নীলকণ্ঠা পর্ব-৩

0
2289

#নীলকণ্ঠা

৩।
আপনি কি পরীর আপন বাবা?
প্রশ্নটা দ্রুতগামী ধনুকের মতো এসে বিঁধলো মইনুর শেখের বুকের বাম পাশে। সভ্য সমাজের একজন যখন চুরি করে ধরা পরে ঠিক তেমনই অনুভূত হচ্ছে মইনুর শেখের কাছে। তিনি নিজের ঘরে বসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র দেখছিলেন। হঠাৎ এহেম প্রশ্নে তার হাত থেমে গেল। তিনি চোখ তুলে তাকালেন। দরজায় ফায়াজ দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজের দৃষ্টি অনড় তবে তার দৃষ্টি এলোমেলো। ফায়াজের অগোচরে কম্পিত বুকে দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে নিজেকে শান্ত রেখে প্রশ্ন করল,
মানে?

ফায়াজ ঘরের ভেতরে ঢুকলো। মইনুর শেখ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি এখনও ফায়াজের সাথে দৃষ্টি মেলাতে পাড়ছেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন ফায়াজের কপালে।

মানে, আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনি পরীর আসল বাবা কি না তা নিয়ে।

মইনুর শেখ গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
কেন সন্দেহ হচ্ছে জানতে পাড়ি?

অবশ্যই। আপনি যদি পরীর আসল বাবা হতেন তাহলে পরীর ঠিক ভাবে যত্ন নিতেন। তার দেখাশোনা, ভালো মন্দ দেখতেন।

আমি আমার মেয়ের দেখেশোনা করি। আমি তার ভালো চাই বলেই রেনুকে ওর দেখভালের জন্য রেখেছি।

ফায়াজ তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল,
শেয়ালের কাছে দিয়েছেন মুরগীর দেখাশোনার ভার।

মানে?

রেনুকা নিয়মিত পরীর উপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে সেই খবর কি আপনি রাখেন?

মইনুর শেখের অশান্ত মন কিছুটা শান্ত হলো। তিনি ফায়াজের কথাগুলো এখন ধরতে পেড়েছেন। তিনি ধীর পায়ে পুনরায় চেয়ারে যেয়ে বসলেন। এবার তাকালেন ফায়াজের চোখের দিকে। বললেন,
তুমি যেটা ভাবছো সেটা না। রেনু ওর ভালোর জন্যই এমনটা করে। আমার মেয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ। তার চারপাশের খবর নেই। তার বাস্তব জ্ঞান নেই। তাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য রেনুর যা করনীয় তা সে করে।

কিভাবে স্বাভাবিক রাখছেন? মেরে, ধকমে, ভয় দেখিয়ে?

দেখো ফায়াজ, তুমি দুদিনের মেহমান তাই আশা করবো আমার পারিবারিক ব্যপার থেকে দূরে থাকবে।

পারিবারিক ব্যপার পারিবারিক ব্যপার বলে একটা মেয়েকে নির্যাতন করছেন।

মইনুর শেখ কথা বাড়ালেন না। ফায়াজ আবার বলল, আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।
মইনুর শেখ ফায়াজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে।

_______
রাত প্রায় একটা দশ। নিস্তব্ধ বাড়ি। সবাই ঘুমে বিভোর। ফায়াজ টিশার্ট এর উপর শার্ট জড়িয়ে নিল। ধীর পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। গাছের পাতা ঝিমাচ্ছে, ঝিঝিপোকার ডাক উৎসবের আয়োজনে মত্ত। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিজলির ছটাক ভোর আলো ধরণীকোল আলোকিত করছে।

পরীর ঘরের দরজা খুলে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করে ভেতরে তাকাতেই থমকে দাঁড়ালো ফায়াজ। এটা ঘর কম কারাগার বেশি। ঘরে একটা বিছানা, টেবিল, চেয়ার ছাড়া কোন আসবাবপত্রের চিহ্ন নেই। বিছানায় চোখ পড়তেই দেখলো পরী বাকা হয়ে শুয়ে আছে। শরীরে পাতলা একটা কাথা দেয়া। ফায়াজ এগিয়ে গেল পরীর দিকে। হাটু ভেঙ্গে বসলো পরীর মুখের কাছে। দীঘল চুলে আবৃত হয়ে আছে মুখশ্রী। ফায়াজ খুব সতর্কে মুখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিল। ফ্যাকাসে পাটল বর্নের অধরে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। চোখের বড় পাপড়ি গুলো মিলেমিশে একাকার। পরীর তৈলাক্ত খাড়া নাকের ডগা দেখতে মন্দ লাগছে না ফায়াজের। প্রতিটি মানুষকে কিছু বিশেষ গুণ দিয়ে পাঠিয়েছেন আল্লাহ। পরীর নিষ্পাপ বৈশিষ্ট্য অন্যতম।

অনেকক্ষন হলো ফায়াজ হাটুভেঙ্গে বসে আছে মেঝেতে। হঠাৎ পরীর তৈলাক্ত নাকের ডগা ছুঁয়ে বলল,
আমি মুক্ত করবো তোমাকে। বাহিরের সৌন্দর্য দেখাবো তোমাকে। নতুন ভাবে বাচবে তুমি।

ফায়াজের মনে পড়লো আমেনার কথা।
তিন হাতি সিলিং পাখাটা অনবরত ঘুড়েই যাচ্ছে। সাদা সিলিংয়ে মিচমিচে কালো পাখার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফায়াজ। সব কিছু তার কাছে কেমন জটিল হয়ে উঠছে। ফায়াজ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়েই আওরাতে লাগলো,
মুখোশ ধারী মানুষ তুমি, কোনটা তোমার আসল রূপ?
পাপ লুকিয়ে সবার কাছে মানুষ তুমি অপরূপ।

মানুষকে চেনা দায়। সকল মানুষের ভিন্ন দুটি রূপ থাকে। একটা রূপের সাথে সবাই পরিচিত আর অন্য রূপ একান্ত ব্যক্তিগত। ফায়াজ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জানালার ছিটকিনি খুলে জানালা খুলে দাঁড়ালো। দমকা বাতাসে হাড় পর্যন্ত শিউরে উঠলো। আজ আকাশে ধূসর মেঘের দারুন খেলা। চাঁদকে লুকাতে ব্যস্ত নিজের বক্ষপিঞ্জরে। ধোঁয়াসা আকাশের কোন এক কোণঘেঁষা চাঁদের আলো বক্ষপিঞ্জর ভেদ করে বেরিয়ে এলো। হেসে ফেললো ফায়াজ মেঘের পরাজিতে।

দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। খুব সূক্ষ্মতা সেই টোকার আওয়াজে। দেয়াল ঘড়িতে বাজে রাত দশটা পনেরো। ফায়াজ যেয়ে দরজা খুলল। আমেনাকে দেখে একটু অবাকই হয়েছে ফায়াজ। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসার জায়গা করে দিতেই দ্রুত ঘরে ঢুকলো আমেনা। দরজা হালকা করে বন্ধ করে দিয়ে প্রশ্ন করলো,
আপনি?

আমেনা একটা ঢোক গিলে সরাসরি বলল,
আমাগো সাহেব পরী মায়ের আসল বাবা না।

ফায়াজ ভ্রু কুচকালো। মানে?

বেগম সাবের দ্বিতীয় স্বামী আমাগো সাহেব। পরী মা আগের ঘরের।

ফায়াজ সতর্ক দৃষ্টিতে দরজার ওপাশে তাকিয়ে বিনাশব্দে দরজা লাগিয়ে বলল,
আপনি কি করে জানেন এসব?

আমি পরী মায়ের বাড়িতে থাকতাম। বেগম সাবের বিয়ের পর এখানে তাদের সাথে চলে আসছি।

পরীর বাবা?

সে নাই দুনিয়ায়।

কবে হয়েছে সেটা?

সাহেবের মৃত্যুর পরই বেগম আমাগো সাহেবরে বিয়ে করে। আর পরী মায়েরে নিয়ে এখানে চলে আসে।

আমেনা থেকে যথাসম্ভব নিচু গলায় বলল,
সাবেরের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।

ফায়াজ ভ্রু কুচকালো। মানে?

তারে কেউ খুন করছে।

ফায়াজ অবাক হয়ে তাকালো।
কি বলছেন? কে খুন করেছে?

তা জানি না।

আপনি জানলেন কি করে খুন করেছে?

সবাই জানে। ছুড়ি দিয়া খুন করছে। সকালে পুকুর ঘাটে সাহেবের লাস পাইছে। জানেন, সাহেব পরী মায়েরে খুব আদর করতো। পরী মা বাবার আদুরী ছিল। বাবারে ছাড়া কিছু বুঝতো না।

আচ্ছা, পরীর মানসিক সমস্যা কবে থেকে?

ছোট থেকে। অনেক ডাক্তার দেখাইছে কিন্তু কাম হয় নাই। তয় ডাক্তার কইছে তারে আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে রাখতে। বাহিরে ঘুড়াইতে। কিন্তু সাহেবের মৃৃত্যুর পর পরী মা ঘরে বন্দি। আর রেনুকা একটা জল্লাদ। পরী মায়ের আমাগো পুকুর ঘাট পছন্দ কিন্তু পরী মায়ে বাইরে গেলেই রেনুকা পরী মায়েরে খুব মারে। কথার এক পর্যায়ে আমেনা কেঁদে দিলেন। নাক টেনে বললেন,
আমার পরী মায়েরে বাচান সাহেব। এমনে তো সুস্থ্য মানুষও অসুস্থ হয়ে যাইবো।

ফায়াজ কিছু বলল না। তাকিয়ে রইলো দেয়ালের দিকে।

_______
মধ্যরাতের বৃষ্টির তেজ এখনও কমে নি। বর্ষন কণা ধরণীকে বিশুদ্ধ করতে ব্যস্ত। গাছের পাতা যেন নতুন জীবন পেয়েছে। পাতার উপর বৃষ্টির ফোটা অমায়িক ছন্দ তুলছে। রিনঝিন ছন্দে মুখরিত পরিবেশ। ফায়াজ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। পুকুরের একাংশ তার জানালা থেকে দেখা যায়।

বৃষ্টির ফোটা গুলো পুকুর জলে পড়ে তরঙ্গ সৃষ্টি করছে। পদ্মর মনমোহিনী রঙ বিরাজ করছে। উজ্জ্বলতা বেড়েছে তার। ফায়াজ ভেজা মাটির ঘ্রাণ টেনে নিল বুক ভরে। এত সৌন্দর্য কেবল গ্রামেই পাওয়া যায়। হঠাৎ রেনুকার চেঁচামিচিতে ধ্যান ভাঙ্গল ফায়াজের। কিছু একটা ভেবেই দৌড়ে প্রায় বাহিরে গেল। বাড়ির দরজার এক কোণায় আমেনা দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা সামনে আতর আলি। তাদের দৃষ্টি সামনে থাকা পরী আর রেনুকার দিকে।

রেনুকার এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে পরীর বাহু চেপে ধরা। পরী ভিজে চুপসে আছে। রেনুকা পরীকে বকছে। রেনুকা রুষ্ট কন্ঠে বলল,
কাল এত কিছুর পরও তুই আজ আবার বাহিরে এসেছিস? সাহস খুব বেড়েছে না?

পরী হাতের যন্ত্রণায় কাঁদছে তবে আজ তার চোখের জল বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে। রেনুকা আরো কিছু বলে পরীকে চড় মেরে দেয়। আকস্মিক চড়ে পরী কিছুটা পিছিয়ে যায়। ফায়াজ এবার আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেয়ে রেনুকার গালে চড় বসিয়ে দিলো। আকস্মিক চড় রেনুকাও আশা করে নি। এত ভারী চড় খেয়ে ছাতা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। নিজেও পড়ে গেল কাদা মাটিতে।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম
(অগোছালো লেখার জন্য দুঃখিত। গঠনমূলক মন্তব্যের অনুরোধ রইলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here