডারে বাড়িত নিয়া যাইতে।’

‘ছোটো সাহেবের বাইত?’

‘হ।’

চোখ-মুখ অস্বাভাবিকভাবে কুঁচকে এলো লিমার মায়ের। ছোটো সাহেব অর্থাৎ আলী আকবর কেন তার রাজপ্রাসাদের মতো বড়ো বাড়িতে লিমাকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রাখছে? সেখানে মানুষ থাকে না কি? যাও থাকে তো ক’জন হাতেগোনা। এরমাঝে তাঁর মেয়ে গিয়ে করবে’টা কি? আদ্যোপান্তে ভেবে কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে করিম মিয়াকেই প্রশ্ন করে বসলেন লিমার মা,

‘আমার মাইয়ারে দিয়া তাঁর কী কাম?’

প্রশ্নের জবাব আগে থেকেই তৈরি করিম মিয়ার, তাই সাথে সাথে উত্তর এলো,

‘খবর শোনো নাই, সাহেব যে বিয়া করছে? তাঁর বউয়ের দেখভালের জন্য লিমারে কামে নিছে সাহেব। চিন্তা কইর না মোটা অংকের বেতন পাবা।’

অর্থকড়ির লোভ কার না থাকে। সেখানে যদি এমন দিন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা লিমাদের পরিবারের হয়, তাহলে তো এসব কাজকর্মকে তারা খোদার দেওয়া আশীর্বাদ মনে করে। তাই কাজটা হাতছাড়া করতে নারাজ লিমার মা। দ্রুত শব্দযোগে তিনি বললেন,

‘আইচ্ছা, আইচ্ছা বুঝছি। এহন কও কহন তে কহন পর্যন্ত কাম করব মাইয়ায়?’

মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে আলীর হুকুম করা কথার অনুযায়ী বলল,

‘উহুম, সাহেব বলছেন সেখানে থাইকা কাজ করন লাগব।’

লিমার মা’র এবার অক্ষিপট কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।

‘জোয়ান মাইয়া আমার। মাথা ঠিক আছেনি?’

‘তোমার মাথা ঠিক আছেনি? জোয়ান মাইয়া দেইখা কী হইছে? তারে কী কেউ খায়া ফেলবনি? সহিসালামত থাকব, সবাই আছি না।’

‘আঞ্জুর কথা আমরা জানি কিন্তু।’

‘তাে কী হইছে তাতে? তোমার মাইয়ার দিকে সাহেব ফিরাও চাইব না। উনি তো বেশিরভাগ সময় ঢাকা থাকেন। মাঝেমধ্যেই শুধু গ্রামে থাকবেন। যখন না থাকবেন তখনকার সময়ে তোমার মাইয়ায় ছোটো বেগমের মন ভুলায় রাখব, যেন ছোটো বেগম একলা একলা মন খারাপ না করে থাকেন।’

বিভিন্ন কথার বাকবিতন্ডায় শেষমেশ লিমার মা রাজি হলেন মেয়ে লিমাকে আলীর বড়ো বাড়ি পাঠানোর উদ্দেশ্যে। ঘরের ভেতরে সকল কথাবার্তাই লিমার কর্ণগোচর হলো। সে তো জানে, বড়ো বাড়িতে তাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আসল উদ্দেশ্যটা কী? মাঝেমধ্যে মন চায়, ঝুলন্ত ফ্যানের সাথে নিজেকে ফাঁস লাগাতে। না সে সেদিন বড়ো বাড়িতে আঞ্জুমানকে নিয়ে যেত, আর না আলী আকবরের চোখে পড়ত মেয়েটা। আর না তাকেই জড়াতে হতো এসব ষড়যন্ত্রের গহীনে। এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস নামক আফসোস বেড়িয়ে আসে মুখ নিসৃত হয়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here