#নীলকণ্ঠা
১।
ওনার একটা পাগল মাইয়া আছে। কাছে যাইয়েন না। থাবড় দিব। কামড়ও দিতে পাড়ে।
আতর আলীর ফিসফিসানিতে ফায়াজ প্রতিউত্তরে চুপ রইলো। মানুষিক সমস্যা হওয়া কোন বড় ব্যপার না। কোন কারনে, কোন পরিস্থিতিতে হয়ত মেয়েটা এর শিকার। হয়ত তারা মেয়ের চিকিৎসাও করাচ্ছেন। ভুঁড়িওয়ালা পেট, অর্ধটাক পড়া মাথা, ফিনফিনে সবুজ রঙের একটা ফতুয়া, বাদামী রঙের লুঙ্গী আর গলায় ফ্যাকাসে লাল রঙের গামছা ঝুলানো আতর আলি নামের লোকটাকে দেখে মনে হলো তিনি আরো কিছু সতর্কমূলক গোপন কথা বলতে চায় ফায়াজকে। ফায়াজের কানের কাছে মুখ নিতেই একটা গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো।
আতির আলি, টেবিলে খাবার দাও।
আতর আলি তৎক্ষণাৎ ফায়াজের কাছ থেকে দূরে সরে কাছুমাছু হয়ে দাঁড়ালো। এই গম্ভীর কন্ঠটা তার মালিকের। এই কন্ঠ শুনলেই আতর আলির আত্মা কাঁপে। আতর আলি কোন রকম মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই গম্ভীর কন্ঠের মালিক আবার বলে উঠলেন,
রেনুকে বলো ওকে খাইয়ে আসতে।
জ্ব-জ্বি সাহেব। বলেই আতর আলি তড়িঘড়ি করে ঘর ছাড়ালো। পেছনে দুহাত বেধে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ফায়াজের বিপরীত সোফায় বসে ফায়াজকে বসতে বললেন। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, বড় দাড়ি, উজ্জ্বল রঙের অধিকারী ব্যাক্তির নাম মইনুর শেখ। ঠোঁটে হাসির ছিটেফোঁটা নেই কিন্তু সে স্বাভাবিক ভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে তাকিয়ে আছে ফায়াজের দিকে। ফায়াজ বসলো।
আমি ফায়াজ আহমেদ। পেশায় একজন লেখক।
হ্যা। জাফর তোমার কথা বলেছে কিন্তু এখানে তোমার কি কাজ?
আমি একটা গ্রাম্য পরিবেশ চাচ্ছিলাম কিছু রিসার্চের জন্য। জাফর সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ একজন। তার সাথে এই ব্যপারে কথা বললে তিনি এই গ্রামের কথা বলেন এবং সাথে আপনার বাড়ির কথা।
মইনুর শেখ ফায়াজের কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে ঘাড় হালকা দুলিয়ে বললেন,
তুমি এখানে যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারো।
ফায়াজ সৌজন্যমূলক হেসে ধন্যবাদ দিল। হঠাৎ কাচের কিছু মেঝেতে পড়ে শব্দ হলো সাথে সাথে একটা মেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। ফায়াজ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ভ্রু কুচকে তাকাতেই পরক্ষনে আতর আলির কথা মনে পড়লো। ফায়াজ মইনুর শেখের দিকে তাকালো। তার মুখভঙ্গি অপরিবর্তনীয়, যেন এসব তার কাছে বেশ স্বাভাবিক। বিশাল বড় ঘরে দুজন মানুষ বসে আছে। দুজনেই চুপ করে বসে আছে। ফায়াজ ঘরটায় নজর বুলিয়ে দেখতে ব্যস্ত। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। বড় দুই পাল্লার জানালা। আতর আলি এসে খাবারের জন্য ডেকে গেল। মইনুর শেখ বললেন,
চলো খাওয়া যাক। খেয়ে বিশ্রাম করো।
ফায়াজ মাথা নাড়ালো।
ফায়াজ খাওয়া শেষে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে যাচ্ছিল। খাবারটা খুব মজাদার ছিল। ফায়াজ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে। এতটা ভালো রান্না ফায়াজ আশা করে নি। রাঁধুনিকে ধন্যবাদ দিতে চেয়েছিল কিন্তু কে রান্না করেছে সেটা সে জানে না। পরক্ষনে ভাবলো আতর আলির থেকে জেনে নেয়া যাবে। ফায়াজ হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। দুইটা বেজে পনেরো মিনিট। ঢাকা থেকে খুব ভোরে রওনা দিয়েছিল। গ্রামে পৌছাতে বেলা বারোটা বেজে গিয়েছিল। তবে বাড়ি খুঁজতে অসুবিধে হয় নি। গ্রামের সবাই এই বাড়ি চেনে।
চারপাশে শত শত গাছের ভীরে একটা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাহির থেকে বাড়িটা দেখতে চমৎকার লাগে। ফায়াজের বরাদ্দকৃত ঘর বসার ঘরের দক্ষিণে। ফায়াজ আশপাশ দেখতে দেখতে নিজের ঘরে যাচ্ছিল। হঠাৎ কারো বিড়বিড় করে কথা শুনতে পেল। ফায়াজ সেখানেই দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে তাকালো। হাতের ডানে একটা ঘর। বাদামী রঙের দরজায় ফুলের কারুকার্য। ফায়াজ ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলো কিন্তু কথা গুলো স্পষ্ট না। ফায়াজ দরজার হাতলে হাত রেখে ঘুড়াতে নিলেই কেউ একজন বলে উঠল,
আপনি এখানে কি করছেন?
চমকালো ফায়াজ। দরজার হাতল ছেড়ে দুপা পিছিয়ে যেয়ে ব্যক্তির দিয়ে তাকালো। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে নীল রঙের থ্রিপিস। মাথায় ওড়না দেয়া। বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ। মেয়েটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফায়াজের দিকে। ফায়াজ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে বলল,
না মানে এই ঘর থেকে আওয়াজ আসছিল তাই আর কি। কে থাকে এখানে?
এটা স্যারের মেয়ের ঘর। আপনি এ ঘর ছাড়া সব ঘরে যেতে পাড়েন। মেয়েটি গম্ভীর কন্ঠে বলল।
ফায়াজ কিছু বলল না। মেয়েটি চলে যেতে নিলেই ফায়াজ জিজ্ঞাস করল,
আপনার নাম?
আমি রেনুকা।
ফায়াজ স্মিত হেসে নিজের ঘরে চলে গেল। নিজের ঘর দেখে ফায়াজ অনুমান করল এ বাড়ির প্রতিটি ঘরই হয়ত বিশাল বিশাল। ফায়াজ শার্ট খুলে একটা টিশার্ট পড়ে নিল। ঘরের মাঝ বরাবর একটা কাঠের কারুকার্যময় বিছানা পাতা। ডানে বড় একটা কাঠের আলমারি। জানালার সামনে একটা টেবিল আর চেয়ার। বা পাশে সোফা সাথে সেন্টার টেবিল। ফায়াজ লক্ষ করলো এক বাড়ির বেশিরভাগ আসবাবপত্র কাঠের। জানালা বেশ বড় দুই পাল্লার। সারাদিনের ধকলে ফায়াজের প্রচুর ঘুম পাচ্ছিল। বিছানায় মেরুদণ্ড স্পর্শ করতেই ঘুমে তলিয়ে গেল।
_______
সকালে নাস্তা সেরে বাহিরে হেটে আসার প্রস্তুতি নিল ফায়াজ। গ্রামের নাম আদুরীগাঁও। নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে বসার ঘরে আসতেই দেখলো আতর আলি আসবাবপত্র পরিষ্কার করছে। ফায়াজকে দেখে হাতের টুকরো কাপড় নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
কোথাও যাইবেন সাহেব?
হ্যা, একটু হেটে আসি।
আতর আলি মাথা নাড়ালো। ফের আসবাবপত্রে হাত চালাতেই ফায়াজ বলল,
গ্রামের নাম আদুরীগাঁও কেন?
আতর আলি হাত থামিয়ে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, জানি না, সাহেব।
আচ্ছা, তুমি কাজ করো। আসি আমি।
ফায়াজ বাড়ি থেকে বের হয়ে আশেপাশে তাকালো। বাড়ির বাম পাশে বড় একটা পুকুর। ফায়াজ সেদিকে গেল। সুন্দর করে ঘাট বাঁধানো পুকুর। পুকুরের চারপাশে পাহারাদার গাছ গুলোর প্রতিবিম্ব পুকুরের জলে ফুটে উঠেছে। এক ছটাক ভোর দৃষ্টি ঝলসে যাওয়া স্বর্ণবর্ণা রৌদ্র এসে বসেছে পুকুর আর ঘাটের মোহনায়। পুকুর জলে হরিত বর্ণের পত্র ঘেরা পাটল রঙা পদ্ম গুলো উকি দিচ্ছে। ফায়াজের ভালো লাগছে পুকুরটা দেখতে। কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল বলা যায় নি।
হাটতে হাটতে বেশ খানিক পথ এসে পড়েছে ফায়াজ। মইনুর শেখের বাড়ির পেছনে ঘন জঙ্গল। বাড়ির সামনের দিকে তুলনামূলক কম। তবে সেই জঙ্গল পেড়িয়ে বের হতে পঁচিশ মিনিট লেগে গেল ফায়াজের। মেইড রোডের পাশে একটা টং দোকান। ফায়াজ যেয়ে দোকানের ব্যাঞ্চে বসলো। দোকানি কিছুক্ষন ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
স্যার কি গ্রামে নতুন?
হ্যা। বুঝলেন কি করে?
এলাকায় এর আগে দেখি নাই।
ফায়াজ মৃদু হাসলো। বলল,
হ্যা এলাম আপনাদের আদুরীগাঁও দেখতে। কয়েকদিনের মেহমান।
দোকানি ঠোঁট প্রশস্ত করে বলল,
স্যার চা দিমু। খাবেন?
হ্যা। দিন।
ফায়াজ চা পান করে কিছুক্ষন কথা বলল দোকানির সাথে। আদুরীগাঁও নামের কারনও জানা গেল দোকানির থেকে। ফায়াজ আরো কিছুক্ষন হেটে বাড়ির দিকে গেল। মাথার উপর সূর্যের কড়া নজর তখন। ত্রিশ মিনিট লেগে গেল বাড়ি ফিরতে। ঘর্মাক্ত শরীরে শার্ট ভিজে লেপ্টে আছে। ফায়াজ বাড়িত ভেতর ঢুকবে হঠাৎ নজর গেল পুকুর ঘাটে। কেউ বসে আছে। কোন মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা ফায়াজের উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছে। দীঘল চুলগুলো পিঠে বিছিয়ে আছে। মাথা বারবার নাড়াচ্ছে। হাত নাড়াচ্ছে। পড়নে হলুদ ফ্রক। ফায়াজ এগিয়ে যেতেই কানে এলো মেয়েটির বিরবির। এই কন্ঠ গত কাল বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে এসেছিল। তারমানে এ-ই মইনুর শেখের মেয়ে। ফায়াজ আরো বেশি আগ্রহ নিয়ে পা বাড়ালো।
ফায়াজের পা থামলো মেয়েটির সামনে এসে। চুল গুলোর জন্য মুখটা ঢেকে আছে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মেয়েটি বিরবির থামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াতে শুরু করলো। ফায়াজ মৃদু হেসে বলল,
হ্যালো, আমি ফায়াজ। তুমি জনাব মইনুর শেখের মেয়ে?
মেয়েটি জবাব দিল না।
ফায়াজ আবার হাত নাড়িয়ে বলল, এই যে শুনছো?
মেয়েটিকে চুপ থাকতে দেখে ফায়াজ এক পা এগিয়ে যেতেই মেয়েটি দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। মুখের উপর থেকে চুল সরে গেল। ফায়াজ থমকালো। অতি ফর্সা গায়ের রঙ। গাল দুটো কোন কারনে লাল হয়ে আছে। চোখের পাপড়ি গুলো বড় বড়। যখন পলক ফেলছে উপরের পাপড়ি গুলো নিচের পাপড়িতে আছড়ে পড়ছে। মেয়েটির চোখ মুখে ভয় স্পষ্ট। হলুদ ফ্রকে মেয়েটিয়ে একগুচ্ছ সোনালু ফুল থেকে কোন অংশে কম লাগছে না। ফায়াজ খেয়াল করল মেয়েটি খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তুমি খালি পায়ে এসেছো কেন? বলে এক পা এগিয়ে যেতেই মেয়েটির হাতে থাকা ইটের টুকরো ফায়াজের দিকে ছুড়ে মারলো। কোণা যেয়ে ফায়াজের চোখের নিচে গালের উপর লেগে গাল কেটে গেল। সাথে সাথে ফায়াজ আহ শব্দ করে উঠলো।
ডান হাত গালে রাখতেই বুঝলো মোলায়েম গাল কেটে রক্ত বের হচ্ছে। ক্ষত স্থানে প্রচুর জ্বালা করছে ফায়াজের। মেয়েটা ভীতু চোখে আশেপাশে তাকিয়ে মাথা দোলাচ্ছে। এর মাঝেই আতর আলি আর রেনুকা দৌড়ে এলো মেয়েটির কাছে। রেনুকা ভীষণ রেগে আছে। মেয়েটির ফরসা হাতের ডান বাহু চেপে ধরতেই মেয়েটির ভীতিগ্রস্ত চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যন্ত্রণাময় হলো। রেনুকার থাবা থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করার শুরুতেই রেনুকার দানবীয় ধমকে মেয়েটা চুপসে গেল। ফায়াজের বড্ড মায়া লাগলো। রেনুকা ফায়াজের দিকে এক পলক তাকিয়ে মেয়েটার বাহু টেনে ভেতরে নিয়ে গেল।
ফায়াজ তাকিয়ে আছে সেদিকে। আতর আলি ফায়াজের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
সাহেবের মাইয়াডাও না। ঘর থেকে বের হইলো কখন দেখলামই না।
ফায়াজ এখনও সেদিকেই তাকিয়ে আছে। আতর আলি আবার বলল,
বেশি কাটছে?
চলবে…
®উম্মে কুমকুম