নীলকণ্ঠা পর্ব-২

0
2734

#নীলকণ্ঠা

২।
বড় একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফায়াজ গালের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছে। আতর আলি প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স হাতে নিয়ে মেঝেতে বসে তাকিয়ে আছে ফায়াজের দিকে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,
মাইয়াডা আসলেই পাগল, না হয় এমন করে?সাহেব, আপনে ডড়াইছিলেন?

ফায়াজ ব্যান্ডেজ লাগিয়ে আতর আলির দিকে ফিরে তাকালো। জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে বলল,
ভয় পাব কেন?

আতর আলি কিছুটা নিচু স্বরে বলল,
ওই যে সাহেবের পাগল মাইয়াডা আপনার কাছে গেছিল।

ফায়াজ হেটে এসে আতর আলির পাশে বিছানায় বসলো। বলল,
বার বার পাগল মেয়ে বলবেন না। শুনতে ভালো লাগে না। ওর নাম কি?

সাহেবের মাইয়ার নাম পরী।

ফায়াজ একটা গুপ্ত নিশ্বাস ফেললো আতর আলির অগোচরে। আতর আলি বাক্সের মুখ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ফায়াজ জিজ্ঞাস করল,
আপনি এখানে কত বছর কাজ করছেন?

চার বছর নয় মাস।

পরীর মা কোথায়? এসে দেখলাম না যে তাকে।

বেগম সাব মইরা গেছে সারে চার বছর হইলো।

ফায়াজ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
আচ্ছা আপনি যান।

আতর আলি চলে গেলে ফায়াজ সটান বিছানায় শুয়ে পড়ে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকতেই ডান চোখের কোণ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। সিলিংয়ের দিয়ে তাকিয়েই বহমান জলের ফোটা হাতের তালুতে পিষে ফেললো ফায়াজ।

_______
ফায়াজ গোসল সেরে বেড়িয়েছে মাত্র। পড়নে শুধু কালো রঙের একটা ট্রাউজার। ভিজা-সিক্ত চুলে তোয়ালে চালান দিচ্ছে বারবার। একটা মিঠা কোমল রৌদ্র জানালা দিয়ে উকি মেরে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সুঠাম দেহে জলবিন্দুগুলো ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। ফায়াজ চুল মুছতে মুছতে দুপা এগিয়ে এসে সামনে তাকাতেই থতমত খেল। রেনুকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ডান হাতের গামছা দুহাতে গলায় পেঁচালো। রেনুকার দিকে তাকিয়ে দেখল সে কেমন করে যেন হাসছে। ফায়াজ গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞাস করল,
কিছু বলবেন?

আমি আপনার ছোট। আমাকে আপনি করে বলার দরকার নেই।

ফায়াজ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
না ঠিক আছে। আমি আপনি বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

রেনুকার ভ্রু হালকা কুঁচকে গেল। কন্ঠে কঠোরতা এনে বলল,
সকালে পরীকে তো তুমি করে বললেন।

হয়ত ভুলে বলেছি।

রেনুকা মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন ফায়াজের উত্তরে সে সন্তুষ্ট নয়। ফায়াজ জিজ্ঞাস করল,
আপনি কিছু বলতে এসেছিলেন?

স্যার খেতে ডাকছেন। গম্ভীর ভাবে কথাটা বলে দ্রুত পায়ে ঘরের বাহিরে চলে গেল। ফায়াজ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মেয়েটা শুধু শুধুই রেগে গেল। আপনি অথবা তুমি ডাক অবশ্যই কোন রাগের কারন হতে পারে না। ফায়াজ চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ফেলে বিছানায় রাখা আসমানি রঙের টিশার্ট গায়ে জড়ালো।

খাবার ঘরে যেয়ে দেখলো মইনুর শেখ আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। তিনি টেবিলে দু হাত তুলে হাতের উপর হাত রেখে বসে আছেন। ফায়াজ টেবিলের কাছে যেয়ে দাঁড়াতে মইনুর শেখ বললেন,
কেমন আছো? বসো।

ফায়াজ মইনুর শেখের বিপরীত পাশের চেয়ার টেনে বসল। বলল,
ভালো আছি।

গ্রাম দেখেছো?

সকালে গিয়েছিলাম। টুকটার ঘুড়লাম।

কেমন লাগলো?

গ্রামটা সুন্দর, ঠিক তার নামের মতো।

কথাটা শুনে মনে হলো মইনুর শেখ হাসলেন কিন্তু ফায়াজ তার ঠোঁটে হাসির রেখা খুঁজে পেল না। মইনুর শেখ খাবারের দিকে হাত তাক করে বললেন,
নাও। শুরু করো।

আজ খাবারের মেনুতে ছিল কালাভুনা, সরষে ইলিশ, ডাল আর সাদা ভাত। ফায়াজ খাবার মুখে পুরতেই তৃপ্তি পেল। আনমনেই মইনুর শেখকে জিজ্ঞাস করে বসলো,
রান্না কে করে?

মইনুর শেখ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
কেন?

ফায়াজ ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি টেনে বলল,
রান্না খুবই ভালো।

মইনুর শেখের ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ম হাসি দেখতে পেল। তবে সেটা তাচ্ছিল্যের হাসির মতো দেখতে। ফায়াজ চুপ হয়ে গেল। ফের খাবারে মনোযোগ দিল। মইনুর শেখ ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আতর আলিকে ইশারা করল। ফায়াজ বেশ মনযোগ দিয়ে খাচ্ছে। আশেপাশে তার খেয়াল নেই। ক্ষানিক বাদে মইনুর শেখ গলা খেঁকারি দিলেন। ফায়াজ খাওয়া থামিয়ে মইনুর শেখের দিকে তাকালো। মইনুর শেখ পাশে চোখ ইশারা করে বললেন,
ওর নাম আমেনা। ও-ই রান্না করে।

ফায়াজ ডান পাশে তাকালো। একজন মহিলা পড়নে সাদা শাড়ি। মাথায় আচল টানা। উজ্জ্বল মুখে মোলায়েম হাসি। ফায়াজও ঠোঁটে হাসি টানলো।
আপনার রান্না খুব মজাদার। আমার খুব ভালো লেগেছে।

আমেনার ঠোঁটের হাসি আরো প্রশস্ত হলো। খাওয়া শেষে আমেনা সব গুছিয়ে রাখলো। ফায়াজ তার পাশেই দাঁড়িয়ে দেখছিল। আমেনা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখে ফায়াজ দাঁড়িয়ে আছে।
আপনি কিছু বলবেন সাহেব?

ফায়াজ এই প্রথম আমেনার কন্ঠ শুনলো। নম্রতায় মোড়ান মোলায়েম কন্ঠ। ফায়াজ হালকা হেসে বলল,
আপনি কি এখানেই থাকেন নাকি রান্না করে দিয়ে যান?

এখানেই থাকি।

আপনার পরিবার?

আমেনার মুখটা নত হয়ে গেল। মলিনতায় ছেয়ে গেল ক্ষানিক আগের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী। গলা খাদে নামিয়ে বললেন,
আমার পরিবার নেই। এখানেই থাকি। এরাই আমার সব।

ফায়াজ তাকে সান্ত্বনাসরূপ কিছু বলতে মুখ খুলতেই কোন মেয়ের আর্তনাদ কানে এলো। ফায়াজ দ্রুত ঘাড় ঘুড়ালো। এটা পরীর কন্ঠ। ফায়াজ আমেনার দিকে ফিরলো। তার চোখ পানিপূর্ণ। ফায়াজ আর সময় নষ্ট না করে বড় বড় পা ফেলে পরীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। আমেনাও গেল ফায়াজের পেছন পেছন।

পরীর ঘরের দরজা বন্ধ। ফায়াজ প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করে আমেনার দিকে তাকালো। তিনি আঁচলে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন। ফায়াজ বড় একটা শ্বাস নিয়ে পরীর ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ভেতর থেকে পরীর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। ফায়াজ দরজায় টোকা দিল।
পরী, পরী।

পরী এখনও কাঁদছে। ফায়াজ আবার ডাক দিল।
পরী কাঁদছো কেন? দরজা খোল, পরী।

ফায়াজ হাতের থাবা দিয়ে দুবার দরজায় বারি দিল। পরীর কান্নার আওয়াজ থেমে গেল। ফায়াজ আবার পরীকে ডেকে দরজায় বারি দিতেই খট শব্দে দরজা খুলে গেল। ফায়াজ উৎসুক দৃষ্টি ফেলল। দরজা খুলে দাঁড়ালো রেনুকা। ফায়াজ রেনুকাকে দেখে খানিকটা অবাক হলো। কিন্তু সেদিকে বেশি লক্ষ না দিয়ে ঘরে উকি দিল। পরী দেয়ালের সাথে জড়োসড়ো হয়ে বসে দুহাত মুঠো করে মুখে সামনে এনে কিছু একটা বিরবির করছে। ফায়াজ ভেতরে ঢুকতে যাবে তার আগেই রেনুকা দরজা আগলে দাঁড়ালো। রুষ্ট কন্ঠে বলল,
আপনি এখানে কি করছেন?

রেনুকার প্রত্তুত্তরে ফায়াজ প্রশ্ন করল,
পরী কাঁদছে আপনি দেখেন নি? তবুও কান্না থামাচ্ছেন না কেন?

রেনুকার ভ্রু কুঁচকে এলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
এসবে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। এসব থেকে যত দূরে থাকবেন ততই ভালো।

ফায়াজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। এক থাপ্পড়ে রেনুকার সব গুলো দাঁত ফেলে দেয়ার ইচ্ছে হলো। যেন পরবর্তিতে দাঁত না থাকার লজ্জায় কথা না বলতে পাড়ে। রেনুকা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আমেনার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
ওনাকে নিয়ে যাও।

আমেনা আঁচলে চোখ মুছে নিচু স্বরে বললেন,
সাহেব চলেন।

ফায়াজ রেনুকা থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালের সাথে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা পরীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে হনহন করে চলে গেল। কোমরে এক হাত রেখে অন্য হাতের দু আঙ্গুল কপালে ছোঁয়ালো। তার রাগ এখনও কমে নি। আমেনা ফায়াজের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ আমেনার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
রেনুকার এখানে কি কাজ?

পরী মায়ের দেখাশোনা।

কত দিন যাবত আছে?

তিন বছর।

ফায়াজ আমেনার দিকে ভালো করে তাকালো মনে হচ্ছে আমেনা কিছু বলতে চায়। ফাজায় আমেনার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার আন্তাজের সাথে মেলানোর জন্য ফায়াজ বলল,
রেনুকা পরীর জন্য ঠিক নয়।

ফায়াজের কথায় আমেনা ঢুকড়ে কেঁদে উঠলো। ভাঙ্গা কন্ঠে বললেন,
রেনুকা পরী মায়েরে মারে খুব। রেনুকারে খুব ভয় পায় পরী মা।

ফায়াজের হাত শক্ত করে মুঠো করে রইলো। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো কিছুক্ষন।
আমি আসছি। বলেই প্রায় দৌড়ে চলে গেল ফায়াজ।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here